বন না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাংলাদেশ বাঁচবে না

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০১৯, ১৩:৫৮

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে বন ও বনভূমির পরিমাণ কমে তিন ভাগের এক ভাগ এখন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূখণ্ডের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা অপরিহার্য হলেও অলিখিত হারে দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অবশ্য কাগজে কলমে দেশে ১৩ শতাংশ বনাঞ্চল রয়েছে; সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও বাস্তবে সেই হার আরো কম বলে মনে করছেন প্রকৃতিবিদরা।

কারণ বনভূমি দখল আর জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের বৃদ্ধির সঙ্গে তালমিলিয়ে দেশে কমেছে বনাঞ্চলের হার। এই যখন পরিস্থিতি তখন হিমশিম অবস্থা বন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা বনবিভাগেরও। আইনী জটিলতা, রাজনৈতিক চাপ, প্রভাবশালী ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে লড়াইয়ে বনবিভাগের শক্তি যেন দিন দিন কমেই যাচ্ছে। এজন্য অধিদপ্তরটির কর্মকর্তারাও বনভূমি সংরক্ষণের আইন কঠোর করার ওপর জোর দিচ্ছি দিনের পর দিন। কিন্তু বিষয়টি হয়তো সরকারের আইন প্রণেতাদের দোড়-গৌড়ায় পৌছুচ্ছে না সময়মতো। এজন্য সময়মতো বলছি কারণ, দেশের বনভূমি হার নির্ণয়ে যে সমীক্ষা শুরু হয়েছে বিগত চার বছর আগে তা এখনো প্রকাশ করতে পারেনি বনবিভাগ। আশ্চর্যে বিষয় বন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারাও নিশ্চুপ, নেই যেন কোন সদুত্তর!

বন মন্ত্রণালয়ের দাবি, প্রাকৃতিক বনভূমি সংকুচিত হয়ে আসলেও এর বিপরীতে বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতেও সরকার নিচ্ছে একের পর এক উদ্যোগ। গেলো বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বন ভবনে বিশ্ব বন দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন খোদ বন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ১৩ ভাগ বন ও ২২ ভাগ বন আচ্ছাদন রয়েছে। একটি দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার প্রয়োজন থাকলেও বাংলাদেশে সম্ভব হবে না কারণ প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার হার ১২শ’র বেশি। এতো জনসংখ্যার দেশে বনভূমি কতটা রক্ষা করা যাবে তা এখন ভাবতে হবে।’

একই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার এখন বনভূমি বাড়ানোর চেয়ে সারাদেশে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে চেষ্টা করছে।’ এছাড়া বনভূমি সংরক্ষণে ব্যক্তিখাতগুলোতে সবুজ আচ্ছাদন বৃদ্ধিতে সচেতনতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন বন সচিব। 

তবে বন সচিবের দেয়া তথ্য সঠিক। দেশে বন আচ্ছাদন যে বাড়ছে তা অবশ্য গত কয়েক বছর আগেই জানা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বন বিভাগের একটি যৌথ গবেষণা ‘বাংলাদেশের বনের বাইরে ও ভেতরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার সমন্বিত মূল্যায়ন: ২০০০ থেকে ২০১৪’। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বনের বাইরে নতুন করে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। 

গবেষণাটির একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের আইওপি সায়েন্স নামক জার্নালেও। যুক্তরাষ্ট্রে ভূতত্ত্ববিষয়ক রাষ্ট্রীয় সংস্থা ইউএসজিএস ও মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা থেকে সরবরাহ করা ছবি ও মাঠ জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছিল ওই গবেষণাটি। যেখানে মূলত ২০০০ সালের সঙ্গে ২০১৪ সালের বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিবর্তনকে তুলনা করা হয়েছিল। 

সমীক্ষাটিতে উঠে এসেছিল বনের বাইরে গাছ বৃদ্ধির চিত্রের পাশাপাশি বনের ভেতরে গাছ কমে আসার চিত্রও। ভয়াবহ তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল প্রতিবেদনটিতে, যে একই সময়কালে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় ৮০ হাজার ৮০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। আর ৩১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল গবেষণাটিতে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, বনের বাইরে যেসব এলাকায় গাছ বেড়েছে এর বেশিরভাগই গ্রামের মানুষের রোপণ করা ঘরের চারপাশের বাগান, বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপন করা ফলবাগান এবং গ্রামের মানুষের সঙ্গে বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে রোপণ করা সামাজিক বনায়ন। এছাড়া উপকূলীয় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় বন বিভাগ নতুন জেগে ওঠা উপকূলীয় চরে বৃক্ষ রোপণ করছে। বর্তমানে দেশের ২১ শতাংশ এলাকায় এসব বৃক্ষ রয়েছে। তবে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট বনভূমির ১১ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে প্রকৃতি বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বাড়লে বা বৃদ্ধির উদ্যোগ একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন দেশের প্রাকৃতিক বন ও সংরক্ষিত বনভূমি যেভাবে দিনে দিনে ধ্বংস হচ্ছে তা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। কেননা দেশের জীববৈচিত্র্য ও জিনগত সম্পদ প্রাকৃতিক বনে থাকে। বনের বাইরের বৃক্ষে এগুলো কম থাকে। তাই বনভূমিগুলো রক্ষা করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।

বন দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকৃতি বিষয়ক আন্তজার্তিক সংগঠন- আইইউসিএন’র বাংলাদেশের সভাপতি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ শঙ্কা প্রকাশ করেন, বনভূমি সংরক্ষণ এখন বন বিভাগের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনভূমি দখল প্রতিরোধে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও এমনকি নির্দিষ্ট কোন আইন বা দণ্ড নেই দেশে। ফলে প্রতি বছর বন বৃদ্ধির চাইতে বেড়ে চলেছে বন উজাড়ের হিসেব।

তিনি বলেন, যারা ভূমিহীন ও প্রভাবশালী তারাই বন দখলের মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। কারণ তারা ভাবেই না যে এটি একটি অপরাধ। এর কারণ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নেই। আর মামলা করলেই দখলকারীরা খুশি, কারণ মামলার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত সেই বনভূমি তারা ভোগ করতে পারে। এতে বলা চলে বন উজাড় একটি সামাজিক ব্যাধি। প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা সংরক্ষণে এজন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ওপর জোর দেন এই প্রকৃতিবিদ। 

বন দিবসের অনুষ্ঠানে বন রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরও জোর দেন প্রকৃতিবিদেরা। তারা বলেন, বনকে ভালোবেসেই একে রক্ষা করতে হবে। কাউকে ভয় দেখিয়ে বন রক্ষা হয় না, সম্ভব নয়। বন না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাংলাদেশ বাঁচবে না।  

লেখক: প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত