শিশু সাহিত্যে অবিস্মরণীয় প্রতিভা সুকুমার রায়

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৫৪

ঝরনা আক্তার জয়া

বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি,তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিলো, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বললো, "ম্যাও!"কি আপদ! রুমালটা ম্যাও করে কেন? গল্পের এই অংশ অথবা

" সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে
আকাশ ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ দোলায় শুয়ে
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছূয়ে" 

ছড়ার এই লাইনগুলো পড়লে আপনার যার কথা মনে পড়বে সে আর কেউ নয় সুকুমার রায়। যিনি একাধারে লেখক,ছড়াকার,শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার,প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি বাংলাসাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশু সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে "ননসেন্স রাইমের" প্রবর্তক। তার বহুমূখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার ননসেন্স ছড়াগুলোতে।

তার লেখা কবিতার বই আবোল-তাবোল,গল্প হ-য-ব-র-ল,গল্প সংকলন পাগলা দাশু এবং নাটক চলচ্চিত্রচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা "ননসেন্স" ব্যজ্ঞাত্নক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল "অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক ই যাদের সমকক্ষ। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই "আবোল তাবোল" শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় বরং বিশ্বসাহিত্যে অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরনের স্বর্নযুগে। জনপ্রিয় এই শিশুসাহিত্যিক ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আদিনিবাস মসূয়া, ময়মনসিংহ, পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ)।

এ কবির ছদ্মনাম উহ্যনাম পন্ডিত। সুকুমার রায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে, তার মাতা বিধুমুখী। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গংগোপধ্যয়ের মেয়ে। বাবা-মায়ের ছয় সন্তান,এর মধ্যে সুকুমার রায় কতোতম জানা যায় নি। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তার দুই ভাই। সুখলতা, পূন্যলতা ও শান্তিলতা তার তিন বোন।

সুকুমার কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি (অনার্স)করেন। কলেজে পড়ায় সময় ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিলেন সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামে একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিলো সাহিত্যনুরাগি যা তার মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। তার পিতা উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিলো।

সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরী নিয়ে গবেষনা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং একটি মানসম্পন্ন ব্লক তৈরীর একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় এন্ড সন্স নামের এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার রায় ও যুক্ত ছিলেন।

মুদ্রনবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে(ইংল্যান্ডে) যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির উপর পড়াশুনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। সুকুমার ইংল্যান্ডে থাকাকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করেন, উন্নত রঙিন হাফটোনব্লক তৈরী ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা তৈরী করেছিলেন। এই সময় তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ' প্রকাশনা শুরু করেন।

১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। বিলেত থেকে ফেরার ২মাস পরেই সুকুমারের বিয়ে হয় জগদাশচন্দ্র দাসের মেজ মেয়ে সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে। তার ডাক নাম ছিলো টুলু। এরপর বিয়ের ঠিক ৮ বছর পর অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২রা মে সুপ্রভা দেবী তার প্রথম পুত্র সন্তান সত্যজিৎ রায়ের জন্ম দেন। যিনি পরবর্তীতে বাংলা সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠেন।

ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর মনডে ক্লাব (ইংরেজি ভাষা: Monday Club) নামে একই ধরনের আরো একটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা জুতা সিলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব ধরনের আলোচনাই করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলার বিষয়বস্তু ছিলো মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষনা ইত্যাদি।

সুকুমার বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবার মৃত্যু হয়। তার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় তার লেখা কম থাকলেও উনি মারা যাওয়ার পর সন্দেশ পত্রিকার দায়িত্ব তিনি নিজের কাধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। তার রচিত গ্রন্থাবলী হলো: আবোল-তাবোল, পাগলা দাশু, হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরী, খাই খাই, অবাক জলপান, লক্ষনের শক্তিশেল, ঝালাপালা ও অনন্যা নাটক,হ-য-ব-র-ল, শব্দ কল্প দ্রুম, চলচ্চিত্রচঞ্চরী, বহুরূপী, ভাষার অত্যাচার।

পিতার পরলোকগমনের পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানার দায়িত্ব পালন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গান নিয়ে তিনি বক্তৃতা ও দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। ইতিমধ্যে সুকুমার লেখচিত্রী/ প্রচ্ছদশিল্পী রূপেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। তার প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মিলে তার, নতুন প্রযুক্তিতে হাফটোন ব্লক তৈরী আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে।

সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী, অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধর্মের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় 'অতীতের কথা' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে- ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তার ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন। সুকুমারের আবোল-তাবোল কবিতার শেষের ২লাইন ছিলো-"ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর/ গানের পালা সাজ্ঞ মোর" এটি বাস্তবায়িত করেই সুকুমার রায় চলে গিয়েছিলেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৯২১ সালেই তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা তখনো অধরাই ছিলো।

১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর  সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ১০০নং গড়পাড় রোডের বাড়িতে বিদায় নিয়েছেন সুকুমার। তবুও যেন সুকুমারের মৃত্যু নেই। তার লেখনী থেকেই নিঃসৃত হয়েছে-"দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ"। এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই প্রানোচ্ছল,কর্মচঞ্চল, আনন্দপ্রিয় মানুষটি তার রেখে যাওয়া সাহিত্য কীর্তির মধ্যে দিয়ে চির ভাস্বর হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করবেন।

আজকের এই কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে নিজেকে অথবা আপনার প্রিয়জনকে উপহার দিতে পারেন এই জনপ্রিয় লেখকের লেখা একটি বই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত