শাহজাদপুর; কবিগুরুর গল্পের দুপুর বেলা

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৯, ১৮:০০

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে- একটি চিঠিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন শাহজাদপুর হচ্ছে গল্পের দুপুর বেলা। শাহজাদপুরের মাটি, মানুষ, জীবন ও প্রকৃতিকেই কতটা ভালবেসেছিলেন তার প্রমাণ রেখে গেছেন অসংখ্য গান, কবিতা, নাটকের মাধ্যমে। তিনি এখানেই ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত মোট ৭ বছর জমিদারির কাজে অবস্থান করেছেন এবং এখানে রচনা করেন অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম।

সম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী অসহিষ্ণুতা, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র রবীন্দ্র চর্চা। রবীন্দ্র চর্চাই পারে মানুষকে মুক্ত, শাণিত, সত্যনির্ভর এবং যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে।

রবিবার (৮ মে) বাংলা ২৫ বৈশাখ কবি গুরুর ১৫৮তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কাচারি বাড়ি ঘিরে রয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত নানা নিদর্শন। ২৫ বৈশাখ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাছারী বাড়িতে বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। তৈরী হয়েছে মঞ্চ, আলোক সজ্জা, ও বিভিন্ন রংয়ের আলপনা। আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে দুইদিন ব্যাপী উৎসবকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা পুলিশ থেকেও নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা।

স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে দু’দিনব্যাপী রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকছে- শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও দু’দিনব্যাপী রবীন্দ্রমেলা। এ উপলক্ষ্যে কবি গুরুর ব্যবহৃত পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, আসবাবপত্রসহ নানা নিদর্শন দেখতে প্রতিদিনই ভীড় করছেন দেশি বিদেশি দর্শনার্থী। 

বুধবার (৮ মে) সকাল ১০টায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র গবেষকরা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল হোসেন জানান, এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন শিল্পীরাসহ জেলার বিভিন্ন শিল্পী গোষ্ঠীসহ জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীবৃন্দ। অনুষ্ঠান ঘিরে নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রায় নয়টি বুক স্টল করা হয়েছে। যেখানে স্থান পাবে কবি গুরুর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ, কবিতার বই, চিত্রকর্ম। প্রতিবারের মতো এবারও কাছারিবাড়ি চত্বর হাজারও রবীন্দ্রভক্তের মিলনমেলায় পরিণত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

দুইদিন ব্যাপী উৎসব নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত করতে জেলা পুলিশ থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জেলা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী জানান, প্রতিটি মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন, সে জন্য বিভিন্ন স্থর বিশিষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও সাদা পুলিশের পাশাপাশি থাকবে সিসি ক্যামেরা এবং পুলিশের বিভিন্ন সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের উপকণ্ঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে কুঠি বাড়ি আদতে এই বাড়িটি পূর্বে ছিল ইংরেজদের নীল কুঠি। শত শত বছরের শাসক ও শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের পতনের পর রানী ভবানীর কাছে নীল কুঠিটি হস্তান্তর হয়। ১৮৪০ সালে তিন তৌজির অন্তর্গত শাহজাদপুরের এই অংশ নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তেরো টাকা দশ আনায় এই অংশ কিনে নেন। সেই থেকেই মূলত এই জায়গাটি রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জমিদারির অংশ।

১৮৯০ সালে লন্ডন থেকে ঘুরে আসার পর রবীন্দনাথ ঠাকুরের ওপর কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ী ও নওগাঁর পতিসর কাচারিবাড়ী এলাকার জমিদারি তদারকির ভার ন্যাস্ত হয়। এবং ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দনাথ শাহজাদপুরে জমিদারি দেখাশোনা করেছেন।

ইতিহাস প্রসিদ্ধ এর নাম সেই থেকেই কুঠিবাড়ি। প্রকৃতির সবুজের মাঝে হলুদ রঙের দ্বিতল ভবন। ভবনের দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার, উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। প্রতি তলায় সাতটি করে ঘর। উত্তর ও দক্ষিণে প্রশস্থ বারান্দা। ভবনের পাশেই কাছারি বাড়ি, মালখানা ও কর্মচারীদের বাসগৃহ।

এই কুঠি বাড়ির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক তার সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। এখানেই যেন ধরণীর সঙ্গে কবিগুরুর প্রণয় ঘটে। কাচারি বাড়ির তার শোবার ঘরের দক্ষিণের বারান্দা এবং তার প্রিয় বকুল তলার বেদীতে বসে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থেকেই রচনা করেছেন অসংখ্য মূল্যবান কবিতা, গান ও ছোট গল্প। লিখেছেন তার প্রিয়জনদের কাছে অসংখ্য চিঠি।

তার সৃষ্টি-সম্ভারের উল্লেখযোগ্য অংশ শাহজাদপুরে বসে রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব কবিতা, দুই পাখি, আকাশের চাঁদ, পুরষ্কার, হৃদয় যমুনা, ব্যর্থ যৌবন, প্রত্যাখ্যান, লজ্জা, চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীতে, নদীমাত্রা, মৃত্যু মাধুরী, স্মৃতি, বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, যাত্রী, তৃণ, মানস লোক, কাব্য, প্রার্থনা, ইছামতি নদী, আশিষ গ্রহণ, বিদায়, নব বিরহ, লজ্জিতা, বিদায়, হতভাগ্যের গান, কাল্পনিক, যাচনা, সংকোচ মানস, প্রতিভা ইত্যাদি কবিতা এখানে লিখিত। পোস্টমাস্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারা প্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি গল্প গুলোও এখানেই লিখেছেন। ছিন্নপত্রের ৩৮টি পত্র, পঞ্চভূতের অংশবিশেষ এবং বিসর্জন নাটক শাহজাদপুরে লেখা। এর মধ্যে, গোপাল সাহার মেয়ে সমাপ্তি গল্পের নায়িকা, হারান চক্রবর্তী ছুটি গল্পের ফটিক, তার কাছারির বাবুর্চি কলিমুদ্দি চিরকুমার সভার কলিমুদ্দি মিঞা, পোস্টমাস্টার মহেন্দ লাল বন্দ্যোপাধ্যায় 'পোস্টমাস্টার গল্পের নায়ক।

ছিন্নপত্রে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাচারি বাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি চারটি বড় বড় ঘরের মালিক’। পূর্বে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি সংলগ্ন উত্তরে ও দক্ষিনে দুটি বড় বাগান ছিল। পাশেই ছিল একটি কৃত্তিম হ্রদ। রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যায় এই হ্রদের মধ্যে বারোমাস পদ্ম ফুল ফুটে থাকতো। একসময় এই কাচারি বাড়ি ঘিরে ছিল বড় বড় ঝাউ, লিচু, আম, দারুচিনি, কামিনী ফুলের গাছসহ আরো দুস্প্রাপ্য গাছ-পালা। কবি এই বাগানের কথাই ছিন্ন পত্রে লিখে গেছেন, ‘দক্ষিণের বারান্দায় কেবল মাত্র কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিষ্কের রন্ধ্র পূর্ণ হয়ে উঠে’।

কাচারি বাড়ির নিচের তলায় ছিল একটি ডাকঘর। পোস্টমাস্টার চিঠিতে স্ট্যাম্প দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কবির সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। তিনিই ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন। কুঠি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ এই কুঠি বাড়িতে তিনি যে সুখানুভূতি পেতেন তা লিখে গেছেন ছিন্নপত্রে।  

এই কুঠি বাড়িতে প্রবেশ পথ সংলগ্ন সবুজ উঠোনের এক প্রান্ত জুড়ে ফুল বাগান। নানান ফুলের সমাহার। একটু পিছিয়েই ঐতিহাসিক হলুদ রঙের দোতলা কুঠি। নিচের তলা জুড়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিভিন্ন ছবির মাঝে তার আঁকা বিভিন্ন ছবি এবং তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতার অংশ বাধাই করে দেয়ালে টানানো রয়েছে। উত্তর দিকের বারান্দার একেবারে পশ্চিমে সিঁড়িঘর। গোল-প্যাঁচানো সিঁড়িটির মুখেই দুটি দরজা। যার একটি দরজা দিয়ে প্রবেশকালেই চোখে পড়বে একটি পালকি। ঠাকুর বাড়ির পালকি। যা বংশ পরম্পরায় ব্যবহার হয়েছে। আছে, পড়ার টেবিল, চিঠি লেখার ডেস্ক, আলনা, গোল টি-টেবিল। এরপর এক ঘর থেকে আর এক ঘরে সুন্দর ভাবে সুরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহত নানারকম আসবাবপত্র : বেতের চেয়ার, বড় ড্রেসিং টেবিল, চিনা মাটির ছাকুনি, টেবিল বেসিন, আলনা, দেবতার আসন, বড় টেবিল, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, আরাম কেদারা, পিয়ানো, কাঠের দোলনা চেয়ার, সোফা সেট, হাতলযুক্ত চেয়ার, স্ট্যান্ডে সংযুক্ত দুটি ড্রয়ার, হাতলওয়ালা গদিযুক্ত চেয়ার, আলনা স্ট্যান্ড, ৫টি আলমারি, আলমারির ভেতরে কেতলি, সসপ্যান, ফ্রাইপ্যান, লন টেনিস খেলার র‌্যাকেট, কাটা চামচ, চিনা মাটির ফুলদানি, ডিস, টব, জগ, জমিদারি মনোগ্রাম ৭টি, বালতি, কেরোসিনের বাতি, ঘণ্টা ট্রে, বাতির চিমনি ইত্যাদি। আরও রয়েছে দুটি খাট। এছাড়া আরও বহু কিছু একসময় এখানে ছিল। যেগুলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্থান গুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের এই কাছারি বাড়ি অন্যতম। ১৮৯৬ সালে তিনি শেষ বারের মতো শাহজাদপুর থেকে চলে যান। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত বাড়িটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হবার পাশাপাশি রবিন্দ্রভাবনার সাথে সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশ গনপ্রজাতন্ত্র সরকারের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।

সাহস২৪.কম/রিয়াজ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত