প্রাণ ফিরবে ‘প্রাণ সায়ের’ খালের

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:৫২

বরুণ ব্যানার্জী

সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত ‘প্রাণ সায়ের খালের’ প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। প্রাণ সায়েরের প্রাণ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। শহরের সব আবর্জনা গিলে খাচ্ছে খালটি। দখল আর দূষণে খালটি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। প্রাণ সায়ের খালের প্রাণ রক্ষায় বিভিন্ন সময় নাগরিক আন্দোলন হলেও রক্ষা করা যায়নি দখল আর দূষণ। জেলা উন্নয়ন সভায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তা কার্যত আলোর মুখ দেখেনি। প্রভাবশালীরা খালটি দখল করতে করতে সরু নর্দমায় পরিণত করেছে। 

খালের দুই মুখে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইস গেট নির্মাণ, দুই তীর জবরদখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতি স্থাপন করা, খালের মধ্যে বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে খালটি হুমকীর মুখে পড়েছে। বর্তমানে খালটিতে সীমিত পরিমাণে পানি প্রবাহ চালু রয়েছে।

১৮৬৫ সালে অবিভক্ত বাংলার সাতক্ষীরার জমিদার প্রাণনাথ রায় শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পিএন হাইস্কুল এন্ড কলেজ এবং ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধার্থে প্রাণসায়ের খাল খনন করেন। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খেজুরডাঙ্গি বেতনা নদী থেকে সাতক্ষীরা শহর হয়ে এল্লারচর মরিচ্চাপ নদী পর্যন্ত এ খালের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। প্রথমাবস্থায় এ খালের চওড়া ছিল ২০০ ফুটের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সে সময় বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা এসে ভিড় জমাতো এ খালে। এর ফলে সাতক্ষীরা শহর ক্রমশ সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত হয়। আর ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতকে প্রাধন্য না দিয়ে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের নামে খালের দুই প্রান্তে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এতে খালে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি বদ্ধ খালে পরিণত হয়। এরপর জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর খালটি খনন করা হয়। ৯২ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ১০ কিলোমিটার খাল সংস্কারের টেন্ডার পায় ঢাকার মেসার্স নিয়াজ ট্রেডার্স। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, নামমাত্র খনন করে প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই লোপাট করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। খাল খননের নামে খালের দুই ধারে শতশত গাছ কেটে ফেলা হয়। বর্তমানে খালটি বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়েছে।

২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রাণ সায়ের খাল রক্ষা কমিটি মিছিল মিটিং আন্দোলন করে। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি। ২০১৭ সালের ৩০ মে সাতক্ষীরার সর্বস্তরের মানুষ প্রাণ সায়ের খালের প্রাণ রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করে। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। জনতার দাবি ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালের পয়লা মার্চ স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে রাজধানীর হাতির ঝিলের আদলে উদ্বোধন করে দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প। কিন্তু প্রকল্পটি উদ্বোধনের মধ্যেই আটকে থাকে।

গত বছর ৪ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিনদিন ধরে প্রাতঃভ্রমণে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল শহরের সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে প্রাণ সায়ের খালের প্রাণ রক্ষায় জনমত গড়ে তোলার লক্ষে পদযাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে জেলা প্রশাসক খালটির দিকে নজর দেয়ায় আশার আলো দেখা দিয়েছে। খালটির দুপাড়ে গড়ে তোলা হবে দৃষ্টি নন্দন পার্ক। ফুলের বাগান, রঙিন দোলনা আর বসার বেঞ্চ থাকবে বৃক্ষ শোভিত এ নন্দন পার্কে। আমাদের গৌরবগাঁথা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ থাকবে। যাতে রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে একদিন আগামীর শিশুরা জানতে পারবে আমাদের গৌরবের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা।

সাতক্ষীরা নাগরিক নেতা অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, প্রাণ না বাঁচলে সাতক্ষীরা শহর বাঁচবে না। শহরের অস্তিত্ব নির্ভর করে এ খালটির উপর। দখল ও দূষণে আজ খালটি মৃতপ্রায়। তিনি অবিলম্বে দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পের কাজ শুরু করার দাবি জানান।

নাগরিক কমিটির নেতা অধ্যাপক আনিসুর রহিম বলেন, সবার আগে দরকার জনসচেতনতা। তারপর ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করে খালটির ম্যাপ অনুযায়ি নকশা বুঝে নেয়া। খালটি খননপূর্বক সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি।

সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রাণ সায়ের খাল শহরবাসির রক্ষাকবজ। খালটি আমাদের ঐতিহ্যও বটে। এ খালের সাথে মিশে আছে গৌরবময় ইতিহাস। রুটি-রুজি ও কর্ম সংস্থানের সাথে এ খালের সাথে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। খালটি রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

পরিবেশ কর্মী অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী বলেন, রুমাল নাকে ধরে খাল পার হতে হয়। দুর্গন্ধময় পরিবেশের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। তাই এসডিজির লক্ষ অর্জনে খালটির সংস্কারের কোন বিকল্প নেই।

সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি বলেন, প্রাণসায়ের খাল দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খাল রক্ষার্থে মাইকিং করে ইতোমধ্যে পৌরবাসীকে জানানো হয়েছে, যাতে কেউ কোনো ময়লা আবর্জনা খালের ভেতরে না ফেলেন।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, জরুরিভাবে প্রাণসায়র খাল খননের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পে ইতোমধ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু হবে। অবিলম্বে খালের দুইধার পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত