হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মারক শঙ্কর মুদি

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০১৯, ১৫:৪৭

একটি সময় ছিল যখন শহরে এবং মফস্বলে ‘পাড়া কালচার’ বিদ্যমান ছিল। প্রায় প্রতিটি পাড়া বা মহল্লায় একটি ‘মাস্তান ধরনরে’ দল থাকতো, যাদের আড্ডা ছিল পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকান কেন্দ্রিক। চাল-চলনে এই দলটি মাস্তানদের মতো হলওে আদতে পাড়ার সবার প্রয়োজনে এই দলটইি এগিয়ে আসতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এই পাড়া কালচার এক সময় বিলীন হয়ে গিয়েছে। এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। বদলে যাওয়া এই সময়ের আখ্যানই রাজনৈতিক পটভূমিতে চিত্রায়ন করেছেন পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাতা অনিকেত চট্টোপাধ্যায় তার শঙ্কর মুদি (২০১৯) চলচ্চিত্রে। 

যে সময়ের গল্পকে তিনি পর্দায় তুলে এনেসছে তা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশক—২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের হাত ধরে কোলকাতায় শুরু হয় তথাকথিত গ্লোবালাইজশেন। গ্লোবালাইজশেন বা বিশ্বয়ানের জোয়ারে বহিঃবিশ্বের মতো আলোকোজ্জ্বল বড়-বড় শপিংমল গড়ে ওঠে কোলকাতায়। একই জোয়ারে রাতারাতি ক্রেতাতে ভরে ওঠে সেই সব সুপার বাজার। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় পাড়ার মোড়ের ছোট-ছোট দোকানগুলোতে। প্রায় ক্রেতাশূন্য ছোট দোকানগুলোতে নেমে আসে শ্মশানরে নীরবতা। এইসব জাকজমকপূর্ণ মার্কেট গড়ে ওঠাই যে উন্নয়নের একক মাপকাঠি নয় তাই যেনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় এই ছবি । 

শঙ্কর মুদি'র গল্পরে প্রেক্ষাপট কোলকাতার একটি পাড়ার মোড়কে কেন্দ্র করে। সেখানে একটি মুদি দোকান চালায় শঙ্কর (কৌশকি গাঙ্গুলী)। আছে নারানর (কাঞ্চন মল্লিক) সেলুন, একটি জেন্টস ও একটি লেডিস টেইর্লাস আর আছে চায়ের দোকান। মোড়েই অটোস্ট্যান্ড। তাই আছে কালী (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)’র মতো অটো চালকদের ভিড়। কালীর আচরণ একটু ঔদ্ধত্য, কিন্তু এই শঙ্কর-কালী-নারানরাই সবার বিপদ-আপদেই এগিয়ে যায়। মধ্যরাতে কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে এক ছুটে নিয়ে যায় হাসপাতালে। পাড়ায় কেউ মারা গেলে সবার আগে দৌড়ে যায়— সৎকারের আয়োজন করে; আত্মহত্যা করতে যাওয়া তরুণীকে দৌড়ে গিয়ে উদ্ধার করে। শঙ্করের দোকানের বৃদ্ধা ক্রেতার বাজারের ব্যাগ শঙ্কর নিজেই বহন করে দিয়ে আসে বাড়িতে। পাড়ার সেই দোকানগুলোতে আধুনিক শপিংমলের মতো সুযোগ-সুবিধা, চাকচিক্য-আভিজাত্য না থাকলেও মানুষদের মধ্যে হৃদ্যতার কোন কমতি ছিল না। এক সময় গ্লোবালাইজশেনের ভূত ভর করে সেই পাড়াতে আমদানি হয় উন্নত বিশ্বের মতো সুপারশপ। যে রাজনৈতিক নেতা এক সময় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামিয়েছিলেন তিনিই পক্ষ নেয় শপিংমলের। পাড়ার সন্নিকটে তৈরী হয় ঝলমলে বহুতল শপিংমল। বদলে যেতে থাকে পাড়ার দৃশ্যপট। একে-একে পাড়ার সব প্রায় সব ক্রেতাই বদলে ফেলে তাদের বাজারের ঠিকানা— স্থান করে সুপারস্টোরের। এই অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে অটোস্ট্যান্ডও চলে যায় শপিংমলের সামনে। ক্রেতাশূন্য পাড়ার দোকানীদের সংসারে তখন নেমে আসে অভাবের খড়্গ।

আধুনিক সুপারস্টোর যে শুধুমাত্র কেনাকাটার জন্য সাবেকি পরিবেশের থেকে একটি ভালো পরিবেশ দিয়েছে তা নয়, নানা রকম পণ্যের সমাহার ঘটিয়ে বদলে দিয়েছে মানুষের চাহিদার নকশা। সেই চাহিদার যোগান দেয়া অল্প-পুঁজির শঙ্কর মুদিদের মতো ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কিন্তু তবুও হার মানতে চায় না মেহনতি শঙ্করেরা। অসম এই যুদ্ধে নিজেদের শেষটুকু দিয়ে লড়ে চলে। টেইলার্‌সে থান কাপড়ের পরিবর্তে স্থান করে নেয় রেডিমেট গার্মেন্টস পন্য— বেকার পড়ে রয় সেলাই মেশিন; সেলুনে অমতিাভ বচ্চনের ছবির জায়গা দখল করে সালমান খানের ছবি; মুদি দোকানে যোগ হয় সেলফ সার্ভিস এবং হোম ডেলিভারি সার্ভিস। তবুও কি পুঁজিবাদীদের সঙ্গে পেরে ওঠে এইসব প্রান্তিক মানুষ?
  
এ গল্প শুধু বদলে যাওয়া সময়ের স্মারক নয়—এ গল্প মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গল্প। বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা মানুষের নৈতিকতাকে আমূলে বদলে দিয়েছে সেই গল্প। শঙ্কর মুদি কোন এক মুদি দোকানদারের আত্মজীবনী বলে না, বলে পুঁজিবাদের আধিপত্যের গল্প। নতুন-নতুন আলোকোজ্জ্বল মল-মার্কেটে যে উন্নয়নের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে সেখানেই আঘাত করেছেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। এসবের আগমনে সমাজের একটি শ্রেনী হয়তো লাভবান হয়েছে কিন্তু সেটা প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কোন উন্নয়ন ঘটায়নি বরং উল্টোটাই ঘটিয়েছে। সেটাই লেখা হয়েছে পুরো ছবিটি জুড়ে। 

এই চলচ্চিতের মূল ফোকাস হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা অনেক বিস্তৃত একটি বিষয়। এই বিস্তৃত বিষয়কে ধরতে গিয়েই হয়তো পরিচালক অনেক জায়গায় ছিটকে গিয়েছেন। গল্পের গতি মন্থর হয়ে গিয়েছে। সিনেমা ভেরিতে স্টাইলে পরিচালক কিছু জায়গায় প্রামাণ্য ফুটেজ ব্যবহার করেছেন যা চলচ্চিত্রের অর্থকে আরো গভীরতা দিয়েছে, কিন্তু কিছু জায়গায় হঠাৎ করে প্রামাণ্যচিত্রে চলে যাওয়া খাপছাড়া লেগেছে। এই চলচ্চিতের আরেকটি দুর্বলতা এর চরিতেগুলো। এতো চরিত্রের সম্মেলন ঘটিয়েছেন-অবশ্য গল্পের প্রয়োজনেই— কিন্তু চরিত্রের এই আধিক্যের কারণেই প্রায় চরিত্রগুলোই পূর্ণতা পায়নি। আরো বিকাশ ঘটতে পারতো চরিত্রগুলোর গঠন। তবে সব দুর্বলতাই মলিন হয়ে গিয়েছে অভিনয়ে। প্রায় সব অভিনয় শিল্পীই তাদের অসাধারণ অভিনয় দিয়ে দর্শককে আটকে রেখেছেন গল্পের সঙ্গে। বিশেষ করে বলতে হয় এ-ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করা কৌশিক গাঙ্গুলীর কথা। তিনি যে ভালো পরিচালক পরিচয়ের বাইরেও দুর্দান্ত একজন অভিনয় শিল্পী সেটি আবার প্রমাণ করলেন শঙ্কর মুদিতে। এই চলচ্চিত্রের গানগুলোও চলচ্চিতের আরেকটি অলঙ্কার। কবীর সুমনের লেখা ও সুর করা গানগুলো চলচ্চিত্রের গল্পেরই অংশ হয়ে উঠেছে। ‘নতুন সকাল’, ‘জন হেনরি’, ‘অসম লড়াই’, ‘গ্লোবালাইজশেন’ গানগুলো শুধু গানের জন্য গান নয়—এই গানগুলো ছাড়া চলচ্চিত্রের গল্পও র্পূনতা পায় না।

চলচ্চিত্র এক সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু দর্শকমনে রেখে যায় একটি প্রশ্ন। যে মেয়েটির ডাকে তার অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে নিতে ছুটে এসেছিল শঙ্কর-কালী’রা, সেই মেয়েটিও এক সময় আধুনিকতার ডাকে সাড়া দিয়ে শপিংমলের ক্রেতাবনে যায়। কিছুদিন পর তার বাবা যখন আবার অসুস্থ হয়ে যায়, মেয়েটি জানলায় দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্য সবাইকে ডাকতে থাকে কিন্তু শূন্য পাড়ায় তাকে সাহায্য করার মতো কেউ আর অবশিষ্ট থাকে না। জন হেনরির মতো পুঁজিবাদিদের বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তে শঙ্কর আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, কালী কোন এক বাসের কনডেক্টর হিসেবে চাকরি নিয়ে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে। নারান আর দোকানে আসে না। বৃষ্টিরাতে জানালায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি যখন ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকে তখন একটি প্রশ্নই জাগে, সাহায্য করার কি কোন মানুষ নেই, নাকি মানুষগুলোকে আমরাই তাড়িয়েছি।

লেখক: স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত