কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০১৯, ১২:৩২

আজ প্রভাবশালী জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্ক্সবাদের প্রবক্তা কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স- এর প্রয়াণ দিবস। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জীবিত অবস্থায় সেভাবে পরিচিত না হলেও মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বিংশ শতাব্দীতে সমগ্র মানব সভ্যতা মার্ক্সের তত্ত্ব দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এ তত্ত্বের জনপ্রিয়তা কমে গেলেও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মার্ক্সবাদ এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্ক্সের দর্শন তথা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে পদ্ধতি হিসাবে দ্বন্দ্ববাদের দেখা মিলেছিল গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের আলোচনায়। কিন্তু মার্ক্স তাঁর দ্বন্দ্ব তত্ত্বের প্রেরণা মূলত তাঁর পূর্বসূরি দার্শনিক হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে লাভ করেন। কিন্তু হেগেলের এই পদ্ধতিকে তিনি ভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

কার্ল মার্ক্স তার দ্বন্দ্ববাদের সাথে হেগেলের দ্বন্দ্ববাদের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে নিজেই বলেছেন, “হেগেলের দৃষ্টিতে চিন্তা বা ধারণাই হলো জগত স্রষ্টা এবং প্রকৃত জগত হচ্ছে মন নির্ভর জগত। পক্ষান্তরে আমার কাছে বস্তুজগৎই হচ্ছে একমাত্র জগত বা আদর্শ এবং মানুষ তার মনের সাহায্যে এই বস্তুজগতকে চিন্তার মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করে।” মার্ক্স দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের যে তত্ত্ব প্রচার করেন তার মূল কথা হলো, বস্তুই একমাত্র সত্ত্বা এবং গতি হলো তার স্বাভাবিক ধর্ম। বস্তুর অস্তিত্ব মনের উপর নির্ভরশীল নয় বরং মনের অস্তিত্বই বস্তুর উপর নির্ভরশীল।

মার্ক্স ইতিহাসের যে বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে তিনি ইতিহাসের বিকাশ ও বিবর্তন সম্পর্কে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গিকেই গ্রহণ করেন। কিন্তু ভিন্নতর ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি মনে করেন, ইতিহাস তথা মানব জীবনের যাবতীয় ঘটনা একমাত্র অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইতিহাসের ঘটনাবলীকে ধর্মীয়, নৈতিক, আধ্যাত্মিক বা যে কোন কারণের অভিব্যক্তি বলে বর্ণনা করা হোক না কেন সেগুলি আদতে অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনা থেকে উৎসারিত। তার মতে, সামাজিক উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন সম্পর্কের যোগফল নিয়েই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠিত হয়। এই ভিত্তির উপর আইনগত এবং রাজনৈতিক অধি-কাঠামোসমূহ প্রতিষ্ঠিত এবং সামাজিক চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ এই ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। বস্তুগত জীবনে উৎপাদনের যে পদ্ধতি বিরাজ করে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন প্রক্রিয়ার সাধারণ চরিত্রকে নির্ধারিত করে। মানুষের চেতনা তার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রিত করে না, বরং সামাজিক অস্তিত্বই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রিত করে।

রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সের ধারণা সনাতনী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ও চিত্তাকর্ষক। ‘রাষ্ট্র একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান এবং তা মানুষের জীবনে মঙ্গল ও কল্যাণ বয়ে আনে’- এমন সনাতনী ধারণার তিনি তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “রাষ্ট্র অভিন্ন কল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত কোন সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান নয় বরং তা যে কোন সমাজের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শ্রেণীর হাতে গড়া একটি সংগঠন এবং অন্যান্য শ্রেণীর উপর এই শ্রেণীর শাসন ও শোষণকে মজবুত করাই এর প্রধান লক্ষ্য।” এটি প্রভাবশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর একটি নির্বাহী কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিহাসগত ভাবে যদিও শ্রেণী শত্রুতার বিষময় প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রের জন্ম কিন্তু কালক্রমে অর্থনৈতিক অবস্থার ফলশ্রুতি হিসাবে তা অনতিকালের মধ্যে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শ্রেণীর ক্রীড়াতে পরিণত হয় এবং একমাত্র প্রভাবশালী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকেই সে তার পবিত্র দায়িত্ব বলে গণ্য করে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র কেবলমাত্র পুঁজিপতিদের শোষণ করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মার্ক্সের মতে, রাষ্ট্রের এই শ্রেণী চরিত্রের কথা বিস্মৃত হয়ে কেউ যদি মনে করেন যে, সকল নাগরিকের অভিন্ন কল্যাণ ত্বরান্বিত করাই রাষ্ট্রের কাজ তাহলে জানতে হবে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।

পুঁজিবাদী সমাজের গতিধারা উদঘাটন করেন মার্ক্স। তিনি দেখান কিভাবে মূল্যতত্ত্বের সাথে উদ্বৃত্ত মূল্যের ব্যপারটা জড়িয়ে থাকে। এডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো যে মূল্যের শ্রমতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। মার্ক্স তাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এবং বিকশিত করেন। ‘তিনি দেখান যে পণ্য (পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য উৎপাদনই প্রধান। মার্ক্সের ‘পুঁজি’ গ্রন্থও তাই শুরু হয়েছে পণ্যের আলোচনা দিয়েই) উৎপাদনে সামাজিক ভাবে যে আবশ্যক শ্রম-সময়ের ব্যয় হয়েছে, তা দিয়েই তার মূল্যের নির্ধারণ হয়’। মার্ক্স তাঁর নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার আলোকে পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ নামে তিনি একটি মৌলিক তত্ত্বের আবিষ্কার করেন। তিনি অন্যান্য পণ্যের ন্যায় মানুষের শ্রম শক্তিকে একটি পণ্য বলে বিবেচনা করে বলেছেন যে, অন্যান্য পণ্যের মত শ্রমেরও দ্বিবিধ মূল্য বিদ্যমান যা বিনিময় মূল্য এবং ব্যবহারিক মূল্য বলে অভিয়িত করা যায়। শ্রম সংগ্রহ করার জন্য শ্রমিককে যে মূল্য দেওয়া হয় তা বিনিময় মূল্য। কিন্তু শ্রমিকের শ্রমের ফলে সৃষ্ট দ্রব্যাদি বাজারজাত করে যে মূল্য পুঁজিপতিরা অর্জন করে তা হলো শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য।

কার্ল মার্ক্স দেখিয়েছেন যে, শ্রমের বিনিময় মূল্য অর্থাৎ শ্রমিককে প্রদত্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য সব সময় বেশী থাকে। ব্যবহারিক মূল্যের এই উদ্বৃত্ত অংশকে তিনি ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ বলে অভিহিত করেছেন। বুর্জোয়া সমাজে একজন পুঁজিপতি উদ্বৃত্ত আহরণ করে মুনাফার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে একজন পুঁজিপতি উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয় এবং একজন শ্রমিককে তার শ্রমশক্তি সেই পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করতে হয় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে। অথচ শ্রমিকই উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতি একাধারে হয়ে ওঠে উৎপাদনের উপকরণের মালিক, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের শ্রমশক্তির মালিক, এমনকি উৎপাদিত দ্রব্যেরও মালিক! শ্রম দিবসের একটা অংশের জন্য সেই শ্রমিক মজুরি পায়, আর একটা অংশের জন্য পায় না। এই বিনা মজুরির অংশটাই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। মজুরি দিয়ে দেওয়ার পর ঐ পুঁজিপতি আগে বলা বিষয়ের সাথে সাথে উদ্বৃত্ত মূল্যেরও মালিক হয়ে বসে। মালিকপক্ষ অনেক সময় শ্রমদিবস বাড়িয়ে (extend) বা মজুরি কেটে উদ্বৃত্ত আহরণের চেষ্টা করে। অন্যান্য শ্রেণীবিভক্ত সমাজেও সামাজিক উদ্বৃত্ত তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু একমাত্র পুঁজিবাদী সমাজেই তা পুঁজির রূপ ধারণ করে। আবার পুঁজির সঞ্চয় আগেভাগেই ধরে নেয় উদ্বৃত্ত মূল্যের সম্ভাবনা। ‘উদ্বৃত্ত মূল্য ধরে নেয় পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদনের উপস্থিতি এবং পুঁজিতন্ত্রী উৎপাদন পূর্বাহ্ণেই ধরে নেয় পণ্য-উৎপাদনকারীর হাতে প্রচুর পরিমাণ পূঁজি ও শ্রমশক্তির অস্তিত্ব।’ মার্কস এই প্রক্রিয়াকে বলেছেন “দুষ্টচক্রের নিয়ত আবর্তন” বা “পুঁজিপতিদের চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত মূল্য” বলে গণ্য করেছেন।

মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, মানব সমাজের প্রতিটি রাজনৈতিক অবস্থা তার বিশেষ বিশেষ অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উৎপাদনের মাধ্যমগুলো যখন যে শ্রেণীর হাতে সংরক্ষিত থাকে তখন সেই শ্রেণী সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রাধান্য লাভ করে এবং তদানুসারে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থার গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় মানব সমাজ পুঁজিপতি ও প্রলিতারিয়েত-এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয় এবং এদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। তাঁর মতে, প্রচলিত সকল সমাজের ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেন, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে আধুনিক সমাজগুলো সুস্পষ্ট দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। একটি হলো পুঁজিপতি শ্রেণী আর অন্যটি হলো প্রলিতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণী। পুঁজিপতিদের ক্রমাগত শোষণের ফলে প্রলিতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণী তাদের দুঃখ ও হতাশা সম্পর্কে যখন পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠবে তখন বিপ্লবে সূচনা হবে এবং আবহমান কাল ধরে যারা শ্রমিকদের শোষণ করে পুঁজিপতি হয়েছে তারা নিঃস্বত্ব হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা যখন প্রোলিতারিয়েত হাতে চলে আসবে তখন তারা সে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাদের মধ্যেকার বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত