রণেশ দাশগুপ্ত

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:০৭

১.
স্বনামধন্য মননশীল লেখক, সাংবাদিক, মানবতাবাদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রণেশ দাশগুপ্ত। রণেশ দাশগুপ্ত ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আজীবন সংগ্রামী রণেশ দাশগুপ্তের প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ভারতের আসাম প্রদেশের ডিব্রুগড় শহরে ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্ব। নীতি, আদর্শের প্রতি দৃঢ়চেতা এই মানুষটি কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবেননি। দেশ, মানুষ ও সমাজের প্রতি সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুহীন প্রাণ। একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, প্রগতীশীল সমাজ গড়ার লক্ষে এবং নতুন প্রজন্ম গড়ার প্রত্যয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন অবিরাম।

২.
রণেশ দাশগুপ্ত আজীবন একটি অসাম্প্রদায়িক মৌলবাদমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। একজন তুখোড় সাংবাদিক, বিজ্ঞ সাহিত্যিক, অসামান্য প্রাবন্ধিক হিসেবে রণেশ দাশগুপ্ত তার জীবনকালে সব সময়ই আশেপাশের মানুষকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে সৎ থেকে, নিজের আদর্শে অটল থেকে সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থে ইতিবাচক কাজ করা যায়। সে লক্ষেই ১৯৫২ সালের ২ মে কবি হাবিবুর রহমান, সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ বেশ কয়েকজন মুক্তচিন্তার মানুষকে নিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠা করেন ‘খেলাঘর’।

৩.
মানবমুক্তির আন্দোলনে নিজেকে পুরোপুরিভাবে সমর্পণ করেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। যৌবনে যুক্ত হয়েছিলেন ভারতজুড়ে জায়মান সাম্যবাদী আন্দোলনের সঙ্গে, কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে একেবারে দেহাতি মানুষদের মধ্যে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি যুক্ত ছিলেন সাহিত্যের আন্দোলনে, সাহিত্যসৃষ্টি ও সাহিত্যবিচারের যৌথ উদ্যোগে, যা চল্লিশের দশকে রূপ নিয়েছিল ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ হিসেবে। লেখক সংঘের ঢাকা কেন্দ্রের মূল ব্যক্তি ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, তরুণ গল্পকার সোমেন চন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার যে সংঘ সর্বভারতীয় দৃষ্টি ও সহমর্মিতা অর্জন করেছিল, ঢাকার বুদ্ধদেব বসুও তখন সংঘের কাজে সম্পৃক্ত না হয়ে পারেননি। কিন্তু উত্তাল চল্লিশ তো মুখ থুবড়ে পড়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক রক্ষণশীল নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে, যে কোনো উদার প্রগতিশীল ভাবনার প্রতি যে-রাষ্ট্র ছিল অসহিষ্ণু ও সহিংস।

৪.
তিনি জীবনযাপনে এতো নিরাভরণ ও নিরঙ্কারী ছিলেন যে তাঁর কাছে পৌঁছাতে কারো কোনো বেগ পেতে হতো না, সবার জন্য অবারিত ছিল তাঁর দ্বার, সকলের অন্তরে শিল্প-সাহিত্যের বোধ সঞ্চারে তিনি ছিলেন উদগ্রীব। নন্দনভাবনার সঙ্গে মুক্তিভাবনার মিশেলে তাঁর শিল্পদৃষ্টিতে যে-প্রসারতা জীবনে ও সাহিত্যে তিনি তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন নিরন্তর। কোনোরকম সঙ্কীর্ণতা ও কুপমণ্ডুকতা তার মধ্যে স্থান পায়নি,‘সবারে বাসরে ভালো’- সঙ্গীতের সেই বাণী যেন তাঁর মর্মে গাঁথা ছিল। একই আকুতি থেকে মানবের সৃজনসাধনার সমগ্রতা বরণে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।

৫.
আয়ত দৃষ্টিতে জীবনের বিশালতা অবলোকনের ক্ষমতা রণেশ দাশগুপ্তের ছিল, আর তাই জীবনের সৌন্দর্যরসে তিনি নিমজ্জিত হতে পেরেছিলেন, মানবের সৃষ্টিশীল সাধনা তাঁকে নিরন্তর সে-রস যুগিয়ে চলেছিল। মানবের এই সৌন্দর্যসাধনার লগ্ন হয়েই তিনি মানবের মুক্তিপথের পথিক হয়েছিলেন। এমন ব্যক্তিত্ব আমাদের জীবনে দুর্লভ, তাঁর ব্যতিক্রমী ও অন্যতর সত্তার যথাযথ উপস্থাপন তাই দুরূহ কাজ, তবে অতীব জরুরি বটে। 

৬.
রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম অবিভক্ত বৃটিশ ভারতের ডিব্রুগড়ের সোনারং গ্রামে, মামার বাড়িতে। তাঁর বাবার নাম অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত। মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত। অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন চাকুরিজীবি। তিনি বিহারের এ.জি. অফিসে কাজ করতেন। রণেশ দাশগুপ্তের পৈতৃকনিবাস বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার গাউরদিয়া গ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পুরুলিয়ার রামানন্দ পন্ডিতের পাঠশালায়।এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেন। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁকে আবার ফিরে আসতে হয় রাঁচিতে। রাঁচি ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। রণেশ দাশগুপ্ত সেই পরিবেশেই নিজেকে মগ্ন রাখেন। সেখানকার নদীর উৎস সন্ধানই তাঁর নিয়মিত পাঠক্রম হয়ে দাঁড়ায়। বাবা অপূর্বরত্ন ছিলেন স্থানীয় ফুটবল কমিটির সম্পাদক। রণেশ দাশগুপ্ত তখন বাবার 'খাস পিয়ন'। এসময় প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে লেখাপড়ায় এক ধরনের ছেদ পরে। বয়স দশ হতে চলেছে কিন্তু আর কোনো স্কুলে নাম লেখাননি তিনি। তিন বছর যে পাঠশালায় পড়েছিলেন সেই বিদ্যা নিয়েই শুরু করেন উপন্যাস পড়া। এরপর রাঁচির ডুরান্ডে বসবাসকারী তাঁর এক বড়ভাই রণেন মজুমদার রণেশ দাশগুপ্তকে নিয়ে যান রাঁচি জেলা স্কুলে। সেখানে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ইংরেজি মাধ্যমে। কিন্তু স্কুল তাঁকে গ্রাস করে ফেললেও থামেনি সাহিত্যের প্রতি অদম্য আগ্রহ। বাড়িতে নিয়মিত আসত প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতি, বিচিত্রা, কল্লোল প্রভৃতি কাগজ। সেগুলো তিনি 'গ্রোগ্রাসে গিলতেন'। রণেশ দাশগুপ্ত স্মৃতিচারণে বলেছেন-"রান্না ঘরেই বসতো আমাদের সাহিত্যের আড্ডা। তখন পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা উপন্যাসের কোনোটিই তাঁর পড়ায় বাদ ছিল না।...রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি মা মুখে মুখে বলতে পারতেন।...মা আমার সাহিত্য সাধনার বহু কথাবার্তার উত্থাপক।" এই সময়ে প্রচুর বিশ্বসাহিত্যের বইও পড়ে ফেলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তবে বাবার তরফ থেকে খেলার যে নেশাটা পেয়েছিলেন সেটাও চালিয়ে যান। এসময় পুরোদমে ফুটবল আর লন-টেনিস খেলছিলেন তিনি।

৭.
রণেশ দাশগুপ্ত স্কুল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে 'স্বদেশী ভাবনায়' উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। রাঁচির হিন্দু পাড়ায় ছিল জিমনেসিয়াম ও থিয়েটার। সেখানে নিয়মিত যেতেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই বিপ্লবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই কাজে তাঁকে প্রভাবিত করেন তাঁরই জেঠতুতো ভাই বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত । আর সেই সময় 'রাজনৈতিক গুরু' হিসেবে আবির্ভূত হন জিমনেসিয়ামের শিক্ষক হরিপদ দে। সবার উদ্যোগে তৈরি করা হয় 'তরুণ সংঘ'। রণেশ দাশগুপ্ত তখনো জানতেন না এর আড়ালে আসলে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন 'অনুশীলন সমিতি'র সাথে জড়িয়ে গেছেন। ১৯২৯ সালেই রাঁচি জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য ভর্তি হন বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রণেশ দাশগুপ্ত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে বাঁকুড়া কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকেই তিনি আইএসসি পরীক্ষায় পাস করেন। কলকাতা সিটি কলেজে পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে লেখাপড়া ব্যাহত হওয়ায় ভর্তি হন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে। বরিশালে অধ্যয়নকালে কমিউনিষ্ট রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর এগোয়নি। 

৮.
রণেশ দাশগুপ্ত থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। সেখানে ছিল 'অনুশীলন সমিতি'র শাখা। ফলে দুয়ে দুয়ে চার মিলতে বেশি সময় লাগল না। সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন 'অনুশীলন সমিতি'র সাথে। সমিতির সদস্যরা তখন কংগ্রেসে কাজ করতেন। ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় রণেশ দাশগুপ্তের উপর দায়িত্ব পরে কলেজ হোস্টেলের শাখার কাজ পরিচালনা করার। সেখানে তাঁর নেতৃত্বে কলেজে দীর্ঘদিন ধর্মঘট সংঘটিত হয়। পরিণতিতে কলেজ থেকে রণেশ দাশগুপ্তসহ ১৬ জনকে বহিস্কার করে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় অন্য কোথাও ভর্তি হতে গেলে প্রয়োজন ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। কিন্তু রণেশ দাশগুপ্তের হাতে ছিল এক্সপেলড সার্টিফিকেট । রণেশ দাশগুপ্ত ফিরে এলেন কলকাতায়। কোনোমতে সিটি কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। থাকতেন কলেজের রামমোহন রায় হোস্টেলে। স্থান পরিবর্তন হলেও আগের পরিচিত বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুন্ন থাকে। ১৯৩১ সালে মাত্র ছয় মাস পড়াশোনা করে সিটি কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন।

৯.
ত্রিশের দশকে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে দীক্ষা নেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি। অনেকেই তখন সোভিয়েত বিপ্লব ও তার সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হন। রণেশ দাশগুপ্ত বরিশালে তিন বছর কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়। তখন তাঁর পরিবারও ঢাকায় চলে এসেছে।

১০.
রণেশ দাশগুপ্ত সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। কলকাতা সিটি কলেজে পড়ার সময় তিনি অনুশীলন দলের ‘যুগবাণী সাহিত্য চক্রে’ যোগদান করেন। ১৯৩৮ সালে বিপ্লবী নেতা সতীশ পাকড়াশির অনুপ্রেরণায় তিনি সোমেন চন্দ, অচ্যুত গোস্বামী প্রমুখ নেতাদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রগতি লেখক সংঘ। সোমেন চন্দের হত্যার পর সংঘের পাক্ষিক মুখপত্র প্রতিরোধের প্রায় সব সম্পাদকীয় তিনি লেখেন, যদিও তিনি এর সম্পাদক ছিলেন না। পান্ডিত্যের জন্য তিনি সংঘের সদস্যদের শ্রদ্ধা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

১১.
চল্লিশের দশকে রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য কীর্তি ছিল ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাত্ত্বিক খোকা রায় লিখেছেন, "পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও গণনাট্য সংঘ ও প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থার শাখা গড়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থা বিশেষ জোরদার ছিল ঢাকাতে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক সোমেন চন্দ ছিলেন ঢাকার ঐ সাংস্কৃতিক সংস্থার নেতৃস্থানীয়।" রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন এই সংস্থার 'ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড'। এসময় তিনি একটি নবাগত লেখকদের জন্য 'প্রগতি সাহিত্যের মর্মকথা' নামে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। ১৯৪২ সালে ঢাকায় 'প্রগতি লেখক সংঘে'র সম্পাদক সোমেন চন্দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সময়ে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-কমরেড প্রদ্যুৎ সরকার ও ১৯৪৪ সালে কচি নাগ নামে আরো দু'জনকে হত্যা হয়। ফলে ঢাকায় ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার পর 'প্রগতি লেখক সংঘে'র কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে নানা বাধা বিঘ্ন সত্ত্বেও এই সংস্থার কার্যক্রম ১৯৫০-৫১ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

১২.
১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ সম্পন্ন হয়। রণেশ দাশগুপ্তের নিকটজনেরা পরিবারিক ও রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি সপরিবারে থেকে যান ঢাকাতেই। বাঙালি মুসলমান যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিল, তাদের সেই মোহ কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না। অচিরেই তারা বুঝে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানকে মূলত শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সেই ধারণা আরো বেশি জোর পায় যখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। সারা বাংলায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ঢাকায় কমিউনিস্টরা তখন আত্মগোপনে কাজ করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র-কমরেডরাও ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে একটি শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার হন। ছাড়া পান কয়েকদিন মধ্যেই। কিন্তু পরে একই বছরের ৭ জুলাই আবার তাঁকে আটক করা হয়। এবং বিনা বিচারে ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কারান্তরালে কাটান। দীর্ঘ ৭ বছর ৮ মাসের কারাবাসে রণেশ দাশগুপ্ত চারটি অনশনে অংশ নেন। প্রথম অনশন ১৯৪৮ সালে ঢাকা জেলে ১১-১৫ মার্চ, দ্বিতীয় অনশন মে-জুন মাসে ৪০ দিন এবং তৃতীয় অনশন হয় সরকারের 'আশ্বাস না রাখার' কারণে। চতুর্থবার অনশন করেন রাজশাহী কারাগারে। এর মধ্যে তাঁকে রাজশাহী ও যশোর জেলে বদলি করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁর পরিবারও ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে একেবারে একা হয়ে পড়েন তিনি। পরিবারের কেউ নেই, নেই রাজনৈতিক সহকর্মীরা। এই অবস্থায় চাকুরি নেন 'ইত্তেফাকে'। দুই বছর সেখানে ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। 

১৩.
১৯৫৭ সালে ঢাকা পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। এসময় ঢাকার ৩৫টি আসনের ৩৪টিতেই জয়লাভ করেছিল মুসলিম লীগের প্রার্থীরা। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। অন্য কয়েকজন বামপন্থী কর্মীর সাথে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান । জেল থেকে বেরিয়েই যোগ দেন সংবাদ অফিসে। তিনি তখন রবিবাসরীয় পাতার দায়িত্বে ছিলেন। মূলত এখান থেকেই নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক সংগঠকের ভূমিকায়। সংবাদে তখন কাজ করতেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির আরো অনেকে মিলে তখন 'সংবাদ-কমিউন' গঠন করেন। এখান থেকেই রণেশ দাশগুপ্ত চালিয়ে যান পার্টির কাজ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আর লেখালেখি তো আছেই। 

১৪.
ইতিমধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ আবার ভয়াবহ হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। গ্রেফতার করা হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের। এই বছরের সেপ্টেম্বরে রণেশ দাশগুপ্ত গ্রেফতার হন। জেলের বাইরে রাজপথে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন অভূতপূর্ব জাগরণ তৈরি করে। এবার জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে। আবার সংবাদে কলাম লেখক হিসেবে যোগ দেন। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। রাজনৈতিক কারণে তিনি প্রায় নয় বছর কারাভোগ করেন। রণেশ দাশগুপ্ত দৈনিক সংবাদসহ দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কাজ করেন। দক্ষ সাংবাদিক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। 

১৫.
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপান হিসেবেই আসে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপর। রণেশ দাশগুপ্ত তখন পুরান ঢাকার বাসিন্দা। প্রথম কিছুদিন তিনি ঢাকাতেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে চলে যান নরসিংদীর রায়পুরায়। সেখান থেকে পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতের আগরতলাতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে চলে যান কলকাতায়। রণেশ দাশগুপ্ত কলকাতায় সভা-সমিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বক্তৃতা করেন। মাঝে মাঝে অংশ নিতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালাতেও। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ততদিনে রণেশ দাশগুপ্ত বাংলাদেশের অসাধারণ এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যেন তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজে ঘুরে বেরিয়েছেন সারা দেশ। এই সময়ে পার্টির সাথেও তাঁর দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের সময় সংবাদ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সাংবাদিক জীবনে ছেদ পরে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বাকশালে যোগদানের বিরোধী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১লা নভেম্বর একটি সভায় যোগ দিতে তিনি কলকাতায় যান। দেশে সামরিক শাসন ও নানা প্রতিকূলতার কারণে তাঁর আর দেশে ফেরা হয়নি। 

১৬.
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেছেন। রণেশ দাশগুপ্ত অনেক গ্রন্থের প্রবক্তা। প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আছে- ১৯৪২-৪৩ সালে কিশোর উপযোগী নাটক 'জানালা'; ১৯৫৬ সালে কার্ল মার্কসের জীবনী; ১৯৬৫ সালে মাও সে তুং-এর 'শতফুল ফুটতে দাও'- এর অনুবাদ; ১৯৫৯ সালে 'উপন্যাসের শিল্পরূপ'; ১৯৬১ সালে 'জিজ্ঞাসা'; ১৯৬২ সালে 'আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম'; ১৯৬৬ সালে 'শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে'; ১৯৬৯ সালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার অনুবাদ; ১৯৬৯ সালে জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্ভার সম্পাদনা; ১৯৭০ সালে 'ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম ও আলো দিয়ে আলো জ্বালা'; ১৯৭৩ সালে 'স্বাধীনতা সাম্য বিপ্লবের কবিতা'; ১৯৮৪ সালে 'রহমানের মা ও অন্যান্য গল্প'; ১৯৮৬ সালে 'আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ'; ১৯৮৭ সালে 'কলাম-সংকলন মনে মনে প্রকাশ'; ১৯৮৮ সালে 'সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ'; ১৯৮৯ সালে 'মুক্তিধারা'; ১৯৯৪ সালে 'সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা' ইত্যাদি। তাছাড়া তিনি বেশ কিছু বই সম্পাদনা করেন। 

১৭.
রণেশ দাশগুপ্ত ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মরদেহ ঢাকায় এনে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পোস্তগোলা শ্মশানে দাহ করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, অনুশীলন, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সমকাল, রণেশ দাশগুপ্ত স্মারক গ্রন্থ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত