ঢাবির প্রথম উপাচার্য

স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৩৬

স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বিবেচনায় নিয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগকে। চার হাজার টাকা বেতন ও বাসভবন-সুবিধা নিয়ে ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি যোগ দেন কলকাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অফিসে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী লেডি ম্যাবেল হেলেন হার্টগ ও দুই শিশুপুত্র।

স্যার হার্টগের জন্ম ১৮৬৪ সালের ২ মার্চ। তাঁর পূর্বপুরুষগণ একসময় হল্যান্ডে বাস করতেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে হল্যান্ড থেকে তাঁর এক পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে যান। ফ্রান্স থেকেই একসময় তাঁর বাবা ফরাসি ভাষার শিক্ষকের পেশায় ইংল্যান্ডে যান। তখন থেকেই পরিবারটির ইংল্যান্ডে বসবাসের শুরু হয়। সে সূত্রে স্যার হার্টগ একজন ব্রিটিশ এবং ধর্মীয় পরিচয়ে তিনি ছিলেন একজন ইহুদি। পরিবারে তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা উভয় ক্ষেত্রেই স্যার হার্টগ ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সময়ের সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষা অর্জন করেছিলেন তিনি। মাধ্যমিক শিক্ষা লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুলে। উচ্চশিক্ষা নেন ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ দ্য ফ্রান্স থেকে। সবশেষে তিনি ম্যানচেস্টারের ওয়েলস কলেজে বিশপ বার্কলে স্কলার ছিলেন।

তাঁর কর্মজীবনের শুরু ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে রসায়নের সহকারী প্রভাষক হিসেবে। এরপর তিনি শিক্ষকতা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যোগ দেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক রেজিস্ট্রার ছিলেন প্রায় ১৭ বছর।

১৯২১ সালের ৭ জানুয়ারি ঢাকার বলধার বাগানবাড়ি প্রাঙ্গণে হার্টগ দম্পতিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য সেদিন বলেন, "এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি আপনারা জানেন। নতুন প্রদেশ বাতিলের পর লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে মুসলমান প্রতিনিধিদের আলাপ-আলোচনার ফসল এই বিশ্ববিদ্যালয়।" তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব বাংলায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও জ্ঞানভিত্তিক মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠুক, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে। যাতে তাঁরা রাজনৈতিক ব্যাপারে আরও বেশি অংশ নিতে পারেন এবং ভবিষ্যতে বাংলার সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বাধিক অগ্রসর রাখার জন্য স্যার হার্টগের প্রচেষ্টা ছিলো ব্যাপক। সে কথা স্মরণ করে আরেক কিংবদন্তী রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন- "সাধারণত এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব দোষত্রুটি দেখা যায়, তার অনেকগুলি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি। তার জন্য স্যার হার্টগের যথেষ্ট কৃতিত্ব আছে।"

তিনি নিজের উদ্যোগে কিছু নিয়ম চালু করেন। যেমন- পরীক্ষার উত্তরপত্র দু'জন শিক্ষক দেখবেন। অথচ উত্তরপত্রে কোনো নম্বর দেয়া হবে না। দু'জনের দেয়া নম্বরের ফারাক শতকরা দশের বেশি হলে উত্তরপত্র তৃতীয় আরেকজন দেখবেন। মৌখিক পরীক্ষার পর ফলাফল নির্ধারণের সময় বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সারা বছর 'টিউটোরিয়াল ক্লাস' হবে ইত্যাদি। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রচলিত নিয়মের অনেকগুলোই বিদ্যমান।

Serve as a model university for the whole India- এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি হাতে নিয়েছিলেন সকল দায়িত্ব। তার প্রমাণ, শিক্ষক নিয়োগে স্যার হার্টগের সচেতন সিদ্ধান্ত। সকল প্রকার পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বোচ্চ যোগ্যকেই বাছাই করতে তৎপর ছিলেন তিনি। গঠিত হয়েছিলো সিলেকশন বোর্ড। ভারত এবং ইংল্যাণ্ডেও বিজ্ঞাপন দেয়ায় দেশ-বিদেশ থেকে অনেক আবেদন আসে।

১৯২০ সালে গভর্নর জেনারেল রোনাল্ডসে একটা লম্বা চিঠিতে তাঁকে পরামর্শ দেন। সুপারিশ করেন কয়েকজন শিক্ষকের নামও। কিন্তু বিচক্ষণ হার্টগ প্রার্থীর একাডেমিক কৃতিত্বের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো কিছুকেই গ্রহণ করেন নি। একারণেই ১৯২৪ সালের দ্বিতীয় সমাবর্তনে বক্তব্য দিতে গিয়ে জোর গলায় বলতে পেরেছেন-" I have no desire to over praise our achievements. But I claim that in the two and half years that have passed since we opened our doors, we have laid the foundation of a real university."

তৎকালীন সময়ে তাঁর সঙ্গিনী মাবেল হেলেনের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। হার্টগের ব্যস্ততায় নিজের নিঃসঙ্গতা পুষিয়ে নেন পিছিয়ে পড়া ছাত্রীদের দিয়ে। রক্ষণশীল বাঙালি ঘরের এসব মেয়েরা অসংকোচে তাঁর গৃহে আদৃত হতো। অনেক ছাত্রী ক্লাস শেষে অপেক্ষা করতো তাঁর কাছেই। পরে অভিভাবকরা এসে ঘরে নিয়ে যেতো।

মোটা দাগে বলা যায়, একই শতকের শুরু এবং শেষের মধ্যে যে অভাবিত পরিবর্তন পূর্ববাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তার প্রথম খসড়া এঁকেছেন স্যার হার্টগ। যেই মিনারে দাঁড়িয়ে বাঙালি নতুনচোখে পৃথিবীকে আবিষ্কার করেছে, সেই ভিত্তি রচনা করে গেছেন তিনিই। আর যেখানে যাই হোক, বাঙালিরা তাঁর কাছে সীমাহীন ঋণে ঋণী। আরো বেশি ঋণী প্রায় হারিয়ে যাওয়া পূর্ববাংলার মুসলমান সমাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেবার পর তিনি ইণ্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিস কমিশনে যোগদান করেন। ১৯২৮-২৯ সালে তিনি ভারতীয় শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হন। পরীক্ষার নির্ভরযোগ্যতা অনুসন্ধানের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ইংলিশ কমিটির পরিচালকও ছিলেন তিনি। নিজের কমিউনিটি নিয়েও তিনি ছিলেন সচেতন। স্যার হার্টগ ছিলেন লণ্ডনে বসবাসকারী উদারপন্থী ইহুদীদের ধর্মমন্দির (সিনাগগ) পরিচালনা পর্ষদের সক্রিয় সদস্য।

ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, উর্দু, হিন্দি এবং বাংলা ভাষায় পারদর্শী হার্টগের রচনার বিষয়বস্তু পড়লেই অনুভব করা যায় তাঁর চিন্তার গভীরতা সম্পর্কে। An Examination of Examination (1935), The Purpose of Examination (1938), Some Aspects of Indian Education: Past and Present, Culture: Its History and Meaning, Worlds in Action (1945) প্রভৃতি বেশ কিছু গবেষণাধর্মী বুদ্ধিদীপ্ত বইয়ের লেখক তিনি। তাঁকে নিয়ে মিসেস হার্টগের স্মৃতিকথা P.J. Hartog: A Memoir.

১৯৪৭ সালের ২৭ শে জুন এই মহান শিক্ষাবিদ মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত