সর্বজনীন স্বাস্থ্য নিশ্চিতে পবা'র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার রুপরেখা

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২০, ১৬:৪৮

সাহস ডেস্ক

করোনার প্রচন্ড আঘাতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্যদশা প্রকটিত হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনা মোকাবিলার দুটো ক্ষেত্র। একটি হলো সংক্রমণ ঘটার আগেই প্রতিরোধ করা। অন্যটি আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা। দুটো ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যর্থতা পাহাড় সমান। তবে তুল্য আলোচনায় দেখা যাবে চিকিৎসা সেবার চেয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী। বিষয়টি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় আমাদের মন্ত্রণালয় প্রধানত স্বাস্থ্যসেবার নামে চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করে আসছে। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজেট বরাদ্দের প্রধান অংশ খরচ হয় পরিচালন ব্যয়, অবকাঠামো নির্মাণ ও ক্রয় সম্পন্ন করতে। জীবনযাপনের চলমান বাস্তবতায় প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া স্বাস্থ্য বাস্তবাকে ধারণ করার সামর্থ্য স্বাস্থ খাতের নেই।
 
আজ ১৮ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার সকাল ১১.০০টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার উদ্যোগে অনলাইনে "করোনা সংকট, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও আমাদের প্রস্তাব" শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আবু নাসের খান চেয়ারম্যান (পবা), ডা. মুশতাক হোসেন সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (আইইডিসিআর), ডা. লেলিন চৌধুরী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পবা), ডা. খালেদ শওকত আলী চেয়ারম্যান, ৭১ ফাউন্ডেশন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিবৃন্দ, সুধীজন। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন পবার সম্পাদক মেসবাহ সুমন। 

আলোচনা সভায় বক্তারা করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলায় আমাদের অসহায়ত্ব, অপ্রস্তুত অবস্থা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচনা করে ভাল চিকিৎসাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরেন। পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমুল সংস্কার ব্যাতিত কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ব্যাপক সংস্কারের বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সকল তথ্যের ডাটাবেইজ (জাতীয় খানা ভিত্তিক জরিপ এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের সমন্বয়ে) ডিজিডাইজ করার কাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্পন্ন করতে হবে। এতে দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থসহ সকল সম্পদের ব্যবহার সহজতর হবে। তিনি আরো বলেন, চিকিৎসা সংক্রান্ত অব্যবহুত সকল যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সম্পদ দ্রুত সনাক্ত করে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করতে হবে। এবং স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়টি শিক্ষার সকল স্তরে জৈবিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

আইইডিসিআর এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রীক স্বাস্থ্য সংস্কার করতে হবে। এখনই শহরাঞ্চলে কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা সম্বলিত জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পিরিমিডের মতো বিবেচনা করে এর ভিত্তিভূমিতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে হবে।

৭১ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ডা. খালেদ শওকত আলী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রয়োজনের নিরিখে বাজেটে বরাদ্দ করা। করোনা চিকিৎসায় সংকট মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে প্রাইভেট হাসপাতাল এবং এনজিওদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেতে হবে। 

সাপ্তাহিক-এর নির্বাহী সম্পাদক শুভ কিবরিয়া আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সমন্বয় ও পরিকল্পনার অভাব রয়েছে, এখানে খুব দ্রুত দৃষ্টি দেয়া উচিৎ। তিনি জানান, করোনাকালীন সময়ে তৃণমূলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কাপাসিয়া উপজেলার পাবলিক প্রাইভেট স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মডেল খুবই ভালো ফলাফল দিয়েছে। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ, স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীর সমন্বয়ে গঠিত কাপাসিয়া মডেল অনুকরণ করে করোনাকালীন সময়ে সুফল পাওয়া যেতে পারে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সুধিজনেরা বলেন, জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার নার্স নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কমিউনিটি হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়ানো ও অবকাঠামো ও ট্রেনিং ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়া প্রয়োজন। শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও কৃষিকে কীটনাশক মুক্ত করা দরকার এবং হাসপাতাল বর্জ্যব্যবস্থাপনা সঠিক ভাবে করা প্রয়োজন। 

সংবাদ সম্মেলনে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চিকিৎসাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংস্কারের রুপরেখা তুলে ধরেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী। 

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন,করোনা মহামারীর সংকটকালে পৃথিবীব্যাপি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবা খাতে গবেষণার বিপুল জোয়ার তৈরি হয়েছে। এইসব গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হলো- মানুষের ভয়, ভোগান্তি ও মৃত্যু কামানো। বাংলাদেশে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ১১০ টি মেডিক্যাল কলেজ, একটি মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল, আইইডিসিআরসহ আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। করোনা সংকটে এদের কারো কোন গবেষণা  উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইনডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ(বিসিএসআরআই) এর কার্যক্রমে আমরা উৎসাহ বোধ করেছি। আমাদের স্বাস্থ্যখাতে গবেষণার অনুপস্থিতি এই খাতের দৃঢ় ভিত্তি গড়ার ক্ষেত্রে বিশাল বাঁধা। 

সারাদেশের মানুষ যখন করোনার ভয়াবহ আক্রমণে সন্ত্রস্ত, মরণাপন্ন এবং উদভ্রান্ত তখন স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতির খবরে আমরা গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। একটু অক্সিজেনের জন্য, হাসপাতালের একটি শয্যার জন্য মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই সময় এই অর্থ তসরূপ করার মতো ঘৃণ্য কর্মে যুক্ত একটি চক্রের  দখলে আমাদের স্বাস্থ্য খাত। আমরা প্রায়শই অনুভব করি দেশের ডাক্তারদের সাথে সাধারণ মানুষের একটি দূরত্ব রয়েছে। আমাদের মনে হয় এদেশে মেডিক্যাল ছাত্রদের ডাক্তার হিসাবে গড়ে তোলার মধ্যে একটি জনবিচ্ছিন্ন ধারা বহমান। 

২০২০-২১ সালের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। এবারে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গতবছর এর পরিমাণ ছিলো  ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে সেটা কমে আসে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায়। অবশ্য করোনাসৃষ্ট স্বাস্থ্য দুর্যোগের জন্য  আরো ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ  প্রস্তাব করা হয়েছে। বরাবরের মতোই এই বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশের কম। সবমিলিয়ে আমরা মনে করি স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাবনার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। শুধু বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়ালেই বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান হবেনা।

এরকম অবস্থায় আমরা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবার পক্ষ হতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়ে পরিবর্তনের রূপরেখা তুলে ধরছি: 

১. করোনা সংকটে আমরা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি আমাদেরকে চিকিৎসা- নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। মানুষের ভালো থাকার সাথে পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণ, বৃক্ষ, বায়ু,জল, মাটি,বন,সমুদ্র ইত্যাদি সকলের ভালো থাকা গভীরভাবে সংযুক্ত। প্রকৃতি ও পরিবেশের একটি সদস্য বা উপাদান অসুস্থ বা দূষিত হলে মানুষের সুস্থ থাকা বিঘ্নিত হয়। তাই মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে অন্য সবাইকে ও সবকিছুকে সুস্থ রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকে এরকম দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতে ও সেই অনুযায়ী কর্ম পরিকল্পনা নির্মাণ করতে হবে। আমরা একে 'সামগ্রিক স্বাস্থ্য (One health)' বলবো। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে - বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক দর্শন হবে 'সামগ্রিক স্বাস্থ্য'। 

২. সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভাবনাকে ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে ঢেলে সাজাতে হবে। মন্ত্রণালয় চার ভাগে বিভক্ত হবে। 

এগুলো হলো: 
ক. জনস্বাস্থ্য বিভাগ (Public health division) 
খ.মেডিক্যাল শিক্ষা ও চিকিৎসা বিভাগ (Medical education and management division) ।  
গ. স্বাস্থ্য পরিকল্পনা ও সমন্বয় বিভাগ (Health planning and coordination division) । 
ঘ. পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ (Family planning division) । 

প্রতিটি বিভাগের সচিব থেকে সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা সবাইকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাডেমিক যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হবে। প্রতিটি বিভাগে অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহনের জন্য একাধিক টেলিফোন নম্বর, পোস্টবক্স, ই-মেইল ঠিকানা ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকবে।
 
৩. স্বাস্থ্য খাতে গবেষণাকে অতিগুরুত্ব প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার চারটি খাতেই গবেষণার গুরুত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণা কাজে নিয়োজিত রাখতে সম্ভাব্য সব আয়োজন করা অতি প্রয়োজন। 

৪. দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে একটি স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক স্বাস্থ্য প্রশাসন গড়ে তোলার অন্য কোন বিকল্প নেই। এটা করতেই হবে।
  
৫. মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের শিক্ষা কোর্সের ভিতরেই জনসম্পৃক্ত করার যথেষ্ট কর্ম পরিকল্পনা যুক্ত রাখতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষা কারিকুলামের সাথে দেশী সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। মেডিক্যাল শিক্ষার সব পর্যায়ে গবেষণা বাধ্যতামূলক হতে হবে।

৬. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হিসাবে উন্নিত করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত