দিনে শুটিং রাতে পোস্টারিং; গল্পটা একজন 'সর্বজয়া'র

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৯, ০১:৩৮ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০১৯, ০১:৪৫

 

"একটাই স্বপ্ন, বাঁচার মতো করে পৃথিবীটাকে তৈরী করতে হবে। আর কোন কাজ নেই- সামনে দুহাতে পাথর ঠেলে সরিয়ে সবুজ ঘাসে ঢাকা সেই জমিটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে যেখানে জীবনটা অন্যরকম- সেই জন্যই তো আন্দোলন।"

উপরের কথা গুলো একজন সর্বজয়ার যাকে আমরা চিনি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় নামে। এই বছরের ২৫ ডিসেম্বর যিনি পা দেবেন জন্মশতবর্ষে। ১৯১৯ সালে যার জন্ম। অধুনা বাংলাদেশের খুলনার পৈত্রিক বাড়ী হলেও জন্ম তার সাঁওতাল পরগনার মহেশপুরে।

করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি, ডায়েরী সংকলন এবং তাকে নিয়ে লেখা 'সর্বজয়া, অ্যান অ্যাক্ট্রেস ইন হার টাইম' থেকে তার সম্পর্কে নাহা তথ্য জানা যায়। বন্ধু পরিমলকে দেখানো ভাতে কতটুকু লবণ দিতে হয় বা রোমান্টিক কবিতা লিখে গোলাপ গাছের নিচে পুঁতে ফেলা কিংবা 'বে অফ বেংগল'কে 'প্যাসিফিক ওশান' লিখে দাদার হাতে মার খাওয়া, এসব মজার তথ্য পাওয়া যাবে বৈকি।

তবে করুণার সংগ্রামী জীবন শুরু হয় রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৮-১৯৫০ সালে কারাগারে বিখ্যাত কমিউনিস্ট স্বামী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বন্দী হওয়ার কারণে। সংসার চালাতে করুণা যোগ দিলেন গণনাট্য সংঘে, শুরু করলেন অভিনয়।

থিয়েটার পাগল এই প্রগতি আন্দোলনের কর্মী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এর অভিনয়ের মাইলস্টোন হয় সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। বিভূতিভূষণের উপন্যাস পড়ে ' সর্বজয়া'র যে রূপ পাওয়া যায় তা প্রতীয়মান রূপ পায় সত্যজিৎ রায়ের সুনিপুণ দক্ষতায় আর করুণার অভিনয়শৈলীতে। 'পথের পাঁচালি' কিংবা 'অপরাজিতা' সর্বজয়া তো তিনিই। শহুরে এক শিক্ষিত নারী ধরতে পেরেছিলেন গ্রাম্য চরিত্রের কান্না। তার সেই শৈল্পিক উপস্থাপনে আবেগ প্রবণ হয় সিনেমাপাগল মানুষ। বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল একজন 'দুর্গার মা'কে যিনি চিরায়ত বাংলার গ্রামের এক সাধারণ মা। শাসন-বারণে যেমন আগলে রেখেছেন তেমনি অপার স্নেহে গড়ে তুলেছেন 'অপু' ও 'দুর্গা'দের। সত্যজিৎ রায়ের ওই ছবি দুটো ছাড়াও সর্বজয়া ওরফে করুণা বন্দোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন 'দেবী' ও 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিতেও। এছাড়াও কাজ করেছেন মৃণাল সেনের 'ইন্টারভিউ' ও 'কলকাতা৭১'-এ, শম্ভু মিত্র এবং অমিত মৈত্রের 'শুভ বিবাহ', অগ্রগামীর 'হেডমাস্টার', ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত ছবি ' কত অজানারে' এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের অমুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ' অন্ত্যেষ্টি' এও অভিনয় করেছেন।

তার ডায়েরী থেকে জানা যায় যে তিনি দিনের বেলা সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন আর রাতের বেলা শহরের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার মেরেছেন প্রগতি আন্দোলোনের। অভিনয়ের প্রতি আত্মনিবেদন থাকলেও তিনি ভুলে যাননি যে তিনি একজন প্রগতি আন্দোলোনের কর্মী। 'সর্বজয়া'র সার্থকতা ঠিক এখানেই।

তিনি তার সময়ের সেরা থেকে সেরাদের সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। পাহাড়ি স্যানাল, চুনিবালা দেবী, ছবি বিশ্বাস, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনয় জগতের মহারথীদের পাশাপাশি চুটিয়ে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন করুণা। কালের অতলে হারিয়ে গিয়েছেন কত 'তারকা'। 'সর্বজয়া' ছাড়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় কে তার নাম হিসেবে চেনে কয়জন? তাকেও কী অকালেই ভুল যাবে বাংলা চলচ্চিত্র?

জেনে রাখা ভাল যে,১৯৫৯ সালে 'ব্রিটিশ একাডেমি অফ ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন আর্ট' তাদের দ্বাদশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য যেই ছয় জন বিদেশী অভিনেত্রীর সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিল তাতে ইনগ্রিড বার্গম্যান, তাতিয়ান সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেত্তা মাসিনি, আনা ম্যাগনানির পাশাপাশি করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এর নামও ছিল উজ্জ্বল।