হুমায়ুন আজাদ চলে যাওয়ার ১৭তম বছর আজ

প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২১, ১০:৫৩

অনলাইন ডেস্ক

মুক্তমনা লেখক, কিশোর সাহিত্যিক, সমালোচক, গল্পকার, রাজনৈতিক ভাষ্যকর ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৪ সালের ১২ আগষ্ট জার্মানির মিউনিখ শহরে মৃত্যুবরণ করে তিনি।

সমকালের এই অন্ধ পাথর সময়ে তাঁর মতোন স্পষ্টভাষী প্রজ্ঞাবানের খুব বেশি অভাব অনুভব করছি। ধর্ম, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদিতা, রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রখর মানবিক যুক্তিবাদিতা এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য তিনি ১৯৮০’র দশক থেকে আমৃত্যু ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছিলেন অন্যের চিন্তাকে আলোড়িত করার, উসকে দেওয়ার মতোন ক্ষুরধার একজন শিক্ষকও। বিতর্কিত এবং বহুল সমালোচিত অনেক বক্তব্যই তাঁকে আলোচনার পাদপ্রদীপে রেখেছে বেশিরভাগ সময়। তবে তাঁর মতোন তর্কপ্রিয় জ্ঞানী শিক্ষকের তীব্র অভাব সমকাল ভীষণভাবে অনুভব করে।

ধারণা করা হয় ধর্ম, মৌলবাদ, নারীবাদ, রাজনৈতিক সমালোচনামূলক বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখার কারণেই ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে একদল সন্ত্রাসী হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে যদিও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে ৭ আগষ্ট গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যাওয়ার পাঁচ দিনপর মিউনিখের নিজ ফ্ল্যাটে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

তিনি ভালবাসতেন বাঙালিকে। আবার সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছেন সেই বাঙালিকেই। এর সপক্ষে তাঁর জবাব ছিল, তিনি এই গোত্রের মানুষ, তাই এই জাতির কাছে তাঁর প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু যখন দেখেন বাঙালি অনিবার্যভাবে পতনের পথকেই বেছে নিচ্ছে তখন তিনি তার সমালোচনা করেছেন। একটি পবিত্র বিশুদ্ধ বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, যেখানে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ফতোয়া দেবে না। এমন একটি দেশ হুমায়ুন আজাদ চেয়েছিলেন যেখানে 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' (কিশোরসাহিত্য, প্রকাশকাল : ১৯৮৫)। গণতান্ত্রিক, মুক্তচিন্তাযুক্ত, ব্যক্তির অধিকারপূর্ণ, বদ্ধ মতাদর্শহীন, সচ্ছল, সৃষ্টিশীল, ভবিষ্যৎমুখি, সৎ, সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র হুমায়ুন আজাদ চেয়েছিলেন। সেখানে কেউ প্রভু, কেউ দাস থাকবে না। সকলের সচ্ছলতার ব্যবস্থা থাকবে, সেখানে কোনো মতাদর্শ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে না। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নকে তাড়া করে ফিরেছে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। বারবার তাঁকে আহত করেছে নানাভাবে। শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করল।

ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা তাঁর জীবনের একটি বিশেষ দিক হিসেবে আলোচিত হয়ে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তখন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত 'সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ' (transformational-generative grammar (TGG)) তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য হুমায়ুন আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল Pronominalization in Bengali (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে এটি একই শিরোনামের ইংরেজি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর পর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বাংলা বই প্রকাশ করেন। একই সালে তিনি বাঙলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে বিবেচিত হয়। তিনি পরবর্তী কালে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের উপর দু'টি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অকাল মৃত্যুর কারণে তাঁর এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া হুমায়ুন আজাদ বিক্রমপুরের রাঢ়িখালের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন সাহিত্যানুরাগীরা।

সাহস২৪.কম/এসএম