জন্ম থেকে মৃত্যু কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৩

কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের সাথে সঙ্গীতজগতে যাত্রা শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চুর। শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কাথায় বাচ্চুর কন্ঠ দেয়া প্রথম গান "হারানো বিকেলের গল্প"।

এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি সোলস ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ‘রক্তগোলাপ’ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) এর মাধ্যমে সফলতা শুরু।

পরে ১৯৯১ সালে নিজের ব্যান্ড ‘এল আর বি’ গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। এই ব্যান্ডের সাথে তার প্রথম অ্যালবাম ‘এল আর বি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের “শেষ চিঠি কেন এমন চিঠি” “ঘুম ভাঙ্গা শহরে” “হকার” গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও’ বের হয়। সুখ অ্যালবামের “সুখ”, “চলো বদলে যাই”, “রূপালি গিটার” “গতকাল রাতে” উল্লেখযোগ্য গান। “চলো বদলে যাই” বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই।

১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয় এই অ্যালবামটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে “কষ্ট কাকে বলে” “কষ্ট পেতে ভালোবাসি” “অবাক হৃদয়” ও “আমিও মানুষ”। একই বছর তার চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়।

২০০৯ সালে তার একক অ্যালবাম ‘বলিনি কখনো’ প্রকাশিত। ২০১১ সালে এল আর বি ব্যান্ড থেকে বের করেন ব্যান্ড অ্যালবাম ‘যুদ্ধ’। এই অ্যালবামে ১০টি গান রয়েছে। ছয় বছর পর তার পরবর্তী একক অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫) বাজারে আসে। এই অ্যালবামে ১০টি গান রয়েছে। গানের কথা লিখেছেন সাজ্জাদ হোসাইন এবং সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন আইয়ুব বাচ্চু নিজে।

এ ছাড়া অনেক মিশ্র অ্যালবামে কাজ করেছেন। এর মধ্যে প্রিন্স মাহমুদের সুরে করা মিশ্র অ্যালবামগুলোতে তাঁর গান আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর সেরা গানগুলো নিয়ে একটি অ্যালবাম বের করা হয়।

প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রেও গেয়েছেন। “অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে” বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। চলচ্চিত্রে তাঁর আম্মাজান গানটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি ধরা হয়।

গিটারে তিনি সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত। জিমি হেন্ড্রিক্স এবং জো স্যাট্রিয়ানীর বাজনায় তিনি দারুনভাবে অণুপ্রাণিত। আইয়ুব বাচ্চুর নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম ‘এবি কিচেন’। তিনি ২০১০ সালে ঈদের জন্য নির্মিত ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি শিরোনামের নাটকে অভিনয় করেন।

২০১৪ সালের ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্ট’-এ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন নিয়ে মাইলস ব্যান্ডের হামিন-এর সাথে বাচ্চুর বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের সূত্রে বাচ্চু ও তার ব্যান্ড এল আর বি বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) সদস্যপদ প্রত্যাহার করে।

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর বাচ্চু ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন।

২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে সকাল সোয়া ৯টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে শেষ কনসার্ট করেন রংপুর জিলা স্কুল মাঠে ১৬ অক্টোবরে। নাম ছিল ‘শেকড়ের সন্ধানে’৷

জানা গেছে, আজ সকালে শরীর খারাপ লাগলে আইয়ুব বাচ্চুর ব্যক্তিগত গাড়িচালক তাঁকে নিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে তোলার সময়ই তাঁর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। সকাল সোয়া নয়টার দিকে তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

চিকিৎসকেরা জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তিনি মারা যান।

স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. মির্জা নাজিমুদ্দিন জানান, জরুরি বিভাগে কার্ডিয়াক কনসালট্যান্ট মুনসুর মাহবুবের উপস্থিতিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে আইয়ুব বাচ্চুর হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

আইযুব বাচ্চুর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই শোক প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম সহ কোটি কোটি ভক্তরা শোক প্রকাশ করেন।

কোটি কোটি ভক্তের চোখে অশ্রু এবং হৃদয় ভেঙে পরপারে পারি জমিয়েছেন প্রিয় কন্ঠ শিল্পী ও গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু।

বাচ্চুর সংগীত জীবন:

একক অ্যালবাম

রক্তগোলাপ (১৯৮৬)
ময়না (১৯৮৮)
কষ্ট (১৯৯৫)
সময় (১৯৯৮)
একা (১৯৯৯)
প্রেম তুমি কি! (২০০২)
দুটি মন (২০০২)
কাফেলা (২০০২)
প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩)
পথের গান (২০০৪)
ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬)
জীবন (২০০৬)
সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭)
রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮)
বলিনি কখনো (২০০৯)
জীবনের গল্প (২০১৫)

ব্যান্ড অ্যালবাম

এলআরবি (১৯৯২)
সুখ (১৯৯৩)
তবুও (১৯৯৪)
ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫)
ফেরারী মন (১৯৯৬)
স্বপ্ন (১৯৯৬)
আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮)
মন চাইলে মন পাবে (২০০০)
অচেনা জীবন (২০০৩)
মনে আছে নাকি নেই (২০০৫)
স্পর্শ (২০০৮)
যুদ্ধ (২০১২)

নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী

লাল বাদশা (১৯৯৯)
গুন্ডা নাম্বার ওয়ান (২০০০)
ব্যাচেলর (২০০৪)
চোরাবালি (২০১২)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত