লেখা ও আঁকা যুগলবন্দী করা এক বিরল শিল্পী ধীরেন বল

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:১৪

মো: মুহাইমিনুল ইসলাম

এক স্মৃতিসভায় সুকুমার রায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমি সারা জীবন শিশুদের জন্য সেইরকম ভাবে কিছু ভেবে উঠতে পারিনি। সুকুমার রায় কিন্তু সেই ভাবে শিশুমনে একটা বিরাট জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন।’ পরবর্তী সময়ে পাঠককুল আরও একটি মানুষকে পেয়েছিলেন- যিনি নীরবে শিশুসাহিত্যকে পুষ্ট করে গিয়েছেন; তিনি ধীরেন বল। সেই নিরহঙ্কারী, আত্মপ্রচারবিমুখ শিশুসাহিত্যিকের আজ ১১১ তম জন্মবার্ষিকী। তুতুভূতু্‌, চেঙাবেঙা’র মতো বাংলা কমিকস বইয়ের স্রষ্টা, নানা পত্রপত্রিকার অলংকারক, লেখা ও আঁকা যুগলবন্দী ছিল যার হাতে; তিনিই নন্দলাল ও দক্ষবালা বলের কৃতী সন্তান ধীরেন বল।

১৯১২ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বারইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ধীরেন বল। তিনি ছিলেন মূলত অঙ্কনশিল্পী। ছোটোদের ছড়া, কবিতা এবং গল্পেও দক্ষতার পরিচয় মিলেছে বারবার। বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে তার তুলিকলম পাখা মেলে উড়ে বেড়াত। চিরশিশু এই মানুষটির মনে কৈশোরের ছায়া জুড়ে ছিল যেন আজীবন। তাই হয়তো তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অসাধারণ সব ‘চিত্রকথা’।

বগুড়ার করোনেশান স্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু ধীরেন বলের। ১৯২৭ সালে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ভর্তি হন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। ১৯৩১ সালে বি.এ. পাশের পর চলে আসেন কলকাতায়। গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট থেকে তিন বৎসরের কমার্শিয়াল আর্টে শিক্ষা লাভ করেন।

গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন ঘরে মন বসাতে পারতেন না কিশোর ধীরেন। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে চলে যেতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, কখনও পুকুরঘাটে আবার কখনও কুমোরপাড়ায়। মাটির পুতুল গড়ার নেশা ধরেছিল মূলত কুমোরপাড়া থেকেই। ফেলে আসা নিজের গ্রামকে ধরে রেখেছিলেন ‘ছড়ায় ভরা গ্রাম’ বইটিতে। ১৯৩৮ সালে তিনি ভারত সরকারের প্রচার বিভাগের শিল্পী হিসাবে সিমলা যান এবং সেখানে অবস্থানকালে তিনি দুর্গা ও সরস্বতীর মাটির প্রতিমা গড়েন এবং সেই মৃন্ময়ী প্রতিমা সেখানে প্রথম পূজিত হয়।

পরে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিভাগে চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ধীরেন বলের বিজ্ঞাপন জগতের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো ছিল- কোকোলা, হিমানী, আমলা, হিমকলন্যাস, ভিভিগ্যান, নিম সাবান ইত্যাদি।

সময়টা ১৯৩৯-৪০, বিমল ঘোষ তাকে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দমেলা’য় নিয়ে আসেন। বর্মণ স্ট্রিটের কার্যালয়ে ধীরেনের কর্মজীবন শুরু হয়। এই বিভাগে তার অঙ্কণে গল্প প্রকাশিত হত। এছাড়া পত্রিকার সকল বিভাগের গল্প ও উপন্যাসের ছবিও আঁকতেন তিনি। পাশাপাশি যুগান্তর, অমৃতবাজার, শুকতারা, মৌচাক, কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান ও আলোর ফুলকিতে ছবি এঁকেছেন ধীরেন।

তার অমর সৃষ্টির কথা মনে রেখে লীলা মজুমদার চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের বন্ধু ধীরেন বলের মতো চিত্রশিল্পী আমাদের দেশে কম জন্মেছেন। ছোটোদের জন্য আঁকা ছবি যেন লাফায়-ঝাঁপায়, মনকে নাড়া দেয়। ধন্য তার তুলিকলম। কেবলি আমার দাদা সুকুমার রায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। নামকরা শিল্পী আমাদের চিত্রজগতে অনেকে দেখা দিয়েছেন, কিন্তু ছোটোদের মনের ছাড়পত্র পেয়েছেন দু’চারজনা। ধীরেন বলের দর্শন পেয়েছি আমার সৌভাগ্য।’

ধীরেনের তুলিকলম কত উঁচু মানের, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সৃষ্টি- চেঙাবেঙা, তুতুভূতু্‌, ঠেকে হাবুল শেখে, দেখে হাবুল শেখে, মজার দেশে মানু, দেখে এলাম ভারত, এই বাংলার মেয়ে, দেখে এলাম কলকাতা, পিকনিকে চ্যাঙাব্যাঙা, চিত্রকথাসহ ৫০টি’র মতো বইয়ে। শিশুমন বুঝে তিনি পশুপাখির গায়ে জামাকাপড় পরিয়েছিলেন। তা দেখে তিন-চার প্রজন্মের সেই হাসি আজও চিরো অমলিন।

ধীরেন এই টাটকা ও তাজা মন পেয়েছিলেন সুকুমার রায়ের কাছ থেকে। কারণ দশ বছর বয়স থেকে ধীরেন- সন্দেশ, শিশুসাথী, খোকাখুকু’র গ্রাহক ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে সেই সব পত্রিকা পৌঁছাত। ওই সময় থেকে বালক ধীরেন ‘শিশুসাথী’তে নিয়মিত লেখা পাঠাতেন। দশ বছর বয়সে স্কুলের খাতাকে তৈরি করেছিলেন পত্রিকা। এ রকম একটি খাতার নাম দিয়েছিলেন ‘গাঁথা’। এই খাতাটি কন্যা পৃথা বলের সংগ্রহে আছে। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসার সময় কাকা শৈলেন বল নানা জিনিসের সঙ্গে সেটি টিনের বাক্সে কলকাতায় নিয়ে আসেন। লেখা ও আঁকার সম্মিলিত দক্ষতার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধীরেন বলকে বিশেষ পুরষ্কার দেন। কয়েকটি পোর্ট্রেট আঁকার আদেশ দেন। সেই আঁকাগুলো দীর্ঘদিন বগুড়ার করোনেশন স্কুলে ঝোলানো ছিল।

মৌমাছি তথা বিমল ঘোষের লেখা চেঙাবেঙা বইটিতে চিত্রাঙ্কনের জন্য তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পুরষ্কৃত হন এবং ওয়াল্ট ডিজনি অব বেঙ্গল নামে ভূষিত হন। তার প্রথম প্রকাশিত বই ‘তোলপাড়’ (১৯৪৭)। ‘টইটুম্বুর’-এর জন্য শিশুসাহিত্য সংসদ পুরষ্কার পান তিনি। এছাড়াও ভুবনেশ্বরী পদক, মৌমাছি পুরষ্কার, রঞ্জিত স্মৃতি পদক সহ বহু পুরষ্কার লাভ করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যে বইয়ের মূল্যায়নের জন্য শেষের দিকে বেশ কয়েক বার এনসিইআরটি-র পুরষ্কারের বিচারক হয়েছিলেন। জীবনে এক বারই ধীরেন বল বার্মা শেল কর্তৃক ‘আর্ট ইন ইন্ডাস্ট্রি’তে প্রদর্শনীর জন্য মাত্র তিনটি ছবি পাঠিয়েছিলেন, যার সব ক’টি পুরষ্কার প্রাপ্ত হয়। ১৯৯২ সালের ৩ জানুয়ারি ধীরেন বল কলকাতায় প্রয়াত হন।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

সাহস২৪.কম/এএম.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত