লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিখাইল কালাশনিকভ

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:১৯

কলম হাতে যিনি লিখেছিলেন শান্তির কবিতা, সেই একই হাতে তিনি তৈরি করেছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র 'আভতোমাত কালাশনিকোভা ১৯৪৭'— যার অর্থ 'স্বয়ংক্রিয় কালাশনিকোভা রাইফেল ১৯৪৭ মডেল'। সংক্ষেপে 'একে-৪৭'। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিখাইল কালাশনিকভ। তিনি কবিতা লিখতেন, কবিই হতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছয়টি গ্রন্থ, কবিতা লিখেই সারাটি জীবন কাটিয়ে দেবেন- এরকমই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তা অার হয়ে উঠে নি। জানলে অবাক হতে হয়, মিখাইল কালাশনিকভ শুধুমাত্র কবিতাতেই নিবদিত হতে চেয়েছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি। রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করলেও আজীবন কবিতার সাধনা ছাড়েন নি কালাশনিকভ। ২০০৯ সালে তিনি বলেছিলেন, "আমি ছাড়াও এখানে আরও খারাপ কবি আছেন। আমি একাই ভিন্ন পথে চলে গেছি।"

২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর মারণাস্ত্র একে-৪৭ রাইফেলের উদ্ভাবক মিখাইল কালাশনিকভ ৯৪ বছর বয়সে রাশিয়ার উদমুরত প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ইজহভস্কে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় তাঁকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বীর ও একসাথে দুবার 'সমাজতান্ত্রিক শ্রমবীর' উপাধি দেওয়া হয়েছে।

জেনারেল কালাশনিকভের পূর্ণ নাম মিখাইল তিমোফিয়েভিচ কালাশনিকভ। তিনি সাবেক সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একজন লেফটেনেন্ট জেনারেল। ১৯১৯ সালের ১০ নভেম্বর সাইবেরিয়ার আলতাই অঞ্চলে কুরিয়া নামের গ্রামে এক কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মিখাইল কালাশনিকভের বাবা টিমোফি আলেক্সান্দ্রোভিচ কালাশনিকভ ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত চাষী, তাঁর মা আলেকজান্দ্রা ফ্রোলোভনা কাবেরিনা কখনো লেখাপড়া শেখেন নি। এই দম্পতির উনিশ সন্তানের মধ্যে আটজনই মাত্র বেঁচে যায়। অন্যদের মৃত্যু হয় জন্মলগ্নে বা শৈশবকালে। মিখাইল কালাশনিকভ ছিলেন এই দম্পতির সতেরতম সন্তান। ছয় বছর বয়সে তিনিও মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি এসে ফিরে গেছেন।

রুশ বিপ্লবের পর থেকে অবস্থাপন্ন কৃষকদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। ১৯৩০ সালে টিমোফি আলেক্সান্দ্রোভিচকে ‘কুলাক’-জোতদার সাব্যস্ত করে বাস্তুচ্যুত করে এবং স্তালিন শাসনামলে গোটা পরিবারকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া হয়। তরুণ কালাশনিকভের জন্য তা ছিল এক ভয়ঙ্কর জীবন। ১৯৩৮ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়। প্রথমদিকে ট্যাংক ড্রাইভার ও মেকানিক পদে। যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজে নান্দনিক দক্ষতা তাঁকে স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বাদশ ট্যাংক ডিভিশনের ২৪ রেজিমেন্টে তিনি ট্যাংক কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালের অক্টোবরে ব্রায়ানস্ক প্রতিরক্ষার সময় তিনি অাহত হন। চিকিৎসা ও সুস্থতার জন্য তাঁকে ছয় মাসের ছুটি মঞ্জুর করা হয়। হাসপাতালে অবস্থানকালে সাধারণ সৈন্যদের কথায় ফুটে ওঠা অাক্ষেপ থেকে তিনি বুঝতে পারেন, জার্মানদের অস্ত্র স্বয়ংক্রিয়, অার তাদের অস্ত্র হাতে টানা। এরপর থেকে রাতে ঘুম হতো না কালাশনিকভের। ছুটিতে থাকাকালেই একটি অাধুনিক কারবাইন তৈরির ধারণা তাঁর মাথায় আসে। নিজের ধারণাকে কাজে লাগাতে তিনি মাতাই অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনে যান। কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। তিনি আমেরিকান এম-১ এবং জার্মান এসআইজি-৪৪ এর ডিজাইনের সর্বোত্তম কৌশলের সমন্বয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। অনেক খেটেখুটে ১৯৪৪ সালে তিনি একটি কারবাইনের ডিজাইন তৈরি করেন। কিন্তু তাঁর ডিজাইন কর্তৃপক্ষের পছন্দ হলো না। তিনি ব্যর্থ হলেন, তবুও দমে যান নি। ১৯৪৬ সালে তাঁর উদ্ভাবিত একে-৪৭ রাইফেলের পূর্ববর্তী সংস্করণ ‘একে-৪৬’ সরকারিভাবে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীতে পরীক্ষা করা হয়। ১৯৪৭ সালে রেড আর্মির কয়েকটি নির্দিষ্ট ইউনিটে তাঁর রাইফেল গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৯ সালে প্রতি মিনিটে ৬ শ’ গুলিবর্ষণে সক্ষম তাঁর উদ্ভাবিত রাইফেল সোভিয়েট সেনাবাহিনীতে পূর্ণমাত্রায় চালু করা হয়। দুই বছরের মধ্যে একে-৪৭ সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সে সময় থেকে এ রাইফেল সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অন্যতম রপ্তানি সামগ্রীতে পরিণত হয়। একে-৪৭ রাইফেল অত্যন্ত কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য হওয়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি এম-১৬ রাইফেল ফেলে দিয়ে এ অস্ত্র গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত্য ৫০টিরও বেশি দেশ এবং অসংখ্য গেরিলা গ্রুপ এ অস্ত্র ব্যবহার করছে। তবে সাবেক ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোতে পাইরেসি হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতি হয় ২ শ’ কোটি ডলার। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও সোভিয়েত যুগে একে-৪৭ রাইফেলের পেটেন্ট সংরক্ষণ না করায় কালাশনিকভ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ১৯৯১ সালে স্বত্ব সংরক্ষণ করার আইনি লড়াইয়ে তিনি হেরে যান। ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি উদমুরত প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ইজহভস্কে বসবাস শুরু করেন। ৭ দশমিক ৬২ এমএম ক্যালিবারের এ রাইফেল উদ্ভাবনের জন্য তিনি স্তালিন মেডেল লাভ করেন। ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর জন্মদিনে রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ তাঁর হাতে ‘হিরো অব রাশা’ পদক তুলে দেন। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে কালাশনিকভ নিজের লেখা একটি দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি করেন।

চল্লিশের দশকে সে সময়টিতে মিখাইল কালাশনিকভের কাছ থেকে বিশ্ববাসী পেয়েছিল ধ্রুপদি নকশার সহজলভ্য, শক্তিশালী আর পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই মারাত্মক এ আগ্নেয়াস্ত্রটি। ধ্রুপদি নকশার জন্য লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়ামে ২০১১ সালে যেসব পণ্য নির্বাচিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল একে-৪৭। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের নাম একে-৪৭। নামকরণ হয়েছিল তাঁর নামেই। অাগ্নেয়াস্ত্রটির নকশা খুবই সাদামাটা এবং এটি তৈরি করতে খরচও খুব কম। এ ছাড়া অস্ত্রটির রক্ষণাবেক্ষণও সহজ। বিশ্বে বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি কালাশনিকভ রাইফেল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ রাইফেল আবিষ্কারের জন্য মিখাইল কালাশনিকভ সেকালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে সম্মানিত হন। তবে তিনি যে আর্থিকভাবে খুব বেশি লাভবান হননি সে কথা একটু অাগেই অালোচনা করা হয়ে গেছে।

অমর হয়ে অাছেন কবি মিখাইল কালাশনিকভ। কবিতার কারণে নয়, অাগ্নেয়াস্ত্র উদ্ভাবন করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা তাদের এম-১৬ রাইফেল ছুড়ে ফেলে নিহত কিংবা গুরুতর আহত ভিয়েতনামি সৈন্যের একে-৪৭ ছিনিয়ে নিয়েছে। সত্তর বছর পরও রুশপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন, "কালাশনিকভ রাইফেল হচ্ছে জনগণের সৃজনশীলতার প্রতীক।" মোজাম্বিকের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কালাশনিকভের রাইফেলকে ঠাঁই দিয়েছে তাদের জাতীয় পতাকায়। মোজাম্বিকের অনেক বিপ্লবী তাদের পুত্রসন্তানের নাম রেখেছে কালাশ। ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ এই অস্ত্রটির সঙ্গে এতই পরিচিত ছিলেন যে, ক্ষমতাসীন হয়েই এক লক্ষ একে-৪৭ রাইফেল ক্রয়াদেশ দিয়েছিলেন। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতেরও প্রিয় অস্ত্র ছিল এটি। বিখ্যাত বিপ্লবী রাস্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে একে-৪৭ রাইফেলসহ- ছবিটির নাম হয়ে গেছে 'কাস্ত্রো কালাশনিকভ'। বিশ্ববিপ্লবের প্রতীক চে' গুয়েভারার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল কালাশনিকভের এই অস্ত্র। সান্দানিস্তা গেরিলারা একে-৪৭ দিয়ে জয় করলেন নিকারাগুয়া। কুর্দি ও কারেন বিদ্রোহীদের হাতে কালাশনিকভ। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়, একে-৪৭ এর মতো ভয়ংকর মারনাস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, "আমার তৈরি অস্ত্র দিয়ে যখন সন্ত্রাসীদের গুলি চালাতে দেখি, তখন কষ্ট পাই।"

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত