থমাস সানকারা: আফ্রিকার চে গেভেরা

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:০০

বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চিত্রায়ন আমরা দেখেছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা গেলেও তেমন কেউ জনগনের ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছেন এমন খুব একটা দেখা যায় না। তারপরও দুইটা একটা উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাস তাদের নানা রকম ভালো খারাপ ট্যাগ দিলেও তারা তার দেশের মানুষের কাছে আপন আর ভরসার প্রতীক হয়েই বেঁচে থাকেন।

পশ্চিম আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশ বুরকিনা ফাসো। আগের নাম রিপাবলিক অফ আপার ভোল্টা। ফ্রান্সের এই উপনিবেশটি ১৯৫৮ সালে স্ব-শাসন ব্যবস্থায় এলেও ফ্রান্স থেকে পুরোপুরিভাবে স্বাধীন হয় ১৯৬০ সালে। 

স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া আপার ভোল্টা পরিচালিত হতে থাকে ফ্রান্সের মদদপুষ্টদের হাতেই। তার সাথে শাসকদের সাথে যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমা আশীর্বাদ। ঐ সময়ে স্বাধীনতার স্বাদটাই তেঁতো হয়ে ওঠে আপার ভোল্টার জনগনের কাছে। সেই সময় যেনো দেশের মানুষের সামনে আশীর্বাদ হয়ে ওঠেন থমাস সানকারা। তিনি ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা। 

তিনি শুধুমাত্র একজন সামরিক কর্মকর্তাই ছিলেন না। ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী ও প্যান-আফ্রিকান চিন্তক। তার সমর্থকদের কাছে তিনি একজন ক্যারিশমাটিক নেতা; একজন আইকনিক বিপ্লবী। তাকে বলা হয় 'আফ্রিকার চে গেভেরা'। 

থমাস সানকারা বলতেন, "অ্যা সোলজার উইথাউট অ্যানি পলিটিকাল ওর আইডিওলজিকাল ট্রেইনিং ইজ অ্যা পটেনশিয়াল ক্রিমিনাল।" 

১৯৮৩ সালে দেশের ক্ষমতায় থাকা ফরাসী মদদ পুষ্ট সরকারকে হটিয়ে দেয় আফ্রিকার মানুষের কাছে জনপ্রীয় হয়ে ওঠা থমাস সানকারার অনুগত গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে নেয় অস্ত্রের মুখেই। সেই সময় গৃহবন্দী ছিলেন এই নেতা। তাকে মুক্ত করে তার হাতে অর্পন করা হয় রাষ্ট্র ক্ষমতা। দেশের মানুষও তখন সায় দিয়েছিল এই মিলিটারি ক্যুতে।

ক্ষমাতাভার গ্রহণ করে তিনি মনোনিবেশ করেন দেশের উন্নয়নে। তিনি চোখ দেন সমাজ ব্যবস্থা, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে। নাম বদলে দেশের নাম রাখেন 'বুরকিনা ফাসো'। থমাস সংগীত খুব পছন্দ করতেন। তাই নতুন করে প্রণয়ন করেন জাতীয় সংগীত। যার গীতিকার ও সুরকার ছিলেন থমাস সানকারা নিজেই। 

সানকারা কখনই চাইতেন না যে, তার দেশ বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ঐ দেশের তাবেদারি করুক। তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন নিজস্ব জনশক্তি আর প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই কোন প্রকার বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণসহায়তা ছাড়াই সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক ও রেললাইন স্থাপন করে সমগ্র দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করেন। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি নারীদের উচ্চশিক্ষিত করার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী পদে চাকরিতে বহাল করেন, সেনাবাহিনীতে রিক্রুটিং শুরু করেন এবং শিক্ষা ও চাকুরিকালীন সময়ে গর্ভকালীন/মাতৃত্বকালীন ছুটির নিয়ম করেন।

স্বাস্থ্যগত সমস্যায় জর্জরিত বুরকিনা ফাসোকে নিয়ে কাজ করেন সানকারা। নানা ধরণের বৈদেশিক বাঁধা থাকা স্বত্বেও তিনি প্রায় ২৫ লক্ষ শিশুকে ম্যানিনজাইটিস, ইয়োলো ফিভার (পীতজ্বর/কালাজ্বর) ও হামের টীকা দেয়ার প্রকল্পকে সফলতার মুখ দেখান। তার সময়েই মাত্র চার বছরে দেশটির স্বাক্ষরতার হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশতে উন্নীত হয়। দেশের মরুকরণ রোধে সারা দেশে প্রায় ১০ মিলিয়নের বেশী বৃক্ষরোপন করেন।

তার সময়ে সরকারী অফিস, ভবন বা দেশের কোথাও তার কোনো ছবি কিংবা ভাস্কর্য ছিল না। সানকারা বলতেন, ‘আমার দেশের ৭০ লক্ষ থমাস সানকারা, তাদের সবাই প্রেসিডেন্ট।’ 

তিনি ক্ষমতা গ্রহণের অব্যাহতি পরেই রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত সরকারী অর্থে কেনা বিলাসবহুল মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি বিক্রি করে নিজের জন্য একটি রেনল্ট-৫ মডেলের গাড়ি কেনেন যা ছিল সে সময়ে বুরকিনো ফাসোর সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সস্তাদামের গাড়ি।

তিনি নিজের বেতনসহ অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের মাত্রাতিরিক্ত বেতন কর্তন করেন, ব্যক্তিগত দেহরক্ষী, সোফার(গাড়িচালক) এবং বিমান ভ্রমণে প্রথম শ্রেণী, বিজনেস ক্লাস বাতিল করেন। তিনি সামান্তবাদী জমিদার ও ফেডারেল ল্যান্ডলর্ডদের কাছ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ করে তা চাষী-কৃষকদের মাঝে বিলি-বন্টন করে দেন।

তার সময়েই কৃষিতে স্বয়ংসপূর্নতা অর্জন করে বুরকিনা ফাসো। ধান ফসল গমের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ১৭০০ কেজি থেকে ৩৮০০ কেজিতে উন্নীত হয়। 

পশ্চিমাবিশ্বের ক্রমাগত পুঁজিবাদী অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদ ও বুর্জোয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠে সোচ্চার আওয়াজ তোলা থমাস বলতেন, ‘তোমাদের যারা ভরণপোষণ করবে তারাই তোমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।’ তিনি আফ্রিকার জাতিগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্যের ডাক দেন যাতে সকলে মিলেই সকলের মাথার উপরে থাকা ঋণের বোঝা নামাতে পারে। 

তিনি মত দেন যে, ‘দরিদ্র, শোষিত ও বঞ্চিতদের ঋণ পরিশোধের কোন বাধ্যবাধকতা থাকতে পারেনা।’ তিনি রাজধানী উয়াগাদুগুউতে সেনাবাহিনীর রশদ মজুদগারকে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সুপার মার্কেট হিসেবে গড়ে তোলেন যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং এটিই ছিল দেশের প্রথম সুপার মার্কেট।

সরকারী ও বেসরকারী কর্মকর্তাদের একবছরের বেতনের একটি অংশ তিনি দেশের জন্য দান করে দিতে অনুরোধ করেন তাছাড়া সরকারী বাসভবন ও আবাসিক ভবনে এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। 

তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার মাসিক বেতন কমিয়ে ৪৫০ ডলারে নামিয়ে আনেন, তার ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল একটি গাড়ি, চারটি বাইক, তিনটি গিটার, একটি ফ্রিজ ও একটি ভাঙা ফ্রিজার। তিনি বুরকিনাবে সুতোয় বোনা সাধারণ টেইলার্সে সেলাই করা ট্রেডিসনাল একটি টিউনিক পরে অফিস করতেন। যা ছিল মূলত পশ্চিমা ফ্যাশনবর্জিত দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক!

তার গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যেখানে সকল বৈদেশিক ঋণ ও অর্থ সহায়তা হ্রাস করতে দেশের সকল ভূমি জাতীয়করণ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বিমুখী হওয়া! তার হাতে নেয়া অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রনীতি ছিল দেশের দূর্ভিক্ষ মোকাবেলা, খাদ্যাভাব হ্রাস, খাদ্যশষ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ভূমিব্যবস্থা পুনর্গঠন, দেশব্যাপী স্বাক্ষরতা অভিযান সহ শিক্ষায় গুরুত্বারোপ এবং জনস্বাস্থ্য অবস্থার উন্নয়ন।

তিনি তৃণমূল চাষী ও দরিদ্র কৃষকদের মাঝে জমি প্রদান, সামান্তবাদীদের জমি পুণর্বন্টন করেন, গ্রামীণ জনপদের সকল ট্যাক্স, টোল ও সরকারি কর বিলোপ করেন। ‘একসূত্রে গাঁথা দেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে তিনি দেশের সড়ক, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতিসাধন করেন।

তিনি প্রতিটি গ্রামে একটি করে মেডিক্যাল ডিসপেনসারি গড়ে তোলেন, পাশাপাশি নিজেদের স্বেচ্ছাশ্রমে একটি করে স্কুলঘর নির্মাণ করেন। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা সন্ত্রাসী ও প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মদদপুষ্ট সিআইএ সাহায্যপুষ্ট বিদ্রোহী গেরিলাদের কঠোর হাতে দমন করেন।

তিনি সরকারবিরোধীদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে উপজাতি ও প্রত্যন্তপ্রদেশ গুলোতে ‘প্রতিপক্ষ বিপ্লবী’ ও ‘ছদ্মবেশী বিদ্রোহী’, সরকারী প্রতিষ্টানে কিছু ‘অলস কর্মচারী’ ক্যাটাগরিতে গুপ্তচর নিয়োগ করেন। এরই সাথে তিনি কিউবান বিপ্লবী ‘ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মস্তিষ্ক’ নামে পরিচিত চে গুয়েভারার সামরিক পরিকল্পনা অনুসরণ করে কমিটিস ফর দ্য ডিফেন্স অব দ্য রেভলিউশন (সিডিআর) গঠন করেন।

তবে এসব কারণে অসুন্তুষ্ট মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখন মেনে নিতে পারেনি ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশ গুলো। তার পেছনে লেগেছিল আমেরিকাও। আর দেশের অভ্যন্তরে মধ্যবিত্ত শ্রেনী, জোতদার, সামান্তবাদী জমিদার, উপজাতি নেতা যারা সানকারার গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দীর্ঘদিনের দাসব্যবসা, বাধ্যশ্রম, কম মুজুরিতে শ্রমিক প্রথার বিলোপ হওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়।

সমাজতন্ত্রের কথা বলায়, সাম্যবাদের কথা বলায় সবার কাছেই শত্রু বনে যান এই আফ্রিকান অকুতোভয় বীর। 

১৫ অক্টোবর, ১৯৮৭ সাল। মার্কিনীদের সিআইএ মদদপুষ্ট একটি বিদ্রোহী সামরিক দল ব্লেইসে কম্পোওরের নেতৃত্ব অভ্যুত্থানে শামিল হয়। সেই অভ্যুত্থানে নিহত হন এই আফ্রিকান সূর্য, যিনি চেয়েছিলেন শুধুই আফ্রিকান মানুষের মুক্তি। ১৪টি বুলেট আফ্রিকার মানুষের এই মুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল সেদিন।

মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে তিনি দীপ্তকন্ঠে বলেন, ‘বিপ্লবীরা প্রত্যেকেই আলাদা স্বত্তা। তাদের চাইলে হত্যা করা যায়, কিন্তু তাদের আদর্শকে হত্যা করা যায় না।’

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত