জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

মাসুম রেজা

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১০:৫৭

১.
আজ প্রিয় নাট্যজন, শিল্প সাধক মাসুম রেজার (Masum Reza) জন্মদিন। একজন সফল নাট্য ও চলচ্চিত্রকার তিনি। মঞ্চ, ছোটপর্দা এবং বড়পর্দার জন্য লিখেছেন নিত্যপুরাণ, আরজচরিত, দ্বিচক্রযান, রঙের মানুষ, ভবের হাট, মোল্লা বাড়ির বউ, বাপজানের বায়স্কোপসহ অনেক রচনা। আমাদের অন্যতম মেধাবী নাট্যকার মাসুম রেজা লেখালেখির সম্মাননা হিসেবে পেয়েছেন নাটকে বাংলা একাডেমি পুরষ্কারসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের মতোন অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননা। বর্তমানে তিনি টেলিভিশন নাট্যকার সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সফল ও বহুল আলোচিত শিল্পস্রষ্টা মাসুম রেজা ২৫ ডিসেম্বর, কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। শুভ জন্মদিন মাসুম রেজা ভাই। স্মৃতির পুরাণ খুলে আপনাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি। আপনার সুস্থ ও আনন্দময় দীর্ঘায়ু কামনা করি জন্মদিনে। আপনার সৃষ্টিলতার ধারা অবিরল অভ্যাহত থাকুক আমৃত্যু। মাসুম রেজা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ইলেকট্রনিকসে স্নাতকোত্তর নিয়ে কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্বেচ্ছায়, সানন্দে বেছে নিয়েছেন নাট্যচর্চা ও সাহিত্য সাধনা। কুষ্টিয়ায় বোধন থিয়েটার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে অনুশীলন নাট্যদল এবং ঢাকায় দেশ নাটক তার নিজের দল। সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষিত নিয়ে শুরু তার নাট্যরচনা, যা অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে অর্জন করেছে একান্ত স্বাক্ষর, নিজস্ব শিল্পমান। স্রষ্টা হিসেবে মাসুম রেজার মূল সত্তা আসলে তিনি নাট্যকার। হুমায়ূন আহমদের জীবদ্দশায় টিভি নাটকে তার একচ্ছত্র রাজত্বকালেও একজন মাসুম রেজা যখন ‘রঙের মানুষ’-এর মতোন দর্শকনন্দিত নাট্যকার হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে যান, তখন তার শিল্পশক্তিকে কুর্নিশ করতে হয় বৈকি। ‘কৈতর’ নাটক দিয়ে যাত্রা শুরুর পর শতাধিক নাটক তিনি লিখেছেন টেলিভিশনের জন্য। রঙের মানুষ, ভবের হাট এখনো নাট্য বোদ্ধাদের কাছে বিস্ময়কর সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘প্রার্থনার মতো শিল্পের চর্চা করতে হবে’। তাই কেবল শিল্পকলার পরিশ্রমী সফল চাষীই তিনি নন, ব্যক্তি জীবনে অসম্ভব সংবেদনশীল মানুষ, সৃজনশীল মানুষ আমাদের প্রিয় মাসুম রেজা ভাই। জীবন যাপনে সজীবতার, প্রাণোচ্ছ্বলতার অফুরাণ খনি মাসুম রেজা ভাই। কোন জটিল মনের কুটিল মানুষের পক্ষে এমন মনখোলা হাসি উপহার দেওয়া সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। সতত ‘প্রাণে স্ফূর্তির ঢেউ’ বওয়া প্রিয় মানুষ মাসুম রেজা ভাইয়ের সৃষ্টিশীলতার শব্দবৃষ্টি আমৃত্যু প্রবাহিত থাকুক, অনুভবের অনুরণন প্লাবন ধারা অব্যাহত থাকুক রচনার মাঝে, জীবন নদীর ঢেউগুলো দোলা দিক আরো আরো প্রবলভাবে আমাদের, সেই কামনাই করি।

২.
আমার একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় মাসুম রেজা বাংলার সবচেয়ে পবিত্র মাটির মানুষ, আমাদের বঙ্গভুমির শিল্পালয়ে তীর্থস্থান কুষ্টিয়ার সন্তান। কারণ এই কুষ্টিয়াতেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, মীর মোশাররফ হোসেনের মতোন অনেক মহান শিল্প সাধকের মানসিক ও দৈহিক জন্মস্থান, সাধনার পীঠস্থান। তিনি ‘পাবনার জামাই’ বলে স্বজনপ্রীতিতে নয় কিংবা আমার নিজের জন্মভুমি পাবনা হলেও নানা বিবেচনায় কুষ্টিয়াই আমার কাছে বাঙালির তীর্থস্থানের মর্যাদা পায়। সেই কুষ্টিয়ার ‘গৌরি’ বা গড়াই নদীর জল-হাওয়া বড় হয়েছেন তিনি। সেখানকার প্রকৃতির নিবিড় পাঠ তাকে শৈশবে কবি করে তোলে। করেছেন অভিনয়ও। কিন্তু সফল নাট্যকার মাসুম রেজার নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কৈশোরে, নিজের শহর কুষ্টিয়ায়, নাটকের দল ‘বোধন’- এর মাধ্যমে। শৈশবে কবি হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছে থেকেই লেখালেখি শুরু করেন মাসুম রেজা। কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গনের সব জায়গাতেই ছিলো সমান আগ্রহ। আর এ কারণে সেই শৈশবেই যোগ দেন কুষ্টিয়ার স্থানীয় নাট্যদল ‘বোধন’ এ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহারের সবুজ অঙ্গণ তার ছাত্র জীবনকে করে তোলে আরো বেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সেবক হয়ে ওঠেন শিল্পকলার, আরধনা করে যাচ্ছেন মানবিকতার মগ্ন চৈতন্যে নিমগ্নতায়। ‘হাউস হাজব্যান্ড’ মাসুম রেজার জীবনে জীবন যোগ ঘটে তার সেই মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাসেই। এরপর ঢাকায় চলে এলেও ‘নগরের নটী’ না হয়ে নাট্যশিল্পের মন্দিরে ‘নটীর পূজা’য় নিত্য নৈবদ্য, অঞ্জলি দিয়ে আপন আসনটি দখল করে নেন তিনি দ্রুতই। আগেই পরিচয় ঘটেছিলো নাট্যকার সেলিম আল দীনের লেখার সঙ্গে, ঢাকায় চলে আসার পরে আজন্মের শিক্ষক সেলিম আল দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত যোগাযোগ গড়ে ওঠে, ফলে তার শিল্পবোধের জগতের মোড় আমূল ঘুরে যায়। ‘এক রকম তাঁকে অনুসরণ করেই নাট্যকার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া’ বলে মাসুম রেজা ভাই কৃতজ্ঞতাসহকারে স্বীকার করে থাকেন। আমার সুযোগ হয়েছিলো সেলিম আল দীন স্যারের সাথে তাদের বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় উপস্থিত থাকার, শ্রোতা হওয়ার। সেই সব আলোকিত, আলোড়িত উচ্চারণের রঙধনু স্মৃতিগুলি মনে পড়ছে খুউব। এই সুযোগে আবারো আমাদের প্রিয় সেলিম আল দীন স্যারের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাও জ্ঞাপন করছি।

৩.
জন্মদিনে লিখতে বসে দেখলাম, মাসুম ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়ের পালা প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি হতে চললো। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক প্রেমের, প্রণয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার আর কী! মাসুম রেজা ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রধরের নামটি উল্লেখ না-ইবা করলাম। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ আরো বড় পরিসরে লিখেছি কিন্তু প্রকাশ করিনি, রচনাটি আলোর মুখ দেখার সময়ের অপেক্ষায় আছে। সেই অপ্রকাশের ভার আর হয়তো বেশিদিন বইতে হবে না আশাকরি। তবে সে বড় মধুর সময় ছিলো আমার জীবনে, আমার সেই তারও হয়তবা। যদিও ‘মধুরেণ সমাপণ’ ঘটেনি সেই সূত্রধরের সাধুসঙ্গ। দেশ নাটক দলে তাকে সঙ্গ দিতে গিয়ে, আসা-যাওয়ার পথের সঙ্গী হিসেবে বাড়তি পাওনা হিসেবে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে মাসুম রেজা ভাইয়ের সাথে, তাদের অনেকের সাথে প্রগাঢ়ও হয়। পরে এই পরিচয় আরো নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ হয় আমাদের দু’জনেরেই পরম গুরু নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যারের কল্যাণে। সেলিম স্যার ঢাকার বিভিন্ন নানট্যজনের আঙ্গিনায় আসতেন সাধুসঙ্গ উপভোগ করতে আর সাথে আমাদের মতোন একনিষ্ঠ সাহাবীদের জুটতো আলোকিত শিল্প সহবাস। ফলে আলোড়িত সেই সব শিল্প আড্ডার, নাট্য সাহিত্য আলাপন ক্ষণের ‘কালের স্বাক্ষী’ হয়ে উঠতে উঠতে একান্ত আপনজন হয়ে পড়ি মাসুম ভাইদের মতোন আজন্মের শিল্প সাধকদের নিবিড় সান্নিধ্য লাভের মাধ্যমে। মাসুম রেজা ভাইয়ের সাথে নানা সময়ের আলাপনের অনেক কথাই স্মরণে আসে। স্মৃতির জানালা খুলে স্মরণ করছি কিছুটা। যেমন, আমাদের জন্য তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘প্রত্যেক মানুষের জীবনই সবার সামনেই অনেক কিছু মেলে ধরে। সেখানকার কিছু জিনিষ আমার জন্য আবার কিছু জিনিষ আমার জন্য নয়। কোনটি নিজের জন্য আর কোনটি নিজের জন্য নয় সেটি বেছে নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করাটা সবার জন্যই জরুরি।’ অর্থৃাৎ সুবিবেচনা বোধের মাধ্যমে বাছাই করে গ্রহণ ক্ষমতা জীবনের জন্য জরুরি বিবেচ্য।

৪.
মাসুম রেজা ভাই নাটকপ্রাণ মানুষ, নাট্য প্রাণিত প্রাণ। সংলাপে শব্দ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন, দক্ষতার সাথে আশার আলো জ্বালাতে যেমন জানেন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও সম্ভাবনাময় শিল্পীর বিকাশের জন্য সহযোগিতার অকৃত্রিম হাত সম্প্রসারিত করেন। তাই আমাদের নাট্য সাহিত্যাঙ্গনে সম্মানের সাথে আলোচিত স্বজনের নামটিই- মাসুম রেজা। আপন সংস্কৃতি এবং নিজস্ব জীবন দর্শনকে ধারণ করেন তার রচনায়। জীবনের কথাই লেখেন, নাটকের সংলাপে উঠে আসে সরসতার আরকে সোমরস সুধা। নাটককে পেশা হিসেবে নিয়েছেন তিনি স্বীকার করলেও আমি মনে করি নাটক তাঁর নেশা এবং সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের, ঘটনার, অসঙ্গতির ‘প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার’। মুক্ত নাটক প্রচারের, প্রসারের একনিষ্ঠ যোদ্ধা মাসুম রেজার কাছে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের নাটক হয়ে উঠেছিলো মুক্ত নাটক। কেবল শস্তা বিনোদন নয়, সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ম্যাধ্যম হিসেবে, প্রতিবাদের কিংবা সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে নাটক সবসময়ই আলোচিত শিল্প মাধ্যম। ফলে তার রচনায় সমাজ ও রজনীতি অচ্ছুত নয় মোটেই। কারণ তিনি প্রবল রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে। পথে নেমেছেন, মিছিল করেছেন। যা তার গল্প, তার নাটকে, সংগ্রামে গতি ঢেলেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। তিনি সাংগঠনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নাটকের এই একনিষ্ঠ সাধকের শিল্পজীবন কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও অভিমুখ ঘুরে যায় নাট্যসাহিত্যের পথে।

৫.
মাসুম রেজার লেখা আমার পছন্দের ঊল্লেখযোগ্য কয়েকটি মঞ্চ নাটকের মধ্যে রয়েছে- নিত্যপূরাণ, আরজ চরিতামৃত, বিরসা কাব্য, জল বালিকা, শামুকবাস। টেলিভিশনে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে তার লেখা রঙের মানুষ এবং ভবের হাট। ২০০০-২০০১ সালে মঞ্চায়িত মহাভারতের আদলে নয়া মিথ একলব্যের কাহিনী নিয়ে নাটক নিত্যপূরাণ কতবার যে দেখেছি সে হিসেব বলতে পারবো না, তবে গোপন রহস্যটি ফাঁস করা যেতেই পারে। মাসুম রেজা ভাইয়ের রচনার গুণে, একলব্য আর দ্রোণাচার্যের পৌরাণিক কাহিনির প্রবল আকর্ষণের পাশাপাশি সূতোছেড়া সূত্রধরের নৃত্যাভিনয়ের প্রতি গোপন প্রীতির তীব্র টান অনুভবে মঞ্চে ছুটে গেছি বারংবার। নিত্য পূরাণের মাধ্যমে মাসুম ভাই বোধের বেদনার শূন্যস্থান পূরণ করেছেন একইসাথে আমাদের প্রত্যাশার বাসনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।নাট্যকার মাসুম রেজা ২০০০ সালে দেশনাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকটি নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। আমার বিবেচনায় মঞ্চনাটকের নির্দেশক হিসেবে এটা ছিলো তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি সৃজনশীল কাজ। অনেক বছর পর সম্প্রতি যোগ হয়েছে ‘সুরগাঁও’। দেশ নাটকের এই নাটকটিরও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন যেন নাটকটি আমার আজো দেখা হয়ে ওঠেনি। ফলে এটি নিয়ে মন্তব্য করা শোভন হবে না। বিভিন্ন মাধ্যমে নাটক লেখার অভিজ্ঞতা আর সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় লেখবার ধারার ভিন্নতা নিয়ে ১৯৯৬ সালে বিটিভিতে মাসুম রেজার প্রথম নাটক কৈতব প্রচারিত হয়েছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি মঞ্চের পাশাপাশি আমাদের টেলিভিশনেরও অন্যতম দক্ষ নাট্যকার। নিত্য পুরাণের পাশাপাশি মন দিয়ে দেখা, কান খাড়া করে সংলাপ শোনা নাটক ‘রঙের মানুষ’-এর কথা না বললেই নয়। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও তিনি দেখিয়েছেন প্রতিভার মুনসিয়ানা। মোল্লা বাড়ির বউ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার তিনি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ সিনেমাটিও একাধিকবার দেখেছি। ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্যের জন্য ২০১৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান দেশের মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের তুমুল জনপ্রিয় এই নাট্যকার।

 

৬.
পারিবারিক প্রয়োজনে মাঝে তাকে বেশ ক’বছর দেশের বাইরে থাকতে হয় বটে কিন্তু তিনি পুঁজির কিংবা বিত্তের দাস হননি প্রবাসে দৈবের বসে। সৃজনী চিত্তের আকুলতায়, প্রাণের শিল্পের টানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন, আপন মাটিতেই স্থিতু হওয়ার বাসনায়। শিল্প জীবন যাপনের সাথে পারবিারিক দায়িত্ব পালনহীনতার অরুচিকর নানান অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় আমাদের অনেককে নিয়ে, সেক্ষেত্রে মাসুম রেজা ব্যতিক্রমী ও উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি পরিবারের কাছেও যেমন দায়িত্বশীল মানুষ, তেমনি সামাজিক প্রাণি হিসেবে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি নিজস্ব দায়ও এড়ান না, কৌশলের আশ্রয় নেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তার স্ত্রীর নাম সেলিনা শেলী এবং এই দম্পতি দুই কন্যা সন্তানের জনক-জননী। তিনি প্রেমিক মানুষ- ঘাস ফরিঙের সাথে প্রভাতের দুর্বাঘাসের শিশিরবিন্দুতে প্রবলভাবে তাড়িত হন। তার রচনায় তাই জীবন ঘনিষ্ঠতার পরিচয় মেলে, নাগরিক অস্থিরতা, ব্যক্তিজীবনের দৈব-দুর্বিপাক, সমাজের অনালোচিত হাসি-কান্না-রসগুলো সবলবেগে ভাষা পায়, আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে।

৭.
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার সরব উপস্থিতি, দুষ্টুমিভরা সচিত্র সংক্ষিপ্ত রচনা আমার মতোন অনেককেই মুগ্ধ করে। এই নাট্যজন সকল প্রকার শিল্প বিকৃতির বিপক্ষে সরব। তার রচনায়, সৃষ্টিতে বিতর্ক তৈরির অহেতুক, অকারণ উত্তেজনার উত্তাপ নেই. আছে কঠিন সত্য অনুধাবনকে উপস্থাপন কুশলতা, সুস্থির মননের দৃপ্ত অঙ্গিকার-বোধের জাগরণ। সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি ও বিকাশে তার প্রকাশ ভাষা অনুসরণযোগ্য। প্রচারণার আলোয় নিজেকে তুলে ধরার অসুস্থ অস্থিরতা নেই তার মাঝে, আছে ভুমিপুত্র কৃষকের সৃজনী মনস্বীতা, মাঠের ফসলের সফলতার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। আত্মপ্রচারণার মানসিক বৈকল্য না থাকায় তিনি মন দেন সৃষ্টিতে, বিষয় থেকে প্রকরণের বৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা খোঁজেন। তার এই গুণ একালে বেশ বিরলই বটে। ব্যক্তি মানুষ এবং সৃজনশীল শিল্প স্রষ্টা, নাট্যজন মাসুম রেজা ভাইকে তাই আমার এত বেশি ভালো লাগে, তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।

৮.
কেবল শিল্পের জন্য শিল্প নয়- মানবিকতার চেতনাই যে জীবনের এবং শিল্পের মূল সত্য- সেই দর্শন ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকে মাসুম রেজা ভাইয়ের রচনায়, সৃষ্টিতে। তিনি মানবিক পৃথিবীর কথাই তুলে ধরেন, নিরন্তর ব্যস্ত আপন কন্ঠস্বরটি সুরের সাম্পানে ভাসাতে, শব্দজলে স্নাতক হতে তার মতোন সমকালে আর তেমন কাউকে খুঁজে পাই না। আমাদের সমকালীন নাট্য সাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ মানুষ, মননশীলতা সমৃদ্ধকরণ প্রচেষ্টার মহান কারিগড় মাসুম রেজা ভাইয়ের জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আনন্দ অনুভব করি। আমার ধারণা, একজন বিশুদ্ধ লেখক হিসেবে তিনি বেঁচে থাকতে চান, শিল্পজীবন যাপন করতে চান আমৃত্যু। আর তাই নাটকের সংলাপের সাথে তার গভীর প্রেম রয়েছে বলে স্বীকার করে থাকেন অকপটে। সাহিত্যের ধারা ও উপাদানগুলো বুঝতে পারেন বলেই মঞ্চসফল নাট্যকার হয়ে উঠেছেন তিনি। কাব্যসুধারসে জারিত তার নাট্য ভাষা, সৈয়দ শামসুল হকের পরে তাকেই সবচেয়ে শক্তিমান নাট্যকার বলে বিবেচনা করলে অতিরঞ্জণ হবে না। দর্শকের মনকে আবেগ তাড়িত করতে পারেন কিন্তু অহেতুক সুরসুরি দিয়ে নয়, সেটা মানব জীবনের জীবন্ত প্রতিকৃতি তুলে ধরে করেন।

৯.
প্রকাশিত হয়েছে মাসুম রেজার উপন্যাসও। ২০১০ সালে তিনি উপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে তার রচিত ‘মীন কন্যাদ্বয়’ এবং ‘গোলকিপার’ উপন্যাস দুটি অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় ‘ভাষাচিত্র’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা উপন্যাস ‘তুমুল প্রেমে ছোটভাই’। তবে তাঁর উপন্যাস পঠের সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি। তাঁর উপন্যাস নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদ ব্যক্ত করে ‘কথাসাহিত্যে স্বাগত মাসুম রেজা’ রচনায় শক্তিমান কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। উপন্যাসের ভুমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘ছাত্র জীবনেই মাসুম রেজা মহাশ্বেতা দেবীর বিখ্যাত উপন্যাস 'অরণ্যের অধিকার সামনে রেখে 'বীরসা কাব্য' নামে একটি মঞ্চোপযোগী নাটক লিখে আর সেটাকে নতুনরীতির অভিনয় কলায় মঞ্চস্থ করে আমাদের বিস্ময়বিমুগ্ধ' করে ফেলেছিলেন। তারপর অনেকটা সময় গেছে। প্রায় নিজের মধ্যে নিজে প্রচন্ড একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আজ বেরিয়ে এসেছে এসময়ের এক অবশ্য উল্লেখ্য নাট্যকার। তবে শেষ পর্যন্ত মঞ্চেই আটকে থাকেননি মাসুম, মঞ্চ কখনোই ছাড়েননি যদিও অসাধারণ বেশ কয়েকটি নাটক রচনা করেছেন, মঞ্চে তাদের স্থাপনও করেছেন, সেই সঙ্গে দখল নিয়েছেন ভিন্ন মাধ্যমগুলিরও খানিকটা করে জমি। আজ অনেক পরিণত বয়সে পৌঁছে মাসুম রেজা তাঁর কৃতির মাত্রা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে লিখেছেন একটি উপন্যাস, মীনকন্যাদ্বয়। কাহিনী এই নষ্ট হয়ে যাওয়া, নষ্ট-করে ফেলা, হতচ্ছাড়া সোনার বাংলাদেশের ও সমাজের। আমরা তো কিছুই করব না, করতে হয়তো চাই-ও না, পারিও না- আমরা শুধুই করুণ কাহিনী শুনতে চাই, পাঁচালি রচনা করতে চাই দুর্দশার, নির্যাতনের, সন্ত্রাসের। তা, মাসুমও শুনিয়েছেন আবার একটি হৃদয়বিদারক কাহিনী- দুটি প্রায় অস্ফুটযৌবনা কুমারীকন্যার হাঙরের-কুমিরের চোয়ালে আটকে পড়ার গল্প। তাতেই উঠে এসেছে বাংলাদেশ। মাসুম লিখেছেন উপন্যাস-কিন্তু দেখিয়েছেন দৃশ্যের পর দৃশ্য। যেমন মঞ্চে দেখা যায়। তাতে আঘাত আসে সরাসরি, ভাবনা-চিন্তা করার, আত্মরক্ষার সময় পাওয়া যায় না। যা দেখবার প্রত্যক্ষ দেখো, ভেবো পরে। এ একরকম পরীক্ষাই বটে-এক আকারকে গলিয়ে অন্য আকার বের করে আনা। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যই পরিকল্পিত, সংলাপবহুল। এই পরীক্ষায় মাসুম উৎরে গেছেন- উপন্যাস লেখার অজস্র ঢং-এর মধ্যে নতুন একটা ঢং দেখতে পাচ্ছি। মাসুমের দৃষ্টি স্বচ্ছ, ভাষা যথাযথ আর বলিষ্ঠ। এরপর থেকে তিনি অনুসৃত হবেন বলেই মনে করি।’ হাসান স্যারের বক্তব্যে মাসুম রেজার চরিত্রের অর্ন্তগত রূপের পরিচয় মেলে।

১০.
মাসুম রেজা নাটকে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬ সালে। এর আগে ১১ বছর নাটকে কাউকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘রঙের মানুষ’ (২০০৩-০৪) এর চিত্রনাট্যের জন্য শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ২০০৬ সালের মধুময়রা টেলিভিশন নাটকের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মেঘলা আকাশ (২০০১), মোল্লা বাড়ীর বউ (২০০৫) এবং বাপজানের বায়স্কোপ (২০১৫) চলচ্চিত্রের কাহিনী রচনা করেন। বাপজানের বায়স্কোপ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ২০১৫ সালে ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব পুরস্কার ঘোষণার পর বিতর্ক তৈরি হয়। একে দেয়া উচিত হয়নি, সে বেশি যোগ্য ছিল- এসব। আমার ক্ষেত্রে এমন কিছুই হয়নি। এটাই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে। এ রকম একটা পুরস্কার পাওয়া তো অনেক আনন্দের। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে যে আমি টেলিভিশন নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র খুব কম লিখি। কিন্তু তার মধ্যেই এবার দুটি শাখায় পুরস্কার পেলাম। এটা আমার জন্য অনেক ভালো লাগার।’

১১.
লেখক, নাট্যকার হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা বিষয়ে মাসুম রেজা বলেছেন, ‘অনুপ্রেরণা বলতে ছোটবেলা থেকেই লিখতে পড়তে ভালো লাগতো। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম কবিতা লিখি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় নাটক লিখি। পরে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তখন পুরোপুরি নাটকের সাথে জড়িয়ে গেলাম।’ নাটক নিয়ে একটি কথা তিনি বারবারই বলে থাকেন, ‘নাটক একটি সাধনার বিষয়। নাটক রচনাও একটা সাধনা। সেই সাধনার মধ্য দিয়েই নাটকের জন্য কাজ করতে হবে। পুরস্কারটি তখন এমনিতেই আসবে।’ আর এ প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘শিল্প মানেই সাধনা, শিল্পী সেখানে উপাসক। প্রার্থনার মতো শিল্পের চর্চা করতে হবে। সেটা না করতে পারলে শিল্পী হয়ে ওঠা যাবে না। থিয়েটার কিংবা টিভি নাটকে কাজের জন্য অবশ্যই সাধনা করতে হবে। এ সময়ের তরুণদের মাঝে অস্থিরতা বেশি। তাদের সামনে এখন অনেক অপশন। ফেসবুক, ইউটিউব, অনলাইনে প্রচুর সময় দিতে হচ্ছে। ফলে কখনো কখনো তরুণরা তার নিজের কাজটার কথা ভুলে যাচ্ছে। অনেক অপশন থাকাতে কোনটা করবে, কোনটা বাদ দিবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একসঙ্গে অনেক কিছু করতে চাই। তাদের বলব, নিজের স্বপ্নটাকে চিনতে হবে। তারপর সেই পথেই হাঁটতে হবে।’ আর থিয়েটার নিয়ে মাসুম রেজার গভীর অনুধাবন, ‘থিয়েটার হচ্ছে মুক্তচিন্তার শিল্প-মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেও থিয়েটার সাধনায় যদি মুক্তচিন্তার প্রকাশ না ঘটাতে পারি তবে কিসের থিয়েটার করবো? দেশে লালনের প্রতিকৃতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া হয়নি; ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বলাকার পাগুলো। আমরা কি চলতে ভুলে যাবো একদিন? থিয়েটার বেঁচে না থাকলে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঁচানো যাবে না। যে-কোনো মূল্যে থিয়েটারকে চলতে হবেই।’

১২.
সেলিম আল দীনকে শিল্পভাবনার গুরু বলে স্বীকার করেন মাসুম রেজা। স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘একটা সময় ছিলো সেলিম আল দীনের সঙ্গে সারাক্ষণ শিল্পকর্মে নিয়ে কথা হতো, কাজ হতো। আসলে তিনি আমার শিল্পভাবনার গুরু। তাঁকে আমি আমার জীবনের পরিপূর্ণ অনুসারী মনে করি। তবে দূরে রেখে আমি তাঁকে অনুসরণ করি। তিনি বেঁচে আছেন আমাদের সবার অন্তরে। সেলিম আল দীন শুধু নাট্যকার ছিলেন না। তিনি একজন বড়মাপের শিক্ষকও ছিলেন। যার শিষ্য স্বয়ং আমি। আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি যে তাঁর মতো একজন গুরু পেয়েছি। আমরা সাধারণত শিক্ষক বলতে বুঝি ক্লাস মধ্যে তা কর্ম সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন ছিলেন। শুধু ক্লাস নয় সর্বক্ষণেই তিনিই তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। এমনকি বিকেলে তিনি হাঁটতে বেড়িয়েছেন তখনও শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে যেতেন। নাট্যকার সেলিম আল দীন আসলে খুব বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তিনি তো শুধু নাট্যকার ছিলেন না, একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, গবেষক, চলচ্চিত্রকারও ছিলেন। এছাড়াও প্রজন্মের কাছে নাট্যতত্ত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য সেলিম আল দীন নাট্যকোষ গবেষণা করে গেছেন। যেখানে, পাঁচালি থেকে শুরু করে লালন, ঘেটুপুত্র’র বড় বড় নাট্যের সবধরণের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর এ গবেষণা থেকে বেড়িয়ে এসেছে বাংলা নাট্যভাণ্ডার কারো কাছে ঋণী নয়।’

১৩.
খ্যাতিমান নাট্যকার ও লেখক মাসুম রেজা নাট্যকার সংঘের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তার ইতিবাচক ভূমিকা আমাকে এই শিল্পক্ষেত্রের বিকাশে আশাবাদী করে তোলে। আমরা জানি, ঢাকার টিভি নাটক নির্মাণে বছরে লগ্নি হয় ৮০০ কোটি টাকা। অথচ টিভি নাটককে এখনো শিল্প ঘোষণা করা হয়নি। এ নিয়ে হতাশ টেলিভিশন নাটক-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এবার তাঁরা দাবি করলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে নাটককে শিল্প ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন টেলিভিশন-সংশ্লিষ্ট ছয় সংগঠনের নেতারা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে আয়োজিত সম্মেলনে পাঁচটি দাবি তুলে ধরে টিভি নাটকের সংগঠনগুলো। মুদ্রিত প্রস্তাব পড়েন নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা। তাঁদের প্রধান দাবি, বাংলাদেশে পরবর্তী সরকারকে টেলিভিশন নাটককে শিল্প ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়া, সংগঠনগুলোর সুপারিশগুলো তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়ন এবং সম্প্রচার নীতিমালা বাস্তবায়নে তাঁদের সম্পৃক্ত করা, পে-চ্যানেল বাস্তবায়ন, টিআরপি পদ্ধতিকে গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত করা এবং টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে প্রযোজকদের পাওনা টাকা আদায়ে সরকারের মধ্যস্থতা।

১৪.
সম্প্রতি এক দৈনিকে প্রকাশিত ‘আমরা কি চলতে ভুলে যাবো’ বিশেষ রচনায় মাসুম রেজার বাস্তবতার লেখনী, আশাবাদী ভাবনা আমাকে গভীরভাবে প্রাণিত করেছে। তিনি লিখেছেন, ‘জঙ্গীবাদের উত্থানও আমাদের সারা দেশের নাটককে ব্যাহত করলো। এটা খুবই দুঃখের কথা । যাদেরকে পরাজিত করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, পেয়েছিলাম মুক্ত দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার সুযোগ, যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছিলো আমাদের থিয়েটার চর্চা, আজ তাদের জন্যেই দেশের কত জায়গায় নিরাপদে নাটকের প্রদর্শনী করা যাচ্ছে না। নাটকের উপর একটা অলিখিত সেন্সর চেপে বসেছে। নাটকের গল্প, চরিত্রের নাম, নির্দেশনার ধরণ সবই যেনো এখন একটা গোষ্ঠিকে মাথায় রেখে নির্ধারণ করতে হয়। থিয়েটার হচ্ছে মুক্তচিন্তার শিল্প-মাধ্যম। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেও থিয়েটার সাধনায় যদি মুক্তচিন্তার প্রকাশ না ঘটাতে পারি তবে কিসের থিয়েটার করবো? দেশে লালনের প্রতিকৃতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া হয়নি; ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বলাকার পাগুলো। আমরা কি চলতে ভুলে যাবো একদিন? থিয়েটার বেঁচে না থাকলে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঁচানো যাবে না। যে-কোনো মূল্যে থিয়েটারকে চলতে হবেই।’

১৫.
‘তারা ফিরে আসে ফিরে যায়’ রচনায় মাসুম রেজার আত্মকণও আমাকে ছুঁয়ে যায় কেন যেন। একজন নিত্য সৃজনশীল শিল্পস্রষ্টা হিসেবে তিনি অকপটে স্বীকার করছেন, ‘মঞ্চের জন্য লেখা নিত্যপুরাণ নাটকের একলব্য ও দ্রৌপদী চরিত্র দুটো। আমার আরেক দুর্বলতা। চরিত্র দুটো আমি মহাভারত থেকে কর্জ নিয়ে আমার নিত্যপুরাণে স্থাপন করেছি। কিন্তু রচনা শেষে তারা কোনোভাবেই মহাভারতের কেউ বলে বোধ হয়নি। বোধ হওয়ার কোনো উপায়ও নেই। কারণ মহাভারতে দ্রৌপদীর সাথে একলব্যের সাক্ষাৎ হয়নি কখনোই। হয়েছে আমার নিত্যপুরাণে। একজন নিষাদরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র নিম্নবর্ণ একলব্য, আরেকজন পঞ্চপাণ্ডবের ভাগ্যবিড়ম্বিত ভার্যা দ্রৌপদী। পাঁচ স্বামীর এক স্ত্রী দ্রৌপদীকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি- তার পঞ্চস্বামীর ভার্যা হতে মত আছে কি-না? দুই ভাগ্যহত নর-নারী আমার নিত্যপুরাণে নিজেদেরকে খুঁজে পায় একান্ত আলাপনে। একলব্যের অপূর্ব বাচনশৈলীর আঘাতে দ্রৌপদীর চক্ষু উন্মীলিত হয়। দু'জনেই বুঝতে পারে, ওদের কেউই প্রকৃত ভালোবাসার স্বাদ কখনোই পায়নি। তাদের এই অসহায় অবস্থান আমাকে বিমর্ষ করে। মন খারাপ লাগে আমার। সৃষ্ট চরিত্রের সাথে আমার সম্পর্ক এ রকমই। তবে আরেকটা একলব্য বা আরেকটা দ্রৌপদী আমি আর কখনোই তৈরি করব না। আমি যেমন আমার চরিত্রকে ভালোবাসি, তেমন উপেক্ষাও করি; দূরে ঠেলে দিই। ঠেলে ফেলে দিই পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায়।’

১৬.
‘বিশ্বময়ীর বিশ্বমায়ের আঁচল’ পাতা বাংলাদেশের জানালা দিয়ে সারাবিশ্বকে দেখার নাট্যশিল্প পর্যটক মাসুম রেজা ভাইকে আবারো তার জন্মদিনে সুস্থ ও আনন্দময় ভবিষ্যত জীবন কামনা করছি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত