বাংলাদেশে কতটা নিরাপদ পরিযায়ী পাখি?

প্রকাশ : ১১ মে ২০১৯, ১৫:৩১

পরিযায়ী শব্দের বাংলা অর্থ-যাতায়াতকারী, যাযাবর, বসবাসের জন্য অন্যদেশে গমনকারী। অর্থাৎ স্থায়ী বাসভূমি থেকে নতুন কোনো অনুকুল পরিবেশে যাত্রা এবং যেখানে সাময়িক বসবাসের পর পুনরায় স্থায়ী বসতিতে প্রত্যাগমনকে পরিযান বা মাইগ্রেশন বলে।

পাখিদের মধ্যে অনেকেই পরিযায়ী। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এরা বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। এ ধরণের স্থানান্তর থেকে বেশি দেখা যায় স্বল্পদৈর্ঘ্যের অনিয়মিত গতিবিধি। বেশিরভাগ পাখিই সামাজিক জীব। 

পরিযায়ী পাখিদের শীতকালেই আগমন ঘটে বাংলাদেশে। শুধু ভরা শীতেই নয়, অক্টোবরের মধ্যেও কিছু কিছু পরিযায়ী প্রজাতির আগমন ঘটেছে দেশে। মূলত এ পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে আসে একটু উষ্ণতা এবং খাবারের সন্ধানে। দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে ওরা অতিথি পাখি নামে পরিচিত। আসলে ওরা অতিথি নয়, পরিযায়ী পাখি। শব্দ দুটি’র মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও পাখি শিকারিরা দুটি শব্দের অর্থকে এক করে ফেলেন। এতে করে ওদের লাভ বৈ লোকসান হয় না। তাদের লোভের কারণে নির্মমতার শিকার হতে হচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের।

সত্যি বলতে কি হাওর-বাঁওড় কিংবা বিল এলাকায় দিনে-দুপুরেই পাখি নিধন চলছে। পত্র-পত্রিকায় এ ধরনের দুষ্কর্মের হোতাদের নাম দেওয়া হয় শিকারি। কিন্তু আমাদের চোখে এরা দুষ্কৃতকারী, শিকারি নয়। শিকারি অমন ছিঁচকে স্বভাবের হতে পারে না। শিকারি হচ্ছেন বীরত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব; সরকার ঘোষিত শ্বাপদসংকুল অরণ্যে যিনি হিম্মত দেখিয়ে বাঘ-সিংহ শিকার করেন তিনি হচ্ছেন শিকারি। সে ক্ষেত্রেও অবশ্যই সরকারের অনুমতির প্রয়োজন। অথচ যারা নিরীহ পাখি মারছে আমরা তাদেরকে বলছি শিকারি!

আমাদের দেশে ‘বালিহাঁস’ মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। অথচ চলনবিল এলাকায় একজোড়া বালিহাঁস ৪শ-৫শ টাকায় বিক্রি হয়! যা অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ।

আমরা জানি পাখি শুধু পরিবেশের ভারসাম্যই রক্ষা করছে না, ওরা আমাদেরকে প্রকৃতির কঠিন পরিবেশে খাপ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। অভিযোগ রয়েছে পাখিরা আমাদের ফল-শস্যাদি খেয়ে ফেলছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ওই ফল খেয়ে দূরে কোথাও গিয়ে মলত্যাগের মাধ্যমে বনায়ন সৃষ্টির ফলে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি তৈরি করছে। আরও অবাক করা তথ্য হচ্ছে, হাওরাঞ্চলের মানুষের ধারণা পরিযায়ী পাখিরা শুধু তাদের ফসল খেয়েই বিনষ্ট করছে। অথচ সেই পরিযায়ী পাখিরা হাওরেই প্রতিদিন একটনের বেশি বিষ্ঠাত্যাগ করছে। যার ফলে ফসলের গাছ-গাছালি ও মাছ পাচ্ছে উপযুক্ত খাবার। সে উপকারী বন্ধু পরিযায়ী পাখিসহ অন্যান্য পাখি নিধন করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। 

পরিযায়ী পাখিদের খাবারে বিষ মাখিয়ে, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে চলছে শিকার। কী জঘন্য কাজই না করছে ওরা! এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার কারণে দেশ থেকে অনেক প্রজাতির পাখি হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়েছে ফ্লোরিকান ময়ূর, পিংক মাথা হাঁস ও রাজ শকুন। আর হারিয়ে যেতে বসেছে ভাদিহাঁস, বালিহাঁস, দিগহাঁস, কালো তিতির, চন্দনা, বাংলা শকুনসহ ইত্যাদি প্রজাতির পাখি। এ ছাড়াও আরও ১৯ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগছে? কেমন লাগছে পরিবেশটা ভারসাম্য হারিয়ে পঙ্গু হতে দেখে? এ নিধন দ্রুত বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। তাই আমাদের উচিত প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বন্যপ্রাণীদের ওপর যেন অত্যাচার নিপীড়ন না ঘটে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়া। কাজটি কিন্তু ইচ্ছে করলেই করতে পারি আমরা। শুধু একটু সচেতন হলে আর প্রচার-প্রচারণা বাড়িয়ে দিলেই হয়। তাতে করে অন্তত প্রকাশ্য দিবালোকে কেউ বন্যপ্রাণী নিধন করতে সাহস পাবে না।

সরকার ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে কিছু ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ পাস অন্যতম। উক্ত আইনের ১ নং ও ২ নং তফসিলে ৬৫০ প্রজাতির পাখিকে ‘প্রোটেক্টেড বার্ড’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিযায়ী পাখি শিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপকে ‘ফ্লাইওয়ে সাইট’ ঘোষণা করেছে। শকুনের প্রাণঘাতী ওষুধ ডাইক্লোফেনাক উত্পাদন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের উত্সাহিত করতে ‘বঙ্গবন্ধু এওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন’ প্রদান করা হচ্ছে। উদ্ধারকৃত ও আহত পাখির সেবাদানে সারাদেশে ৪টি অঞ্চলে ‘বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়েছে। পাখিসমৃদ্ধ এলাকাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২-তে বাঘ বা হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা ৭ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে অনেক বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা পাবে। তবে শুধু আইন পাস হলেই চলবে না, তার প্রয়োগও হতে হবে যথাযথ। তাতে করে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হবে, তেমনি সার্থক হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’ পুরস্কার অর্জন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত