করোনা পরিস্থিতি ও আমাদের কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ

‘আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২০’ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপ (ওয়েবিনার)

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২০, ১৩:০৮

সাহস ডেস্ক

‘আমরা সবাই সোচ্চার, বিশ্ব হবে সমতার’ - এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে রুম টু রিড বাংলাদেশ আজকে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২০ উপলক্ষে ‘করোনা পরিস্থিতি ও আমাদের কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করেছে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডা. দীপু মনি, এম.পি, মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। জনাব জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত উপস্থিত ছিলেন। ভার্চুয়াল সংলাপে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জনাব রাখী সরকার, কান্ট্রি ডিরেক্টর, রুম টু রিড বাংলাদেশ। 

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে দীর্ঘ ৬ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মেয়ে শিশুদের পরিবারে অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছে, দরিদ্রতার কবলে পড়ে কোনো না কোনো পরিবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। শিক্ষা উপকরণের অভাবে দৈনন্দিন লেখাপড়া কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বাল্যবিয়ের কবলে পড়ে অনেক কন্যাশিশু ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে। এরকম নানামূখী প্রতিবন্ধকতার সাথে নিয়ত লড়াই করছে আমাদের কন্যাশিশুরা। তাই বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও মেয়েশিশুদের উন্নয়নে গৃহীত উদ্যোগগুলোকে বেগবান করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আরও উদ্যোগ গ্রহণ করার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষার্থীরা যেন বাড়িতে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে এজন্যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার নানামূখী পদক্ষেপ চলমান রেখেছে। আর দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিক‚ল অবস্থার মধ্য দিয়েও নিরাপদে টিকে থাকার লড়াইকে বেগবান করে যাচ্ছে। সরকারি প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে শিশু-কিশোরদের বিশেষ করে কন্যাশিশুদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, আজকের এই ভার্চুয়াল সংলাপে মেয়েশিশুদের ঝরে পড়া রোধে সকল মহলের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সকল পর্যায়ে মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষপ নিয়ে আলোচনা করা হয়। 

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এম.পি, তার বক্তব্যে বলেন, ''সরকার পাঠক্রমে যুগোপোযগী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সেইসাথে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে, শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সেইসাথে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার, নারী- প্রতিবন্ধী-বান্ধব শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।  শিক্ষায় সকলের অভিগম্যতা যেন থাকে সেইটা সরকার নিশ্চিত করছি । ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শিক্ষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। সেইসাথে আগামীদিনে কারিগরি শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে  ভবিষ্যত জীবন আর জীবিকাকে গুরুত্ব দিয়ে ।''

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি, তার বক্তব্যে বলেন, ''মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরীর কারণেই আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে সবার এই ভার্চুয়াল সভায় একত্রিত হতে পেরেছি । এখন দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ কোটি ৭০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে । ৭৮ হাজার টাকা প্রতি এম.বি.পি.এস. থেকে কমিয়ে মাত্র ৩০০ টাকা করেছেন দেখেই এই করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, বিচারিক কার্যক্রম  আমরা ভার্চুয়ালি চালিয়ে যেতে পারছি। আজকের জীবন ও জীবিকা দুটোই সুরক্ষা করে কিভাবে দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া যায় সেটাতে আমরা সফল হয়েছি । এখন দেশের মোট ৬০-৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঘরে বসে সংসদ টিভির মাধ্যমে আমাদের এই ডিজিটাল শিক্ষা গ্রহণ করেছে। বাকি ৩০ শতাংশ যাদের হয়তো ইন্টারনেট সংযোগ নেই তাদের জন্য আমরা ৩৩৩ এই হেল্পডেস্ক এর মাধ্যমে কিন্তু আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি ।''

ভার্চুয়াল সংলাপটির আহবায়ক রুম টু রিড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর জনাব রাখী সরকার বক্তব্যে বলেন, “২০২০ মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম চ্যালেঞ্জযুক্ত বছর। করোনা মহামারী কারণে বিশ্বের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই শিশুদের ঘরে থাকাকালীন তাদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে এবং স্কুলগুলি পুনরায় খোলা হলে তাদের যথাযথভাবে সহায়তা  করার জন্য আমাদের প্রস্তুত করার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। রুম টু রিড বাংলাদেশ মেয়েশিশুদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষা সম্পূর্ণকরণে ও জীবনে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি স্থানীয় জনগোষ্ঠী, অংশীসংগঠন ও সরকারের সাথে। আমরা ঢাকা, নাটোর এবং কক্সবাজারের ৫,০০০ মেয়ের সাথে কাজ করছি যারা এই মহামারী চলাকালীন তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমরা এই জরুরি অবস্থায় আমাদের মোট কভারেজ থেকে প্রায় ৩% মেয়েদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। গত ১০ দিনের মেয়েশিশুদের নিজস্ব মনিটরিং রিপোর্ট করা তথ্যের ভিত্তিতে, ৫.৬% মেয়েরা স্কুলে ফিরে আসার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ২.৪% ঘরে বসে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না, ৬% পরিবারের আয়ের উৎস হারিয়েছে কোভিড -১৯ এর ফলশ্রুতিতে । সামগ্রিকভাবে, এই তিনটি ঝুঁকির কারণে কমপক্ষে ১০.১% মেয়েদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমস্ত চ্যালেঞ্জ সত্তে¡ও রুম টু রিড বাংলাদেশ দূরশিক্ষন উদ্যোগের আওতায় মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পিতামাতার কাছে গত ০৬ মাসে মুঠোফোনের মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ সরাসরি বার্তা প্রেরণ করেছে, এবং স¤প্রতি সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'আমার ঘরে আমার স্কুল'-এর ক্লাস রুটিন অনুযায়ী ৩য় ও ৪র্থ পিরিয়ডে প্রচারিত হচ্ছে রুম টু রিড বাংলাদেশের জীবন-দক্ষতা অধিবেশন।

এছাড়াও ভার্চুয়াল সংলাপে বক্তব্যে রাখেন জনাব নাছিমা বেগম, এনডিসি, চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন; ড. আবুল হোসেন, প্রকল্প পরিচালক, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়; প্রফেসর ড. সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক, মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর; প্রফেসর ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য, পরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর;  জনাব আসমা সিদ্দিকা মিলি, ডেপুটি কমিশনার, ডিএমপি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিদল এই ভার্চুয়াল সংলাপে করোনাকালীন সময়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। রুম টু রিড বাংলাদেশ এর সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোকসানা সুলতানা মেয়েশিশুদের শিক্ষা সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায় গৃহীত দূরশিক্ষন পাশাপাশি নানা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। তিনি তার উপস্থাপনায় বলেন, রুম টু রিড বাংলাদেশের মেয়েশিশুদের শিক্ষা সহযোগিতা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত মোট ৬০ ভাগ মেয়েশিশু ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ - কার্যক্রমে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছে। গত ০৬ মাসে ৩৮৬৯ জন মেয়েশিশুকে ভার্চুয়াল একক মেন্টরিং সহযোগিতা, ২৯৬২ জনকে ভার্চুয়াল জীবন-দক্ষতা অধিবেশন, ১৩৩৫ জনকে শিক্ষা উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। রুম টু রিড বাংলাদেশ গত ০৬ মাসে ৩৮৬০ জন অভিভাবকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে ও ৬৩টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে। ভার্চুয়াল সংলাপটি সঞ্চালনা করেন ফাহ্মিদা হামিদ এ্যানি - প্রোগ্রাম অফিসার, রুম টু রিড বাংলাদেশ।

রুম টু রিড একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২টি দেশে শিশুদের শিক্ষা সহায়তায় কাজ করে আসছে। সংগঠনটি ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ‘মানসম্মত সাক্ষরতা’ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘মেয়েশিশুদের শিক্ষা সহযোগিতা কার্যক্রম’- এর আওতায় মেয়েশিশুদের শিক্ষা ও জীবন-দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদনক্রমে ঢাকা, নাটোর, কক্সবাজার ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ‘মেয়েশিশুদের শিক্ষা সহযোগিতা কার্যক্রম’ বাস্তবায়ন করছে। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত