সৈয়দ মাইনুল হোসেন

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০১৯, ১৪:৪০

১.
আমাদের জাতীয় স্মৃতি সৌধের স্থপতি, জাতির এক মহান শিল্প পুরুষ, কবি গোলাম মোস্তফার নাতি, একুশে পদক প্রাপ্ত শিল্পী, স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন, তাঁর পারিবারিক বা ডাক নাম ছিলো তারেক। ১৯৫২ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দেশ ও জাতির প্রতীক হয়ে ওঠা মহান জাতীয় স্মৃতি সৌধের স্থপতি- স্থাপত্য অঙ্গনের এক উজ্বল নক্ষত্র স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন-এর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, সৈয়দ মাইনুল হোসেন ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে স্মৃতিসৌধের নকশা তৈরি করে সৈয়দ মাইনুল হোসেন অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি যা করেছেন, তার কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। যতদিন এদেশ থাকবে তার সৃষ্টি নান্দনিক শিল্প স্থাপনা স্মৃতিসৌধের মতোই মহাগৌরবে এদেশের ইতিহাসে তিনি বেঁচে থাকবেন। অনন্য শিল্পী ও স্থপতি মাইনুল হোসেন তার অন্যন্য এই কর্মের জন্য আমাদের স্মৃতিতে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। তিনি স্মৃতিসৌধের স্থপতি হিসেবে এ দেশের জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার ধারক হিসাবে আমৃত্যু বেঁচে থাকবেন এবং এ মহান কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতি তার নাম চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

২.
প্রথিতযশা স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের খালাতো বোন মঞ্জু আপা (লন্ডন প্রবাসী প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক ফাহমিদা মঞ্জু মজিদ) এবং এবং মামা শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের কাছে মেধাবী এই স্থপতির অনেক গল্প শুনেছি, ২/১ বার ক্ষণিকের জন্য দেখা এবং কথাও হয়েছে মঞ্জু আপার সৌজন্যে। কিন্তু আমার চরম অলসতার কারণে মহান এই স্থাপত্য শিল্পীর একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে ভীষণই অনুতাপ হয় এখন। তার দীর্ঘ দিনের শিল্পসঙ্গী মামা মুস্তাফা মনোয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘আমরা তাকে তারেক নামে ডাকতাম। ছোটবেলায় খুব একটা দুষ্টু ছিল না, তবে মজার মজার খেলা করতে পছন্দ করত। তারেক ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকত। বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি মাইনুল হোসেন। এমন একটি স্থাপনা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি মনে করি এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্মৃতি সৌধ। আমাদের মনের মধ্যে তো থাকবেই, শত বছর পরও যাঁরা আসবেন, তাঁদের মনের মধ্যেও মাইনুল হোসেন থাকবে। বরেণ্য এই স্থপতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রইল।’ 

‘জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় তাঁর সতীর্থ বদরুল হায়দার লিখছেন, ‘দিনে দিনে ওকে বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণর্ মানুষ হিসেবে মনে করতে শুরু করেছিলাম। মনে হতো আমাদের চেয়ে বিশাল উচ্চতায় ওর অবস্থান। ওর বন্ধু হতে পেরে আমরা অবশ্যই গর্ব বোধ করতাম। দুর্ভাগ্য আমাদের, সঠিক সময়ে ওর মূল্যায়ন হলো না। বেঁচে থাকতে কোনো খোঁজখবর না রেখে, কোনো মূল্যায়ন না করে মৃত্যুর পরে শোকসভা, শোক প্রস্তাব করার মূর্খদের কালচার এ দেশ থেকে কবে যাবে?’

৩.
ঢাকা থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাভারে বাঙালির সাধনা-সংগ্রামের অমর স্মৃতি নিয়ে গর্বভরে দাঁড়িয়ে যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, তা আর কারো নয়, এই স্থপতির মহান কীর্তি। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়াও তাঁর নকশায় দাঁড়িয়ে নানা নান্দনিক স্থাপনা। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি অনেকটাই একা হয়ে পড়েছিলেন, বুকের ভেতর জমেছিল পুঞ্জীভূত অভিমান। স্বেচ্ছায় তাই বেছে নিয়েছিলেন আপাত লোকচক্ষুর আড়াল। সেই আড়াল থেকেই চির আড়ালে চলে গেলেন, নীরবে নিভৃতে। স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মদানকারী বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে নির্মিত সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিসৌধের স্তম্ভের আকৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে। আর স্মৃতিসৌধে সাতটা খাঁজ সম্পর্কে বলেছিলেন, বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সাতটা বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল। সবচেয়ে নিচের খাঁজটা বায়ান্ন, সবচেয়ে উঁচুটা একাত্তর।

৪.
জাতীয় স্মৃতিসৌধের নকশার সম্মানী বাবদ সৈয়দ মাইনুল হোসেনের পাওয়ার কথা ছিল তাঁর ২ লাখ টাকা। কিন্তু এই সম্মানীর উপর আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ। পরে রাজস্ব বোর্ডের কমিশনারকে অনুরোধ করার পর ২০ হাজার টাকা আয়কর নেয়া হয় তার কাছ থেকে। তবে সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার ছিল তার নকশায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন এই স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। তখন সে অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে স্মৃতিসৌধ দেখেছিলেন।

৫.
সৈয়দ মাইনুল হোসেনের দাদা ছিলেন সাহিত্যিক সৈয়দ এমদাদ আলী আর নানা কবি গোলাম মোস্তফা। বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক আর মা রাশিদা হকের তিন সন্তানের মধ্যে বড় সৈয়দ মাইনুল হোসেন ১৯৫২ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘বাবা সম্পর্কে অনেকেই ভুল তথ্য দেন’ উল্লেখ করে জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের মেয়ে সৈয়দা তানজিনা হোসেন বলেছেন, ‘আমার বাবা সম্পর্কে অনেকে ভুল তথ্য দিয়ে থাকে। বাবার নাম মাইনুল হোসেন, অনেকে ভুল বলে “মইনুল” হোসেন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত স্মৃতিসৌধের স্মৃতিফলকে নাম ভুল ছিল। আমার বাবার জন্ম ১৭ মার্চ, ৫ মে না। আমার বাবার জন্ম ঢাকায়, মুন্সিগঞ্জে না।’

৬.
সৈয়দ মাইনুল হোসেনের বাবার পেশা ছিল অধ্যাপনা। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইতিহাস পড়াতেন তিনি। তাঁর বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ফরিদপুর মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল মাইনুলের। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা স্কুলে। তখন থেকেই স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৬৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭০ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্বাধীন দেশে ১৯৭৬ সালে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি পান মাইনুল হোসেন। 

৭.
ইএএইচ কনসালট্যান্ট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করলেও কয়েক মাসের মধ্যে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেডে। এরপর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই স্থপতি। পেশাগত জীবনে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৮ সালে সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া পান শেলটেক পদক। সৈয়দ মাইনুল হোসেন ১৯৮২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার দুই মেয়ে সৈয়দা তাহরিমা হোসেন ও সৈয়দা তানজিলা হোসেন।

৮.
প্রচার কিংবা খ্যাতির মোহ ছিল না তাঁর। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল তাঁর নিভৃতবাস। ২৩ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তার। এর পর থেকে তার জীবন কেটেছে একাকী। কারও সঙ্গে দেখা করতেন না, কথাও বলতে চাইতেন না। স্বেচ্ছায় বন্দি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ‘জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় তাঁর সতীর্থ বদরুল হায়দার লিখছেন, ‘এমনিতেই অন্তর্মুখী, বিশেষ কয়েকজন ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলার বা মেশার কোনো চেষ্টা ওর ছিল না। হঠাৎ করে জাতীয় পর্যায়ে ওর ডিজাইনের স্বীকৃতি, সঙ্গে সীমাহীন অবহেলায়, সে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল। ইতোমধ্যে সংসার ভেঙে গেল – দুই মেয়েসহ স্ত্রী তাকে ত্যাগ করল। মাইনুল নিজেকে আরো গুটিয়ে ফেলল। মনে পড়ে, আমরা একবার সুন্দরবন গেলাম মাইনুল ও তার স্ত্রীসহ, বড় মেয়ে বিদিতা তখন একদম ছোট। মাইনুলের উচ্ছল প্রাণবন্ত রূপ আবার নতুন করে দেখেছিলাম তখন।’ অজানা এক অভিমানে নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন মেধাবী স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলতেন না, দেখাও করতেন না। কোথাও যেতেন না তেমন। আর তার চিরপ্রস্থানও ঘটল অনেকটা নীরবেই। ২০১৪সালের ১০ নভেম্বর মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি অনেক দিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। রক্তচাপও ছিল খুব কম। হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো গেল না।

৯.
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাভারে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণপূর্ত বিভাগ ১৯৭৮ সালে পরিকল্পিত জাতীয় স্মৃতিসৌধের জন্য নকশা আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সৈয়দ মাইনুল হোসেন তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি। কাজ করছিলেন ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এ জুনিয়র স্থপতি হিসেবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যে নির্মমতা তিনি কল্পনায় অনুভব করেছেন সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি স্মৃতিসৌধের নকশা করে জমা দেন। কিন্তু কোনো নকশাই পছন্দ না হওয়ায় গণপূর্ত বিভাগ দ্বিতীয়বার নকশা আহ্বান করে। দ্বিতীয়বারও নকশা জমা দেন সৈয়দ মাইনুল হোসেন। মোট ৫৭টি নকশার মধ্যে থেকে সে সময়ের তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নকশাটি গৃহীত হয়, তিনি প্রথম হন। আর তাঁর করা নকশা অনুসারে নির্মিত হয় অমর স্থাপনা জাতীয় স্মৃতিসৌধ। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। তাঁর নকশা অনুযায়ী স্মৃতিসৌধের বেদিমূল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাতটি ত্রিকোণ কলাম, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ১৫০ ফুট উঁচু। এই সাতটি কলামে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায় সূচিত হয়েছে। আকার-আকৃতিতে ভিন্নতা থাকায় একেক দিক থেকে স্মৃতিসৌধকে দেখায় একেক রকম।

১০.
জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাতটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভের সমন্বয়ে নির্মিত। এটি ১৫০ ফটু উঁচু। এই সাতটি স্তম্ভ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সাতটি পর্যায়ের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত। পর্যায়গুলো হলো ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ২০০৬ সালের মার্চে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয় স্তম্ভটির আকার এমন কেন? কী অর্থ তার, জানতে চাইলে এই স্থপতি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘চারদিকে প্রচণ্ড চাপ। সেই চাপে কিছু একটা উঠে যাচ্ছে।’‘জাতীয় স্মৃতিসৌধে সাতটা খাঁজের মানে জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত সাতটা বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল। সবচেয়ে নিচের খাঁজটা বায়ান্ন, সবচেয়ে উঁচুটা একাত্তর...।’কথায় কথায় তিনি আরও বলেছিলেন, স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর কারা যেন বেনামি চিঠি দিয়ে তাকে খুন করতে চেয়েছিল। তারপর পত্রিকায় ইচ্ছা করে তার নাম ভুল লেখা হয়েছিল। নকশার সম্মানী বাবদ ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তার আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ শতাংশ, মানে ১ লাখ। পরে রাজস্ব বোর্ডের কমিশনার ধরে-টরে ২০ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন, সে অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন।

১১. 
‘জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় তাঁর সতীর্থ বদরুল হায়দার লিখছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে রাশিয়া সফরের সময় প্রায় শহরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের অনেক স্মৃতিসৌধ দেখে এবং ভোলগাগ্রাদে ‘মাদার মাদারল্যান্ড কমপ্লেক্স’ দেখে অভিভূত হন। দেশে ফিরে তিনি বললেন, আমাদের শহীদদের জন্যও কবর এবং স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে হবে। তার ফলশ্রুতিতেই স্মৃতিসৌধ। স্থান নির্ধারিত হলো সাভারে। প্রাথমিকভাবে ২৪ একর জমি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান হলো। নাম দেওয়া হলো, ‘অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ’। স্মৃতিসৌধের পুরো কমপেলক্সটার ডিজাইন পিডব্লিউডির স্থাপত্য অধিদপ্তরের স্থপতি আব্দুর রশিদের তত্ত্বাবধানে করা। সঙ্গে ছিলেন স্থপতি অপরেশ দাশ, মনসুর আহমেদ ও অন্য বেশ কয়েকজন স্থপতি। সৌধের জন্য নির্ধারিত স্থানটি পুরো কমপ্লেক্সের শেষ প্রান্তে। শুধু সামনে থেকেই কাছে যাওয়া যাবে, চারদিকে ঘুরে দেখবার অবকাশ নেই। সৌধটির ডিজাইনও পিডব্লিউডির করার কথা। কিন্তু স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও অন্যদের চেষ্টায় সেটা প্রতিযোগিতায় আসে। বঙ্গবন্ধু সেখানে দু-তিনবার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ প্রকল্পটি ১৯৭৫ থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত ফাইলবন্দি হয়ে অবহেলায় পড়ে রইল। এর মধ্যে ১৯৭৯ সালে শুনলাম স্মৃতিসৌধের স্থাপত্য ডিজাইন প্রতিযোগিতা হবে। মাইনুল জমা দিলো ডিজাইন। তিন কোনা ১৫০ ফুট উঁচু পিলার, উপরটা আড়াআড়িভাবে কাটা, বাঁশের মতো। আহামরি কিছুই না। আমরা সেবার কেউ জমা দেইনি বা দিতে পারিনি। কিছুদিন পর মানসম্মত না হওয়াতে সব নকশা বাতিল করে নতুন প্রতিযোগিতার আহবান করা হয়। এবার আমরা সবাই অংশগ্রহণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম।’

১২.
‘জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় তাঁর সতীর্থ বদরুল হায়দার আরো লিখছেন, ‘১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। ১৯৭৬-এ আমরা পাশ করে বের হলাম। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায়। স্মৃতিসৌধ ফাইলবন্দি। আমরা তখন শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে – আমাদের দিনগুলো চলে যাচ্ছিল কোনো রকমে। ১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়া নিহত হলেন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। ১৯৮২ সালে হঠাৎ করেই ঠিক হলো, ১৬ ডিসেম্বর এরশাদ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করবেন। মাইনুলকে ত্বরিত যোগাযোগ করা হলো, কাজ শুরুর জন্য। ঠিক হলো যেহেতু মাইনুলের নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা কম, সেজন্য শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সহযোগিতায় ডিটেইল ডিজাইন দাঁড় করানো হবে। মাইনুল সর্বমোট দুই লক্ষ টাকা ফি পেয়েছিল। শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, যা নিজে থেকেই ও দিয়েছিল। ড্রইং সব মাইনুলই করত – মাঝে মাঝে স্থপতি রবিউল হুসাইন ও আমি ওর সঙ্গে সহযোগিতা করতাম, বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমাদের মতামত দিতাম। প্রাথমিক অবস্থায় মাইনুলের ডিজাইনে আটটি ডানা ছিল। ওর মাথায় তখন সৌধকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মকরণের চিন্তা। এর মধ্যে পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়াররা ডানাগুলোর যে পুরুত্বের কথা বললেন তাতে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। মাইনুলের মাথায় তখন নানা চিন্তা।
৫২ থেকে ৭১ – আন্দোলন ৭ - ৭
৭ মার্চ ৭
২৫ মার্চ ২+৫ = ৭
১৬ ডিসেম্বর ১+৬ = ৭
৭ বীরশ্রেষ্ঠ ৭
ধন্য মাইনুল! মিলালি কীভাবে! মাইনুল ৭টি ডানায় স্মৃতিসৌধকে দাঁড় করাল। কনকর্ডকে নির্মাণকাজ দেওয়া হলো, সময় মাত্র ৯০ দিন। দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলল। মাইনুল আর আমি প্রায়ই চলে যেতাম সাভারে। রাতদিন কাজ চলছে। তদারকির ভার পিডব্লিউডির ওপর। মাইনুলকে কেউ চিনেই না। ৯৫ দিনে নির্মাণকাজ শেষ হলো। এলো ১৬ ডিসেম্বর, জেনারেল এরশাদ জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করবেন। সাজ সাজ রব চারদিকে, কিন্তু মাইনুলের কোনো খবর কেউ রাখেনি, সাধারণ নিমন্ত্রণ পর্যন্ত পায়নি। সে আর আমরা কয়েকজন জনতার ভিড়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলে ভেতরে গেলাম। মাইনুলের সাফল্যের হাসিমাখা চেহারা ভুলবার নয়।’

১৩.
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরের কর্মজীবনে সৈয়দ মাইনুল হোসেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশা করেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো এসবের মধ্যে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (১৯৭৭), বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন (১৯৭৮), চট্টগ্রাম ইপিজেড কার্যালয় (১৯৮০), জাতীয় জাদুঘর (১৯৮২) ও উত্তরা মডেল টাউনের (১৯৯৫) নকশা উল্লেখযোগ্য।

১৪.
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে মাইনুল হোসেনের অনন্যসাধারণ নকশায় নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলা এবং বাঙালি জাতির সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে চিরভাস্বর থাকবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাঙালির এক অনন্য প্রতীক। স্বাধীনতার ইতিহাস, একাত্তরের শহীদ এবং দেশপ্রেমের অমর স্থাপনা। উপলব্ধি ও অনুভবের এক বিজয় স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধের রূপকার সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে বাঙালি জাতি চিরকাল স্মরণ করবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত