গহিন সুন্দরবনের রহস্যময় নিভৃতচারী ‘প্যারাপাখি’

প্রকাশ : ১৬ মে ২০১৯, ১৪:০৩

সুন্দরবনের গহিনে রহস্যময় পাখি ‘প্যারাপাখি’। বাঘের মতো প্যারাপাখিকেও সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায় না। সুন্দরবনের জেলে ও বাওয়ালি একে বলে ‘হাঁসপাখি’, কেউ নাম দিয়েছে ‘গইলো হাঁস’। কিন্তু পাখিটি হাঁস তো নয়ই, তার নিকটাত্মীয়ও নয়, বরং সারস, কালেম, কুট ও পানমুরগির ঘনিষ্ঠজন। পাখিটি মূলত প্যারাবনেই বাস করে। সুন্দরবনের বাঘ এর মত নিভৃতচারী রহস‍্যময় তেমনি রহস‍্যময় এই ‘কালামুখ প্যারাপাখি’। ইংরেজিতে বলা হয় Masked Finfoot।

সমগ্র পৃথিবীতে মাত্র দুই জাতের প্যারাপাখি আছে, ‘কালামুখ প্যারাপাখি’ ও ‘আফ্রিকার প্যারাপাখি’। বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত সাতটি দেশের মুষ্টিমেয় কটি বাদা এলাকায় কালামুখ প্যারাপাখি টিকে আছে। 

বর্তমানে সুন্দরবনই সম্ভবত পাখিটির বৃহত্তম আবাস। বিশ্বে কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা খুবই কম ও সংখ্যাটা নিম্নগামী বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল একে ‘বৈশ্বিক সংকটাপন্ন’ পাখির তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ-আইইউসিএন পাখিটিকে ‘বিপন্ন’ আখ্যায়িত করেছে।

প্যারাপাখি দূর থেকে দেখে সহজেই হাঁস বলে ভুল হতে পারে, আকারে-প্রকারে পাতিহাঁসের সঙ্গে এর কিছু মিল আছে। তবে এর বিশাল হলুদ ঠোঁট বেশ চোখা, হাঁসের মতো চেপ্টা নয়। এর লম্বাটে সবুজ পায়ের প্রতিটি আঙুলে বিচ্ছিন্ন পর্দা আছে, হাঁসের মতো পর্দা দিয়ে আঙুলগুলো জোড়া নয়। ছেলে ও মেয়ে প্যারাপাখির আকার ও রঙে পার্থক্য আছে। মেয়ের চেয়ে ছেলে বড়। মেয়ের ওজন আধা কেজির কম, ছেলের ওজন পৌনে এক কেজি। মেয়ের গলার পালক সাদা, ছেলের ঘন কালো।

কাদামাটিতে হেঁটে অথবা তীরসংলগ্ন পানিতে সাঁতার কেটে প্যারাপাখি মাছ, মাডিস্কপার, চিংড়ি ও পোকা শিকার করে। মানুষ দেখলে প্যারাপাখি খুব দ্রুত পানিতে দেহ ডুবিয়ে ফেলে অথবা বনের মধ্যে গা ঢাকা দেয়।

বাঘের মতো নিভৃতচারী এ পাখি কখনো দলবেঁধে বাস করে না, একাকী বিচরণ করে এবং কেবল প্রজননের সময় জোড়া বাঁধে। পানির কাছে ঝুঁকে থাকা গাছের সমান্তরাল ডালে পাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে বর্ষাকালে প্যারাপাখি চার-ছয়টি ডিম দেয়।

বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা তবু মোটামুটি জানা আছে, কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা সম্পূর্ণ অজানা। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা, এ দেশে বাঘের চেয়েও প্যারাপাখির সংখ্যা কম, পাখিটি চোখে দেখেছেন এমন পাখিবিদের সংখ্যা আরও কম। বাগেরহাট ও খুলনা জেলার সুন্দরবনের দক্ষিণে মানুষের আনাগোনা কম এমন নিভৃত খালের পাড়েই অধিকাংশ প্যারাপাখির বাস, বনের উত্তরে ও পশ্চিমে পাখিটি কমই চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে প্যারাপাখির দেখা একেবারেই মেলে না। পৃথিবীর কোনো চিড়িয়াখানায় কালামুখ প্যারাপাখি নেই। সুন্দরবনের বাঘ গবেষণার মতোই দীর্ঘক্ষণ ধরে প্যারাপাখি পর্যবেক্ষণ করাও দুঃসাধ্য কাজ। ফলে পাখিটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে।

‘তথ্যের অপ্রতুলতার বিচারে কালামুখ প্যারাপাখির মতো পাখি পৃথিবীতে কমই আছে’—এ মন্তব্য করা হয়েছে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল প্রণীত ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ। প্যারাপাখির বিচরণভূমির বৈশিষ্ট্য, আহার্য-তালিকা, পূর্বরাগ, প্রজনন-সফলতা ও ছানার জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য এখনো মানুষের অজানা। অদূর ভবিষ্যতে পাখিটির বিলুপ্তি রোধ করার জন্য ওই সব তথ্য সংগ্রহে দেশের দক্ষ গবেষকদের উৎসাহ দেওয়া জরুরি বলে পাখিপ্রেমীরা মনে করেন।

এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহজেই এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। সুন্দরবনের অনন্যসাধারণ এ পাখিটি সংরক্ষণে বন বিভাগেরও বিশেষ উদ্যোগ থাকা উচিত। বৈশ্বিক সংকটাপন্ন এ পাখি রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সব পাখিপ্রেমী ও সচেতন মানুষের।

কালোমুখ প্যারাপাখি বা মুখোশপরা জলার পাখি Heliornithidae (হেলিওর্নিথিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Heliopais (হেলিওপাইস) গণের এক প্রজাতির অত্যন্ত দুর্লভ লাজুক জলচর পাখি। কালোমুখ প্যারাপাখির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ মুখোশওয়ালা সূর্যসন্তান (গ্রিক helios = সূর্য, pais = শিশু; ল্যাটিন personatus = মুখোশপরা)। সারা পৃথিবীতে কেবল মাত্র গুটিকতক স্থানে এ পাখিরা বসবাস করে। পৃথিবীর মাত্র ৩৩ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের বিস্তৃতি। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে ক্রমেই কমছে এবং এদের পূর্ববর্তী কয়েকটি বিচরণস্থলে সম্ভবত এরা বিলুপ্ত। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। 

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পৃথিবীতে মোট কালোমুখ প্যারাপাখির সংখ্যা আনুমানিক ৬০০ থেকে ১৭০০টি বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখ করেছে। আবার আরেকটি হিসাবে এ প্রজাতিটির সদস্য সংখ্যা ১০০০ এর কম বলে ধারণা করা হয়েছে।

প্রজাতিটির ইংরেজি নামের জন্য এই মুখোশ অনেকাংশে দায়ী। চোখের পেছন থেকে সাদা ডোরা ঘাড়ের পাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। থুতনি ও গলার কিয়দংশ সাদা। চোখের তারা লালচে-বাদামি ও চোখের বলয় মটর-সবুজ। ঠোঁট লম্বাটে ও মজবুত। উপরের ঠোঁটে বর্ম থাকে। ঠোঁটের রঙ উজ্জ্বল হলুদ, তাতে বাদামি মধ্যভাগ দেখা যায়। লেজে কোমল পালক থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ প্যারাপাখির ভিন্নতা মুখোশে। পুরুষ পাখির পুরো কপাল, গলা ও ঘাড়ের উপরিভাগ কালো; কিন্তু স্ত্রী পাখির গলার কেন্দ্রের নিচে ও ঘাড়ের উপরের অংশ সাদা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ধূসর। কপাল ছাড়া স্ত্রী পাখির সাথে চেহারায় কোন পার্থক্য নেই।

কালোমুখ প্যারাপাখি খুব লাজুক স্বভাবের ও বিরল হওয়ায় এদের সম্পর্কে খুব কম জানা গিয়েছে। গাছপালা বহুল জলাভূমি, প্লাবিত বন, প্যারাবনের খাল ও চিরসবুজ বনের হ্রদে বিচরণ করে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে এদের সবসময়ই স্বাদু পানিতে বিচরণ করতে দেখা গেছে, লোনা পানিতে কখনোই দেখা যায়নি। একা, জোড়ায় কিংবা ছোট পারিবারিক দলে ঘুরে বেড়ায়। কাদায় হেঁটে বা অগভীর জলে সাঁতার কেটে খাবার খায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে মাডস্কিপার, ছোট মাছ, জলজ পোকা, শামুক, চিংড়ি ও অন্যান্য জলচর অমেরুদণ্ডী প্রাণী। ভয় পেলে শুধু ঠোঁট ও মাথা পানির উপরে রেখে পানিতে ডুবে থাকে। অথবা দৌড়ে পাড়ে উঠে লুকিয়ে পড়ে। পানির উপর গাছের ঝুলন্ত ডালে বসে এরা বিশ্রাম নেয়। মাঝে মধ্যে হাঁসের মত উচ্চস্বরে ক্যাঁক ক্যাঁক স্বরে ডাকে। এমনিতে খুব লাজুক স্বভাবের হলেও প্রজনন মৌসুমে এরা প্রায় পোষা হাঁসের মত আচরণ করে। দৌড়ে পালায় না, বরং অনেক কাছে আসতে দেয়। সে কারণে এরা মানুষের হাতে মারা পড়ে বেশি।

বর্ষাকাল অথবা বর্ষার শেষদিক কালোমুখ প্যারাপাখির প্রজননকাল। মূলত জুলাই থেকে আগস্ট মাসে এরা বাসা করে। এ সময় পানি বা ভূমি থেকে ১-৩ মিটার উঁচুতে গাছের বড় ডালে ঘন পাতার আড়ালে ডালপালা দিয়ে গোল স্তূপাকার বাসা বানায়। শুকনো জলজ উদ্ভিদাংশ বাসার মূল উপকরণ। বাসা বানানো শেষে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সবুজাভ সাদা। উপরে কালচে বড় বড় ছিট থাকে। প্রতিবারে ৩-৬টি ডিম পাড়ে। ডিমের মাপ ৫.২ × ৪.৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী ও পুরুষ প্যারাপাখির উভয়েই ডিমে তা দেয়। ছানা ফোটার ১০-১২ দিন আগে পুরুষ পাখি অন্যত্র চলে যায় এবং পরে আবার ফেরৎ আসে।

তথ‍্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত