সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে?

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:৫৮ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:২১

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে একজন আইয়ুব বাচ্চু গোটা কয়েক প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছেন সংগীত আর গিটারের ছয় তারের মূর্ছনায়। ভরাট গলার সেই জাদুকরী কন্ঠের অসংখ্য গানে প্রেরণা খুঁজেছিলেন লাখো শ্রোতা। বুঁদ হয়ে থেকেছেন রাতের পর রাত। নব্বই এর দশকের একটা প্রজন্মের কাছে ব্যান্ড সংগীতের আরেক নাম হয়ে গিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। যাকে ভক্তরা ‘এবি’ নামে ডাকতেই পছন্দ করতেন। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে লাখো ভক্তদের হতবাক করে দিয়ে ‘এবি’ পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। আকস্মিক এই মৃত্যুতে শোকবিহবল হয়ে পড়েন লাখো ভক্ত।

আশির দশক হতে বাংলা ব্যান্ডের নব উত্থানে আইয়ুব বাচ্চু যুক্ত করেছেন বিভিন্ন ধাঁচের রক গান। হার্ড রক থেকে শুরু করে সফট রক, অল্টারনেটিভ রক সহ গেয়েছেন চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক পর্যন্ত। সংগীত জীবনের শুরুতে ব্যান্ড দল ফিলিংস এর সদস্য হিসেবে গান শুরু করেন তিনি। ‘হারানো বিকেলের গল্প’ শিরোনামের একটি গানে প্রথম কন্ঠ দেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৮০-১৯৯০, এই দশ বছর ব্যান্ড দল সোলসের সাথে গান করেন। এর মধ্যেই নিজের প্রথম একক এলবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশ করেন। এই এলবামটি তেমন সাড়া না পেলেও, আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু ১৯৮৮ সালে তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ দিয়ে।

১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন। আইয়ুব বাচ্চু, জয়, স্বপন এবং এস আই টুটুল ছিলেন এলআরবি ব্যান্ডের চার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এরপর একে একে যোগ দেন মিল্টন, রিয়াদ, সুমন ও কাজী হাবলু। এলআরবি প্রথম কনসার্ট করে ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক ক্লাবে। এই ব্যান্ডের সাথে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। পরের বছর প্রকাশিত হয় এই ব্যান্ডের দ্বিতীয় এলবাম ‘সুখ।’ এই এলবামের গান ‘চলো বদলে যাই’ গানটি তখন এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, তাদের প্রায় সব কনসার্টেই এই গান থাকতো শ্রোতাদের প্রথম পছন্দের তালিকায়। এলআরবি’র কনসার্ট মানেই ‘চলো বদলে যাই'। আইয়ুব বাচ্চুর নিজেরও প্রিয় ছিলো এই গানটি।

এর পরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ড এলবামের পাশাপাশি সোলো এলবাম, চলচ্চিত্রের জন্য প্লে-ব্যাক, আধুনিক গান সহ নানান মাত্রায় যুক্ত করে নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন নিজেই। ব্যান্ড এলবামের শুরুটা ১৯৯২ সালে ‘এলআরবি’ দিয়ে শুরু হলেও, এরপর একে একে প্রকাশ করেন ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ;ফেরারী মন’ (১৯৯৬), ‘স্বপ্ন’ (১৯৯৬), দ্বৈত এলবাম ‘আমাদের বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন মন পাবে’ (২০০০), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নেই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২)। এরপর প্রকাশ হয়নি কোনো ব্যান্ড এলবাম।

এছাড়াও বেশ কয়েকটি সোলো এলবাম প্রকাশ করেন আইয়ুব বাচ্চু। তার প্রথম একক এলবাম ‘রক্ত গোলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশ করেন ‘ময়না’ এলবামটি। এরপর লম্বা বিরতিতে ১৯৯৫ সালে প্রকাশ করেন নতুন এলবাম ‘কষ্ট।’ এই এলবামটির ‘কষ্ট’ শিরোনামের গানটি এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করেন ‘একা’ এলবাম। এরপর ‘প্রেম তুমি কী?’ ২০০২ সালে প্রকাশ করলেও একি বছর আরো দুটি এলবাম প্রকাশ হয় ‘দুটি মন’ ও ‘কাফেলা’ নামে। ‘প্রেম প্রেমের মতো’ এলবামটি প্রকাশ করেন ২০০৩ সালে। ২০০৪ সালে ‘পথের গান’, ২০০৬ সালেও দুটি এলবাম প্রকাশিত হয় ‘ভাটির টানে মাটির গানে’ এবং ‘জীবন’ শিরোনামে। ২০০৭ সালে ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স-ইন্সট্রুমেন্টাল’, ২০০৮ সালে ‘রিমঝিম বৃষ্টি’, ২০০৯ সালে ‘বলিনি কখনো’, ২০১৫ সালে ‘জীবনের গল্প’ এলবাম প্রকাশ করেন আইয়ুব বাচ্চু।

গিটার হাতে বাচ্চু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। গিটার বাজনায় কিংবদন্তী আইয়ুব বাচ্চুর যশ-খ্যাতি বিশ্বজোড়া। নিজের গিটারের সংগ্রহ নিয়ে করেছিলেন প্রদর্শনী। গিটারের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ মেলে তারই গান ‘রুপালী গিটার’ এ।

“এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে বহুদূরে,

সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে”

গিটার নিয়ে তার স্বপ্ন ছিলো আকাশছোঁয়া। গানের পাশাপাশি এক জীবনে তিনি সংগ্রহ করেছেন বেশ কিছু গিটার। অথচ সেই তিনিই অভিমান থেকে গিটার তুলেছিলেন নিলামে। সারাজীবন যে গিটারগুলো বাজিয়েছেন সেখান থেকে পাঁচটি গিটার তিনি তুলে দিতে চেয়েছিলেন নতুন প্রজন্মের হাতে। বেশ কয়েকটি জেলায় গিটার শোও করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশব্যাপী গিটার প্রতিযোগিতা করবেন। বিজয়ীদের হাতে তুলে দেবেন তার প্রিয় গিটারগুলো। কিন্তু অর্থায়নের সংকটে সফল হয়নি তার সেই উদ্যোগ। আর তাই কিছুটা অভিমানে নিজের প্রিয় পাঁচ গিটার বিক্রির জন্য নিলামে তুলেন তিনি।

এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের হতাশার কথা জানাতে গিয়ে লিখেছেন,

“আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার গিটারগুলো নিয়ে গিটারবাজিয়েদের সাথে নিয়ে দেশব্যাপী একটা গিটার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করার। যেখানে এই গিটারগুলো বাজিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেবে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় এক একটি গিটার! কিন্তু বেশ কিছুদিন চেষ্টা করার পরও যখন কোনো স্পন্সর পেলামই না, গিটারগুলো তরুণদের হাতে তুলে দিতে তাদের মেধার মূল্যায়ন স্বরূপ। তারা প্রাণ উজাড় করে গিটার বাজাবে আর আমরা আনন্দের সাথে শুনবো, দেখব এবং উৎসাহ দেব যাতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেন এটা একটা নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন! কারণ হয়তো-বা আমার স্বপ্নটা একটু বেশিই বড়ই ছিল গিটার নিয়ে! আর তা ছাড়া গিটারগুলো রক্ষণাবেক্ষণও বেশ কষ্টকর।”

আইয়ুব বাচ্চু তার ফেসবুক প্রোফাইলে আরো লেখেন,

“আমি ঠিক করেছি- প্রথম এই ৫টা গিটার বিক্রি করে দেব তাদের কাছে যারা গিটার বাজায় কিংবা যারা আমার গিটারগুলো সংরক্ষণে রাখতে চায়।”

বিক্রির জন্য প্রিয় যে পাঁচটি গিটার নিলামে তোলা হয়েছিল সেগুলো হলো (১) ErnieBall MUSIC MAN #AXIS, made in USA (২) CARVIN #JB, made in USA (৩) CARVIN, made in USA (৪) CHARVEL, made in USA ও (৫) ErnieBall MUSIC MAN #JP

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর আইয়ুব বাচ্চু ফুসফুসে পানি জমার কারণে এর আগেও ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন।

হৃদরোগের কারণে সপ্তাহ দুই আগেও একবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ১৮ অক্টোবর, ২০১৮, বৃহস্পতিবার, বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সকালে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসের পরিচালক মির্জা নাজিমউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “সকালে উনার হার্ট অ্যাটাক হয়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তার ড্রাইভার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।”

নব্বইয়ের দশকে জন্মানো প্রতিটা তরুনের মনের হাহাকারের জায়গাটুকুর নাম আইয়ুব বাচ্চু। একজন আইয়ুব বাচ্চু তার মন্ত্রমুগ্ধ সুরের ভেলায় ভাসিয়েছেন এই গোটা প্রজন্মকে। ব্যান্ড সংগীতের উন্মাদনায় মাতিয়েছেন সহস্র কনসার্টে, অনুপ্রেরণা হয়ে পাশে ছিলেন অযুত নিযুত রাতের ছায়া হয়ে। মন খারাপের অজস্র অনুভুতি মুছে দিয়েছেন নিজের শক্তিশালী গানের মাধ্যমে। বারবার ভেঙ্গে পড়ার পর উঠে দাড়ানোর জন্য গেয়েছিলেন, ‘তুমি ভয় পেও না, তুমি ভেঙ্গে যেও না’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’ গেয়ে বলেছিলেন, কষ্টকেও ভালোবাসতে হয়। জীবনকে রাঙ্গিয়ে তুলতে গেয়েছিলেন, ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি।’ তার গাওয়া প্রথম প্লেব্যাক ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান। এছাড়া ‘আম্মাজান’ সিনেমার শিরোনাম গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ‘হাসতে দেখো, গাইতে দেখো’, ‘দরজার ওপাশে’, ‘ফেরারী’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’ সহ অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে থাকবেন প্ত্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।