‘মঙ্গল আসর’-এর স্মরণীয় শিক্ষা সফরনামা

প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:১৪

১.
‘কি আনন্দ ! কি আনন্দ !! কি আনন্দ !!! দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ। সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে, পাছে পাছে।’ …
জীবনশিল্প সাধনায় জগতের ‘জতুগৃহে’ মানুষ বড্ড একা, আসলেই একান্তভাবে একা, চরম নি:সঙ্গ, বিশেষত কর্মি মানুষ, আশাবাদী কৃষক। তেমনই এক চরম ‘নিষ্ফলা’ স্বপ্নচাষি ‘ভূবনমোহন মোহিনী’ জনারণ্যে নি:সঙ্গতা ঘোচাতে সবুজ-সজীব প্রাণের সংস্পর্শে একাকিত্ব দূর করার প্রয়াস চালায়, ‘এই লভিনু সঙ্গ’দোষে আকণ্ঠ সৎসঙ্গ খোঁজে। ‘যত দোষ নন্দ (পড়ুন-মোহন) ঘোষ’ অবোধ এই নির্বোধ অভাজন সুবোধ (না)বালক না হলেও সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ প্রাঙ্গণে পরমাত্মীয় জ্ঞানে বনফুলের ‘নিমগাছ’ বোনে অসীম স্বপ্ন নিয়ে, আশাবাদের আকাশ ছুঁয়ে যাবার ভাবালুতায়, বোদলেয়ারের মতোন ‘চলিঞ্চু মেঘ’ ভুলে মানুষকে ভালোবেসে। আমার ঠাকুর রবিলোকে তাই মানসসংগীত হয়ে ওঠে ‘আমার যে সব দিতে হবে- সে তো আমি জানি, আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী, সব দিতে হবে …’। এবারের জন্মদিনে শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলাম না বলে ‘গর্তজীবি’ এই আমি ‘পরজনমে রাধা’র ‘কানাই’ হওয়ার প্রত্যাশা ভুলে মোহন বাঁশিটি হাতে তুলে ফু দেই পথে নেমে ‘জন্মের দায়শোধে’ । ‘ভালোবাসি ভালোবাসি এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি’ মন সঙ্গীত বলেই সঙ্গী-সাথী যে একদম জোটে না, তা কিন্তু নয় মোটেই। মোহাম্মদপুরের ‘হাঁটা বাবা’র অনুকরণে স্বপ্নবান নবীনদের সাথে আমিও ‘মানুষ তার আশার সমান বড়ো’ বাণীর প্রদীপ জ্বালিয়ে ‘পথ ভুলিবার খেলায়’ নিজেকে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া’। আমার জীবনে ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’ থাকলেও সদা ‘পিছু ডাকে ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে’, সেই পিছুটানকে কি করে অগ্রাহ্য করে আজন্মের বাউল প্ররিব্রাজক এই জীবনপুরের মোহন পথিক? ‘তাই তো আমার আনন্দ’ ভরপুর ‘অনাকংখিত’ এই মানব জীবনে।

২.
‘আমার মতোন সুখি কে আছে’ …
সম্প্রতি জন্মদিনে সাধুসঙ্গে জীবনানন্দে ‘সময় সহবাস’ ঘটেনি বলেই সুদাসলে সেই ঘাটতি মেটাতে সন্তানসম শিক্ষার্থীদের সাথে দিনব্যাপী ‘হন্টন’ শিক্ষাভ্রমণ কর্মের আয়োজনে আন্তরিকভাবে বেশ উৎসুকই ছিলাম। আমার প্রায় এক যুগের শিক্ষকতার জীবনে গুরু সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের অনুসরণে মাঠে বসে আলাপন ‘অনিয়মিত নিয়মিত’ ঘটনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে আনন্দময় শিক্ষাসফর এবং সে ভ্রমণ আয়োজনের সকল ব্যয় আমার নিজের অর্থে নির্বাহ করা। সন্তান মনে করি বলেই ওদের সারাদিনের সকল ব্যয় বহন করা আমার একান্ত নৈতিক ও ভালোবাসার দায় বলেই বিশ্বাস করি। যেমনটি করেছি সরকারী মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজের নিয়মিত পাঠচক্র আয়োজনের দিনগুলিতে। তবে এবার সহযোগিতার ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের পরম শুভাকাংখি একজন স্বজন। আমরা তাই শুরুতেই সবিশেষ কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি আমাদের এই আয়োজনে নিরন্তর অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা প্রদানের জন্য ‘বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড’ এবং রাফিয়া হাসিনা (Rafia Hasina ) আপাকে, যিনি আমেরিকায় বসবাস করেও প্রতিনিয়ত আমাদের ‘মঙ্গল আসর’-এর সকল কাজে ভালোবাসার অদৃশ্য ছায়া-মায়া দিয়ে উপস্থিত থাকেন। প্রিয় শান্তা ম্যাডামসহ (Rashna Rashid রাশনা রশীদ, সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, হোম ইকনমিকস কলেজ, ঢাকা) আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় অধ্যাপক মাহমুদা খাতুনের (Mahmuda Shilpi) উৎসাহদানও কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। সকলের সহযোগিতায় ‘আলোকিত মানুষ চাই / করি দৃঢ় অঙ্গীকার / গড়ি ঘরে ঘরে পাঠাগার’ মনোভাবকে গভীরভাবে চেতনায় ধারণ করে ‘মঙ্গল আসর’-এর স্মরণীয় শিক্ষা সফর (তথাকথিত পিকনিক নয়) আয়োজন সম্পন্ন করে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পেরেছি একরাশ স্বপ্ন-আশাবাদের বীজ মনের জমিনে বপন করে। উল্লেখ্য যে, এবারের শিক্ষা সফরের আয়োজনে প্রধান আলোচ্য বিষয়/স্মরণ/উপলক্ষ/ভ্রমণ স্থান ১৭টি নির্ধারণ করা হয় এবং পূর্ব প্রস্তুতিতে ১৭জন সেই স্মারক স্থানে বক্তব্য প্রদান করে। আরো উল্লেখ্য যে, উপস্থিত ২০ জনই সবার বক্তব্যের মূল্যায়নে অংশ নেয়। আলোচনায় মানসম্পন্নদের মাঝে পরে পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা যেমন ছিলো, তেমনি প্রত্যেকে শিক্ষাসফর শেষে একটি করে ‘শিক্ষা সফরের শিক্ষা’ বিষয়ে নিজের মতোন করে রচনা জমা দেবে। সেই রচনাগুলোর সমন্বয়ে পরবর্তীকালে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশনারও ইচ্ছে আছে আমাদের।

৩.
‘ক্ষেপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?’…
ধান ভানতে শীবের গীত তো একটু গাইতেই হয়। ইদানিং ‘যৎসামান্য দর্শন’-এ পেয়ে বসা এই আমি লালন সাঁইজীর ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা’ চরণকে ছেড়ে থাকতে পারি না, স্মরণের জানালায় সারাক্ষণ ভুলিয়ে রাখে মোরে। মহাত্মা লালন সাঁইজীর পাল্লায় চেতনাবাণীর জলে ডুবে, স্নাতক হয়ে ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা’র চেষ্টায় ছুটোছুটি বেড়েছে তখনই আজন্মের ভরসা হয়ে মনের আকাশে রবির উদয় ঘটে, পাশে দাঁড়ান পরম বিশ্বস্তসঙ্গী হয়ে কবিগুরু, ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে; / কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি–/ লহো লহো করুণ করে॥’ আস্থা জাগিয়ে। যৎসামান্যেই পড়ে পাওয়া এক মানব জীবনে অসামান্য আনন্দ খুঁজে ফেরা এই ফেরিওয়ালা পথ হাঁটে আপন আলোয়, স্বপ্নের ধূলোবালি গায়ে মেখে, মনে রঙধনু মেঘ ভাসিয়ে, সজীব-নবীন বসন্ত প্রাণকে সন্ন্যাসের সহচর করে। অপার হয়ে বসে থাকা ফকিরকে ভাবনগরের মহাসাগর পাড়ে লয়ে যায়। ‘আপনারে আপনি চিনিনে’ সত্যানুসন্ধানের অভিক্ষায়, জীবনানন্দ অভিযাত্রায় যতই আপ্রাণ চেষ্টা করি না কেন, বাড়ির কাছের আরশী নগরের পরশীর একদিনও দেখা মেলে না, খোঁজ-খবর নেওয়া তো দূরের কথা। গুরুদেবকে জাম গাছের কাণ্ডটি উপহার দেবার কান্ডজ্ঞান লোপ পায় বলেই ‘জামাই’ না হয়ে নিমের ডাল দিয়ে ‘নিমাই’ বিশেষণেও সীমাবদ্ধ থাকি। জ্ঞানগুরুর চরণামৃতসুধা আশাবাদের আকাশেই ঘাস ফড়িঙ হয়ে উড়াউড়ি করে, আলোর দেখা মেলে তবে ভয়াবহ বজ্রপাতের আভায়, জীবনবিনাশী প্রক্রিয়ায়। ফলে গুরুসত্য অনুভবে রূপ দেখায়, ‘ক্ষেপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়?’ ‘মঙ্গল আসর’-এর (সৃজনশীল সহশিক্ষার আনন্দময় আয়োজন) জীবনানন্দে শিক্ষা সফরের দলনেতার দায়িত্ব তাজনীন (Aiyan Ahmed Taznin ) এবং উপনেতা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌস (Jannatul Furdousi ) যোগ্যতার সাথে, সুচারুভাবে পালন করে আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। এবার শিক্ষা সফরের প্রধান আলোচ্য ১৭টি বিষয়/স্মরণ/উপলক্ষ/ভ্রমণ স্থান নিয়ে উপস্থাপনাকারী, বক্তব্য প্রদান ও প্রশ্নোত্তরের জবাবদানকারী ছাত্র/ছাত্রীর নাম ও উপস্থাপনার বিষয় উল্লেখ করা হলো: জান্নাতুল ফেরদৌস (ড. শহীদুল্লাহ), বৃষ্টি আক্তার (শেরে বাংলা), মনি রাণী সরকার (বসন্ত উৎসব), মাহাবুবা খান (কার্জন হল), নুসরাত জাহান (ভালোবাসা বাংলা ভাষা), জাহান কবির (সোহরাওয়ার্দী), মো: তাজনিন (৭ মার্চ), ইমন হাসান আকাশ (বাংলা একাডেমি), সুইটি আক্তার (শহীদ মিনার), অনুপম কুমার দাস (বঙ্গভঙ্গ), মো: রাজিব মিয়া (মুক্তিযুদ্ধের কবিতা), মো: রাকিব শিকদার (একুশ থেকে একাত্তর), মো: আকাশ (অপারেশন সার্চলাইট), মো: রাকিব হোসেন (রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক), সিমরান নেহা (বাংলা ভাষা), মো: নাজমুল হোসাইন (শহীদ মিনার), সুমি রাণী সরকার (নজরুল)। স্মরণীয় এই শিক্ষা সফরে (পিকনিক নয়) ছবি তোলার দায়িত্ব পালন করে অন্তু হাসান (AnThu HaSan ON TO ) , সহযোগিতায় ছিলো নূর মোহাম্মদ ( )। ‘মঙ্গল আসর’-এর পুরাতনীদের মধ্যে উপস্থিত থেকে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও নির্দেশনা প্রদান করে ফয়সাল (S M Foyshal Hossain), সাকিব (Sherajul Kabir Sakib) রেদোওয়ান (রেদোওয়ান আহমেদ ) এবং সাব্বির (Sabbir Hossain Arnov )। আমরা সবাই তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ।

৪.
‘মলয় এসে কয়ে গেছে কানে’…
এবারো তাই তো আমি ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভূবন ভরা’ ধরাকে সরা জ্ঞান না করে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে আয়োজন করেছি প্রকৃত অর্থেই শিক্ষা সফরের। আমাদের কাছে শিক্ষা সফর মানে মোটেই কোন পিকনিক নয়, জীবনের সাথে জীবন যোগ করার অনুশীলন, অব্যাহত চর্চা। একটু নজর দিলেই দেখতে পাই, দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয় না প্রকৃত শিক্ষা সফর, পিকনিককেই শিক্ষাসফরের মুখোশে জায়েজ করার অপচেষ্টা চলে। এভাবেই যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়, তার অনেকটাই রূপ নেয় পিকনিকে। সফরের শিক্ষাটা পাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীরই। আমরা এই ছায়াটাকে মাড়িয়ে আলোর পথে পা বাড়াতে চেয়েছি প্রতিবছরই। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৫ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার সকাল ৯টায় রওনা দিয়ে প্রায় ১০টায় সময় বাছাই করা ২০ জনের দলের সবাই চলে এলো শাহবাগে। শাহবাগের ফুলের দোকান থেকে আগেই অনেক গোলাপ ফুল কিনে রেখেছিলাম সকলের আগে এসেই। আমার পরে আরো ২জন চলে এলো। আমরা এই কয়েকজন অপেক্ষায় ছিলাম অন্যদের জন্য বারডেমের সামনে। ‘ট্রাস্ট’ পরিবহন বিশ্বস্ততার সাথেই পৌঁছে দিলো। সবাই নিরাপদে রাস্তা পার হয়ে শুরু হলো আমাদের আলোর পাঠশালার ‘হাঁটতে হাঁটতে জানা’র চারুপাঠ কর্মসূচির, যার সূচনা আনন্দে, সমাপ্তি প্রজ্ঞায়। কবিগুরুর গুরুবাক্য মেনে ‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া,/ একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু’র শুরু মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণার মাধ্যমে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা চত্ত্বরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে, শিখা চিরন্তনে ফুল দিয়ে। এর আগে বেগম সুফিয়া কামাল কেন্দ্রীয় গণ গ্রন্থাগারের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও (ছুটির দিন বলে বন্ধ থাকায়) মূল ফটকে দাঁড়িয়ে শওকত ওসমান ও বেগম সুফিয়া কামালকে স্মরণ করলাম। 

৫.
‘আলোকের এই ঝরণা ধারায় ধুইয়ে দাও’ … 
রমনা রেসকোর্সের, এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই নানা ইতিহাস চলে এলো আলোচনায়। শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, স্বাধীনতা স্তম্ভ এলাকায় গমন করে যথাসাধ্য জানাতে চেষ্টা করলাম আমাদের বাংলাদেশ ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো বাঁকগুলোকে। সৎ ও দেশপ্রেমিক সুনাগরিক হয়ে ওঠার নিরন্তর অনুশীলনের আত্মশপথ গ্রহণ করলাম সবাই। অত:পর শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরকে ঘিরে স্মৃতির ইতিহাস নিয়ে বক্তব্য রাখলো আমার চারুশিল্পী ছাত্র তাজনীন। গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এখানেই ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণে ভূষিত করা, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকসেনাদের আত্মসমপর্ণের দলিলে স্বাক্ষর করাসহ জাতীয় নানান ইতিহাসের স্মৃতি-সাক্ষী হয়ে আছে উদ্যানের এই অংশটি। এরপর চলে গেলাম ঘুরে দেখতে চারুকলা, সেখানে দেখা দিলেন ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ ঘোচানোর মহান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান প্রমুখ স্বজনগণ তাদের জীবনশিল্প নিয়ে জাগ্রত আছেন। প্রাচ্যকলা বিভাগের সামনে পাটের ব্যবসায়ী ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে প্রসঙ্গক্রমেই চলে এলো সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ, নিবিষ্ট বিজ্ঞানসাধক মাকসুদুল আলম, বিশ্বখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ, পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম-এর নাম। পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। আমি শোনালাম মহান এই দেশপ্রেমিকের আত্মদানের গল্পকাহিনি। গর্বসহকারে জানালাম পাটের জিন আবিস্কারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জাদুকর বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বৈশ্বিক বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বড় অবদান রেখেছেন, অনুসরণীয় আলোকিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ক্ষতিকর ছত্রাকের ‘জীবনরহস্য’ উন্মোচনকারী কৃতী এই বিজ্ঞানী শস্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের হয়ে পাট ছাড়াও পেঁপে, রাবার এবং এক ধরণের ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন ড. আলম। ড. মাকসুদুল আলমের আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। সোনালি আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখানো সেই বাঙালি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের স্বপ্ন ছিলো তাঁর ‘ড্রিম টিম’ প্রকল্পটি বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হবে, বাঙালির মধ্য থেকে মেধাবিরা বিজ্ঞান গবেষণায় সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বকে তাক লাগাবে, বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করবে। আগ্রহী গবেষকদের জন্য বিশ্ব মানের বিজ্ঞান গবেষণাগার বাংলার বুকেই প্রতিষ্ঠা করার আজন্মের স্বপ্ন নিয়ে পাটের দুটি জাত ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী এই বিজ্ঞানী ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সন্তান ড. মাকসুদুল আলম সবসময় নবীন গবেষকদের উৎসাহ জাগিয়ে বলতেন, ‘স্বপ্ন দেখো, তুমিও পারবে’। মনের ভাষাও প্রকাশ করতে দ্বিধা করলাম না যে, বাঙালি এই মহান জিন বিজ্ঞানীর জন্মদিনে কিংবা প্রয়াণদিনে কোন আয়োজন চোখে পড়েনি, পড়ে না আমার। অথচ তিনিই সরকার থেকে গবেষণা প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মাসে ২৮ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হলেও নেননি। তিনি ওই টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে তার প্রতিষ্ঠিত জৈব প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রে দিয়ে দিলেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই তাই মনে প্রশ্ন জাগে একজন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক মাকসুদুল আলম কী করে তৈরি হলেন? যিনি মোট প্রায় ৬ কোটি টাকা পারিশ্রমিক না নিয়ে দেশের জন্য দিয়ে দিলেন? এই মহান জিন বিজ্ঞানীর স্মৃতি অন্তরে ধারণ করে চলে গেলাম নজরুলের সমাধি সৌধে।

৬.
‘পাগল আমার মন জেগে ওঠে, / চেনাশোনার কোন বাইরে, / যেখানে পথ নাই, নাই রে, / সেখানে অকারণে যাই, যাই ছুটে’...
স্বাধীনতা চত্ত্বর, চারুকলা-বকুলতলা হয়ে একে একে আমরা নজরুল, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের সমাধি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার গেলাম। এরপর মধুর কেন্টিন, অপরাজেয় বাংলা, গুরুদুয়ারী নানকশাহী, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, তারেক মাসুদ-মিশুক মুনিরের দুর্ঘটনার গাড়ী ভাস্কর্য দেখি, প্রশ্নোত্তরে বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করি। মধুর কেন্টিনে রাজনৈতিক নেতাদের ভীড় থাকায় আমরা অপরাজেয় বাংলার সামনের ঐতিহাসিক বটগাছের নিচে বক্তব্য-আলোচনা করলাম। নেওয়া হলো সম্মিলিত শপথ গ্রহণ, দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা- ‘নিজ মেধা-যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশিত বিভাগে লেখাপড়া করে ‘মানুষের মতোন মানুষ হবো, ভালো মানুষ হবো’। এরপর আমরা টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাই, মহান ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের স্মরণ করি, ঢাকা মেডিকেলের গেটের ঐতিহাসিক আমতলায় দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাঠ নেই। জাতীয় পাখি দোয়েলের সুর শুনি দোয়েল চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে, মহান বাঙালি বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবরে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করি, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের জন্য প্রাণদানকারী ও অংশগ্রহণকারী সকলের জন্য পরম শান্তি কামনা করি, শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বসি, রক্ত পলাশ ফুলের ছায়ায় জীবন ফিরে পাই। কার্জন হলের বিভিন্ন ভবনের মাঝে বঙ্গভঙ্গ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তথা শিক্ষার বিবর্তনের আলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করি, রসায়ন বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যেন বসু, হুমায়ুন আহমেদকেও স্মরণ করি। এখানে বঙ্গভঙ্গ বিষয়ে অনুপম কুমার দাস, ড. শহীদুল্লাহকে নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস, কার্জন হল বিষয়ে মাহাবুবা বক্তব্য রাখে।

৭.
‘আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই’ …
এরপর শিশু একাডেমি হয়ে ঐতিহাসিক ঢাকা গেটে দাঁড়িয়ে নতুন ঢাকা আর পুরান ঢাকার দুই রূপের সন্ধান করি আমরা। পাশেই জাতীয় তিন নেতার মাজারে ছোটখাটো সেমিনার-পথসভা করি। কারণ সেখানে শায়িত শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং খাজা নাজিমুদ্দিন- তিনজনেরই জীবনী ও কর্ম আমাদের পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠ্যক্রমে অর্ন্তভুক্ত থাকায় শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ করতে হয়। ফলে আগের অনেকবারের মতোন এবারও আমরা এই তিনজনকে যেমন স্মরণ করলাম, সেই সাথে কোটি কোটি বাঙালির মনে যিনি চিরভাস্বর, বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও বিনম্রচিত্তে স্মরণ করলাম। জানালাম, বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলার ঐতিহ্য-এই সকলই ছিল তাঁর একান্ত আপন ও ভাবজগতের চেতনা। আর তারই প্রমাণ পাই তাঁর রাজনৈতিক নানান কর্মকাণ্ডে। তার আরো বড় প্রমাণ আমরা পাই ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসের এক আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে বাংলাদেশ।’ (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, পৃ:৪০৭)। আবার অন্যত্রও পাই, ‘এক সময় এদেশের বুক হইতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির শেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে– একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। আমি ঘোষণা করিতেছি– আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।(‘বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশ,’ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ভোরের কাগজ, ২৬ মার্চ ’৯৮)। সুতরাং ‘বাংলাদেশ’ নামটি যতবার উচ্চারণ করবো ততবারই যেন জনকের মুখচ্ছবি আমাদের মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে, দেশের নামের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ না করলে সেটা ‘অন্যায়’ করা হবে বলেই মনে করি।

৮.
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ …
এরপর আমরা বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ করি, ঘুরে দেখি সব, আলোচনায় আসে বর্ধমান হাউজে প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকাহিনি, পাঠ করি স্মারকলিপিটিও। একাডেমির জাদুঘরে ঢুকে নানা মনীষীর সচিত্র জীবনী পাঠ আমাদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে। কারণ আমরা আমাদের ভাসানটেক সরকারি কলেজের আনন্দময় সহশিক্ষার কার্যক্রম ‘মঙ্গল আসর’-এ নিয়মিতভাবে দেশ-বিদেশের আলোকিত মানুষদের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসে স্মরণ করি, তাদের নামে কলেজের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের নামকরণও করেছি আমরা। ফলে আমাদের নিয়মিত ‘মঙ্গল আসর’-এর আন্তরিক কাজের সাথে বাংলা একাডেমির জাদুঘরের উপস্থাপনার ভাবের মহামিলন দেখে আমরা অসম্ভব আলোড়িত, শিহরিত হই। এই প্রদর্শনী পরিদর্শনের মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের সহশিক্ষার কাজটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করি। বাংলা একাডেমিতে আমার জন্য আরো আনন্দময় অভিজ্ঞতা ছিলো সহপাঠী, চিন্তন বন্ধু আজাদসহ (ড. কুতুব আজাদ, সহকারি পরিচালক, বাংলা একাডেমি) কয়েকজন স্বজনের সাথে শিক্ষার্থীদের একান্ত আলাপনে উজ্জীবিত হওয়া এবং সকলকে প্রাণিত করার ঘটনাটি। আগত সকলের জন্য মূল্যবান বই উপহার প্রদানের প্রতিশ্রুতিও মিললো বন্ধুবর আজাদের কাছ থেকে। এটা ভীষণ সুখবরই বটেেআমাদের কাছে, এই কারণে যে, আমাদের জীবনে উপহার হিসেবে বই পাওয়ার স্মৃতি তেমন নাই বললেই চলে। সুতরাং তাদের স্যারের প্রিয় বন্ধুর কাছ থেকে সবসময়ের জন্য দামি বলে বিবেচিত বই উপহার পেয়ে শিক্ষার্থীরা যার পর নাই আনন্দিত হয়, সম্মানিত বোধ করে। আমার প্রিয় বন্ধুটির সাথে ওদের মতের মিল ঘটলো, আমিও সহমত পোষণ করলাম, ‘আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটি-বাটি-থালা না দিয়ে যে কোন আয়োজনে কেবলমাত্র বই-ই পুরস্কার, উপহার হিসেবে প্রদান করা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।’

৯.
‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা না না না’…
পড়ন্ত দুপুরে বাংলা একাডেমির ক্যাফেটেরিয়াতে ‘গোগ্রাসে খাওয়ার জন্য বাঁচা নয়, বাঁচার জন্য পরিমিত আহার’ নীতিতে ভোজনের স্মৃতিও আনন্দময় অভিজ্ঞতা ওদের জন্য। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবারের লোভে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না বলেও স্বীকার করে সবাই। ফলে স্বল্পাহার ও পরিমিতি ঘুম জীবনের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য, স্বপ্নকে সফল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলেই ওদেরও আস্থা জন্মালো।

১০.
‘প্রতিদিন যদি কাঁদিবি’…
বইমেলা থেকে বই কেনাও হলো আমাদের, আমি আমার প্রিয় বই আরশাদ আজিজের ‘দর্শনের গল্প’ উপহার দিলাম সকলকে। বইমেলা থেকে বেরিয়ে অভিজিৎ রায়ের নিহত হওয়ার স্মৃতি বিজড়িত স্থান এবং হুমায়ূন আজাদের রক্তাক্ত হওয়ার স্মৃতির স্থান দেখে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ (মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতার অধিকার) আলোচনা করলাম, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করলাম অভিজিৎ রায়, দীপনসহ যারা চিন্তাচর্চায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখার কারণে তাদের মহামূল্যবান জীবনটি দ্বিতে দ্বিধা করেনি, সেই সকল চিন্তন শহীদদের। 

১১.
‘জগৎসভায় এই টুকু মোর স্থান’ …
বইমেলার শেষবেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাটের অংশে বসলাম গোল হয়ে। সেখানে নানা বিষয়ে বক্তব্য রাখলো বাকি কয়েকজন। সেখানকার ভাবনগরে পরিভ্রমণ সাধুসঙ্গ সুধা উপহার দিলো। পদব্রজে অত:পর ওভারব্রিজ পেড়িয়ে শাহবাগ বাসস্ট্যান্ডে শিক্ষা সফরের আশা প্রকাশ করে প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যেই আনন্দময় দিনব্যাপী শিক্ষা সফরের সমাপনী ঘোষণা দিলাম। অচিরেই জাতীয় জাদুঘর, ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ অন্যান্যস্থানে শিক্ষা সফরেরও আশাবাদ ব্যক্ত করলাম। ৫টায় সকলকে গাড়ীতে তুলে দিলাম, যথাসময়ে নিরাপদে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার খবর মুঠোফোনে জানার মধ্য দিয়েই আমার দু:শ্চিন্তা দূর হলো, সেই সাথে একান্ত চিন্তাচর্চা নবরাগে, নতুন সুরে শুরু হলো রাত্রি অন্ধকার এবং গভীর হলেও।

১২.
‘মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে’ …
অপ্রাসঙ্গিক নয় বিবেচনায়, এবার মনের আকাশে ভেসে ওঠা অপ্রিয় নানা অনুভবের-ভাবনার রঙধনুকে উপস্থাপন করা যাক। প্রিয় গল্পকার রফিকুর রশীদের ‘অমেরুদণ্ডী’ গল্পের মেরুদণ্ড থাকা না থাকার ‘মায়ার খেলা’র ছলনা ভুলে ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে’ কিংবা ‘যদি তোর যাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ নীতিই আমার জীবনাদর্শ। আমার ছেলে-মেয়েরা সুযোগের অভাবে হলেও এখনো সৎ আছে বলেই জানি। আর তাই জীবনানন্দে কাটে বলে অন্যদের চেয়ে ওদের সাথে সময় বেশি কাটানোর নিরন্তর সচেষ্ট থাকি।চারপাশের মহাপণ্ডিতদের কাজকাম দেখে বিজনে আপনমনে ভাবনা জাগে, কাজ কিংবা পরিশ্রম আর পণ্ডশ্রমের মানে অনেকেই বোঝেন কি না, সে বিষয়ে আমার দারুণ সংশয় আছে। সময় ক্ষেপন কিংবা চাকরের জীবন যাপন করার বাইরে, লাভের-লোভের লক্ষ্মণরেখার, প্রচলিত বৃত্তের বাইরে অধিকাংশজনই বেরুতে চান না বলেই জানেন না পথটা, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার নানা কারণ আছে।

১৩.
আমাকে ভর করে থাকা, ভূত নয়- ভাবনাতে ‘আছর’ করে থাকা জীবনাদর্শের কবিতাটি স্মরণ করলাম, শোনালাম সবাইকে- প্রিয় কবি, রাজনীতিবিদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ‘লোকটা জানলই না’। চেতনাবৃত্তের ভরকেন্দ্রকে গভীরভাবে ছুঁয়ে থাকা কবিতাটির পাঠই বলে দেবে এর শক্তির কথা, প্রচন্ড বাস্তবতার প্রবল ঢেউকে, প্রবণতাকে। কবি লিখেছেন-
‘বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায়! হায় ! লোকটার ইহকাল পরকাল গেল !
অথচ আর একটু নীচে হাত দিলেই
সে পেতো আলাদ্বীনের আশ্চর্য প্রদীপ,
তার হৃদয় !
লোকটা জানলোই না !
তার কড়ি গাছে কড়ি হল ।
লক্ষ্মী এল রণ-পায়ে
দেয়াল দিল পাহারা
ছোটলোক হাওয়া যেন ঢুকতে না পারে !
তারপর একদিন
গোগ্রাসে গিলতে গিলতে
দু’আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে-
কখন খসে পড়েছে তার জীবন-
লোকটা জানলই না !’

১৪. 
‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’…
আমার জীবনের নানা সমস্যার অন্যতম এক জনকের নাম শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। কারণ তিনিই বলেছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘ভবেতে এসেছিস যখন, তখন একটু চিমটি কেটে যা’। এই চিমটিটি কাটতে গিয়েই আমার যত যন্ত্রণা। শিক্ষকতায়ও এসেছি সেই যুগ যন্ত্রণার মন্ত্রণাকে মেনেই, মনে রেখেই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের কল্যাণে পঠিত অচিন্ত্যকুমারের ‘কবি রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থটি তাই আমার জীবনের অচিন্ত্যনীয় দু:খের আখড়, নিরন্তর বেদনার ‘অনাথ আশ্রম’। ‘জীবনে জীবন যোগ করার নামই শিক্ষা’ মহান বাণীতে ঋদ্ধবান ছাড়া এই চিমটি কাটা বা দাগ রেখে যাওয়ার ব্যাপারটি অনেকে না বুঝেই ভবলীলা সাঙ্গ করেন। ‘এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা’ চেতনার কৃষকই ফসল মাঠে সফল না হলেও একেবারে নিষ্ফলা নন কারণ তিনি জানেন চরের বালিমাটিতে ধান হয় না, সেখানে বাদাম, তরমুজ জাতীয় নানান শস্য ফলানো সম্ভব, সেই কৃষকই সফল হন ফসলের ক্ষেত্রে যিনি মাটির এইসব গুণাগুন বিষয়ে ধারণা রাখেন, চেনতায় ধারণ করেন। চারপাশের চেতনাহীন কৃষকরা ‘কামলা’ খাটেন, নিজের জমি-ভূমিটির স্বরূপটিও জানার চেষ্টা করেন না, ফলে বেলাশেষে ‘হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে’ তার ‘শেষের কবিতা’ হয়ে ওঠে। দিতে জানি না বলে আমাদের পাওয়াটাও আর হয়ে ওঠে না এই জীবনে। বস্তুগত সম্পদকেই একমাত্র কামনার ধন বিবেচনায় চিতার লেলিহান বিছানার কিংবা সাড়ে তিন হাত মাটির হিসাব ভুলে বেহিসেবি উত্তেজনায় আগ্রাসী জীবন যাপন করি অধিকাংশই। কামলার জীবন কাটাতে কাটতেই আমলনামা আর লেখা হয়ে ওঠে না আমাদের, চাকরের সংস্কৃতির বাইরের ‘প্রেমিক’-এর আবেগে জেগে ‘স্ব-ক্ষমতা’র সৃষ্টিশীলতার বীজ বপনও করা হয় না ফলে কেবল ‘প্রাক্তন’ প্রদর্শনেই ‘সপ্তপদী’ জীবন ভ্রমণ হয় ভ্রমে, বিস্ময়হীন বিস্মরণে।

১৫.
‘এ তুমি কেমন তুমি’ …
সখিগণ (প্রাণ নয় কি না জানি না) যখন ‘মাধবী এসেই বলে হেসে, যাই যাই যাই’, তখন পরাণ সখার প্রাণে বাজে প্রিয় গায়িকা দিয়া সুদেষ্ণা চক্রবর্ত্রীর কণ্ঠের মতোনই ব্যথিত সুর, ‘প্রিয়, যাই যাই বলো না’। বিদ্রোহ ভুলে নজরুল অন্তরে করুণসুরে বাজে, ‘রূপের মধুর মহুয়া, বলো না কি করে ছাড়ি’। ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি’ ভুলে আমার কেবলই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের বাণী মনে পড়ে, ভাষায় বলতে মন চায়, ‘আমরা এমনই এসে ভেসে যাই -/… চপলার মতো চকিত চমকে/ চাহিয়া, ক্ষণিক হেসে যাই।/ আমরা স্নিগ্ধ, কান্ড, শান্তি-সুপ্তিভরা/ আমরা আসি বটে, তবু কাহারে দিই না ধরা/ … স্বপ্নরাজ্য হতে এসে, ভেসে/ স্বপ্নরাজ্য দেশে যাই/ আমরা এমনই এসে ভেসে যাই –।’ ফলে পাথর সময়ে চিন্তাচর্চাহীন মানবের ‘(অ)সুখ’ সহবাস কলরবে ‘কানার হাটবাজারে’ রঙধনুর রঙে সৃষ্টি প্রজাপতির ভাস্কর্যও ভেঙ্গে পড়ে লজ্জায়, কাশবন ভুলে যায় প্রবল ঢেউ তুলে সৌন্দর্য সুখানুভব বিতরণ। ‘প্রেমে মাতোয়ারা’ মাতাল ‘কোন বলরামের আমি চেলা’ তখনও অস্বীকার করি ‘সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’ । ‘কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে, ভেবে না কুলায়’ ভুলে আপন নিসর্গ রচনা করি, মনের গহীনের গোপন সুন্দরবনে মৌ-লোভী না হয়েও হিংস্র কুমিড়ের সাথে মরণপণ পাঞ্জা লড়ি, জীবন বাজি ধরি অতল জলের আহ্বানে, জীবনের গানে, খুঁজে-খুঁড়ে জীবনের মানে।প্রজন্মের পরিভ্রমণ আমার তাই আর শেষ হয় না, ‘পথের শেষ কোথায়’ প্রশ্নটির মীমাংসা খুঁজি না। ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ আমি সততই স্বত:প্রণোদিত হয়ে তাই গ্রহণ করি, আর সুরভাজি, ‘তোমায় হৃদ-মাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেবো না, ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর তো পাবো না’ …।

১৬.
‘দিন থাকিতে দিনের সাধন’ … 
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ বলেই পতিত থাকে মানব জমিন, স্বপ্নদোষে আক্রান্ত দিবানিদ্রা কুম্ভকর্ণের আশপাশ দিয়ে ঘোরে কেবল। ‘ভবের কুটুম্বিতা’ভাইবন্ধুরা কেউই আসলে সাথে যেতে পারে না বলেই সাঁইজী জানতে চেয়েছেন, ‘কে তোমার আর যাবে সাথে’? কিন্তু ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ বলেই ‘দিন থাকিতে দিনের সাধন’ করতে প্রবৃত্ত মন ‘যা করবি কর ত্বরায়’পথে নামতে বাধ্য হয়। ‘নিস্ফলা মাঠের কৃষক’ অসময়ের কৃষিকাজে অভ্যস্ত নয় বলেই বালুচরের জমিতেও আবাদ করে প্রবল জলোচ্ছ্বাস কিংবা বাণের প্রবণ্ড ঢেউকে উপেক্ষা করে হলেও। ‘আপন ঘরের খবর’ নিয়ে সদা ব্যস্ত বারামখানায় আরামের জন্য সন্ত্রস্তজনকে সাঁইজী শান্তনাও দেন, ‘ভুগিসনে ভবের ভোগে।।’ জীবনের বিচিত্র রঙ-রেখা-রূপের সমাবেশ ও বহুবিধ শৈলী নির্মাণের মধ্যে দিয়েই এমন একটা ঐকতান সৃষ্টি করতে হয়, জীবনশিল্পের অর্কেস্ট্রা সুরেলা সুরে আনন্দধ্বনি উপহার দেয়। ‘তব বিচিত্র আনন্দ’ জয়ের এই অর্কেস্ট্রার সুর আমাদের জীবনকে মুগ্ধ, আনন্দিত ও স্পন্দিত করে। এখানেই জীবনশিল্পী হিসেবে প্রতিটি মানুষের প্রচেষ্টার সার্থকতা নিহিত।

১৭. 
‘ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে- করে কেবল খেলা’ …
সব দৃশ্যই দৃশ্যমান নয়, অন্তরালের ছবিটির পাঠও শিখতে হয়। তেমনি সব শব্দও ‘আওয়াজ’ নয়, তার বোধগম্যতার মাধ্যমে বাণী-চরণে পরিণত হয়। সেই অনুভূতির স্ব-ক্ষমতাও নিরন্তর চেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বিকশিত করতে হয়। তবেই কি না মানুষ অন্য প্রাণি থেকে পৃথক সত্ত্বা, ‘যুক্তিবাদী’ প্রাণি। সেই মহামূল্যবান মানব জনমকে আরেকটু ঋদ্ধ করতে, সম্পূর্ণ করার প্রক্রিয়া হিসেবে মঙ্গল আসর সদা সচেষ্ট, সক্রিয় নানান আয়োজনে। আমার একান্ত অনুভবের বেদনায় মনে হয়, ‘জীবনশিল্প’ যাপন করতে জানি না, চিনিই না, ন্যূনতম চেষ্টাটাও দেখি না আমাদের অধিকাংশের মাঝেই। আমরা কেবল বেনিয়াবুদ্ধিজাত ‘অর্থ’ খুঁজি ‘অর্থে’, জীবনের সদর্থকতায় নয়। শিল্পকলার মানবীকরণ নিয়ে ভাবনার শুরুতেই বহুল প্রচারিত, চর্চিত প্রশ্নটিও চলে আসে মনে- ‘শিল্প কী কারো পেট ভরায়, না ভাত দেয়?’ এই প্রশ্নের জবাবে স্বাভাবিকভাবে প্রথমেই চলে আসে ভাষার প্রশ্নটিই। কারণ মানুষ আনন্দ পাবার জন্য এবং জ্ঞান অনুশীলনের জন্য যত রকম উপায় উদ্ভাবন করেছে- তার মধ্যে ভাষা একটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চা চলছে ভাষাকেই বাহন করে। ভাষাচর্চার যেমন দু’টো দিক আছে- একটা আনন্দ ও জ্ঞানের দিক, আরেকটা অর্থলাভের দিক। তেমনি শিল্পচর্চারও দু’টো দিক আছে- একটা আনন্দ দেয়, আরেকটা অর্থ দেয়। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের উদাহরণটি বড় মনোরম। ছায়ানটের নন্দনতত্ত্বের ক্লাসে তিনি বলেছিলেন- একটি কাপে চা পান করি বটে কিন্তু সেটার গায়ে নানা রঙ আর ছাপচিত্র দেখে কিনি আমরা। চা পানের সাথে কাপের রঙ কিংবা অংকিত চিত্র কী কাজে দেয় আমাদের? শিল্প আমাদের ব্যবহারিক দায় ছাপিয়ে আনন্দ দান করে বলেই এত বৈচিত্র্যের সমাহার সর্বত্র। আর তাই দেখতে পাই শিল্পচর্চারও দু’টো দিকের সাথে আছে দু’টি ভাগও। এ দু’টি ভাগের নাম চারুশিল্প ও কারুশিল্প। চারুশিল্পের চর্চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দু:খ-দ্বন্দ্ব সংকুচিত মনকে আনন্দলোকে-মঙ্গলালোকে মুক্তি দেয়, আর কারুশিল্প আমাদের নিত্য প্রয়োজনের জিনিসগুলিতে সৌন্দর্যের সোনার কাঠি ছুঁইয়ে কেবল যে আমাদের জীবনযাত্রার পথ ও মানকে সুন্দর করে তোলে তাই নয়- আমাদের অর্থাগমের পথও করে দেয়। সুতরাং সঠিক শিল্পশিক্ষার অভাব যে আমাদের জীবনকে অসুন্দর করে তুলেছে তাই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও নানা সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে, মানসম্পন্ন জীবন যাপনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করছে। আর তাই আমাদের প্রত্যেকের জীবনশিল্পে চিত্র, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদির গুরুত্ব অসীম। নান্দনিকবোধের মানবিক শিক্ষার জীবনবীক্ষায় ঘাটতি থাকলে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে বিনষ্ট হয় মানবতাবাদের, পরিবেশ হয় চরম বৈরি ও অস্বাস্থ্যকর। নিশ্চয় আমরা সেই অন্ধকারের ঘরে বসবাস করতে চাই না। আর সে কারণেই চাই শৈশব থেকেই শিল্পবোধের নিরন্তর অনুশীলন, চর্চা চেষ্টা। কারণ মানুষ যেমন তার দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দিয়ে বহির্জগতের সকল বস্তুর তত্ত্ববোধ ও রসবোধ করে এবং তা অপরের কাছে প্রকাশ করে তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রেও কলাশিল্পের চর্চার দ্বারা তার তত্ত্ববোধ ও রসবোধ শিক্ষা সম্পূর্ন হয় এবং তার প্রকাশভঙ্গি আয়ত্ব হয়। সৌন্দর্যবোধের অভাবে মানুষ যে কেবল রসের ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়, তা নয়। তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৌন্দর্যজ্ঞানের অভাবে যারা বাড়ির উঠোনে ও ঘরের মধ্যে জঞ্জাল জড়ো করে রাখে, নিজের দেহের এবং পরিচচ্ছদের ময়লা সাফ করে না, ঘরে-বাইরে ময়লা কিংবা থুথু ফেলে- তারা যে কেবল নিজের স্বাস্থ্যেরই ক্ষতি করে তা নয়, সমগ্র জাতির স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করে থাকে। তাদের দ্বারা যেমন সমাজদেহে নানা রোগ সংক্রমিত হয় তেমনি তাদের কুৎসিত আচরণের কু-আদর্শও জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মানবজীবনে তাই সুরুচির প্রশ্নটি অতীব জরুরি ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করি।

১৮.
‘মোহ মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে, দেখিতে দেয় না’ …
এভাবেই ভীড়ের মাঝেও ‘বসিয়া বিজনে’ একান্তে আমি নিজের সাথে নিজেই কথোপকথন করি, আত্মবিশ্লেষণক্ষণে মনে ‘উদাস’ হাছন রাজার চরণ স্মরণ করি, ‘আমি করি যে মানা- অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না শুনবে না’। আর তাই আমি ঋষি কবি ভবভূতিতে সচেতন থাকি, ‘বেরসিকের কাছে যেন কখনো রসের কথা কইতে না হয়’। কারণ আমি জানি, মানিও গুরুবাক্য, ‘সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর’। সংস্কৃত শাস্ত্রের-সাহিত্যের কবি ভবভূতির মহান বাণীখানির জলছবি প্রতিনিয়ত দেখতে পাই চারপাশে বাক্যবাগিশদের শব্দদূষণে, (অ)সুর বীনার বাণীতে। ‘আমি বাংলাকে ভালোবাসি, মানুষের কাছে আসি, আমি যা কিছু মহান গ্রহণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, আমি একবার দেখি বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ।’ আর তাই ‘অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত আলো’র আমার এই ভাবনার ভেলা ভাসানো, ভাবের মেঘদল ভ্রমণ। ভুলে থাকতে চাই নজরুলগীতিখানি, ‘ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এতো আলো / আমি কেন অন্ধ মাগো দেখি শুধু কালো।’ এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক, মূলতবি রাখা যাক ‘চিন্তন হন্টন’। সকলের মাঝে শুভবোধের জাগরণ ঘটুক, শুভবুদ্ধির সচেতন প্রচেতীকরণ হোক আমাদের সবার মনে এবং অবশ্যই মানবিক ও অকৃত্রিম।

সবিশেষ কৃতজ্ঞতা : ‘বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড’ এবং রাফিয়া হাসিনা

(অকৃপণ ঋণ : রবি ঠাকুর, সাঁইজি লালন, কাজী নজরুল ইসলাম)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
পরিচালক, মঙ্গল আসর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত