হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:০৩

১.
‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’, উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মহান এই জননেতা ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকায় সুধী সমাজের কাছে তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে আখ্যায়িত হন। জনগণের প্রতি অসীম ভালোবাসা এবং গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দেশ ভাগের আগে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি অখণ্ড স্বাধীন বাংলা নামে একটি ‘ডমিনিয়ন রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। 

২.
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (জন্ম: ৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২ - মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৩) ১৯২১ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা এবং পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রী, ১৯৪৩-১৯৪৫ সালে খাজা নাজিমউদ্দীন মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী, ১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪-৫৫ সালে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী এবং ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা এ অঞ্চলের জনগণ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। উপমহাদেশের মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় গণমানুষের সংগঠন আওয়ামী লীগ আরো বিকশিত হয়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকাশে তিনি আজীবন কাজ করেছেন। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে এ মহান নেতার জীবন ও আদর্শ আমাদেরকে প্রেরণা জোগাবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও কর্ম আজও নতুন প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।

৩.
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে, বঙ্গবন্ধুর লেখনীতে প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছেন ভাসানী, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ খ্যাতিমান। ইতিহাসের এই প্রামাণ্য দলিলে গল্পচ্ছলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের নানা কথা আর বাংলার মানুষের ওপর শোষণ ও বঞ্চনার ধারাবাহিক ইতিহাস বলে গেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাষানী, এ কে ফজলুল হক থেকে শুরু করে অনেক চরিত্রেরই দেখা পাওয়া যায় বইটিতে। এ ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে মানবিক করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু । তিনি জানিয়েছেন, তাঁর সংগ্রামময় জীবনে এ মানুষগুলোর স্থান কতখানি। বইয়ের প্রতিটি পরতে পরম যত্নে এ মানুষগুলোর অবদানের কথা লিখে গেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেই রাজনৈতিক গুরু মেনেছিলেন শেখ মুজিব। রাজনীতির একেবারে শুরু থেকেই সোহরাওয়ার্দীর আদর্শেই চলেছেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাই সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবটাই ছিল সবচাইতে বেশী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মুজিব সম্বোধন করতেন শহীদ সাহেব বলে। স্মৃতিকথায় অসংখ্যবার তার প্রসঙ্গ এসেছে। শুধুমাত্র আদর্শ হিসেবে নয়, তাকে পিতৃতুল্য মনে করতেন মুজিব। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন ও বিশ্বাস করতেন। কারণ, তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তার সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এজন্য তাকে বার বার অপমানিত ও পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।’ সোহরাওয়ার্দীকে বঙ্গবন্ধু একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা উল্লেখ করেছেন। মুসলিম লীগের সীমাহীন দুর্নীতি-অবিচার আর পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার মানুষ এক সময় হয়ে পরে দিশেহারা। বড় অস্থির তখন মুজিব। আওয়ামী লীগ গড়তে যেয়ে হোঁচট খাচ্ছেন বারবার। সে সময় মুজিবের পাশে এসে দাঁড়ান শহীদ সাহেব। সেই অসাম্প্রদায়িকতাকেই ধারণ করেন মানসপটে। মুজিব জানিয়েছেন, ‘তিনি ঢাকায় আসলেন, ঢাকায় জনসভায়ও বক্তৃতা করলেন। পাকিস্তান হওয়ার পর বিরোধীদলের এত বড় সভা আর হয় নাই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা, বন্দিমুক্তি, স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে বক্তৃতা করলেন। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল।’ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা পরিচয় পাই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীদের মতোন মানুষদের সাহচর্য্যেই জনগণ অন্তঃপ্রাণ শেখ মুজিব কিভাবে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।

৪.
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর কনিষ্ঠ সন্তান। জাহিদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা বিচারক ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেন এবং বাংলার চর্চা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি তার মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক অর্জন করেন। এছাড়া এখানে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে গ্রে'স ইন হতে বার এট ল ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯২০ সালে বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। বেগম নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা। 

৫.
সোহরাওয়ার্দী প্রথমে যোগ দেন চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে। এটি তখন মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ ছিল। ১৯২৩ এর বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। ১৯২৭ সালে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৯ সালে পরবর্তী অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের সময় তিনি বেঙ্গল মুসলিম ইলেকশন বোর্ড নামে অপর একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পূর্বে সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন এবং নিজে এই দলের সম্পাদক হন। আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ভারতের মুসলমানদের একটি সর্বভারতীয় সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের নবগঠিত দল নিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। প্রধানত সোহরাওয়ার্দীর সাংগঠনিক শক্তির সুবাদেই মুসলিম লীগ ভারতের সর্বমোট ১১ প্রদেশের মধ্যে কেবল বাংলায় সাফল্য অর্জন করে। ১২১ টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৩৯টি আসন পায় মুসলিম লীগ এবং ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনে সমর্থ হয়। ১৯৩৭-৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সোহরাওয়ার্দী সমগ্র প্রদেশে দলকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলায় মুসলিম লীগের স্থপতি। হক-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে মাত্র ১৬ মাসের মধ্যে তথাকথিত শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার (১৯৪১-১৯৪৩) পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন মূল শক্তি। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছরই দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ আছে, “এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমি লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তোললেন। ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলার বন্দোবস্ত করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা করার হুকুম দিলেন। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন এবং সাহায্য দিতে বললেন।”

৬.
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এক প্রতিভাবান রাজনৈতিক সংগঠক। বিশ শতকের বিশের দশকে কলকাতা খেলাফত কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি প্রথম তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। একজন শ্রমিকনেতা হিসেবে কলকাতায় রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে নাবিক, রেলকর্মচারী, পাটকল ও সুতাকল কর্মচারী, রিক্সাচালক, গাড়িচালক প্রভৃতি মেহনতি মানুষের প্রায় ৩৬টি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলায় মুসলিম লীগের বিস্ময়কর বিজয়ের রূপকারও ছিলেন সোহরাওয়ার্দী । সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১২১টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে জিতেছিল ১১৪টি আসনে। এ বিজয়কে অনেকেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে মুসলমানদের রায় বলে মনে করেন, আর এই বিচারে সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন জিন্নাহর সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম স্রষ্টা। ১৯৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘১৯৪৭-এ অবিভক্ত বাংলাকে ভাগ না করে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাখার চেষ্টায় জনাব সোহরাওয়ার্দী ও শরৎবসু যখন দিল্লিতে গিয়ে জিন্নাহ, গান্ধীর সঙ্গে দরবার করলেন, সেই সময় মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আর সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন- ‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।’ (৭৪ পৃ.)।

৭.
১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে মুসলিম লীগের রক্ষনশীল নেতারা খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর আগে ১৯৪৭ সালের আগস্ট ৫ এ খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মূখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে "ভারতীয় এজেন্ট" এবং "পাকিস্তানের শত্রু" হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়। তার অনুসারী রা অনেকে ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং ১৯৪৯ এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এ দল গঠনে তিনি কলকাতা থেকে তাঁর পূর্ববঙ্গীয় সমর্থকদের পরামর্শ ও সাহসও যুগিয়েছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। দেশ ও জাতির জন্য আওয়ামী লীগ যে-সব অবদান রেখেছে, তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে তথ্য উদঘাটন করে ‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস সোহরাওয়ার্দী থেকে শেখ হাসিনা’ গবেষণায় সন্নিবেশিত করে এম এ বার্ণিক বলেছেন, ‘সংগঠনের নাম ‘আওয়ামী লীগ’ হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে- আরবী ‘আওয়াম’ মানে জনগণ এবং ইংরেজি ‘লীগ’ মানে দল বা সংঘ। ‘আওয়াম লীগ’ মানে ‘জনগণের দল’। এটির পূর্ব নাম ছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ (বা জনগণের মুসলিম লীগ)। মুসলিম লীগ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, তখন ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে জনগণের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী কালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ বা জনগণের দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আসলে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামটি এসেছে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নেতা মানকি শরিফের পীর সাহেবের সংগঠন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে। এ ধরনের নামকরণের ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল। কারণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মানকি শরিফের পীর উক্ত দল গঠন করেন। উল্লেখ্য, “ঢাকা হাইকোর্টে দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কার্পাস মামলা পরিচালনার জন্য জনাব সোহরাওয়ার্দী যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখনই তিনি মানকি শরিফের পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন” (সূত্র : জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, কৃত-অলি আহাদ : ঢাকা, খোশরোজ কিতাবমহল, ১৯৯৭ : পৃ ৭২)।

৮.
প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন- ১) মওলানা ভাসানী, ২) একে ফজলুল হক ও ৩) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল- ১) লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি।

৯.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৭ বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্টের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ 'মুসলিম' শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রীসভায় তিনি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ডিসেম্বর ২০, ১৯৫৪ হতে আগস্ট, ১৯৫৫ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। আগস্ট ১১, ১৯৫৫ হতে সেপ্টেম্বর ১, ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সেপ্টেম্বর ১২, ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১১, ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পররাষ্ট্র বিষয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে তাকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাকলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে তিনি পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনের তার চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। 

১০.
এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করেন। আগস্ট, ১৯৫৯ হতে ইলেক্টিভ বডি ডিসকুয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাস্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২ তে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। আগস্ট ১৯, ১৯৬২ সালে তিনি মুক্তি পান। অক্টোবা]র, ১৯৬২ তে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট(এন ডি এফ ) গঠন করেন।

১১.
বিভাগপূর্বকালে সোহরাওয়ার্দী মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় বরাবরই তৎপর ছিলেন। ১৯৩২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে তিনি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থারও অটল সমর্থক ছিলেন। জিন্নাহর উদ্যোগে ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম আইন প্রণেতাদের কনভেনশনে গৃহীত আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাবকও ছিলেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানের দাবিতে মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস (১৬ আগস্ট ১৯৪৬) পালনকালে কলকাতায় ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ হিসেবে পরিচিত এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। 

১২.
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের প্রাক্কালে সোহরাওয়ার্দী সমগ্র বাংলা, আসাম ও বিহারের মানভূম, সিংভূম ও সম্ভবত পূণির্য়া জেলা সমন্বয়ে পূর্বভারতে ‘বৃহৎ বাংলা’ নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। একথা সর্ববিদিত যে, ভারত বিভাগের প্রাক্কালে বাংলা প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায়, সত্যরঞ্জন বক্শি প্রমুখ হিন্দু নেতাদের সহযোগে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি অখন্ড স্বাধীন বাংলা নামে তৃতীয় একটি ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম এতে সর্বাত্মক সমর্থন যুগিয়েছিলেন। এ প্রয়াস সফল হয় নি। 

১৩.
দেশবিভাগের পর অন্যদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী তখনই পাকিস্তানে আসেন নি। তিনি কলকাতায় থেকে যান এবং গান্ধীর সঙ্গে শান্তি মিশনের কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। অপরদিকে, মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক তথা নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সঙ্গে কখনোই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল না। সে কারণে ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা নন এ অজুহাতে লিয়াকত আলী খানের সরকার পাকিস্তানের গণপরিষদ থেকে সোহরাওয়ার্দীর সদস্য পদ খারিজ করে দেয়। 

১৪.
ভারত ও বাংলা বিভাগের পর সার্বিকভাবেই একটি ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টিতে অতঃপর পূর্ববাংলার স্বাধীন অস্তিত্বের আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি সম্মিলিত পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় সমঅধিকার ও ক্ষমতার সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাঙালি ও অবাঙালি সমস্যার সমাধানের পথকেই যথার্থ বলে ভেবেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সমতার নীতি এবং পশ্চিম পাকিস্তান এক ইউনিট গঠনের একান্ত সমর্থক ছিলেন। 

১৫.
সোহরাওয়ার্দী সাংবিধানিক শাসনে দৃঢ়বিশ্বাসী ছিলেন; আর এ কারণেই তিনি ১৯৫৪ সালে দলীয় আপত্তি উপেক্ষা করে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। তিনি পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আইনমন্ত্রী থাকাকালে সোহরাওয়ার্দীর বলিষ্ঠ ও উদ্যোগী ভূমিকার সুবাদেই পাকিস্তানের দুই অংশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ১৯৫৫ সালে মারী চুক্তি সম্ভব হয় এবং এই চুক্তি পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের পথ সুগম করে। 

১৬.
সোহরাওয়ার্দী একজন বাস্তববাদী রাজনীতিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। বিভাগপূর্ব কালে বাংলার মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণে তিনি তাদের জন্য পৃথক নির্বাচনের একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি সাধারণ জাতীয়তা গড়ে তোলার জন্য যৌথ নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি বিল পাস হয়। 

১৭.
স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৬৩ সালে দেশের বাইরে যানএবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অবস্থানকালে সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু অনেকের কাছে রহস্যমণ্ডিত। বৈরুতের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর একটি কক্ষে মৃত্যুর পর ঢাকায় এনে শেরেবাংলার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজারেই রয়েছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি। তার মৃত্যুতে ঢাকায় লাখো লোকের জানাজা ও শোক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সেতুবন্ধনের শেষ চেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা এবং আমৃত্যু তিনি এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এই মহান নেতা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে কোন আপোষ করেননি এবং সেজন্য তাকে কারাবরণ পর্যন্ত করতে হয়েছে। তার রেখে যাওয়া আদর্শ হলো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক ধারাকে চালু রাখা।

(অকৃপণ ঋণ / তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, দৈনিক প্রথম আলো, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত