সন্দেশ কিংবা সুখবর

শিল্পকলায় অনন্যার একক নৃত্যসন্ধ্যা দেখার আমন্ত্রণ

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০১৮, ১১:৪১

১.
নান্দনিক বিমুগ্ধতার আলো ছড়ানো সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিশেষভাবে আগ্রহের শিল্পকলার নাম- নৃত্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৃত্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ/ নৃত্যে তোমার মায়া/ বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে/ কাঁপে নৃত্যের ছায়া।’ এ নৃত্য আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় নৃত্য। আমাদের উপমহাদেশে শাস্ত্রীয় নৃত্য সম্পর্কে চেনা-জানা, যথার্থ উপলব্ধি ও বোধ সেই নির্দিষ্ট সীমানা কোনো মতেই অতিক্রম করতে পারছে না। এদেশে সেই শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রসারের শিল্পীদের মধ্যে অনন্য এক নাম অনন্যা ওয়াফি রহমান। ভালোবাসার শিল্পের প্রতি একান্ত নিমগ্ন সাধিকা এই শিল্পী কত্থক নৃত্যকে নান্দনিক পরিবেশনার মাধ্যমে মুগ্ধ করে চলেছেন, অনন্যতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন শিল্পমনাদের মাঝে। অকৃত্রিম নৃত্য প্রীতি আর কঠোর সাধনা, পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছেন আমার প্রিয় এই শিল্পী। নিরন্তর ও নিরলসভাবে চর্চা অব্যাহত রেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে শাণিত ও সমৃদ্ধ করে চলেছেন এই গুণী নৃত্যশিল্পী। অর্জন করেছেন শ্রমসাধ্য শৈল্পিক মানসম্পন্ন শিল্পকলার মাধ্যম কত্থক নৃত্যের নানান আঙ্গিক। এবার নৃত্যপ্রেমীদের সামনে শিল্পী অনন্যা ওয়াফি রহমান মেলে ধরবেন সেই শিল্প-প্রয়াস। 

আজ ২০ জুলাই এই শিল্পী নৃত্যরসিকদের সামনে উপস্থাপন করবেন তার একক কত্থক নৃত্য পরিবেশনা। শিল্পীর নাচের সঙ্গে এই আয়োজনের বাড়তি আকর্ষণ থাকবে প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া, সুরেলা শব্দধ্বনি তোলা সুরসাধক মাহমুদুল হাসানের বেহালা বাদন। আজ ২০ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনের নৃত্য ও যন্ত্রসঙ্গীতে সাজানো অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে নৃত্যমঞ্চ ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিষদ। আপনি সবান্ধবে আমন্ত্রিত। সুতরাং চলে আসুন প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে এই আনন্দ আয়োজনে।

২.
একান্ত আলাপনকালে নৃত্যানুষ্ঠানটি প্রসঙ্গে নাচের মুদ্রায় গড়া দুনিয়ার শিল্পী অনন্যা ওয়াফি রহমান বলেছেন, সকাল ধরনের নাচের উৎস হচ্ছে শাস্ত্রীয় নাচ। এই নৃত্যশৈলী রপ্ত করতে একজন শিল্পীকে সাধনার মধ্য গিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। সেই বিবেচনায় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রচার ও প্রসার বাড়াতে এ ধরনের নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি শিল্পীদের অনুপ্রেরণা সৃষ্টিতে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়ে পৃথক অনুষ্ঠান করতে হবে। আর শুক্রবারের নৃত্যসন্ধ্যা প্রসঙ্গে ওয়াফি রহমান জানালেন, কত্থক নৃত্যের পরিবেশনাটি হবে ৪০ মিনিট ব্যাপ্তির। সরাসরি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে কত্থক নানা আঙ্গিক উপস্থাপন করা হবে এই আসরে। বিলম্বিত লয়ে বন্দনার আশ্রয়ে শুরু করবেন পারফরমেন্স। বিভিন্ন মুদ্রার উপস্থাপনার সঙ্গে অভিব্যক্তির মেলবন্ধনে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে শিল্পীর পরিবেশনা। একে একে উপস্থাপিত হবে ঠাট, আমোদ, টুকরা, পরন, তেহাই, গৎভাও। দ্রুত লয়ের মাধ্যমে এ পর্বের সমাপ্তি হবে। এরপর পরিবেশিত হবে মীরা ভজন। এ পর্বে প্রকাশ হবে কৃষ্ণের প্রতি প্রবল অনুরাগী মীরার হৃদয়ের আকুলতা। তারানা দিয়ে শেষ হবে একক শিল্পীর পরিবেশনা।

৩.
ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কত্থক। কত্থক নামে পরিচিত একটি প্রাচীন নর্তক সম্প্রদায়ের নাম বা তাদের নৃত্য ‘কথক’ এর নামানুসারে এর প্রচলন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে উত্তর ভারতের মন্দিরকেন্দ্রিক নৃত্য হিসেবে কত্থকের সূচনা বলেও কেউ কেউ মত দেন। কত্থক শব্দটি এসেছে বৈদিক সংস্কৃত শব্দ কথা থেকে যার অর্থ “গল্প“, এবং সংস্কৃততে কথাকার শব্দটির অর্থ হচ্ছে “যিনি গল্প বলেন” বা “গল্পের সাথে কাজ করা“। নৃত্যের চলে গল্প বলা হতো বলেই প্রারাচীন উপমহাদেশীয় কত্থক শিল্পীরা কথাকার নামেই পরিচিত ছিলেন। মেরি স্নোডগ্রাসের মতে, ভারতবর্ষের কত্থক নৃত্য কলার অস্তিত্ব ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পাওয়া যায়। কত্থক সম্পর্কে পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় লিপি “নাট্য শাস্ত্র”এ। তা ছাড়াও প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন সাহিত্য কর্মে কত্থকের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোগল আমলে দরবারি সংগীত ও নৃত্য যুগের সূচনা হলে কত্থক নৃত্য দরবারে স্থান পায়। অতীতে নৃত্যটি সুগঠিত ছিল না। মোগল দরবারের সঙ্গে যুক্ত নৃত্যবিদেরা একে সুগঠিত ও শাস্ত্রসম্মত করে তোলার প্রয়াস নেন। তবে এই নৃত্যধারার প্রকৃত বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতকে লহ্মৌর নবাব আসাফউদ্দৌলা ও ওয়াজিদ আলী শাহ্ দরবারকে কেন্দ্র করে। ওয়াজিদ আলী (১৮২২-১৮৮৭) এই নৃত্যের প্রকৃষ্ট রূপ প্রবর্তন করেন। তাঁর দরবারে আশ্রিত অসাধারণ এক নর্তক পরিবার এতে সহায়তা করেন। এই পরিবারের সর্বাগ্রে ছিলেন প্রকাশজী। তাঁর ছেলে ঠাকুরপ্রসাদ ও দুর্গাপ্রসাদ এবং ঠাকুরপ্রসাদের ছেলে বিন্দাদীন, কালকাপ্রসাদ ও ভৈরবপ্রসাদও ছিলেন এই অভিযাত্রায়। কালের পরিক্রমায় সেই কত্থক আজ শাস্ত্রীয় নৃত্যের শ্রেষ্ঠতায় অধিষ্ঠিত।

৪.
নূপুরের রিনিকঝিনিক ছন্দে আদুরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ঢেউ খেলা আর প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি তার চোখে ধাঁ ধাঁ ধরিয়েছিল শৈশবেই। সেই মোহমায়ায় ছোটবেলা থেকেই শাস্ত্রীয় নাচের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে এ সময়ের প্রতিভাদীপ্ত নৃত্যশিল্পী অনন্যা ওয়াফিয়া রহমানের। সমবয়সীরা যখন নানা ধরনের খেলাধুলায় ব্যস্ত তিনি তখন নাচের মহড়ায় কঠোর কসরতে ব্যকুল। এমনিভাবে নৃত্যকে ধ্যান-জ্ঞান করে পথ চলছেন বীরদর্পে। এরই মধ্যে নিজের মেধাদীপ্ত কর্ম-মুখরতায় মাতিয়েছেন সংস্কৃতিপ্রেমীদের। সময়ের অন্যতম প্রতিভাধর এই নৃত্যশিল্পী সাধারণ নৃত্য, আধুনিক নৃত্যসহ সবধরনের নাচের মুদ্রায় সাজিয়েছেন নিজের শিল্পসৃজন। প্রায় সব শাখাতে শৈল্পিক পরিবেশনায় দক্ষ হলেও সাধনার বিষয় হিসেবে কত্থক নৃত্যেই জোর দিয়েছেন বিশেষভাবে। আর সেই সাধনাই তার ঝুলিতে এনে দিয়েছে বহু পুরস্কার-সম্মাননা। বর্তমানে শিশু একাডেমিতে নাচের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন অনন্যা। পাশাপাশি ইটিসি নাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘ড্যান্স উইথ অনন্যা’ নামের একটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। শিশু একাডেমির প্রশিক্ষক ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে ভারত, চীন, নেপাল, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। 

৫.
বাবা ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য আর মা সেকালে কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে পাস করা চিত্রশিল্পী। বাড়িতে সবসময়ই মানুষের আনাগোনা থাকত, সাহিত্য আড্ডা চলত। তাই বলা যায়, একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই তার বেড়ে ওঠা। সম্ভবত সে কারণেই আশির দশকে একজন নারী হয়ে তার নিজের স্বপ্নের জগৎ সাজাতে পেরেছিলেন নাচকে আরাধনা করে। সাবেক সাংসদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাবা ওয়ালিউর রহমানের অনুপ্রেরণায় এবং মা চিত্রশিল্পী সুজাতা রহমানের নিরন্তর সহযোগিতায় শৈশব থেকেই নাচের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন অনন্যা ওয়াফি রহমান। সেই সাধনার ফসল হিসেবে নব্বইয়ের দশকে নতুন কুঁড়ি অনুষ্ঠানে অংশ কত্থক নৃত্যে পুরস্কার অর্জন করেন। নিবেদিত এই শিল্পী ভারতের আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে দিল্লির শ্রীরাম কলা কেন্দ্র থেকে কত্থক নৃত্যের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেন। এছাড়া কত্থক নৃত্যে দীক্ষা নিয়েছেন পন্ডিত বিরজু মহারাজ, গুরু শিখা খেরে ও পদ্মভূষণপ্রাপ্ত ড. উমাশর্মার কাছ থেকে। নৃত্যমঞ্চ নামক একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর পাশাপাশি এই শিল্পী বর্তমানে শিশু একাডেমি ও লিটল স্টেপস স্কুলে নৃত্য প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

৬.
তখনো স্কুলে ভর্তি হননি। স্বরলিপি শেখার সে বয়সেই তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় নাচ শেখার স্কুলে। বলা চলে প্রথম স্কুল কিংবা পরিবারের বাইরে প্রথম শিক্ষালয় এটিই। আর এসব কথা যাকে নিয়ে তিনি ওয়াফি রহমান অনন্যা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও আঁচ করা গেছে আজকের আয়োজন যাকে ঘিরে, তিনি সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে আছেন নাচের সঙ্গে। তিনি নাচের জগতের মানুষ। নাচই তার ধ্যানজ্ঞান। নিজে নাচেন, অর্থাৎ তিনি একজন নৃত্যশিল্পী এবং একনিষ্ঠ নাচের শিক্ষক, নৃত্য সংগঠক। ১৯৮৩ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করার মধ্য দিয়ে সাফল্যের মালাগাঁথা শুরু করেন। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে বিটিভি’র নতুন কুঁড়িতে সাধারণ নৃত্যে প্রথম স্থান ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। একই বছরে শিশু একাডেমি পুরস্কারও জিতে নেন অনন্যা। এরপর ভারতের প্রাচীন কলাকেন্দ্র থেকে কত্থক নৃত্যের উপর পরপর তিনবার পুরস্কার জিতেন বাংলাদেশী এই নৃত্যকন্যা। 

৭.
১৯৮৪ কি ’৮৫ সালের কথা। পুতুল খেলার সে বয়সে বুলবুল একাডেমি ফর ফাইন আর্টস বা বাফার ওয়াইজঘাট শাখায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় অনন্যাকে। মেয়ে নাচ শিখুক এমনটাই চাইতেন তার মা। মায়ের ইচ্ছায় ছোট্ট অনন্যা গুটি গুটি পায়ে নাচের স্কুলে যেতেন। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখতেন। নাচ সঙ্গী করেই বেড়ে ওঠেন তিনি। একটা সময় খুব টের পান যে, নাচের প্রতিটা মুদ্রাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন। ওয়াফি রহমান অনন্যা বলেন, সে সময় খুব কম মেয়েই নাচ শিখতে আসত। আমার যতটা মনে পড়ে বাফাতে আমাদের ক্লাসে আমরা মাত্র ছয়জন মেয়ে ছিলাম। নব্বইয়ের আগে আগে শিশুদের নিয়ে বিটিভি আয়োজিত তুমুল জনপ্রিয় প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান নতুন কুঁড়িতে অংশগ্রহণ করেন অনন্যা। সে বছর সাধারণ নৃত্য ও কত্থক নৃত্যের দুটো পুরস্কারই উঠে আসে তার দখলে। সে স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে হয়েই আছে অনন্যার স্মৃতির অ্যালবামে। কেননা প্রথম কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আর জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়ার মধুর স্মৃতি ছিল সেটি। অন্যদিকে শুধু নতুন কুঁড়িই না, শিশুশিল্পী হিসেবে জিতেছেন শিশু একাডেমি থেকে পুরস্কারও।

৮.
ঢাকার মোহাম্মদপুরে বড় হয়েছেন। শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন এখানে। মাধ্যমিক পাস করার পরই মূলত হাতে পান বাফা কর্তৃক সাত বছরের কোর্সের মূল্যায়নপত্র। যদিও তিনি কোর্স সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন আরো আগেই। তবে মাধ্যমিক পাস না করা পর্যন্ত এ মূল্যায়নপত্র দেয়া হয় না বলে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। সে সময়ই মূলত মনস্থির করেন নাচ নিয়েই উচ্চতর পড়াশোনা করবেন বলে। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস সংক্ষেপে আইসিসিআর স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেন। তখন স্কলারশিপ পেয়ে পাড়ি জমান দিল্লিতে। সেখানে শ্রীরাম ভারতীয় কলাকেন্দ্র থেকে কত্থক নৃত্যের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯-০৪ সাল পর্যন্ত তিন বছর ও দুই বছর মেয়াদে প্রথম বিভাগ পেয়ে দুটো ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশী একজন ছাত্রীর এ কৃতিত্বে কলাকেন্দ্রের সবাই বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। কত্থক নাচে ভালো ফলাফল করার পেছনে মূলমন্ত্র হিসেবে তিনি বলেন, দিল্লিতে যাওয়ার পর খুব অল্প সময়েই আমি সবার নজরে এসেছিলাম নাচ দিয়ে। আমি যেহেতু আগে থেকেই কত্থক শিখেছিলাম, তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। দিল্লি থেকে কত্থক নাচের ওপর ভালো ফলাফলের তকমাই শুধু আনেননি অনন্যা। সেসঙ্গে তার অর্জনও কিন্তু ভারী হয়েছে বেশকিছু সম্মাননায়। যেমনটা বলা যেতে পারে, ২০০০-০২ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর প্রাচীন কলাকেন্দ্র থেকে কত্থক নৃত্যের ওপর পেয়েছেন পুরস্কার।

৯.
নৃত্যচর্চা নিয়ে অনন্যা ওয়াফিয়া বলেন, ‘নাচ একটি দীর্ঘমেয়াদি সাধনার বিষয়। এখানে হুট করে এসেই কিছু করা যায় না। শুধু নাচই নয়, যেকোনো কাজের ক্ষেত্রেই দৃঢ় মনোযোগ, কঠোর পরিশ্রমের সাথে সাধনের চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই। নৃত্য যেহেতু একটা শিল্প সেহেতু শিল্পের চর্চাটা একান্তভাবেই করা প্রয়োজন। আমি সেটি চিন্তা করেই নিজেকে তৈরি করেছি এবং করছি।’ বাংলাদেশে নাচের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে বলেও মনে করেন অনন্যা। ভারতীয় গুরুদের কাছ থেকে শিক্ষার পর একুশে পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী মীনু হক, সাজু আহমেদ, নিলুফার ওয়াহিদ পাপড়ি, লায়লা হাসান, দীপা খন্দকার প্রমুখদের সহযোগিতা তার চলার পথকে অনেক সহজ করে দিয়েছে বলেও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কত্থক নৃত্যের তরুণ এই প্রশিক্ষক। 

১০.
কত্থকের ওপর পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে নৃত্যমঞ্চ নামে একটি ইনস্টিটিউট চালু করেছেন অনন্যা। সেখান থেকে প্রায়ই অনুষ্ঠান করেন। একই সঙ্গে উত্তরার দিল্লি পাবলিক স্কুলের নাচ বিভাগের প্রধানও ছিলেন অনেক দিন। টানা ছয় বছর। মাঝখানে পরিবারের কারণে কিছুদিন নাচ বন্ধ রেখেছিলেন। এখন আবার পুরোদমে ফিরে এসেছেন নাচের জগতে। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে যোগ দিয়েছেন শিশু একাডেমিতে, নাচের প্রশিক্ষক হিসেবে। নিজে নাচ শিখেছেন যেখানে, সেখানেই তিনি এখন প্রশিক্ষক, এটা তার জন্য বাড়তি রোমাঞ্চ হয়ে এসেছে। অনন্যা বলেন, শিশু একাডেমিতে কাজ করাটা তাই আমার কাছে বিশেষ কিছু। আমি ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে নাচ শিখতে আসতাম এখানে। এখানকার প্রত্যেকটা শিশুর মাঝে যেন আমি নিজেকে খুঁজে পাই। অন্যদিকে শিশু একাডেমির পাশাপাশি অনন্যা নাচের প্রশিক্ষক ইটিসি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও। সেখানে ডান্স উইথ অনন্যা নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছেন তিনি।

১১.
অনন্যার দুনিয়া শুধু নাচের মুদ্রায় সাজানো। তার সার্বক্ষণিক ধ্যান। বুঝতে শুরু করার পর থেকে তার পুরো জীবনটাই চলেছে নাচকে কেন্দ্র করে। দুই সন্তানের মা অনন্যা এখনো পুরো দিনের ছক কাটেন নাচের সময়টুকু আলাদা রেখেই। নিয়মিত অনুশীলন করেন। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বেছে নেন, যখন পুরো সময়টুকু ডুবে থাকেন নাচের তাল-লয় নিয়ে। পাশাপাশি সংসার-সন্তানও সামলে যাচ্ছেন দেবী দুর্গার মতোই। সন্তানের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে নাচের পোশাক তৈরি সবকিছুই করতে হয় তার নিপুণভাবে। তবে সব ব্যাপারে সহযোগিতা পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকেও। সেদিক থেকেও নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান বলে মনে করেন তিনি। 

১২.
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই জানেন, মানেন সংস্কৃতির দৃঢ় বন্ধনই মানুষের মধ্যকার বিভেদ-বৈষম্য ঘোচাতে পারে। সংস্কৃতির ভিন্নতার মধ্যেই ঐক্য গড়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। আর কুসংস্কারকে সংস্কৃতির শক্তিতে পরাজিত করা যায়। ১৯৭১ সালে সংস্কৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ দেশের মানুষেরা। সংস্কৃতি সেখানে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংস্কৃতির বিকাশ ও সাধনা হতে পারে অন্যতম প্রতিরোধ, হাতিয়ার। তরুণদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে নৃত্যশিল্পসহ সংস্কৃতির নানান মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে দেশ ও জাতির প্রয়োজনেই।

১৩.
শাস্ত্রীয় নৃত্যজগতের সঙ্গে পরিচিত করা এবং নৃত্যচর্চাকারী ও নৃত্যরসগ্রাহীদের মধ্যে যোগসাধন নিবিড় করতে বিভিন্ন সময় নানা আয়োজন করা হয়ে থাকে এদেশে। সে সব উৎসবে-আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে মুগ্ধ করেন নৃত্যশিল্পী অনন্যা। ইন্ধিরা গান্ধি কালচারাল সেন্টারে পরিবেশনাসহ মর্যাদাপূর্ণ বহু অনুষ্ঠানে কত্থকের শৈল্পিক মুদ্রায় অগণিত নৃত্যানুরাগীদের হৃদয়ে ঢেউ তুলেছেন এই নৃত্যপ্রাণ শিল্পী। বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পকে আরো আলোকিত ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে অনন্যার এই দীপ্ত পথচলা অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে নৃত্যসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা। আর আমার মতোন নৃত্যপ্রেমিকদের পক্ষ থেকে রইলো অনন্যা ওয়াফি রহমান-এর জন্য নিরন্তর শুভকামনা। অনন্যা ওয়াফি রহমান- জয় হোক আপনার মতোন শুদ্ধ শিল্পকলার নৃত্যসাধকদের।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত