আজ কমেডির মহারাজ চার্লি চ্যাপলিনের জন্মদিন

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২০, ১৮:০২

সাহস ডেস্ক

নাকের নিচে আধ ইঞ্চি পুরু গোঁফ লোকটার। প্রথম দেখায় মনে হবে, পুরোদস্তুর সাহেব। একটু মনযোগ দিয়ে তাঁর দিকে তাকালে কারও বুঝতে বাকি থাকবে না যে, আদতে তিনি সম্বলহীন। জরাজীর্ণ পোশাক, মাথায় ব্যাক হ্যাট আর হাতে ছড়ি। নির্বাক-কমেডির মহারাজ চার্লি চ্যাপলিনের জন্মদিন আজ।

স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র ওরফে ‘চার্লি চ্যাপলিন’ জন্মেছিলেন ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল। আজ তাঁর ১৩১তম জন্মবার্ষিকী। নির্বাক-কমেডিতে ‘বিশ্বরূপ’ দেখিয়ে গেছেন এই অভিনেতা। জন্ম এবং মৃত্যুর এত বছর পর আজও একইভাবে সমাদৃত তিনি। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটি, মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তিনি করতেন অভাবনীয় পরিবেশনার মাধ্যমে। হোক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা দুঃখের, যে কোনো কঠিন মুহূর্তকে তিনি জাদুকরের মতো ঠাট্টাচ্ছলে বেঁধে ফেলেছিলেন নির্বাক সেলুলয়েডে, যা আজও মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে সার্থকভাবে।

তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার। হলিউড চলচ্চিত্রশিল্পের শুরুর সময় থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত তিনি তাঁর অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। চ্যাপলিনকে বড় পর্দার শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতাদের একজন বলেও বিবেচনা করা হয়। চলচ্চিত্রশিল্পে চ্যাপলিনের প্রভাব অনস্বীকার্য।

ভিক্টোরীয় যুগে তাঁর শৈশব থেকে ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগ পর্যন্ত জীবন ছিল কর্মময়। প্রায় ৭৫ বছর ব্যক্তি ও সমাজজীবনে খ্যাতি ও বিতর্ক দুইই কুড়িয়েছেন তিনি। প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে শৈশব পার করতে হয়েছিল চ্যাপলিনকে। বাবা ছিলেন না, মা ছিলেন দরিদ্র। শিশুশ্রমিক হিসেবে নয় বছর বয়সে তাঁকে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন মা। চৌদ্দ বছর বয়সে কিশোর চ্যাপলিনের মাকে পাঠানো হয় পাগলাগারদে। শৈশব থেকেই শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রঙ্গশালায় যাতায়াত করতে শুরু করেন চ্যাপলিন। পরে শুরু করেন অভিনয়। ১৯ বছর বয়সে স্বনামধন্য ফ্রেড কার্নো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন, যারা তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে হলিউডের সঙ্গে যুক্ত হন চ্যাপলিন এবং ১৯১৪ সালে কিস্টোন স্টুডিওর হয়ে বড় পর্দায় অভিনয় শুরু করেন।

অচিরেই নিজের সৃষ্ট ভবঘুরে দ্য ট্রাম্প চরিত্রের মাধ্যমে পরিচিতি পেয়ে যান। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগালে ‘শার্লট’ নামে পরিচিত চ্যাপলিনের ট্রাম্প ভবঘুরে হলেও ব্রিটিশ ভদ্রজনোচিত আদব-কায়দায় সুসংস্কৃত এবং সম্মানবোধে অটুট। শার্লটের পরনে চাপা কোট, ঢোলা প্যান্ট, বড় জুতো, মাথায় বাউলার হ্যাট, হাতে ছড়ি আর অদ্বিতীয়তম টুথব্রাশ গোঁফ। চ্যাপলিন শুরুর দিক থেকেই তাঁর চলচ্চিত্রগুলো পরিচালনা করতেন এবং পরে এসানে, মিউচুয়াল ও ফার্স্ট ন্যাশনাল করপোরেশনের হয়েও চলচ্চিত্র পরিচালনা চালিয়ে যান। ১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন।

১৯১৯ সালে তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড আর্টিস্ট গঠন করেন, যার ফলে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হল ‘দ্য কিড’ (১৯২১)। পরে ‘আ ওম্যান অব প্যারিস’ (১৯২৩), ‘দ্য গোল্ড রাশ’ (১৯২৫) এবং ‘দ্য সার্কাস’ (১৯২৮) ছবিগুলো বানান তিনি। এসবে অভিনয়ও করেন তিনি।

১৯৩০-এর দশকে তিনি সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ১৯৩৬ সালে ‘গ্রেট ডিক্টেটর’-এর ঠিক আগেই তিনি আর বিখ্যাত নির্বাক সিনেমা ‘মডার্ন টাইমস’ বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি নিজের শাণিত বক্তব্যের চারাটি বুনে দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের বিশ্ব-অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল এই মাস্টারপিস চলচ্চিত্রটি। এতে তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে বেকারত্বের ওপর শিল্পায়নের প্রভাব তুলে ধরেন।

১৯৪০-এর দশকে চ্যাপলিনকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তাঁর জনপ্রিয়তা তখন কমতে থাকে। অভিযোগ ওঠে চ্যাপলিন সমাজতান্ত্রিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ ছাড়া নিজের তুলনায় তরুণ এক নারীকে বিয়ে করায় তাঁকে নিয়ে শুরু হয় নেতিবাচক প্রচারণা। তারপর তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর তদন্ত শুরু করে এফবিআই। চ্যাপলিন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যান আর সেখানেই বাস করতে শুরু করেন। পরের সিনেমাগুলোয় ‘ট্রাম্প’ সত্তা বিসর্জন দেন চ্যাপলিন এবং ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ (১৯৪৭), ‘লাইমলাইট’ (১৯৫২), ‘আ কিং ইন নিউইয়র্ক’ (১৯৫৭) এবং ‘আ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’ (১৯৬৭) ছবিগুলো নির্মাণ করেন।

নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয় করতেন। পাশাপাশি চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সংগীত পরিচালনাও করতেন। আর্থিক স্বাধীনতার কারণে তিনি চলচ্চিত্রের গল্পের বিকাশ ও নির্মাণে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারতেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু ছিল এবং কয়েকটিতে ছিল আত্মজীবনীমূলক উপাদান। গত শতাব্দীর চলচ্চিত্রকে শিল্পরূপে দাঁড় করানোর পেছনে অবদানের জন্য ১৯৭২ সালে তাঁকে সম্মানসূচক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।

শিল্পকলায় অবদানের জন্য ফ্রান্স সরকার ১৯৭১ সালে চ্যাপলিনকে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার ও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে নাইটহুড দেন। ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান চার্লি চ্যাপলিন। মৃত্যুর পরও চ্যাপলিন তাঁর নির্মিত ‘দ্য গোল্ড রাশ’, ‘সিটি লাইটস’, ‘মডার্ন টাইমস’ ও ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ চলচ্চিত্রের কারণে অমর হয়ে আছেন। এই চলচ্চিত্রগুলোকে এখনো মার্কিন চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা ছবি জায়গা দখল করে রাখতে দেখা যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত