কানের সম্মানজনক তালিকায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্র

প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২১, ১৪:১২

সাহস ডেস্ক

প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে কান-এর ৭৪ তম আসরে সম্মানজনক জায়গা পেলো রেহানা মরিয়ম নূর। আগামী ৬ থেকে ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কান চলচ্চিত্র উৎসব। আর তাই মহাসমারোহে গত ৩ জুন এক যোগে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট সহ কানের সবগুলো সামাজিক মাধ্যম থেকে ঘোষণা করা হয় নির্বাচিত চলচ্চিত্রগুলোর নাম।

কানের আন সার্তেইন রিগার্দ বিভাগের ১৮ টি ছবির তালিকায় সহমহিমায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের রেহানা মরিয়ম নূর-এর নাম। বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পে এ এক বিশাল অর্জন। চলুন, নতুন এই চলচ্চিত্রটি ও এর অর্জনের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেই।

রেহানা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রের পটভূমি

একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষিকা ৩৭ বছর বয়সী রেহানা মরিয়ম নূর আর দশজনের মতোই তার কর্ম ও সংসার জীবনকে শত ঝামেলার মাঝেও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার জীবনটা হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করে যখন একদিন সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বেরোনোর সময় তিনি কলেজের এক ছাত্রীকে জড়িয়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখে ফেলেন। এরপর থেকে তিনি এক ছাত্রীর পক্ষ নিয়ে সহকর্মী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে সেই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। ঠিক সেই সময়েই স্কুল থেকে খারাপ আচরণের জন্য তার ৬ বছরের মেয়ের নামে অভিযোগ আসে। এমন প্রতিকূল অবস্থায় রেহানা চিরাচরিত নিয়মের বেড়াজাল কাটিয়ে সেই ছাত্রী ও তার সন্তানের জন্য ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।

চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ

চিত্রনাট্য লেখা এবং সিনেমায় রূপ দান দুটোই করেছেন তরুণ সিনেমা নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়াকালীন টিভি নাটকের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি শর্টফিল্মও নির্মাণ করেন।

নির্মাতা ওয়াহিদ তারেকের ‘আলগা নোঙর’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন সাদ। পূর্বে ২০০৯ সালে ওয়াহিদ তারেক পরিচালনা করেছেন সাদের লেখা ‘অগাস্টে লেখা গল্পসমগ্র’, ‘লিটল অ্যাঞ্জেল আই অ্যাম ডায়িং’ এবং ‘একটি যথাযথ মৃত্যু’সহ বেশ কিছু টিভি নাটক।

তার প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ (২০১৬) ২৭ তম সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক এবং সেরা পারফরম্যান্সের (মোস্তফা মনোয়ার) জন্য সিলভার স্ক্রিন পুরষ্কার লাভ করে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব রটারড্যামে (আইএফএফআর) এটি প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে সম্পূর্ণরূপে ফিচার করা হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পাড়ায় বেশ সাড়া পড়ে যায়। এছাড়া ২০১৭ সালে ছবিটি ফাইভ ফ্লেভার এশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনয়ন পায়। সাদাকালো পর্দার এই ছবিতে একাধিক ভিগনেটের মাধ্যমে ঢাকা শহর ছেড়ে যাবার চেষ্টায় এক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরা হয়।

চলচ্চিত্রের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সাদ লো-প্রোফাইল থাকতেই বেশী পছন্দ করেন। তাই ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ মুক্তির বছর ২০১৯ সালে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন অনেকটা গোপনেই। দেড় বছরের মধ্যে শেষ করেছেন ছবির শুটিং-এর কাজ। এমনকি ছবির নাম, প্লট, নায়ক-নায়িকা নিয়েও মিডিয়ার সামনে তেমন কিছুই প্রকাশ করেন নি।

অবশেষে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ তৈরি হয় পোটোকল ও মেট্রো ভিডিওর ব্যানারে। ছবিটির প্রযোজনায় আছেন সিঙ্গাপুরের প্রযোজক জেরেমি চুয়া ও সহ-প্রযোজনায় সেন্সমেকার্স প্রডাকশনের পাশাপাশি আছেন রাজীব মহাজন, আদনান হাবিব ও সাঈদুল হক খন্দকার। নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে আছেন এহসানুল হক বাবু। এছাড়া চিত্রগ্রহণে তুহিন তমিজুল, পোশাক পরিকল্পনায় নাবিলা হক, শিল্প নির্দেশনায় মাসুম মেহেদি এবং সাউন্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন শৈব তালুকদার। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির আন্তর্জাতিক পরিবেশনার জন্য পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে ইতোমধ্যেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জার্মান ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ফিল্মস বুটিক।

রেহানা মরিয়ম নূর নাম ভূমিকায় বাঁধন

রেহানা মরিয়ম নূর ছবির প্রধান চরিত্রে কাজ করেছেন লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৬ এর রানার আপ আজমেরি হক বাঁধন। ছোট পর্দায় বেশী নিয়মিত এই অভিনেত্রী ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘নিঝুম অরণ্যে’ (২০১০) নামক একটি মাত্র সিনেমায় কাজ করেছেন। মাঝে মিডিয়া থেকে প্রায় দেড় বছরের একটা বিরতি নিয়ে এই সিনেমায় কাজ শুরু করেন বাঁধন। অতঃপর এ সিনেমায় কাজ করাটা তার ক্যারিয়ারের সব থেকে ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো বলে তিনি মনে করেন। সহকর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক সব মহল থেকেই বাঁধনসহ সব কলাকুশলীরা অভিনন্দিত হয়ে আসছেন তাদের এই অসামান্য অর্জনের জন্য।

১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের এই সিনেমাটিতে বাঁধন ছাড়াও আরও যারা যারা কাজ করেছেন তারা হলেন সাবেরী আলম, আফিয়া জাহিন জায়মা, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, কাজী সামি হাসান, ইয়াসির আল হক, জোপারি লুই, ফারজানা বীথি, জাহেদ চৌধুরী মিঠু, খুশিয়ারা খুশবু অনি, অভ্রদিত চৌধুরী প্রমুখ।

কানের আন সার্তেইন রিগার্দ

কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনের চারটি বিভাগের মধ্যে প্রতিযোগিতা বিভাগের পরের বিভাগটিই ‘আন সার্তেইন রিগাদ’। প্রতিযোগিতা বিভাগের পর এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি নিয়ে মৌলিক ও ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্রগুলোর মুলত এ বিভাগে স্থান পেয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের লাইমলাইটে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে বিভাগটি চালু করা হয়। আন সার্তেইন রিগাদ ফরাসী শব্দ যার অর্থ হলো ‘অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে’। সুতরাং চলচ্চিত্র বিচারের ক্ষেত্রে এখানে চিরাচরিত নিয়মের বাইরের কাজগুলোকে বেশী মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।

প্রতি বছর দক্ষিণ ফ্রান্সের সাগর তীরবর্তী শহর কান-এর পালে দ্যা ফেস্টিভাল ভবনে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত এই ভবনটির স্যালে ডিবাসি প্রেক্ষাগৃহে আন সার্তেইন রিগার্দ বিভাগের ছবিগুলোর প্রদর্শনী হয়ে থাকে।

এ বছর বাংলাদেশ সহ মোট ১৫টি দেশের ১৮টি ছবি নির্বাচিত হয়েছে বিভাগটিতে। গত ৩ জুন প্যারিসের ইউজিসি নর্ম্যান্ডি হলে অন্যান্য সিনেমাগুলোর সাথে ঘোষণা করা হয়েছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর নাম। সেখান থেকেই সরাসরি অনলাইন মাধ্যমগুলোতে সম্প্রচার করা হয়। আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন কান উৎসবের জেনারেল প্রতিনিধি থিয়েরি ফ্রেমো এবং সভাপতি পিয়েরে লেস্কিউর। উৎসবের শেষ দিন ১৭ জুলাই বিচারকদের সভাপতি স্পাইক লি স্বর্ণ পাম বিজয়ী চলচ্চিত্রের নাম ঘোষণা করবেন।

বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে একটি বড় পদক্ষেপ

এর আগে প্রথমবারের মত কান চলচ্চিত্র উৎসবে নাম লেখায় প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছবিটি। ২০০২ সালে ৫৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্যারালাল বিভাগ ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে নির্বাচিত হয়েছিলো এটি। এছাড়া সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক (ফিপ্রেস্কি) পুরষ্কার অর্জন করে।

আর এবারে আন সার্তেইন রিগার্দ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। এই অর্জন এখন সিনেমাটির পোস্টারেও সংযুক্ত হবে এবং সর্বসাকুল্যে প্রতিটি প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের মান বহন করবে। সর্বপরি এটাই প্রমাণিত হবে যে, বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ এখন বাংলাদেশেও সম্ভব।

পূর্বে যদিও বেশ কিছু বাংলা সিনেমা ও নির্দেশক কানসহ আরো মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় বাংলা চলচ্চিত্রকে সগর্বে তুলে ধরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ জন্ম নেয়ার পর বাংলাদেশি নির্মাতাদের তৈরি বাংলা সিনেমার নাম করা হলে নিঃসন্দেহে উঠে আসবে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ এবং আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’।

সাদের সিনেমা কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে থাকার খবর পেয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ তাকে অভিনন্দন জানান।

শেষ কথা

আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ নির্মিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ বাংলাদেশে সমসাময়িক একটি অবস্থাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত একটি সিনেমা। সমস্যার জটিলতার পাশাপাশি এর নিরূপণেরও একটি যথোপযুক্ত বার্তা দেয়ার এক সুনিপূণ প্রয়াস। কান চলচ্চিত্র উৎসবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে এধরনের রূপরেখা নিয়ে আরো কাজ করার উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতঃপর এই বিশাল অর্জন বিশ্বমানের সিনেমা নির্মাণের তাগিদে বাংলাদেশের তারুণ্য নির্ভর পরিশ্রমী দলের প্রয়োজনীয়তা জানান দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ তরুণ নির্মাতাদের আরো বেশী এগিয়ে আসতে হবে চলচ্চিত্র নির্মাণে। তবেই তথাকথিত মুলধারার সিনেমার সীমানা পেরুনো সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত