নগরকীর্তন: শরীর ও মনের দ্বন্দ্বের গল্প

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১৪:৪৩

“আমার শরীরে ভুল করেছে মধু দা…ঠিক করতে হবে” শরীর আর মনের টানাপোড়েনের গল্প নগরকীর্তন। সময়ের অনন্য চলচ্চিত্রকার কৌশিক গাঙ্গুলীর অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতোই এটিও সমাজকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অমোঘ আহ্বান জানায়, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কি মারাত্মক রকমের ভুল রয়েছে। শার্ট-প্যান্ট পরলেই কি কেউ পুরুষ হয়ে ওঠে অথবা শাড়ি বা অন্য কোন মেয়েলি পোশাক গায়ে চাপালেই কি কেউ নারী হয়ে যায়—এমনই এক প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় নগরকীর্তন।

নারী কিংবা পুরুষ স্বত্ত্বা বাহ্যিক আবরণে নয়—বাস করে মানব শরীরের গভীরতর কোন রন্ধ্রে। গল্পের মূল চরিত্র পরিমল তথা পরি তথা পুঁটি (ঋদ্ধি সেন) জন্ম নিয়েছে পুরুষ শরীর নিয়ে কিন্তু বাহ্যিক খোলসের ভেতরে সে আপাদমস্তক একজন নারী। তাই মধু (ঋত্বিক চক্রবর্তী) কিংবা সুভাষকে যখন সে ভালোবাসে তখন শারীরিক বাঁধার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে সমস্ত নারীস্বত্ত্বা দিয়েই ভালোবাসে। কিন্তু সমাজতো পুঁটি আর মধুর মতো এতো সরল নিয়মে চলে না—সামাজিকতার নামে সেখানে থাকে জটিল সব অংক। তাই পুঁটি-মধুর সরল ভালোবাসা সমাজের কাছে ব্রাত্য হয়ে রয়। সমাজ পুঁটিকে তার পুরুষ শরীর দিয়েই বিচার করে যেখানে তার ‘মন’ কে বেঁধে ফেলে ‘মেয়েলি’ শব্দের বন্ধনীতে।

কৈশোরে পরিমল যখন তার ভেতরের পরিকে পূর্ণরূপে আবিস্কার করছিল তখন তাঁর জীবনের ত্রাতা হয়ে আসে সুভাষদা—পরি এবং তার বড় বোনের গৃহশিক্ষক এবং পরির জীবনের প্রথম প্রণয়। সুভাষের সঙ্গ পেয়েই পরিমল হয়ে ওঠে পরি। পরি সুভাষকে বলে, ‘আমারিকায় শুনেছি ছেলে-ছেলে বিয়ে হয়...তুমি আমায় নিয়ে যাবে সুভাষ দা...’ কিন্তু সুনীলের কবিতার মতো কথা রাখেনা সুভাষ দা। সামাজিকতার ভ্রুকুটি সহ্য করার মতো সাহসীকতা সে দেখাতে পারে না—সামাজিক মানুষ হিসেবে সংসার পাতে পরির বড় বোনের সঙ্গে। পরি বাড়ি থেকে পালিয়ে কোলকাতার এক হিজড়া পল্লীতে স্থান করে নেয় এবং সেখানেই পরি হয়ে ওঠে ‘পুঁটি’। নগরকীর্তন এক দিকে যেমন পুঁটির জীবনের গল্প—জীবন যুদ্ধের গল্প, তেমনি এ-চলচ্চিত্র মধু’রও গল্প—মধু’র সমাজের প্রতিকুলে দাঁড়িয়ে পরিপার্শ্বকে নতুন করে আবিস্কার করার গল্প।

মধু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ যারা বংশপরম্পরা কীর্তন করে আসছে। বংশের প্রথা ভেঙ্গে মধুই একমাত্র অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। শহরের একটি ফাস্ট ফুড দোকানের ডেলিভারি বয় হিসেবে চাকুরী করে আর সুযোগ পেলে কীর্তনের দলের সঙ্গে বাঁশী বাজায়। মধু পুরুষ শরীর ভেতরের নারী পুঁটিকে আবিস্কার করে। কিন্তু নিজের ভেতরে যে সামাজিক নিয়ম জন্মের পর থেকেই সমাজ গেঁথে দিয়েছে তাকে জয় করা অতো সহজ নয়। মধুও প্রথম-প্রথম পারে না। প্রেমের প্রবল টানে তাঁর ভেতরের পুরুষকে যতই শাসন করুক না কেন মাঝেমাঝেই তা মধুকেও গ্রাস করতে চায়, আর তাই মধুকে বলতে শোনা যায়, ‘ফুলবডি মেয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছে এসো না’। পুঁটি জানে তার ভেতরে যে নারীত্ব বহন করছে তাতে এক বিন্দু কমতি নেই তাই সেও দৃপ্ত কন্ঠে উত্তর করে, ‘আমায় ছুঁয়ে কোথাও কি তোমার মনে হয় আমি ছেলে?’ 

না, মধু কোন ছেলের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না কিন্তু তবুও পরিবার, সমাজ, লৌকিকতার একটি প্রচ্ছন্ন ছায়া থেকে যায় মধু এবং পুঁটির চিন্তায়। তাই পুঁটি বদলে ফেলতে চায় নিজের শরীর। একটি নারী শরীরের জন্য হাহাকার করে তার অন্তরাত্মা। এই চাঁপা আর্তনাদ ধরা পড়ে পুটি মধুদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে যখন মধুর ভাবিকে কাপড় বদলাতে দেখে তখন। এই হাহাকার শুধু পুঁটির একার নয় পুঁটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে আসলে সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মানসিক কষ্টবোধ এবং তাদের বুক ফাটা আর্তনাদের কথাই উঠে এসেছে। আমরা যারা রাস্তায় বা গণপরিবহনে বৃহন্নলাদের দেখলেই আঁতকে উঠি তাদের জন্য নতুন ভাবে ভাবনার খোরাক যোগায় নগরকীর্তন। চলচ্চিত্রে যে পুঁটিকে দেখে সামাজিকতার অগ্নিচক্ষু উপেক্ষা করে দর্শক নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে সে পুঁটি যে এইসব বৃহন্নলাদেরই প্রতিনিধি! 

নগরকীর্তনে আরেকটি বিষয় ঘুরে ফিরেই এসেছে রূপালী পর্দায়—তা হলো কীর্তন। একই অঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণ প্রেমভাবই তো কীর্তনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আবার অপর দিকে মধু-পুঁটির প্রেম সমাজের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ যেমনটি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের বেলায়ও ছিল। এই দুই নিষিদ্ধ প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় অভিনয় এবং আবহ সঙ্গীতে। মধুদের বাড়িতে পুঁটির আসল পরিচয় ধরা পড়ে যাবার পর পুঁটি যখন বাড়ি থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে আসে এবং ক্ষুধার জ্বালায় ও কোলকাতা ফেরার টাকা যোগাড় করতে হোলি উৎসবের দিন স্থানীয় বাজার থেকে টাকা তুলছিলো তখন স্থানীয় আরেকদল হিজড়া এসে পুঁটিকে মারধোর করে—নগ্ন করে। এমন সময় পরিচালক আসলেন ত্রাতা হয়ে। পুঁটির শরীরে এঁকে দেন নীল রঙ। এ যেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণের হাহাকার পুঁটির হাহাকারের সঙ্গে ঐক্যতান করে গেলো! 
 
চলচ্চিত্রের সমাপ্তি আমাকে বেশ ধাক্কা দেয়। না, পুঁটির আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া নয়, বরং চলচ্চিত্রকারের এমন সমাপ্তি প্রদানই আমাকে বেশী ধাক্কা দিয়েছে। এই ধরনের গল্পের অধিকাংশ চলচ্চিত্রই শেষ হতে দেখি মূল চরিত্রের আত্মহননের মাধ্যমে। ভেবেছিলাম পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী হয়তো অন্য রাস্তায় হাঁটবেন। কিন্তু তিনিও সেই চিরচেনা পথই দেখালেন। দুই ঘন্টা ধরে পুঁটির যে লড়াই আমরা দেখতে পাই আত্মহত্যাই তার শেষ পরিনতি চলচ্চিত্রকার যেন এমন বাণীই দিয়ে গেলেন! সমাপ্তি যেমনই হোক এই চলচ্চিত্রের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে অভিনয়। মধু চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং পুঁটি চরিত্রে ঋদ্ধি সেন একে অপরের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে অভিনয় করেছেন যেন দু'জনে শিল্প প্রদর্শনের মধুরতম কোন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যদিও এ ক্ষেত্রে আমি ঋদ্ধিকেই কিছুটা এগিয়ে রাখছি কারণ তাঁকে একই সঙ্গে পরিমল, পরি, এবং পুঁটিকে ধারণ করতে হয়েছে। 

পরিশেষে বলবো একটি সাদামাটা গল্প কৌশিক গাঙ্গলীর নির্মাণশৈলি, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ সঙ্গীত এবং ঋত্বিক-ঋদ্ধির অনিন্দ্য সুন্দর অভিনয়ে একটি নিষ্পাপ প্রেমের আঁচড় কেটে যায় নগরকীর্তন। 

লেখক: স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত