তারেক মাসুদ

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:০১

১.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র বানিয়ে এ দেশের দর্শক হৃদয় কাঁপিয়েছিলেন তারেক মাসুদ। স্বপ্রশিক্ষিত একজন চলচ্চিত্রকার ছিলেন তারেক মাসুদ। তিনি শুধু বাংলাদেশের শিল্প-চলচ্চিত্র সৃষ্টির ধারাকেই এগিয়ে দেননি, একে বিশ্বমুখীনও করেছিলেন। তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্র কেবল কাহিনি-কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এগুলোর মধ্যে সমকালীন সমাজব্যবস্থার নানা প্রসঙ্গ যেমন মানবজীবন, লোকসংস্কৃতি, ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র, জগত্ প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর ভাবনাও স্থান করে নিত। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের জন্য এক কালো দিন ১৩ আগস্ট। বাংলা সিনেমার বিখ্যাত স্রষ্টা জুটি তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীরের মৃত্যুবার্ষিকী ১৩ আগস্ট। আমরা জানি, আমাদের জন্য এপ্রিল নয়, আগস্টই শোকের মাস। ২০১১ সালের এদিনেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন। বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের এক সংশপ্তক তারেক মাসুদ, আরেকজন মিডিয়ার গুরু মিশুক মুনীর। নিজেদের সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছিলেন এই দুই গুণী ব্যক্তিত্ত্ব।

২.
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার সালজানা গ্রামে ‘কাগজের ফুল’ ছবির লোকেশন দেখে ঢাকা ফেরার পথে ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তারেক মাসুদ- মিশুক মুনীরদের বহনকারী মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-০৩০২) সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গাগামী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪২৮৮) মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর, মাইক্রোবাসের চালক মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোডাকশন সহকারী মোতাহার হোসেন ওয়াসিম ও জামাল হোসেন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তাঁর স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেক মাসুদের সহকারী মনীশ রফিক আহত হন। 

৩.
নিজের ট্রাজিক নিয়তিকে কি তবে তারেক টের পেয়েছিলেন ? তা না হলে লিখবেন কেন, ‘আমার মনে হয় কিছু কিছু জাতি আছে, যারা অমৃত সম্ভাবনাময়। কিন্ত ট্রাজেডির যে চরিত্র, সেটা হচ্ছে অসম্ভব সম্ভাবনাময় অথচ সামান্য একটি ছোট জায়গায় সেই বিরাটত্বের থমকে যাওয়া। এটা একটা জাতির বৈশিষ্ট্য। আমাদের জাতির নিয়তি কি না, জানি না। আমরা বঙ্গবন্ধু থেকে জহির রায়হান, আলমগীর কবিরকে হারিয়েছি’(চলচ্চিত্রযাত্রা, পৃষ্ঠা : ৬৭)।

৪.
বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের এক সংশপ্তক তারেক মাসুদ। এই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটির মর্মান্তিক মৃত্যুতে অপূরনীয় ক্ষতি সাধিত হয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এবং বাংলাদেশের। চলচ্চিত্র অন্তপ্রাণ এই মানুষটির এভাবে চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক প্রলয় আঘাত। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত-এর মাধ্যমে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ ১৯৮২ সালে। এরপর নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ যা তাঁকে এনে দেয় দেশজোড়া সুখ্যাতি। নির্মাণ করেন আরও অনেকগুলো শিল্পমন্ডিত চলচ্চিত্র। মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র খুবই শক্তিশালী একটি মাধ্যম। সেই মাধ্যমকে যথার্থভাবে কাজে লাগিয়ে তারেক মাসুদ বরাবরই ভিন্নধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা আমৃত্যু করে গেছেন। তারেক মাসুদের মননশীল ভাবনায় সমৃদ্ধ লেখা ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বইটি নিয়ে ইতিপূর্বে আমরা এক স্মরণ আলোচনার আয়োজন করেছিলাম। আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনীদের পক্ষ থেকে অকাল প্রয়াত এই ঋদ্ধিমান পরিচালকের প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়েছিলাম তাঁর রচনাগ্রন্থ পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমেই। ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নিয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেছিলামও আমি। সেদিন আমাদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন তারেক মাসুদের যথার্থ অর্থেই সুযোগ্য জীবন ও মনন সঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ।
 
৫.
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি ও মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আশির দশকের মধ্যভাগে শুরু হওয়া স্বাধীনধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রগণ্য পরিচালক তিনি। চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতানের জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত (১৯৮৯) নির্মাণের অংশ হিসেবে প্রায় সাত বছর তিনি শিল্পীর সান্নিধ্যে কাটান এবং সেই সময়েই তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় তারেক মাসুদ নিজেকে যুক্ত করেন।

৬.
মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজনির্ভর প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান (১৯৯৫)-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তারেক মাসুদ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পকালীন প্রবাসজীবনে তিনি আবিষ্কার করেন মার্কিন পরিচালক লিয়ার লেভিনের ধারণকৃত ১৯৭১ সালের ফুটেজ যা তার জীবনের ধারা বদলে দেয়। লিয়ার লেভিনের ফুটেজ ও পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটেজ মিলে তিনি ও আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মিলে নির্মাণ করেন মুক্তির গান যা জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড-এর পরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। মুক্তির গান ‘ফিল্ম সাউথ এশিয়া’ (১৯৯৭) থেকে বিশেষ সম্মাননা অর্জন করে। মুক্তির গান সারা দেশে বিকল্প পরিবেশনায় প্রদর্শিত হয় এবং বহুল জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্রটি দেখে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তার ভিত্তিতে ভিডিও চলচ্চিত্র মুক্তির কথা (১৯৯৯) নির্মিত হয়। মুক্তির কথা প্রাধান্যশীল মধ্যবিত্তের বয়ানের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিন্ন ভাষ্য নির্মাণ করে।

৭.
মুক্তির গান তারেক মাসুদকে দেশে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র মাটির ময়নার (২০০২) মাধ্যমে তারেক মাসুদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। মাটির ময়না ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কারের আওতায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশে নির্মিত সবচাইতে আলোচিত চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা-পরবর্তী বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মাটির ময়না পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক মনোযোগ পায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এটি পরিচালকের আত্মজৈবনিক এক চলচ্চিত্র যাতে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক বালকের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা ছাড়াও বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও দর্শন প্রতিভাত হয়েছে। মাটির ময়না ইউরোপ ও আমেরিকায় বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা হলে মুক্তি পায় এবং বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্রটির ডিভিডিও প্রকাশিত হয়।

৮.
তারেক মাসুদের (১৯৫৬-২০১১) উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো অন্তর্যাত্রা (২০০৬), নরসুন্দর (২০০৯) এবং রানওয়ে (২০১০)। অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে বার বার শেকড়ের টানে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের নরসুন্দর চলচ্চিত্রে প্রাধান্যশীল মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের বিনির্মাণ দেখা যায় যেখানে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ধাওয়া খেয়ে পলায়নরত এক মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় বিহারী নরসুন্দররা, যাদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা আছে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। রানওয়ে চলচ্চিত্রে সমসাময়িক বাংলাদেশের নানান ইস্যুকে মোকাবেলা করা হয়েছে, বিশেষত ২০০৪-০৫ সালের জঙ্গিবাদের সমস্যাকে আলোকপাত করা হয়েছে।

৯.
জাতীয় আত্মপরিচয়, লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতি তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে বিশেষ গুরুত্বসহকারে চিত্রিত হয়েছে। যেজন্য তার বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যে ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় আত্মপরিচয় সুনির্দিষ্ট হয়েছে। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নির্মীয়মান চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর বিষয়বস্তু ছিল ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ। তারেক মাসুদ বাংলাদেশের প্রথম ভিডিও চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫), প্রথম অ্যানিমেশন-চিত্র ইউনিসন (১৯৯৪) ও প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র অন্তর্যাত্রা নির্মাণ করেন। স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের সহ-পরিচালনা ও সম্পাদনার কাজ করেছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন মিলিয়ে তারেক মাসুদ মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

১০.
‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৪০ বছর : গলা সাধা বনাম কান সাধা’ প্রবন্ধে তারেক মাসুদ নিজেকে উন্মোচন করেছেন সততার সাথে,‘সত্তরের দশকের সাহিত্যমনস্ক যেকোনো তরুণের মতো আমিও চলচ্চিত্রমাধ্যমকে খাটো করে দেখতাম। সবকিছু বদলে গেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ (বিএফএস) আয়োজিত একটি মার্কিন প্রামাণ্যচিত্র দেখার মধ্য দিয়ে। মাদ্রাসাভিত্তিক শৈশব ও রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবারে বড় হওয়ার কারণে দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক বা জনপ্রিয় ধারার সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে একরকম মুক্ত ছিলাম। তাই চলচ্চিত্রশিল্প মাধ্যমের সঙ্গে আমার পরিচয় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন তথা মুহম্মদ খসরুর মাধ্যমে’(পৃ:৪৭)। তারেক ছিলেন রীতিমতো সিরিয়াস পাঠক। বিএফএস অফিসে চলচ্চিত্রসহ নানা বিষয়ের বইগুলো দেখে তিনি বিস্মিত হন। ওই বইগুলো পড়ার লোভেই সে অফিসে যাতায়াত বাড়িয়ে দেন। সেই সাথে চলে নিয়মিত বিশ্বখ্যাত সিনেমা দেখা। হয়ে ওঠেন লেখকও। ফলে ছবি নিয়ে লিখতে বসে তাঁর চলচ্চিত্র পাঠ করে তোলে ভবিষ্যতের সফল ‘চলচ্চিত্রনির্মাতা’। যে দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারেক তৈরি হয়েছেন তার জন্য তিনি মুহম্মদ খসরুর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন,‘সংসদ আন্দোলনের কাছে, মুহম্মদ খসরুর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। সে কারণেই যতবার খসরু ভাইয়ের গালাগালি খেয়েছি, ততবারই তাঁর সঙ্গে আমার গলাগলি আরও বেড়েছে’(চলচ্চিত্রযাত্রা, পৃষ্ঠা : ৪৯)।

১১.
প্রখ্যাত ইরানি আব্বাস কিয়েরোস্তামি বলেছিলেন,‘ছায়াছবি এক মিথ্যার শিকল, যার মাধ্যমে আমরা একটা বৃহত্তর সত্যে পৌঁছাই।’ কিয়েরোস্তামি’র এই বক্তব্যে প্রাণিত হয়ে সিমেনা সম্পর্কে নিজের ভাবনায় তারেক বলছেন,‘আমার কাছে ছবি বানানো হলো চূড়ান্ত রকমের বাহ্যিক একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও অর্ন্তমুখী এক যাত্রা; সর্বোচ্চ রকমের সামষ্টিক একটা প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে ব্যক্তিক কল্পনার রূপায়ণ। শুটিং হচ্ছে প্রতিটি দৃশ্যায়নের মাধ্যমে বাস্তবতা ও চিত্রনাট্যকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলা, আর সম্পাদনা হলো ছিন্ন বাস্তবতাকে জোড়া লাগানো। শুটিং অনেকটা বাজার করার মতো, আর সম্পাদনা হলো হেঁশেলে রান্না করা। একটা গদ্য, আরেকটা কবিতা। কিন্ত দুই প্রক্রিয়ারই একটা সাধারণ লক্ষ্য আছে- একটি খেয়ালি আয়তক্ষেত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।... ছবি বানানো হলো একটা কুৎসিত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আমরা বৃহৎ সৌন্দর্যের কাছে যেতে চাই। সত্য ও সৌন্দর্যের পথে যাত্রা সবসময়ই ছলনাময়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় পাই, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী! ’(অন্তর্যাত্রা, বহির্যাত্রা : সিনেমা যখন সহযাত্রী, চলচ্চিত্রযাত্রা, পৃষ্ঠা : ৪২)। 

১২.
‘তবে আমিও ‘কুয়াশা’ ছিলাম’ লেখায় পাই আরেক তারেককে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন লেখক শিবিরের সঙ্গে সম্পর্ক, আহমদ ছফার সান্নিধ্য, বন্ধুমহল ইত্যাদি সম্পর্কে সরস বর্ণনা আছে লেখাটিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলে শুরু হয় তারেকের নবজীবনযাত্রা। ক্লাসের তথাকথিত লেখাপড়া তাঁকে তেমন টানতে পারেনি। তারেক বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আমার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমি বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। মুনতাসীর মামুন আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। তারপরও প্রশ্রয় দিতেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম আমার শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আহমদ শরীফ। আমি তাঁর খুব ভক্ত ছিলাম।... বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে আহমদ ছফার সান্নিধ্য’(পৃ:৫৪)। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এই যে চার-পাঁচ বছর আমার কেটেছে, এর পুরোটাই আমার কাজে লেগেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যে ধরনের প্রস্তুতির দরকার, প্রকারান্তে তা-ই ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তোলা জলে আমার স্নান নয়।’ আমার ওই বিশিষ্টতা নেই যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করব, তবে আমি ঠিক উল্টো বলব। আমার যে শিক্ষা-দীক্ষা, তার পুরোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, কিন্ত ক্লাসের ভেতরে নয়, ক্লাসের বাইরে ক্যাম্পাসে। কারণ, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাগুলো খুবই সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক হতো’(পৃ:৫৬)। একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা, দারিদ্র্য ও অর্থাভাবে কাটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অকপট স্মৃতিচারণ করে এই তারেকই বলেছেন,‘একবেলা খেতে পারিনি-এমন অনেক সময় হয়েছে, কিন্ত সেটা আমল করিনি। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার প্রাপ্তি অনেক’(চলচ্চিত্রযাত্রা, পৃষ্ঠা : ৫৭)। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন নস্টালজিক এই মানুষটি। তা আর হয়ে ওঠেনি, নিয়তির নির্মম পরিহাসে উঠবেও না। আমরা বঞ্চিত হলাম তারেকের আরেকটি সৃজনীসৃষ্টিকর্ম থেকে। এই হাহাকারের কোন শেষ নেই।

(তথ্যসূত্র ; বাংলাপিডিয়া, চলচ্চিত্রযাত্রা: তারেক মাসুদ, দৈনিক প্রথম আলো, সমকাল, ইন্টারনেট)