আনিসুল হক

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৫২

ছবি- আনিসুল হক ও লেখক আবদুল্লাহ আল মোহন

১.
আমাদের সকলের প্রিয় আনিস ভাইয়ের (সাবেক নগরপিতা আনিসুল হক) মহাপ্রয়াণ দিন আজ। অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আনিস ভাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, নন্দিত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হক, আমাদের অনেকের পরম স্বজন, স্বপ্নদ্রষ্টা আনিস ভাইকে স্মরণ না করে পারি ? কত শত স্মৃতি যে ছড়িয়ে-জড়িয়ে আছে আপনার সাথে আনিস ভাই কী করে ভুলি সে সব? না, ভুলি নাই, ভুলি নাই আনিস ভাই …। স্বপ্নকে সফল করা অনন্য মানুষ আনিসুল হক ১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। (যদিও বিভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্মদিন বা তারিখ ২৭ সেপ্টেম্বর উল্লেখ পাই কিন্তু আমি বনানী কবরস্থানে খোদিত ফলকে তার জন্মতারিখ ২৭ অক্টোবর পেয়েছি বলে সেটাকেই সঠিক বলে ধরে নিচ্ছি)। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর, লন্ডন সময় ৪:২৩ মিনিটে, বাংলাদেশ সময় রাত ১০:২৩ মিনিটে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোক গমন করেন। নাতির জন্ম উপলক্ষে সে বছরের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে লন্ডনে যান ৬৫ বছর বয়সী আনিসুল হক। তিনি সেরিব্রাল ভাসকুলাইটিসে (মস্তিষ্কের রক্তনালীর প্রদাহ) আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন জনপ্রিয় এ ব্যক্তিত্ব। 

২.
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে তার ছিলো গভীর আত্মিক সম্পর্ক। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সহকারি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে আনিসুল হক উঠেছিলেন প্রিয় আনিস ভাই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুখ-দু:খ, বিপদে-আপদে তার নিরন্তর সহযোগিতার কথা যেমন ভুলতে পারি না, তেমনই আমাদের সাথে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার নানা স্মৃতির মেঘমালা আজ ভারাক্রান্ত করে মনকে। বহুমাত্রিক জীবন ছিলো তার। যেখানেই গিয়েছেন, উজ্জ্বল করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন চারপাশের সবাইকে। তার জনসংযোগ সক্ষমতাটা ছিল দারুণ অনুকরণীয়। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এমন মনমানসিকতা খুব কম মানুষেরই হয়। স্বপ্নবান আর নিজের প্রতি অসম্ভব আস্থাশীল মানুষের প্রতিমূর্তি ছিলেন আনিস ভাই। তার সাথে সায়ীদ স্যার আর জুয়েল আইচের সাথে দীর্ঘ সময়ের আলাপন শুনেছি মনোযোগ দিয়ে, ঋদ্ধ হয়েছি। সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে কিভাবে সাফল্য লাভ করা যায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ ছিলেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে স্বপ্নকে সফল করার ক্ষেত্রে তার নানান ভূমিকা আমার মতোন অনেকেই মুগ্ধ করতো সবসময়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে, সাফল্যের জন্যেই নিজেকে তৈরি করতে হবে, স্বক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে। শূন্য থেকে শিখরে উঠেছিলেন স্বপ্নের সমান বড় কিংবা স্বপ্নের চেয়েও বড় করে তুলেছিলেন নিজেকে। পরিকল্পনা করে কাজ করতে জানতেন, ভবিষ্যতের গতিপথ বুঝে কাজে নামার কথা বলতেন। সেই আনিস ভাই অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে অচেনালোকে চলে গেলে আমাদের যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়ই থেকে যায় বলে দৃশ্যমান হয়।

৩.
আনিসুল হক নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কবিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার শৈশবের একটি বড় সময় কাটে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে নানার বাড়িতে। তার বাবা শরীফুল হক ছিলেন আনসার কর্মকর্তা; মা রওশন আরা হক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন আনিসুল হক। আনিসুল হক স্ত্রী রুবানা হক এবং তিন সন্তান রেখে প্রয়াত হন। আশির দশকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের বিকাশের পর্বে এর সঙ্গে জড়ান তিনি। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন আনিসুল হক। তৈরি পোশাক ছাড়াও এ গ্রুপের রয়েছে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা। 'ডিজিযাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড' ও 'নাগরিক টেলিভিশনের' মালিকানাও তার ব্যবসায়ী গ্রুপের। আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাদের ছেলে নাভিদুল হক এবং মেয়ে ওয়ামিক উমাইরা ও তানিশা ফারিয়ামান হকও গ্রুপটির পরিচালক। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান 'দেশ এনার্জি লিমিটেডের' ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন নাভিদুল। ওয়ামিক উমাইরা স্নাতক শেষ করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের সিমন্স কলেজ থেকে স্নাতক করেছেন তানিশা ফারিয়ামান। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক ছিলেন আনিসুল হকের ভাই। তার আরেক ভাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইকবাল হক পেশায় চিকিৎসক। মার্কিন নৌবাহিনীতে কর্মরত তার আরেক ভাই হেলাল হক। 

৪.
গত শতাব্দীর আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে সুপরিচিত টিভি উপস্থাপক ছিলেন আনিসুল হক। বিটিভিতে (বাংলাদেশ টেলিভিশন) তার উপস্থাপনায় 'আনন্দমেলা' ও 'অন্তরালে' অনুষ্ঠান দুটি পায় তুমুল জনপ্রিয়তা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিটিভিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা বিশেষভাবে আলোচনায় আসেন। এরপর তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। শিখরস্পর্শী ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম অর্জনের পর এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। 

৫.
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। মেয়র হিসেবে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তার মোড় থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে রাস্তা নির্মাণ, গাবতলীতে ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়ে রাস্তা সংস্কার, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর কূটনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গুলশান-বারিধারার নিরাপত্তা জোরদার, গুলশান-বনানী এলাকা থেকে পুরনো বাস সরিয়ে ‘ঢাকা চাকা’ নামের নতুন এসি বাস সার্ভিস চালু, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনভুক্ত বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, ‘সবুজ ঢাকা’ নামের বিশেষ সবুজায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে নাগরিকমহলে বিশেষ প্রশংসিত হন তিনি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সমস্যায় দিনে-রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েও নাগরিকবাসীর আস্থাভাজন হয়েছেন তিনি।

৬.
মানবসমাজে একজন মানুষ যদি তার সততা, সদিচ্ছা ও সাহসিকতার যথাযথ ব্যবহার এবং প্রয়োগ করে সমাজ, দেশ ও জাতিকে কিছু উপহার দিতে চান তবে তা অনায়াসেই প্রদান করতে পারেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন সৎ, সাধারণ গর্বিত পিতার সন্তান পিতার প্রদর্শিত আদর্শ ও শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত এবং অনুপ্রাণিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রথমে নিজ পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর একজন সৎ ও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বাংলাদেশ এবং বিদেশী ব্যবসায়িক সংস্থার প্রধান নির্বাচিত হয়ে দারুণ সফলতা লাভ করেছিলেন। ভদ্র, শিক্ষিত, জনপ্রিয় এই মানুষটির আচার-আচরণ, কথাবার্তা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মানুষের দৃষ্টি ও হৃদয়কে জয় করেছিল। সরাসরি রাজনীতি না করেও এক বর্ণাঢ্য জীবনের মঞ্চে অবস্থান করেছিলেন আনিসুল হক। স্বপ্নজয়ের সিঁড়িতে ভর করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নগরবাসীর নজর কেড়েছিলেন তিনি। স্থবির হয়ে পড়া রাজধানীর গতিও ফিরিয়েছিলেন খানিক। রাজনৈতিক পরিচয়ে মেয়র নির্বাচিত হলেও পেশীশক্তির রাজনীতিতে পা রাখেননি কখনই এই সফল ব্যবসায়ী। নষ্ট রাজনীতির কাদা গায়েও লাগননি তিনি। বরং রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করছেন, তাদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। আর তাই তার বিদায় বেলায় কাঁদছেন অরাজনৈতিক আর রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষরাও।

৭.
নতুন ঢাকা গড়ার উদ্যোক্তা আনিসুল হক মেয়র হিসেবেও আদর্শ ছিলেন। খুব বেশি দিন সে কাজ করার সুযোগ পাননি তিনি, অল্প দিনেই ঢাকা উত্তরকে ঢেলে সাজিয়েছেন। ‘ক্লিন ঢাকা, গ্রিন ঢাকা’ শুধু তার স্লোগানই ছিল না, কাজ করে প্রমাণও রেখে গেছেন। রাস্তার পাশে প্রশস্ত ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজগুলোতে ফুলের টব, বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে মনোরমভাবে সাজানো, কী করেনি সে। সাতরাস্তার ট্রাকস্ট্যান্ড উঠিয়ে মানুষ চলাচলের যোগ্য করা, ‘ঢাকার চাকা’ নামে গুলশান এলাকায় গাড়ি চালু করা, লেকের পাড় দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি থেকে শুরু করে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার সব দিকেই সফল আনিসুল। দায়িত্ব পালনকালে রংবাজ, মস্তানসহ বিভিন্ন দলীয় পরিবহন মালিক, শ্রমিক বা কোন মতলববাজ মহলের কাছে নতি স্বীকার বা আপোস করেননি তিনি। কোন প্রকার ভয়ভীতি ও অনুরোধের প্রতি কর্ণপাত না করে নিজ জীবনকে বিপন্ন করে অত্যন্ত শান্ত মস্তিষ্কে সাহসিকতার সঙ্গে একজন মেয়র হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছিলেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, সঠিক ও সুচিন্তিত গঠনমূলক সদিচ্ছা এবং উদ্যোগ থাকলে, জনগণের কল্যাণে যে কোন কঠিন ও দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা যায়। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ, মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। তিনি নিজ কাজের মধ্য দিয়ে ঢাকাবাসীর অন্তরের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

৮.
মাত্র দুই বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নগরের রূপ বদলে দিতে পেরেছিলেন খানিকটা। তার জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ আর স্বপ্নের মধ্য দিয়েই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন নগরবাসীর মাঝে। ঢাকা উত্তরের ব্যাপক উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে তিনি সরকারপ্রধান ও শহরের উত্তরের জনগণের কাছে পেশ করে তার যথাযথ বাস্তবায়নে মহাকর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। তিনি সবচেয়ে দুরূহ ও অসম্ভব কাজগুলো অত্যন্ত স্বল্পসময়ের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন। অতীতের কাজের স্মৃতির জানালা খুলে আনিসুল হকের অভাব টের পাচ্ছেন উত্তরের বাসিন্দারা। নগরপিতা আনিসুল হকের নানা অর্জন প্রায় ম্লান হতে বসেছে দেখতে পাই বলেই তার অভাবকে অনুভব করি তীব্রভাবে। আশাকরি, তার কাজের মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

৯.
জানি, সবাইকেই যেতে হবে, তবু সব যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। তার চলে যাওয়াটাকে মানতে আজো ভীষণই কষ্ট হয়। আমাদের প্রিয় মানুষ, প্রিয় আনিস ভাইয়ের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত