অধ্যাপক অমর্ত্য সেন

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০১৮, ১১:২৮

১.
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, অর্থনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আজ বিশ্বব্যাপী। কেবলমাত্র সুশিক্ষকই নন, তাঁর প্রবল পাণ্ডিত্য বিনম্র শ্রদ্ধা জাগিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও সমাজ দার্শনিক হিসেবে তিনি মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন, বির্নিমাণে সদা সচেষ্ট। দুর্ভিক্ষ, মানব উন্নয়ন তত্ত্ব, জনকল্যাণ অর্থনীতি ও গণদারিদ্রের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা এবং উদারনৈতিক রাজনীতিতে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে ব্যাংক অব সুইডেন পুরস্কার (যা অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত) লাভ করেন। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে জন্মগ্রহণ করেন অমর্ত্য সেন। শুভ জন্মদিন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। জন্মদিনে আপনাকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী তাঁকে বলেছেন ‘ইন্টেলেকচুয়াল ডেমোক্র্যাট’। সেই অমর্ত্য সেন মনে করেন, কোন পরিবর্তনই স্বয়ংক্রিয় হতে পারে না, তাকে সম্ভব করে তোলার জন্য আমাদের ‘শিক্ষিত, সংগঠিত, সক্রিয়’ হতে হবে। আর তাই তিনি ‘স-ক্ষমতা’ ও ‘স্ব-ক্ষমতা’ ধারনার প্রতি গুরুত্ব দিতে মোটেই ভুল করেন না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলতে দ্বিধা করেন না, ‘দরিদ্রদের স্বার্থে পরিবর্তন খুবই কম’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর প্রবল আস্থা। রবি ঠাকুর বলেছিলেন "আমাদের সকল সমস্যার সবচেয়ে বড় রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা।" অমর্ত্য সেন সুনিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করেন, ‘শিক্ষা সবকিছু বদলে দেয়’। আর তাই তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তুমি যা করছ তা ভালোবেসে করো’।

২.
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন-এর জন্মদিনে আমার খুব মনে পড়ছে, বাংলাদেশে এসে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে যা বলেছিলেন, তাঁর বলা কিছু কথা। গত বছর ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, সোমবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে তাঁর নিজের লেখা বইয়ের অনূদিত সংস্করণ ‘ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা’-এর প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত আলোকিত আয়োজনে আম জনতার একজন হিসেবে উপস্থিত থাকার, অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। প্রজ্ঞাবান জাদুশিল্পীর মোহন আসরে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘আমরা ছাত্র জীবনে যে চিন্তাগুলো করি সাধারণত সে চিন্তাগুলোই সারজীবন চলে, যারা ছাত্র জীবনে বড় প্রশ্ন কখনো ভাবেননি, তারা পরবর্তী জীবনে হঠাৎ বড় ভাবনা ভাববেন সেটা কিন্তু হঠাৎ আশা করা কিন্তু খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাও অতি গুরুত্বপূর্ণ। মাস্টার মশাইরা ছাত্র-ছাত্রীর ভাবনাকে কিভাবে জাগিয়ে তুলছেন, আলোচনার বিষয়ে প্রশ্নত্তোরে সমাজ নিয়ে মানবিক চিন্তা কতটা বড় প্রেক্ষিতে তুলে ধরতে পারছেন, সেটাও খুউব গুরুত্বপূর্ণ।’ এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে কিছু কথা শেষের অংশে সংযুক্ত করা হলো আগ্রহীজনের জন্য। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন-এর প্রতি সম্মান জানাতে আমাদের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ভাসানটেক সরকারি কলেজের একটি কক্ষের নামকরণ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন-এর নামে করা হয়েছে।

৩.
কোন কোন আলোচক যেমন, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘অমর্ত্য সেন কেবল বহু বিষয়ের লেখক নন। কেবল অন্য মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল উদার, গণতান্ত্রিক মনের প্রাবন্ধিক নন। তাঁর আলোচনা দাঁড়িয়ে থাকে একটি সুচিন্তিত নৈতিক ভিত্তির উপরে। যদি এক কথায় সেই ভিতটিকে বোঝাতে চাই, তবে বলতে হবে তার নাম ‘জাস্টিস’ বা ন্যায্যতা। এই ন্যায্যতা কোনও বিমূর্ত, পূর্বনির্ধারিত ধারণা নয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানান মাপকাঠি দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে হবে, এটাই তাঁর দি আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থের (২০০৯) অন্যতম সার কথা।’‘ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠায় ভারতের কৃতিত্ব গর্ব করার মতো নয়, সেটা অমর্ত্য সেন বহু দিন ধরে অক্লান্ত ভাবে বলে আসছেন। কেল শিক্ষায় নয়, সব বিষয়েই ‘ফার্স্ট বয়’দের নিয়ে মাতামাতির আড়ালে বহু মানুষের ধারাবাহিক বঞ্চনার প্রতি আমাদের ঔদাসীন্য তাঁকে পীড়া দেয়’, সেই বেদনাই ভাষা পেয়েছে তাঁর ‘দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ’ গ্রন্থে । কোন কোন আলোচক যেমন, অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘অমর্ত্য সেন কেবল বহু বিষয়ের লেখক নন। কেবল অন্য মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল উদার, গণতান্ত্রিক মনের প্রাবন্ধিক নন। তাঁর আলোচনা দাঁড়িয়ে থাকে একটি সুচিন্তিত নৈতিক ভিত্তির উপরে। যদি এক কথায় সেই ভিতটিকে বোঝাতে চাই, তবে বলতে হবে তার নাম ‘জাস্টিস’ বা ন্যায্যতা। এই ন্যায্যতা কোনও বিমূর্ত, পূর্বনির্ধারিত ধারণা নয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানান মাপকাঠি দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে হবে, এটাই তাঁর দি আইডিয়া অব জাস্টিস গ্রন্থের (২০০৯) অন্যতম সার কথা।’‘ন্যায্যতার প্রতিষ্ঠায় ভারতের কৃতিত্ব গর্ব করার মতো নয়, সেটা অমর্ত্য সেন বহু দিন ধরে অক্লান্ত ভাবে বলে আসছেন। কেবল শিক্ষায় নয়, সব বিষয়েই ‘ফার্স্ট বয়’দের নিয়ে মাতামাতির আড়ালে বহু মানুষের ধারাবাহিক বঞ্চনার প্রতি আমাদের ঔদাসীন্য তাঁকে পীড়া দেয়’, সেই বেদনাই ভাষা পেয়েছে তাঁর ‘দ্য কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ’ গ্রন্থে।

৪.
আমরা জানি, অধ্যাপক অমর্ত্য সেনই প্রথম যুক্তরাষ্টের নগরিক না হয়েও ন্যাশনাল হিউমিনিটিস মেডেল পান। তিনি বর্তমানে থমাস ডাব্লিউ লেমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক অধ্যাপক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি হার্ভার্ড সোসাইটি অফ ফেলোস, ট্রিনিট্রি কলেজ, অক্সব্রিজ এবংক্যামব্রিজের একজন ফিনিয়র ফেলো। এছাড়াও তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজের মাস্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।তিনি বর্তমানে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হেলথ ইমপ্যাক্ট ফান্ডের এডভাইজরি বোর্ড অফ ইনসেন্টিভ ফর গ্লোবাল হেলথ এর সদস্য। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিক্ষাবিদ যিনি একটি অক্সব্রিজ কলেজের প্রধান হন। এছাড়াও তিনি প্রস্তাবিত নালন্দা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করেছেন। অমর্ত্য সেনের লিখিত বই বিগত চল্লিশ বছর ধরে প্রায় তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ইকোনমিস্ট ফর পিস এন্ড সিকিউরিটির একজন ট্রাষ্টি। ২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে অনূর্ধ ষাঁট বছর বয়সী ভারতীয় বীর হিসেবে চিহ্নিত করেছে।এবং ২০১০ সালে তাকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যাক্তির তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। নিউ স্টেটসম্যান ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ৫০ গুরুত্বপূর্ন প্রভাবশালী ব্যাক্তির তালিকায় স্থান দেয়।

৫.
অমর্ত্য সেনের আদি নিবাস বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে। তাঁর শিশুকাল কেটেছ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ওয়ারীতে। জানা যায়, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম রেখেছিলেন অমর্ত্য, যার অর্থ অমর বা অবিনশ্বর। অমর্ত্য সেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেছেলেন। তার নানা আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন মধ্যযুগীয় ভারতীয় সাহিত্যের একজন পন্ডিৎ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগী। এছাড়াও তিনি সংস্কৃতি ভাষার অধ্যাপক এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য ছিলেন। ক্ষিতিমোহন সেনের তিনজন ভাতিজার মধ্যে সুকুমার সেন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার, অমিয় সেন একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার এবং ব্যারিস্টার অশোক কুমার সেন, এমপি. ছিলেন ভারতের কেন্দ্রিয় আইন ও বিচার মন্ত্রনালয়ের একজন সাবেক কেবিনেট মন্ত্রি। অমর্ত্য সেনের বাবা অধ্যাপক আশুতোষ সেন এবং মা অমিতা সেন দুজনেই ঢাকার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহন করেন। আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েররসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং পরবর্তীতে ওয়েষ্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত ছিলেন।

৬.
১৯৪১ সালে অমর্ত্য সেন তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয় এ। দেশ ভাগের পরে তারা ভারতে চলে গেলে অমর্ত্য সেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ বছরই তিনি ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে পড়তে যান। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ একই বছর তিনি ক্যামব্রিজ মজলিসের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ট্রিনিট্রি কলেজে স্নাতকের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটির ফেলো প্রশান্ত চন্দ্র মোহালনবিশের সাথে দেখা করেন। তিনি অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা করে অভিভুত হন এবং পরবর্তীতে কোলকাতা ফিরে এসে তৎলালীন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রি ত্রিগুনা সেনের কাছে অমর্ত্য সেনের জন্য সুপারিশ করেন। ত্রিগুনা সেন তখন জাতীয় কাউন্সিলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিলেন।

৭.
কেমব্রিজের টিনিট্রি কলেজে পি.এইচ.ডি ডিগ্রির জন্য ভর্তি হয়ে দুই বছরের ছুটিতে কোলকাতা ফিরলে সাথে সাথে ত্রিগুনা সেন তাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অর্থনিতী বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। অমর্ত্য সেনই ছিলেন ভারতের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ (২৩ বছর) অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং তাত্বিক এ.কে. দাশগুপ্তকে তার অধীক্ষক (সুপারভাইজার) হিসেবে পেয়েছিলেন। পূর্ন দুই বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর ১৯৫৯ সালে তিনি ট্রিনিট্রি কলেজে তার পি.এইচ.ডি ডিগ্রি শেষ করতে ফেরত যন।

৮.
ট্রিনিট্রিতে ফেরত যাবার পর তিনি সেখানে ফেলোশিপ অর্জন করেন যা তাকে পরবর্তী চার বছর তার ইচ্ছামত যেকোন কাজ করার সুযোগ এনে দেয়। তিনি দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। দর্শনশাস্ত্রের জ্ঞান তাকে পরবর্তীতে তার গবেষনা কাজে অনেক সাহায্য করে। তার মতে, “দর্শন চর্চার মাধ্যমে জ্ঞান বিকশিত করা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণৃ ছিল তার কারণ এই নয় যে আমার প্রিয় বিষয় অর্থনীতি, দার্শনিক চিন্তাভবনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার মূল কারণ দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন নিজে থেকেই অনেক ফলপ্রসু।” যদিও দর্শনের প্রতি তার এই আগ্রহ অনেক আগেই তার কলেজ জীবন থেকে শুরু হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি নিয়মিত দর্শন চর্চা এবং এর উপর বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রথম বলেছেন সম্রাট আকবর। তবে এটি পশ্চিমা সেক্যুলারিজম থেকে আলাদা। পশ্চিমের সেক্যুলারিজম হলো ধর্মটা বাদ দিতে হবে। এখানে তা নয়। এখানে ধর্মটাকেও থাকতে দিতে হবে। এখানে হলো ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যেন নিরপেক্ষ হয়। এ বিষয়টা বাংলায় থেকে গেছে, অন্যত্র থাকেনি।

৯.
অমর্ত্য সেনের জন্য কেমব্রিজ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিল। সেখানে কেইনিসিয়ান অর্থনিতীর পক্ষাবলম্বি ও কেইনিসের অবদান সমর্থনকারীদের সাথে নিও-ক্লাসিক্যাল ও কেইনিসের বিরোধিতাকারীদের সাথে বিতর্ক লেগেই থাকত। সৌভাগ্যবশত অমর্ত্য সেনের সাথে দুই পক্ষের সম্পর্কই ভাল ছিল এবং ট্রিনিট্রি কলেজে সহনশীল এবং গনতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকত। বি.এ শেষ করার পর পি.এইচ.ডি গবেষনার জন্য অমর্ত্য সেনকে সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী একটি বিষয়ের চয়ন করতে হয়। তিনি জন রবিনসনের অধীনে অর্থনিতীর বিকল্প কৌশলের উপর তার গবেষনাপত্র দাখিল করেন।জন রবিনসন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু কিছুটা অসহনশীল এবং নব্য-কেইনিসিয়ান ধারনায় বিশ্বাসী ছিলেন। কুইন্টিন স্কিনারের মতে অমর্ত্য সেন কেমব্রিজ এপোস্টেলস নামক একটি গোপন সংঘের সদস্য ছিলেন।

১০.
অমর্ত্য সেন মাত্র ২৩ বছর বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এর অর্থনীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৬০-৬১ সালে ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলেতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। তিনি ১৯৭২ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। অমর্ত্য সেনের লেখা গ্রন্থাবলী ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

১১.
অমর্ত্য সেন শতাধিক সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন।
• 1981; He was elected a Foreign Honorary Member of the American Academy of Arts and Sciences.
• 1982: He was awarded honorary fellowship by the Institute of Social Studies.
• 1998: He received the Nobel Memorial Prize in Economic Sciences for his work in welfare economics.
• 1999: He received the Bharat Ratna 'the highest civilian award in India' by the President of India.
• 1999: He was offered the honorary citizenship of Bangladesh by Sheikh Hasina in recognition of his achievements in winning the Nobel Prize, and given that his ancestral origins were in what has become the modern state of Bangladesh
• ২০০০: তিনি অর্ডার অব কম্প্যানিয়ন অব অনার এ ভূষিত হন
• 2000: He received Leontief Prize for his outstanding contribution to economic theory from the Global Development and Environment Institute.
• 2000: He was awarded the Eisenhower Medal for Leadership and Service USA;
• 2000: He was the 351st Commencement Speaker of Harvard University.
• 2002: He received the International Humanist Award from the International Humanist and Ethical Union.
• 2003: He was conferred the Lifetime Achievement Award by the Indian Chamber of Commerce.
• He is awarded the Life Time Achievement award by Bangkok-based United Nations Economic and Social Commission for Asia and the Pacific (UNESCAP)
• 2010: He was chosen to deliver the Demos Annual Lecture 2010
• 2011: The National Humanities Medal will be given to Amartya Sen by US Govt.
এছাড়াও, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১ সালে অমর্ত্য সেনকে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলা একাডেমী তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।

১২.
তাঁর প্রকাশিত প্রধান গ্রন্থাবলি :
• Sen, Amartya, Collective Choice and Social Welfare, San Francisco, Holden-Day, 1970
• Sen, Amartya, On Economic Inequality, New York, Norton, 1973
• Sen, Amartya, Poverty and Famines : An Essay on Entitlements and Deprivation, Oxford, Clarendon Press, 1982
• Sen, Amartya, Choice, Welfare and Measurement, Oxford, Basil Blackwell, 1982
• Sen, Amartya, Food Economics and Entitlements, Helsinki, Wider Working Paper 1, 1986
• Sen, Amartya, On Ethics and Economics, Oxford, Basil Blackwell, 1987.
• Drèze, Jean and Sen, Amartya, Hunger and Public Action. Oxford: Clarendon Press. 1989.
• Sen, Amartya, More Than 100 Million Women Are Missing. New York Review of Books, 1990.
• Sen, Amartya, Inequality Reexamined, Oxford, Oxford University Press, 1992.
• Nussbaum, Martha, and Sen, Amartya. The Quality of Life. Oxford: Clarendon Press, 1993
• Sen, Amartya, Reason Before Identity (The Romanes Lecture for 1998), Oxford, Oxford University Press, 1999. ISBN 0-19-951389-9
• Sen, Amartya, Development as Freedom, Oxford, Oxford University Press, 1999 Review
• Sen, Amartya, Rationality and Freedom, Harvard, Harvard Belknap Press, 2002
• Sen, Amartya, The Argumentative Indian, London: Allen Lane, 2005.
• Sen, Amartya, Identity and Violence.The Illusion of Destiny New York W&W Norton.

১৩.
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৬১ সংখ্যক ভাব-অনুভবে ‘অমর্ত্য সেন : প্রজ্ঞাবান জাদুশিল্পীর মোহন আসরে’ শিরোনামে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটিও পুনরুল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তুলে ধরা হলো।-
‘আমরা পারফেকশন খুঁজব না উন্নতি খুঁজব? আমার মনে হয় উন্নতি খোঁজাটাই শ্রেয়’ - অমর্ত্য সেন।

১৩.১
একজন প্রজ্ঞাবান মানুষের বিনয়, সৌজন্যতা যে কতটা আলোকিত হতে পারে, তারই অসাধারণ দৃষ্টান্ত দিলেন, রাখলেন আমাদের সন্তান, কৃতি বাঙালি অমর্ত্য সেন। তথাকথিত শিক্ষকসুলভ ভাবগাম্ভীর্যময়তা ছিলো না, কথার মারপ্যাচের অন্ধকারের খেলাও ছিলো না, যা বলবার তা সাহিত্যিক কুশলতায় মোলায়েম ভাষায় কঠিন বিষয়টিকেও বলতে তিনি ছিলেন সপ্রতিভ, সরস কথক। আমার মতোন অসংখ্যজনই অমর্ত্য সেনের বক্তৃতায়, আলোচনায় ভীষণই মুগ্ধ, আনন্দিত। তাঁর গভীর পান্ডিত্য বা জ্ঞান নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আছে কী না সে নিয়ে সংশয় থাকলেও, আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মননশীল সুশিক্ষকের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। ইউটিউবের কল্যাণে অনেক সময়ই তাঁর বিদগ্ধ আলোচনা শোনার সুযোগ হয় আমার। সেসবের চেয়ে সরাসরি আজকের আলোচনায় অমর্ত্য সেন ছিলেন আরো বেশি প্রাণবন্ত, যুক্তি আর মানবিকতার প্রশ্নে নিজের ভাবনার প্রখরতায় উজ্জ্বল, ছোট ছোট কথায়, যতটা সম্ভব ইংরেজি এড়িয়ে বাংলায় কথা বলতে বলতে কথার জাদুশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

১৩.২
২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, সোমবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে নিজের লেখা বইয়ের অনূদিত সংস্করণ ‘ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা’-এর প্রকাশনা উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আম জনতার একজন হিসেবে উপস্থিত থাকার, অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। রবি ঠাকুরকে খুব মনে পড়ছিলো, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণি, আমি শুনি কেবল অবাক হয়ে শুনি।’ উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, পৈতৃকসূত্রে মানিকগঞ্জের সন্তান অমর্ত্য সেনের নামটিও কিন্ত কবিগুরুর দেওয়া।
১৩.৩
প্রথম আলো ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘অর্থনৈতিক প্রগতি ও মানবিক প্রগতি’ শীর্ষক একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি মূল্যবান নানা কথা বলেন, পরিসংখ্যানসহ তথ্য বিশ্লেষণ করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডি চেয়ারম্যান প্রফেসর রেহমান সোবহান। একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানে নিজের লেখা বইয়ের অনূদিত সংস্করণ ‘ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনার’ প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করেন।

১৩.৪
আয়োজক কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতার আর অব্যবস্থাপনার সাময়িক সংকট এড়িয়ে যারা শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি শুনেছেন, আখেরে তারা সুদাসলে বুঝে পেয়েছেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মাত্রায় বলেই আমার ধারণা। প্রজ্ঞাবান জাদুশিল্পী অমর্ত্য সেনের মোহন আসরের আয়োজনের জন্য আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ না জানানোটা চরম অশোভনই হবে।

১৩.৫
অমর্ত্য সেন বলেন, গণতন্ত্রে আলোচনা না করলে কোন কিছু বদলানো সম্ভব নয়; কিন্তু দিন দিন আলোচনার জায়গাটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। মানবিক প্রগতি ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় উল্লেখ করে একক বক্তৃতায় নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, ভারত অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকলেও তারা বাংলাদেশ থেকে মানবিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোতে ১৯৯০ সালে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে এগিয়ে আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সামাজিক খাতগুলোতে অনেক উন্নতি করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। আগের সময়ের চেয়ে শিশু মৃত্যুহার অনেক কমেছে। একই সঙ্গে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সংখ্যাও ভারতের চেয়ে বেশি। অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে মানবিক প্রগতি অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। মানবিক প্রগতি না হলে অর্থনৈতিক প্রগতি বা উন্নতি স্থায়ী হয় না। ভারত অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকলেও তারা বাংলাদেশ থেকে মানবিক দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, ভারতের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সূচকগুলো অত্যন্ত খারাপ। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে কার্যকর সরকারী পদক্ষেপের অভাবে ভারতের স্বাস্থ্য সমস্যাকে জটিল করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি হয়নি। বাংলাদেশ গত এক দশকে স্বাস্থ্যখাতে ভাল উন্নতি করেছে। আগের চেয়ে বর্তমানে শিশু মৃত্যুহার অনেক কমেছে। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের দ্বিগুণ, কিন্তু বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি। বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন অর্থনৈতিক প্রগতি ও মানবিক প্রগতির পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয় তুলে ধরে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও মানবিক প্রগতি স্থির হয়ে থাকতে পারে। মানবিক প্রগতির জন্য দেশের সব নাগরিকের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিশ্চিত করা দরকার। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে অবশ্যই সরকারকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয়। ভারতের উদাহরণ টেনে অমর্ত্য সেন বলেন, ভারত ১৯৪৭ সালের পর থেকে ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারলেও মানবিক প্রগতি সুনিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোতে ১৯৯০ সালে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে এগিয়ে আছে। অমর্ত্য সেন বলেন, মানবিক প্রগতি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। মানবিক প্রগতি ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন বঞ্চনার সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অমর্ত্য সেন বলেন, ১৭৭৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক উন্নতির কিছুই হয়নি। এই সময়ে গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র ০.০১ শতাংশ। নিজেকে বামপন্থী উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেন, যারা ইউনিয়ন করেন তাদের নজর সদস্যদের নিয়ে। কিন্তু তারা কখনই সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন না। অ্যাডাম স্মিথের দ্য ওয়েলথ অব নেশনস বইয়ের উদাহরণ টেনে অমর্ত্য সেন বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়, তেমনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানবিক প্রগতির জন্য কাজ করতে সরকার টাকা পায়। তিনি বলেন, নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থার দায়িত্ব সরকারের নেয়া উচিত; বেসরকারীভাবে তা সবার জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।বক্তৃতায় ভারতের কেরালা রাজ্যের উন্নয়নের উদাহরণ টেনে অমর্ত্য সেন বলেন, ভারতের ২৪ প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী প্রদেশ কেরালা। শুধু কেরালাকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সব সূচক থেকে এটি এগিয়ে। তবে গোটা ভারতের বিবেচনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশ এগিয়ে। তিনি বলেন, ভারতের এখন যে উন্নয়ন ঘটেছে তা হলো-তথ্য প্রযুক্তি, ওষুধ ও অটো মোবাইল খাতের রফতানি বাড়ার কারণে। 

১৪.
এডিনবরায় কমনওয়েলথের এক শিক্ষা সম্মেলনে অমর্ত্য সেন মৌলিক শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ক একটি বক্তৃতা করেন।সেটি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষা-সংক্রান্ত এ সম্মেলনে কথা বলতে পারছি বলে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি। এ সম্মেলনের জন্যে এডিনবরাকে বেছে নেওয়ায় আমি খুবই খুশি। শিক্ষার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে আয়োজিত এ সম্মেলনের জন্যে এডাম স্মিথ, ডেভিড হিউম এবং বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের স্মৃতিবিজড়িত এডিনবরার চেয়ে উত্তম স্থান আর কী হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে, কেন শিক্ষাগত বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন? কেন শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষা অর্জন, শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির মধ্যে বৈষম্য থাকবে? পৃথিবীতে পক্ষপাতহীন একটি পরিবেশ তৈরি করতে আমাদের এ বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এইচ জি ওয়েলসের ভাষায়, মানব ইতিহাস ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে শিক্ষা ও বিপর্যয়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতায়। যদি আমরা এভাবেই পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার কক্ষপথ থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে রাখি, তবে পৃথিবী হয়ে যাবে অপেক্ষাকৃত কম নিরাপদ, ন্যূনতম ন্যায়পরায়ণতার পৃথিবী। এইচ জি ওয়েলসের বিংশ শতকের চেয়ে আজকের পৃথিবী এখন আরো অনেক অনিশ্চিত। ৯/১১-এর বিভীষিকা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে অগণন মানুষের মৃত্যু মানব জীবনকে আরো অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। শুধু সন্ত্রাস ও সহিংসতাই মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ নয়। সহিংসতায় যত মানুষ মারা যায়, এইডস রোগে তার চেয়ে কম মানুষ মারা যায় না। মানুষের নিরাপত্তাহীনতা নানাভাবেই তৈরি হতে পারে, সন্ত্রাস ও সহিংসতা তার অন্যতম কারণ মাত্র। সন্ত্রাসবাদ কিংবা গণহত্যা প্রতিরোধ করতে চাইলে আমাদের এই মানব-নিরাপত্তাহীনতার বহুমুখি প্রকৃতি এবং প্রকাশিত রূপগুলি মেনে নিতে হবে। যেহেতু এটা ঘটছে, সেহেতু সকল ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে মৌলিক শিক্ষার প্রসার এবং ফলপ্রসু প্রচারই শক্তিশালী প্রতিরোধী ভূমিকা রাখতে পারে। সারা পৃথিবীতে এই নিরাপত্তাহীনতা হ্রাস করতে সকল ধরনের বৈষম্য এবং অবহেলাকে দূর করতে হবে যেখানে মৌলিক শিক্ষার ভূমিকা বিবেচনা করা জরুরি। 

নিরক্ষরতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব নিরাপত্তাহীনতার দুটি রূপ। যে পড়তে, লিখতে, গুনতে কিংবা যোগাযোগ করতে পারে না, সে সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার। এভাবেই তাঁর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার মানসিকতা গড়ে ওঠে। সফলভাবে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ যদি ব্যক্তির নাগালে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে তা হবে এই বৈষম্য দূর করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, এ নিরাপত্তাহীনতাই পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, সংঘর্ষের সূচনা করে। 

মৌলিক শিক্ষা জীবনকে সহজভাবে দেখতে শেখায়। অসম্ভব দরিদ্র পরিবারগুলোও এ বিষয়টি ভালোভাবে বোঝে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দরিদ্র ও বঞ্চিত পরিবারগুলি শিক্ষাকে কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। 
ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে দেখা গেছে সফলভাবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের মধ্য দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কীভাবে কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরস্কারের পুরো অর্থ দিয়ে আমি তৈরি করেছি ‘প্রতীচী ট্রাস্ট’, যার লক্ষ্য ভারত ও বাংলাদেশে মৌলিক শিক্ষা এবং লিঙ্গ সমতায়নকে ত্বরান্বিত করা। 

আমি দেখেছি, কেন মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হয়। স্কুলের খরচ, নিরাপত্তাসংকট এবং আরও অনেক সামাজিক বাধা তাদের স্বপ্ন পূরণে দেয়াল তৈরি করে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা স্কুলে না পাঠানোর বড় একটি কারণ। এ বাধাগুলো দূর করতে হবে। তবে আরও অনেক বাধা আছে, মেয়েদের নিরাপত্তা ও ছেলেমেয়ের শ্রমের ওপর দরিদ্র পরিবারের নির্ভরতাও স্কুলে না পাঠানোর জন্য দায়ী। পাঠদানের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি জানাতে হবে যাতে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি দূর করা সম্ভব হয়। মানুষের নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে আমাদের পাঠদানের গুরুত্ব বুঝতে হবে। মৌলিক শিক্ষা মানুষকে চাকরি পেতে এবং অর্থসংস্থানে সাহায্য করে। শিক্ষার সাথে অর্থনৈতিক এ সম্পর্ক বিশ্বায়নের এ যুগে খুব জরুরি। এগুলো কিন্তু আমাদের সমাজের নিরপত্তাহীনতারই স্বরূপ। তাই মৌলিক শিক্ষার সম্প্রসারণ করা দরকার। এটি তাদের দারিদ্রের সমাপ্তি টানার ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখাবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষাপ্রাপ্তির সঙ্গে তাদের যে বিশাল শূন্যতা, একে পূরণ করতে হবে। মেইজি স্থাপনের পর জাপানে ১৮৭২ সালে ‘মৌলিক শিক্ষার কোড’ প্রচলন করা হয়। প্রচার করা হয়, কোনো সম্প্রদায়ে একটিও অশিক্ষিত পরিবার থাকবে না, কোনো পরিবারে একজনও অশিক্ষিত ব্যক্তি থাকবে না। শিক্ষা বৈষম্য দূর করার মধ্য দিয়ে আজ জাপান এ শতকের একটি অন্যতম দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের দেশ। ১৯১০ সালে সেখানে অনেক দরিদ্র মানুষ ছিল। এরপর জাপান ব্রিটেনের চেয়েও অধিক বই ছেপে গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্বিগুণ বই প্রকাশ করেছে। আজ তার ফল সুস্পষ্টভাবেই দেখা মেলে।

বিংশ শতকের মধ্যভাগে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুরসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ প্রত্যেকেই এভাবে তাদের উন্নয়নের পথটি তৈরি করেছিল। শিক্ষার প্রসারই একে সহজ করেছে। বিশ্বব্যপী অর্থনীতিতে তাদের অংশ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কারণ, তাদের জনগণ আজ লিখতে ও পড়তে পারে, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তৈরি করতে পারে, নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে। অশিক্ষা মানুষকে তার আইন অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, দেশ গঠন ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। অশিক্ষার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা। নারীরা তাদের অধিকার, প্রাপ্তি, সম্পদের মালিকানা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, তেমনি সমাজে প্রকট বৈষম্যের শিকার হয়। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অবিচার ও অন্যায় আচরণ। গবেষণায় দেখা গেছে, কীভাবে ন্যূনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নারীদের শিক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ত্বরান্বিত করে, যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সঙ্গে নারীর এই দুরত্বকে দূর করা। 

বন্ধুতা এবং বিশ্বস্ততা নির্মাণে হোক কিংবা স্বাধীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারেই হোক, এসব ক্ষেত্রে মৌলিক শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর জন্য প্রয়োজন, একদিকে যেমন শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সকলের জন্য সহজলভ্য করে দেওয়া, অন্যদিকে শিশুদের বিভিন্ন অঙ্গনের জ্ঞানের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া। তারা যেন জিন্তা করতে পারে, কারণ অনুসন্ধান করতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের উৎ সাহিত করা দরকার। মৌলিক শিক্ষা যে শুধু দক্ষতা বৃদ্ধির আয়োজন করে তা নয়। এটি প্রাকৃতিক পৃথিবীর সাথে একাত্ম করে মানুষকে। তার মনকে করে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্রপূর্ণ। বুঝিয়ে দেয় স্বাধীনতা, যুক্তি ও বন্ধুত্বের গুরুত্ব।’(গার্ডিয়ান-এর আর্কাইভ-২০০৩)।

১৫.
‘ব্যক্তি ও সমষ্টি’ ভাবনায় ‘সামাজিক বিকল্প ও সামাজিক কল্যাণ’ প্রবন্ধে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন লিখছেন, ‘মানুষ চিরকাল দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপন করেছে। তাঁর জীবন অনিবার্যভাবে সমষ্টির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজ কাজ নয়। বিশেষত, দলের প্রত্যেক সদস্যের চিন্তা ও স্বার্থ এক নয়। ফলে সামষ্টিক সিদ্ধান্ত কীভাবে গ্রহণ করা সম্ভব? একনায়কেরা মানুষের জীবনের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সেটা করতে গিয়ে তারা অন্য সবার অভিরুচিই অগ্রাহ্য করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেরূপ ক্ষমতা অর্জন করা খুব সহজ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, যেকোনো ধরনের একনায়কত্বই সমাজ পরিচালনার পদ্ধতি হিসেবে মারাত্মক। ফলে সামাজিক বিজ্ঞানীরা সামষ্টিক সিদ্ধান্তের মধ্যে কীভাবে ব্যক্তির চিন্তা প্রতিফলিত করা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই তার উপায় তালাশ করছেন। এমনকি সে সমাজটি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক না হলেও কীভাবে তা করা যায়, সে উপায় বের করতেও তাঁরা নানা গবেষণা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিসে অ্যারিস্টটল ও ভারতে কৌটিল্য তাঁদের গ্রন্থ যথাক্রমে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সামাজিক নির্বাচনের নানা দিক অনুসন্ধান করেছেন (কৌটিল্যের বইয়ের সংস্কৃত শিরোনাম হচ্ছে অর্থশাস্ত্র। এর আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে ‘বস্তুগত কল্যাণের শাস্ত্র’)। একটি আনুষ্ঠানিক শাস্ত্র হিসেবে সামাজিক নির্বাচন প্রথম আলোর মুখ দেখে ১৮ শতকের শেষের দিকে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন ফরাসি গণিতবিদেরা, বিশেষত জে সি বোরদা ও মারকুইস ডি কনডোরেক্ট। তখন ছিল ইউরোপীয় আলোকায়নের স্বর্ণসময়। আলোকায়ন যুক্তিভিত্তিক সামাজিক কাঠামোর কথা বলেছে। আর তার অগ্রাধিকার ছিল মানুষের অভিরুচির ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণ। কিন্তু বোরদা, কনডোরেক্ট প্রমুখের তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফল হয় নেতিবাচক। যেমন কনডোরেক্ট যে ‘নির্বাচনী প্যারাডক্স’ (আপাত স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়)-এর কথা বলেছেন, তাতে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শাসন শেষমেশ এক অচলায়তনের সৃষ্টি করতে পারে। এ ব্যবস্থায় প্রত্যেক বিকল্পই অন্য কোনো বিকল্পের কাছে ভোটে পরাজিত হয়। ফলে কোনো বিকল্পই অন্য কোনো বিকল্পের সামনে দাঁড়াতে পারে না। আজকের সুনির্দিষ্ট ও আধুনিক রূপের যে সামাজিক বিকল্পের তত্ত্ব, তার গোড়া খুঁজলে দেখা যায়, কেনেথ জে অ্যারো ১৯৫০ সালে তাঁর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিসন্দর্ভে তার রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। অ্যারোর তত্ত্বে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ইম্পসিবিলিটি থিওরেম’ রয়েছে।

অ্যারোর এই থিওরেমে দেখা যায়, সমাজে ব্যক্তির অভিরুচির শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে সামাজিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষেত্রে খুব স্বল্প মাত্রায় যুক্তির দোহাই পাড়তে হলে কোনো প্রক্রিয়াতেই এই দুটো শর্ত পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত ও যুক্তি দুটি একত্রে ঠিকঠাক যায় না। তাঁর অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে ১৯৫১ সালে সোশ্যাল চয়েস অ্যান্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল ভ্যালুস গ্রন্থটি রচিত হলে তা তৎক্ষণাৎ ধ্রুপদি গ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে যায়। 

অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও এমনকি সাধারণ জনগণও এক ঝলকেই বুঝে যায়, ফলাফল কতটা ধ্বংসাত্মক। আলোকায়নের চিন্তায় সামাজিক যুক্তির ফুল ফোটার দুই শতাব্দী পর মনে হচ্ছে, ভাসা ভাসা হলেও, এ প্রকল্প অনিবার্যভাবে ধ্বংস হবে। কেন ও কীভাবে অ্যারোর এই অসম্ভাব্যতার ফলাফল এল, তা বোঝা দরকার। যে আনুষ্ঠানিক যুক্তিকাঠামো, এই তত্ত্বের নাড়ি পুঁতে দিয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়, শুধু ব্যক্তির অভিরুচির ক্রমের ওপর নির্ভর করলে একদম বিসদৃশ সামাজিক বিকল্পগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে ওঠে। সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে কিছু বলতে গেলে ব্যক্তিদের লাভ ও লোকসানের তুলনামূলক হিসাব নেওয়া আবশ্যক। তাঁদের সমৃদ্ধির আপেক্ষিক হিসাব নেওয়াও জরুরি। শুধু সামাজিক বিকল্পের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত থেকে তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এটাও পরীক্ষা করা দরকার, কোনো ধরনের অভিরুচি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তা ভোটের নানা প্রক্রিয়ার জন্য সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। তথাপি, গণতন্ত্রের দাবি কী, তা বুঝতে অ্যারোর ইম্পসিবিলিটি থিওরেম এক বড় ভূমিকা পালন করে। তা শুধু ভোট গণনার ওপরই নির্ভর করে না (অবশ্যই সেটা গুরুত্বপূর্ণ)। গণতন্ত্র আরও কার্যকর করতে তথ্যের ভিত আরও সমৃদ্ধ করা ও মিথস্ক্রিয় গণযুক্তি আরও বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে সামাজিক কল্যাণের আরও যৌক্তিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়। সামাজিক বিকল্পের তত্ত্ব একটি বড় শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে, সেটা বিভিন্ন প্রশ্ন আমলে নিয়েছে। কোন পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত ও ধারাবাহিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে? অকাট্য ফলাফল পাওয়ার জন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়াই বা কতটা শক্তিশালী? একটি সমাজ তার ব্যক্তিদের নানামুখী স্বার্থের আলোকে কতটা ভালোভাবে কাজ করছে, সে বিচার আমরা কীভাবে করব? ব্যক্তির অভিরুচির যথাযথ ও সামগ্রিক স্বীকৃতি দিয়ে আমরা কীভাবে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা আত্তীকরণ করতে পারি? সমাজে নানা ধরনের মানুষ আছে, তাদের দুঃখ-দুর্দশাও ভিন্ন। ফলে সমাজের সামষ্টিক দারিদ্র্য আমরা কীভাবে নির্ণয় করব? পরিবেশের মতো গণসম্পদের সামাজিক মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করব? এসব প্রশ্নের বাইরেও ন্যায়বিচারের তত্ত্ব সামাজিক নির্বাচনের তত্ত্ব থেকে রসদ জোটাতে পারে (২০০৯ সালে আমি আইডিয়া অব জাস্টিস বইয়ে যা বলেছিলাম)। তদুপরি, সামাজিক বিকল্পের তাত্ত্বিকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর পরিচালিত গবেষণা থেকে যে বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে, তা এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়—এরূপ গবেষণায়ও সহায়তা করেছে। যেমন লৈঙ্গিক অসমতার পরিণতি ও রূপ বা দুর্ভিক্ষের সংঘটন ও প্রতিরোধ। সামাজিক নির্বাচন তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম, এর পরিসরও বৃহৎ। সামাজিক যুক্তিবিন্যাসের প্রচেষ্টা খাটো না করে অ্যারোর এই গভীরভাবে চ্যালেঞ্জিং ইম্পসিবিলিট থিওরেম, যা আরও অনেক রচনার রসদ জুগিয়েছে- আমাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে যৌক্তিক উপায়ে ভাবতে উৎসাহিত করেছে। এর ওপরই আমাদের বেঁচে থাকা ও সুখ নির্ভর করে।’

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত