সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে পেঁয়াজ

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:২৫

সাহস ডেস্ক

পেঁয়াজ এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। হু হু করে বেড়েই চলছে রান্নায় নিত্য প্রয়োজনীয় এ পণ্যের দাম। দিনে দিনে পেঁয়াজ সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা। গত এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা। সে হিসাবে শুধু এক সপ্তাহের ব্যবধানে রান্নায় অতি প্রয়োজনীয় এ মসলা জাতীয় পণ্যটির প্রতিকেজি দাম বেড়েছে ৯৫ টাকা। তবে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও মসলা জাতীয় পণ্য আদা-রসুনের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।

শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর খিলগাঁও, মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি, ফকিরাপুল কাঁচাবাজার, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার, রামপুরা কাঁচাবাজার, খিলগাঁও রেলগেট বাজার কাঁচাবাজার ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।

বর্তমানে এসব বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১৫ টাকা কেজি দরে। মিশর থেকে আমদানি করা প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা প্রতিকেজি পেঁয়াজ ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা দরে। এদিকে, রাজধানীর শ্যাম বাজার পাইকারি বাজারে দেশি প্রতিকেজি পেঁয়াজ আকারভেদে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা, মিয়ানমারের আকারভেদে ১৮০ থেকে ১৬০ টাকা, মিশরের পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে পাইকারি দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি আকারভেদে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা, মিশরের  পেঁয়াজ ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। 

আমদানি সংকটের অজুহাতে পেঁয়াজের বাজারে এখন রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। এ নৈরাজ্যের পেছনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জড়িত থাকতে পারে বলে অভিযোগ উঠেছে খোদ সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনের এক প্রতিবেদনে। বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে একটি সিন্ডিকেট থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়।

গতকাল কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পরও দুই লাখ ৯০ হাজার টন পেঁয়াজ মজুদ ছিল। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ছয় হাজার টন করে খরচ হওয়ার কথা। সেই হিসাবেও যে মজুদ থাকার কথা, তা দিয়ে আরো দেড় মাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাহলে পেঁয়াজের দাম এত বাড়ল কেন? এ বিষয়টি প্রতিযোগিতা কমিশন খতিয়ে দেখছে। আমরা মনে করি, এর পেছনে কোনো অসাধু ব্যবসায়ীচক্র একচেটিয়া মুনাফা করছে।’

অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এক লাফে এত টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বাজারে কথা প্রচলিত রয়েছে, একই ব্যক্তি আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুদ্রাপাচার হচ্ছে। সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক গোয়েন্দাদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। আমি মনে করি, এটা শুধু বাণিজ্যিক কারণ নয়; এর পেছনে অন্য কোনো ফাঁয়দা নেওয়ার অপচেষ্টা হতে পারে।’

ওই বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা নুরুল সরদার জানান, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় খুচরায়ও বেড়েছে। কারণ হিসেবে তিনি সরবরাহ ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন।

একইভাবে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। কোনো দোকানে পেঁয়াজ নেই—এমন কথা শোনা যায়নি। এর পরও কেন আকাশছোঁয়া দাম? এমন প্রশ্নে নানা অজুহাত দেখান বিক্রেতারা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পেঁয়াজের বাজারে সংকট কাটাতে টিসিবি নিয়মিত ট্রাক সেল বাড়িয়েছে। পাঁচটি ট্রাকের খোলাবাজার এখন ৩৫টিতে উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা ধরে বিক্রি করা হচ্ছে। এর পরও কেন এভাবে দাম বাড়ছে; তা বোধগম্য নয়।’

শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রদেশ পোদ্দার জানান উল্টো কথা। তিনি বলেন, ‘বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজ নেই। বুলবুলের কারণে গত তিন দিন মিয়ানমারের পেঁয়াজ দেশে আসেনি। এ ছাড়া সরকারি দপ্তরের লোকেরা কোনো কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীদের জরিমানা ও হয়রানি করছেন। ফলে তাঁরাও আতঙ্কিত হয়ে আমদানি করছেন না। সব মিলিয়ে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। বাজারে ভারতের পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত পেঁয়াজের সংকট কাটবে না।’

কনজ্যুমার অ্যাসোশিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান পেঁয়াজের বাজারের চলমান সংকট দেখে চরম হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী, অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী। সরকারে এমন অনেক বড় বড় মন্ত্রী ব্যবসায়ী হওয়ার পরও ভোগ্যপণ্যের বাজার এতটা নিয়ন্ত্রণহীন হবে, ভাবা যায় না। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী পুুরো পেঁয়াজের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের অনুরোধে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর পেঁয়াজ আমদানি করার কথা থাকলেও সেই পেঁয়াজ এখনো বাজারে আসেনি। এটা এক ধরনের আইওয়াশ।’

এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, পেঁয়াজের আমদানি কমছে। গত জুলাই মাস থেকে গত বুধবার পর্যন্ত দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৮৮ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টন।

সরকারি সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত সাতটি দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাঁচ হাজার টন বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। আরো ৬১ হাজার টন এ মাসের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশে আসবে। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছে। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পর বিভিন্ন দেশ থেকে এ পর্যন্ত ৪০ দিনে ৩৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ সাধারণত উজবেকিস্তান থেকে কখনো পেঁয়াজ আমদানি করেনি। এবার ওই দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন নিয়েছেন একজন আমদানিকারক। কিছুদিনের মধ্যে ওই পেঁয়াজও দেশে আসবে।

এদিকে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেলে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া ট্রাকসেলে প্রতিদিন ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রাকসেলে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।

সূত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ও কালের কণ্ঠ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত