জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

পাবলো পিকাসো

‘তুমি যা কিছু কল্পনা করতে পারো তার সবই বাস্তব।’ (Everything you can imagine is real.)- পিকাসো

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০১৮, ১১:৫৩

১.
বিশ্ববরেণ্য স্পেনীয় চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর পাবলো পিকাসো, বিংশ শতাব্দীর সেরা চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম। পিকাসো কিউবিস্ট ধারার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিখ্যাত। বৈচিত্র্যের জন্যও তার শিল্পকর্ম সমাদৃত। বিশ্ববিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর পাবলো পিকাসো ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের মালাগায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, পাবলো পিকাসো ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে ফ্রান্সের মুগী শহরে পরলোকগমন করেন। পিকাসো নিঃসন্দেহে সর্বকালের একজন সেরা সৃজনশীল শিল্পী। কিউবিজম তথা আধুনিক শিল্পকর্মের প্রধান প্রবর্তক ও পথিকৃৎ পিকাসো শিল্পী হিসেবে যেন এ যুগের এক বিস্ময়। যেমন ছিল সৃজনক্ষমতা তেমনই ছিল মাধ্যমের ব্যবহারে তাঁর দক্ষতা। একই সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করার সামর্থ্য তাঁর মতো অন্য কারো তেমন ছিল না। রাজনৈতিকভাবে, পিকাসো ছিলেন একজন শান্তিবাদী এবং সাম্যবাদী। তিনি তার মৃত্যু পর্যন্ত ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একবার এক প্রশ্নের জবাবে সেই পিকাসোই বলেছিলেন, ‘আমি যাদের ভালোবাসি তাদের প্রতি নোংরা আচরণ করি, যাদের আমি পাত্তাই দিই না তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি।’ এই হচ্ছেন পিকাসো।

২.
Art washes away from the soul the dust of everyday life.- পিকাসো
পাবলো রুইজ পিকাসো বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর ও ভাস্কর যিনি পাবলো পিকাসো নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। স্পেনের মালাগা শহরে জন্মগ্রহণকারী এই বিশ্বনন্দিত শিল্পীর পূর্ণ নাম ২৩টি শব্দ দিয়ে গঠিত। পাবলো দিয়েগো খোসে ফ্রান্সিসকো দে পাউলা খোয়ান নেপমুসেনো মারিয়া দে লস রেমেদিওস সিপ্রিয়ানো দে লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ মার্টির পাট্রিসিও ক্লিতো রুইজ ই পিকাসো। স্পেনে জন্মগ্রহণ করলেও পিকাসো নিজ জন্মস্থানে থাকতে পারেননি। দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় তিনি ফ্রান্সে অবস্থান করেন। জীবনের একটা বড় অংশ তিনি ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে উত্তর আধুনিকতার জনক বলা যায় তাঁকে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে বিশ্বের চারুকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। বাস্তববাদী অঙ্কনরীতি যেমন তার হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তেমনি পরাবাস্তববাদী শিল্পরীতিও সমৃদ্ধ হয়েছে তার প্রতিভার স্পর্শে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্ম লেস ডিমোয়সিলিস দ্য এভিগনন (১৯০৭) ও গোয়ের্নিকা (১৯৩৭) অন্যতম। শৈশব এবং কৈশোরে রিয়ালিস্টিক ধারায়ও অতিপ্রাকৃতিক শৈল্পিক মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন পিকাসো। তবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তিনি বিভিন্ন শিল্প তত্ত্ব, কৌশল এবং ধারণার মুখোমুখি হন। তদানীন্তন ইউরোপ সমাজের ক্রান্তিকালে ঘুণে ধরা সমাজের পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনি যে শৈল্পিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন এর প্রভাব সে সময়কার অন্যান্য মহান শিল্পীর ওপর দারুণভাবে পড়েছিল। যে কোনো কল্পনাকেই তিনি জীবিত ফুটিয়ে তুলতেন তার নিপুণ হাতের তুলির সাহায্যে। সেদিনের তার অশ্রান্ত ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ২০ হাজারেরও অধিক চিত্রশিল্প আজ অবধি বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে নিদর্শন হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

৩.
তার বাবার নাম ডন জোসে রুইজি ব্লাস্কো এবং মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। পিকাসোর শিল্পী হওয়ার পেছনে তার বাবার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। কারণ পিকাসোর বাবাও একজন চিত্রকর ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই অঙ্কনের প্রতি পিকাসোর এক ধরনের ঝোঁক ছিল। আর ফিগার ড্রইং এবং তৈলচিত্রের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই। তার বাবার ছবিতে তার অঙ্কনের গল্পটি ছিল এরকম- বাবা একদিন দেখলেন, তার অসমাপ্ত কবুতরের চিত্রটি পিকাসো এত নিখুঁতভাবে আঁকছে যে, তার মনে হলো না এটি একটি ১৩ বছরের ছেলে আঁকতে পারে। তার বাবার মনে হলো পিকাসো তাকে অতিক্রম করে গেছে। এরপর থেকে পিকাসোর বাবা পেইন্টিংয়ে ইস্তফা দেয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করেন। পিকাসো পড়াশোনার জন্য মাদ্রিদে যান এবং পড়াশোনা শেষে প্যারিসে চলে আসেন। এখানে তিনি বন্ধু ম্যাক্স জ্যাকবের সহায়তায় ভাষা এবং সাহিত্যের ওপর দখল নেন। 

৪.
পিকাসো ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ধাত্রী ভেবেছিলেন মৃতশিশুর জন্ম হয়েছে। এই কারণে ধাত্রী শিশুটিকে একটি টেবিলের ওপর রেখে মায়ের সেবা-শুশ্রুষায় ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় শিশুটিকে টেবিলের ওপর নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে তার চাচা এগিয়ে আসেন এবং তার মুখে থাকা সিগারেটের ধোঁয়া শিশুটির মুখে নিক্ষেপ করা মাত্রই শিশুটি নড়াচড়া দিয়ে ওঠে। শিশু পিকাসোর মুখ থেকে উচ্চারিত প্রথম শব্দটি ছিল পিজ। পিজ শব্দটি লাপিজ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। স্পেনের ভাষায় লাপিজকে পেন্সিল বলা হয়। মাত্র ৯ বছর বয়েসে পাবলো পিকাসো তার জীবনের প্রথম তৈলচিত্রের কাজ সম্পন্ন করেন। 

৫.
স্পেনে অল্প বয়স থেকেই শিল্পীর শিল্পচিন্তার বিকাশ ঘটে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি পান্ডিত্যপূর্ণ সব ড্রয়িং আঁকতে পারতেন। বাবা তাঁর ছেলের ছবি আঁকার ক্ষমতা দেখে অভিভূত হন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, বড় হয়ে এই শিশু একদিন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হবে। তখন থেকে মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায় শিল্পীর শিক্ষানবিশি চলে একনাগাড়ে ১৯০০ সাল পর্যন্ত। পিকাসোর অল্প বয়সের আঁকা ড্রয়িংগুলো দেখে সমালোচকরা তাঁকে রাফায়েলের সমকক্ষ বলতেন। পিকাসো বলতেন, ‘আমার ছবি আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাকে দিয়ে সে তার চাহিদামাফিক কাজ করিয়ে নেয়।’ ওঁর নবীন বয়সের ‘সেবা ও বিজ্ঞান’ দেখেই ওঁর শিল্পনৈপুণ্য আন্দাজ করে নেওয়া যায়, যেটাতে অসামান্য দক্ষতা ও একাগ্রতার ছাপ ছিল সুস্পষ্ট। এ ছবি দেখে মনে হয় যেন স্পেনের কোনো প্রাচীন শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি। অথচ শিল্পী এটা করেছেন ওঁর মাত্র ষোলো বছর বয়সে। পিকাসো প্রতিটি ধাপে এগিয়ে গেছেন শিল্পেরই প্রয়োজনে, শিল্পেরই আহবানে। আর পিকাসোর বয়স ও পরিপক্বতার তুলনায় তা হয়ে উঠেছে অনেকখানিই অগ্রগামী। নিজের শিল্পপরিবেশ এবং যার ভেতর দিয়ে তিনি বড় হয়েছেন, সেসবই পিকাসোর উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল, যা তাঁর অন্তরকে করেছিল প্রগাঢ় শিল্পবোধ, শিল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পমূল্যবোধে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসবই একজন সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে পিকাসোর সৃষ্টি-রহস্যের সারবস্ত্ত ও ভিত্তি। পিকাসো তার জীবদ্দশায় ২০ হাজারের অধিক শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে গেছেন।

৬.
মাত্র ১৪ বছর বয়সে পিকাসো ধর্মীয় সংবলিত কিছু ছবি সিরিজ আকারে এঁকেছিলেন যা তিনি কখনই বিক্রির আগ্রহ দেখাননি। পিকাসো কেবল কুড়ি পেরোলেন। তখন দারিদ্র্য তাঁর নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে তাঁর এক বন্ধু আত্মহত্যা করেছেন। পিকাসোর তুলিতে তখন আঁকা হচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত বিপন্ন মানুষ। রঙের ব্যবহারে অন্যসব রংকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নীল। এটিই পিকাসোর চিত্রকর জীবনের ‘নীল অধ্যায়’ (১৯০১-০৪) বা ব্লু পিরিয়ড। এই সময়কালে শিল্পীর ক্যানভাসে কেবল মানুষের দুঃখ, ক্লেশ আর দুর্দশা ফুটে উঠত। কারণ খাবার কিংবা ছবি আঁকার উপকরণ কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা তখন ছিল না তাঁর। ভীষণ শীতে সে সময় ঘর উষ্ণ করার জন্য যখন মরিয়া হয়ে উঠতেন, কখনো পিকাসোকে তাঁর আঁকা ছবি পুড়িয়ে ঘর উষ্ণ করতে হয়েছে। ১৯০৪ সাল থেকে ১৯০৫ সাল ছিল শিল্পীর জীবনে রুপালি বছর। এই দিনগুলোতে তিনি প্যারিস শহর এবং সার্কাস পার্টি দ্বারা আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

৭.
শিল্পীর সৃষ্টি কিউবিজম পিরিয়ডের স্থায়িত্ব কাল ছিল ১৯০৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত। ১৯৮১ সালে পিকাসোর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বিখ্যাত চিত্রশিল্প গুয়ের্নিকা নিউইয়র্কের মর্ডান আর্ট মিউজিয়াম থেকে মাদ্রিদে ফেরত আনা হয়। পিকাসোর ইচ্ছাটি বাস্তবায়ন করতে তদানীন্তন স্বৈরাচারী সরকার ফ্রানেকার পতন অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্পেনের ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক তিনি অপদস্থ ও নিগৃহীত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্যারিস থেকে আন্টিবে আসেন পিকাসো। সঙ্গী প্রেমিকা চিত্রশিল্পী ফ্রাঁসোয়া জিলো (১৯৫৩ সালে পিকাসোকে ছেড়ে যাওয়ার আগে জিলোর গর্ভে পিকাসোর দুই সন্তানের জন্ম হয়)। জিলো তার বইয়ে লিখেছেন, আন্টিব আর কানের মধ্যবর্তী উপকূল তখন জনমানবহীন এক জায়গা। এখানেই পিকাসোর সাক্ষাৎ হয় বিখ্যাত আলোকচিত্রী মাইকেল সিমার সঙ্গে। সিমা পিকাসোকে গ্রিমালদি দুর্গের সন্ধান দেন। রোমান এই দুর্গটি চতুর্দশ শতকে পুনর্নির্মাণ করে ফ্রান্স। তখন দুর্গের নাম দেয়া হয় মুজে গ্রিমালদি বা গ্রিমালদি জাদুঘর। ঠিক ওই সময়টাতে জাদুঘরের সুবিশাল জায়গা ভরাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন জাদুঘরের কিউরেটর। খুশি মনেই দুর্গের দোতলায় প্রহরীদের একটা ঘর পিকাসোর স্টুডিও হিসেবে ছেড়ে দিতে রাজি হলেন তিনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি। মাস দুয়েক সময় এই স্টুডিওতে কাটিয়েছিলেন পিকাসো। এই দুই মাসেই (মতান্তরে তিন থেকে চার মাস) তার শিল্প সৃষ্টি ছিল বিস্ময়কর। এর মধ্যেই তিনি এঁকেছিলেন ২৩টি পেইন্টিং আর ৪৪টি ড্রয়িং! গ্রিমালদি ছেড়ে যাওয়ার আগে পিকাসো কথা দিয়েছিলেন ‘শুভেচ্ছা উপহার’ হিসেবে তিনি দুর্গের দেয়ালসজ্জার কাজটি করে দিয়ে যাবেন। শেষ পর্যন্ত পিকাসো তার কথা রাখতে পারেননি। তবে, দেয়ালসজ্জার বদলে পিকাসো আন্টিবে আঁকা সব ছবিই দান করে দেন এই জাদুঘরে। ১৯৪৮ সালে তার নিজের করা আরও ৭৮টি সিরামিকসের কাজ এই জাদুঘরে দেন পিকাসো। এগুলো পিকাসো তৈরি করেছিলেন আন্টিবের কাছেই তার ভেলোরিসের স্টুডিওতে। থালা, ফুলদানি এমন নানা তৈজসপত্রের ওপরে তার ‘হাতের কাজ’ দেখিয়েছিলেন পিকাসো। সম্ভবত, এই সময়টাতেই সিরামিকসের কাজের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন পিকাসো। তিনি ভেবেছিলেন, কেউ তার আন্টিবের কাজ দেখতে চাইলে আন্টিবে এসেই তাকে তা দেখতে হবে। ১৯৬৬ সালে পিকাসোর সম্মানে আন্টিবের মেয়র জাদুঘরের নতুন নাম দেন পিকাসো মিউজিয়াম। 

৮.
পিকাসো মানব না দানব - এ বিতর্কটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন তাঁর ভালোবাসার এবং উপেক্ষার নারীরাই। যেমনটি জানা যায়, পিকাসোর প্রণয়িনী ও উৎসাহদাত্রীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন ফ্রাঁসোয়াজ জিলো।১৯৪৩-৫৩ প্রায় দশ বছর চিত্রকলার শিক্ষার্থী ফ্রাঁসোয়াজ জিলো পিকাসোর মিসট্রেস ও প্রেরণাদাত্রী ছিলেন; বৈধতার সংকট মেনে নিয়েই তিনি শিল্পীর ক্লদ ও পালোমা – এক পুত্র ও এক কন্যার জননী হয়েছেন। পিকাসোর নারীদের অন্তত একজন ফ্রাঁসোয়াজ জিলো নিজেকে এই শিল্পীর কাছে শতভাগ সঁপে দেননি। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান ফ্রাঁসোয়াজ প্রতিবাদী ছিলেন এবং তাঁর ভাষায়, ‘অন্য নারীদের মতো নিজেকে পিকাসোর কাছে বিছিয়ে দেননি। তিনিই পিকাসোকে ত্যাগ করেছেন। তাঁকে নিয়ে আঁকা ছবির মধ্যে রয়েছে : ওমেন ফ্লাওয়ার। সেই ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর পিকাসোর সঙ্গে জীবন কেন্দ্রিক গ্রন্থ আরিয়ানা হাফিংটনের পিকাসো : স্রষ্টা ও ধ্বংসকারী এবং আরো কিছু রচনা অনুসরণ করে জেনেট হাউলের লিখিত গ্রন্থ ‘দুর্বিনীত রক্ষিতার চোখে পিকাসো’। 

২০১১ সালে নব্বই বছর বয়সে জেনেট হাউলের কাছে অনেক বছর পর ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মুখ খোলেন তাঁর নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে। স্মর্তব্য, তিনি নিজ মেধা ও শৈলীতে একজন উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী এবং পিকাসোকে নিয়ে লেখা বেস্ট সেলার একটি গ্রন্থের রচয়িতা। ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বলেছেন, আমিই একমাত্র নারী যে পিকাসোকে পরিত্যাগ করে এসেছি। আমিই একমাত্র নারী যে এই ঐশ্বরিক দানবের কাছে নিজেকে বলিদান করিনি, আমিই একমাত্র নারী যে তাঁর কাহিনি বলার জন্য এখনো বেঁচে আছি। ভ্রূ উঁচিয়ে তিনি বলেছেন, অন্যদের কী হয়েছে দেখো - ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টার আর জ্যাকুলিন রোক আত্মহত্যা করেছে – প্রথমজন ফাঁসিতে ঝুলেছে, দ্বিতীয়জন নিজেকে গুলি করেছে। ওলগা খোকলোভা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়েছে আর ডোরা মার তো বদ্ধ উন্মাদ। মনমোহিনী ফ্রাঁসোয়াজ জিলো যখন চবিবশ, তাঁকে নিয়ে পিকাসোর আঁকা বহু ছবি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে।

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো বলেছেন, ‘পাবলো আমার সঙ্গে অনবদ্য এক মানুষ – তার সঙ্গ আতশবাজির সঙ্গে থাকার মতো। পাবলো বিস্ময়কর ধরনের সৃজনশীল, মেধাদীপ্ত এবং জাদুকরী ব্যক্তিত্বের মানুষ। তার মন যখন মোহিত করতে চায়, এমনকি পাথরও তার সুরে নাচতে চাইবে। কিন্তু পাবলো একই সঙ্গে অন্যের প্রতি নির্মম, মর্ষকামী ও নির্দয়, কখনো নিজের প্রতিও। পাবলো চাইত সবকিছুই তার ইচ্ছে অনুযায়ী হবে, নারীকে থাকতে হবে তার সেবায়। সে নারীর জন্য নয়। পাবলো ভাবত সে ঈশ্বর – কিন্তু সে তো ঈশ্বর নয় – এটা তাকে বিচলিত করত। পাবলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেম, কিন্তু (তার মতো ঐশ্বরিক দানবের সঙ্গে থেকে) নিজেকে রক্ষা করার পদক্ষেপও তো নিতে হবে। আমি নিয়েছি। ধ্বংস হয়ে যাবার আগে আমি বেরিয়ে এসেছি। অন্যরা পারেনি। তারা প্রবল শক্তিশালী মিনোটার (গ্রিক উপকথার অর্ধেক মানব, অর্ধেক ষাঁড়) আঁকড়ে থেকেছে এবং সেজন্য চরম মূল্য দিয়েছে।’

ফ্রাঁসোয়াজ জিলো খোলামেলাভাবেই বলছেন, ‘আসলে দুজনের সম্পর্কটা ছিল মূলত শারীরিক। পিকাসোর আঁকা তার ছবিগুলো যৌনতাধর্মী, গীতিময়, কোমল, পান্ডুর এবং সমুদ্রবরণ রঙে ছাওয়া। মেয়েটির জন্য আমার মায়া হয়, কারণ সে নিষ্পাপ – তেমন চাতুর্য নেই তার, অক্রিয়, মধুর এবং সুন্দর। সে পিকাসোকে অর্চনা করত, তার জীবনে আর কিছু ছিল না।১৯৩৫-এ তাদের একটি কন্যাসন্তান জন্মে, মায়া তার নাম।’ জিলো আরো বলেছেন, ‘ভালোবাসা নিয়ে পিকাসোর ধারণাটি মূলত শারীরিক এবং অধিকারের, কিছু দেবার নয়। আবার একই সঙ্গে তার বুদ্ধিদীপ্ত ভালো দিক হচ্ছে যখন কেউ তার সঙ্গে তার ভাবনার কথা শুনছে, তাকে রঙের কাজ করতে দেখছে সে এতই বিস্মিত হবে যে, ভাববে, বুঝি অলৌকিক কিছু দেখছে। এই অনুভূতি পিকাসো দিতে পারে – আর এটা যার বোঝার ক্ষমতা আছে সে-ই এই অনুভূতিতে ভাগ বসাতে পারে।’

৯.
পিকাসোর নারীর ছবি ছবির আরো কয়েকজন নারীর কিছুটা পরিচয় না জানলে আসলে তাঁর জীবনকে, সৃষ্টিকে অচেনাই থেকে যাবে, অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ক্রমান্বয়ে তুলে ধরছি।

ফার্নান্দে অলিভিয়ে : পিকাসো যখন তাঁর শিল্পীজীবনের নীল অধ্যায় অতিক্রম করছেন, লালের আভা উঁকি দিতে শুরু করেছে, এমনি সময় ৪ আগস্ট ১৯০৪ অপ্রত্যাশিত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে আরো অপ্রত্যাশিতভাবে আবির্ভূত হন পিকাসোর চেয়ে চার মাসের বড় বৃষ্টিভেজা ফার্নান্দে অলিভিয়ে। তিনি তখন অন্য শিল্পীদের মডেল হিসেবে কাজ করতেন। পিকাসো তাঁকে বেঁধে ফেললেন প্রণয়ের বন্ধনে। ১৯০৪ থেকে ১৯১২ – সাত বছরেরও বেশি সময় তিনি শিল্পীর সঙ্গে ছিলেন, মিসট্রেস হিসেবেই। সে সময় পিকাসো তাঁকে অন্য কারো মডেল হতে নিরস্ত করেছেন।তাঁকে নিয়ে আঁকা পিকাসোর ভাস্কর্য : নারীর মাথা (১৯০৯)।

ইভা গুয়েল : ফার্নান্দে অলিভিয়ে ১৯১২ সালে পিকাসোকে ছেড়ে যান। সে সময় তাঁর জীবনে আসেন সাতাশ বছর বয়সী মার্সেল হামবার্ট কিংবা ইভা গুয়েল। পিকাসো তখন একত্রিশ। ১৯১৫ সালে যক্ষ্মা কিংবা ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যু হয়। পিকাসো ব্যথিত হয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। ইভাকে নিয়ে ‘আই লাভ ইভা’ নামে কয়েকটি ছবিও এঁকেছেন। ১৯১৩ সালে আঁকা ‘ওমেন ইন আর্মচেয়ার’ ইভাকে নিয়ে আঁকা অন্যতম শ্রেষ্ঠ তেলচিত্র।
ওলগা খোকলোভা : ব্যালে নৃত্যশিল্পী ওলগার সঙ্গে পিকাসোর দেখা রোমে। শিল্পী তখন ব্যালে নৃত্যনাট্য ‘প্যারেডে’র ডিজাইন করছিলেন। প্যারিসের এক রুশ অর্থোডক্স চার্চে ১৯১৮-তে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের সাক্ষী ছিলেন জ্যঁ ককতো। বিয়েটা সুখের হয়নি। দুজন ভিন্ন মেজাজের শিল্পীর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। তাঁকে নিয়ে আঁকা পিকাসোর ছবির মধ্যে রয়েছে : হাতলওয়ালা চেয়ারে ওলগা (১৯১৩)।
ম্যারি-থেরেস ওয়াল্টার : ওলগার সঙ্গে বিবাহিত থাকা অবস্থায় ১৯২৭ সালে ছেচল্লিশ বছর বয়সী পিকাসোর সঙ্গে সতেরো বছর বয়সী ম্যারির দেখা। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৬ প্রায় দশ বছর পিকাসোর মিসট্রেস ও মিউজ। এ সময়গুলোয় পিকাসো স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতেন। তাঁকে নিয়ে পিকাসোর হাতে উঠে এসেছে কিছু অসাধারণ স্নিগ্ধ ছবি। ‘স্বপ্ন’ ও ‘ঘুমন্ত’ এরকম দুটি ছবি। পিকাসোর লেখা একটি কবিতার উলটো পিঠেই ম্যারি-থেরেস লিখেছেন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার যা কিছু আছে তার সবই তোমাকে দিয়েছি।’ পিকাসোর মৃত্যুর চার বছর পর থেরেসে আত্মহত্যা করেন। 

ডোরা মার : যুগোস্লাভিয়ান ফটোগ্রাফার ডোরা মারকে পিকাসোর বাম রাজনীতির প্রতি আসক্তি ও প্রতিবাদী চিত্রের প্রেরণা বলে মনে করা হয়। ১৯৩৬ সালে পিকাসো চুয়ান্ন, ডোরা ঊনত্রিশ; ডোরা স্প্যানিশ গণযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে আঁকা গুয়ের্নিকার হয়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বের চিত্র ধারণ করেন। মিসট্রেস হিসেবে পিকাসোর সঙ্গে কাটিয়ে দেন ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত আট বছর। শিল্পী তাঁকে নিয়ে আঁকা কেন তাঁর ‘ক্রন্দসী’ সিরিজের বহু ছবি। বঞ্চিত ডোরার জীবনে পিকাসো অধ্যায় শেষ হলে নিজে ছবি আঁকতে শুরু করেন, প্যারিসে প্রদর্শনীও করেছেন। নিঃসঙ্গ, জনবিচ্ছিন্ন ও দরিদ্র অবস্থায় তাঁর শেষ দিনগুলো কাটে। ডোরাকে নিয়ে পিকাসোর সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘দ্য উইপিং ওমেন’- ক্রন্দসী নারী।
জেনভিয়েভ লোপার্ত : ১৯৪৪ সালে সতেরো বছর বয়সী এই তরুণী স্কুলের সংবাদপত্রের জন্য পিকাসোর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে পিকাসোর বয়স সত্তর বছর – জেনভিয়েভ তাঁকে দেখতে তাঁর স্টুডিওতে আসেন। গ্রীষ্মে তাকে নিয়ে চলে যান সেইন্ট ত্রোপেজ। তাকে নিয়ে সেখানেই থাকতে চান। কিন্তু এই তরুণী যেতে অসম্মতি জানান। ১৯৫৩ সালে তাকে ছেড়ে যান। একই সময়ে ফ্রাঁসোয়াজও পিকাসোকে পরিত্যাগ করেন। তাঁকে নিয়ে পিকাসোর ছবি : জেনভিয়েভের পোর্ট্রেট (১৯৫১)।

জ্যাকুলিন রোক : মৃৎশিল্প প্রদর্শনী ও বেচাকেনার দোকানের সেলসগার্ল জ্যাকুলিনের সঙ্গে ১৯৫৩ সালে পিকাসোর প্রণয় পর্ব যখন শুরু হয়; তাঁর বয়স ঊনআশি বছর। তিনি জ্যাকুলিনকে বিয়ে করেন। পিকাসো তাঁকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি ছবি এঁকেছেন। কেবল পোর্ট্রেটের সংখ্যা সত্তর ছাড়িয়ে। তিনি পিকাসোকে তাঁর মিসট্রেস ও তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। তাঁকে নিয়ে পিকাসোর একটি বিখ্যাত ছবি : জ্যাকুলিন উইথ ফলাওয়ার্স।

১০.
বিখ্যাত শিল্পী যোগেন চৌধুরী ‘পাবলো পিকাসো’ রচনায় লিখছেন, ‘পিকাসো তো শুধু ছবি-আঁকিয়ে ছিলেন না, এক জন ভাস্কর হিসেবে, সেরামিক আর্টিস্ট এবং ম্যুরালিস্ট হিসেবেও আমরা তাঁকে চিনেছি। আর্টের বিভিন্ন ধরনের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। অদ্ভুত ছিল তাঁর ড্রইংয়ের জোর। সঙ্গে নিখুঁত অবজার্ভেশন। পিকাসোর এই সহজাত ক্ষমতা আমায় ভীষণ টানে। পাঁচ-ছ’বছর থেকেই অসম্ভব ভাল ড্রইং করতেন। ওই বয়সের বাচ্চাদের মতো কাঁচা হাতের টান নয়, সাবলীল টানে আঁকা তাঁর পায়রাদের ছোট ছোট ছবিতে সেনসিটিভ গড়ন ও ভঙ্গি স্পষ্ট। পিকাসো নিজেও বলতেন, ছোটবেলায় তিনি ওল্ড মাস্টারদের মতো আঁকতেন। আর বড় হয়ে শিশুদের মতো। তাঁর ছবিতে ছিল শিশুদের সেই স্বাধীন, কোনও কিচ্ছু পরোয়া না-করা মনটা। অর্থাত্, রিয়ালিজ্মের মূল জায়গাটাকে তিনি ছোট্ট বয়সেই অর্জন করেন। তার পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, নানা ভাবে ছবিকে ভাঙার কাজ। রাত দশটা-এগারোটা থেকে আঁকা শুরু করতেন তিনি। চলত সারা রাত। একের পর এক অসাধারণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে জীবনের শেষ দিন অবধি শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন। দর্শক যখন ছবি দেখে, সে তো শুধু বিষয়বস্তু দেখে না। কাজের মধ্যে শিল্পীর যে এনার্জি রয়েছে, যে মন এবং নান্দনিক বোধ রয়েছে, তাকেও অনুভব করে। মানুষের মুখ, চেহারা, ল্যান্ডস্কেপ পিকাসোর যে কোনও ছবি আমরা যখনই দেখি, তাঁর সেই প্রচণ্ড শারীরিক এবং মানসিক এনার্জি উপলব্ধি করা যায়। এই এনার্জির সঙ্গে মিশেছিল নন্দনতত্ত্ব।

১০.২
নানা পর্যায় রয়েছে তাঁর কাজে। একেবারে গোড়ার দিকে বাস্তবধর্মী ছবি। পরের পর্যায়টি ‘ব্লু পিরিয়ড’। তখন তিনি চরম দারিদ্রের মধ্যে। রেস্তোরাঁয় খেতে আসা রুগ্ন, জীর্ণ চেহারার গরিব মানুষের ছবি আঁকতেন। এ ছবিগুলো ছিল মূলত নীল রঙে আঁকা। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হতে শুরু করেন। শিল্পমাধ্যমের ওপর তাঁর ক্ষমতা, প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে থাকে। এর পরে ‘রোজ পিরিয়ড’। স্প্যানিশ সার্কাসের হার্লেকুইন, কলাকুশলী, ক্লাউন, রিঙের খেলা হয়ে ওঠে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু। এই পর্যায়ের ছবিতে দেখি রঙের প্রাচুর্য। পিকাসোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি প্রত্যেক পর্যায়ে তাঁর আগের পর্যায় থেকে সরে এসেছেন, এক-একটা পর্যায়কে ভেঙে আর একটা পর্যায়ে গিয়েছেন। যেটা অনেক বড় বড় শিল্পীর মধ্যেও আমরা পাই না। যেমন, ভ্যান গখ সারা জীবন ধরে প্রায় একই ধরনের সুন্দর সুন্দর এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি এঁকেছেন। কিন্তু পিকাসোর সৃষ্টিশীলতা ছিল বাঁধনহারা, সব সময়ই নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করতেন। যদিও উনি নিজে বলতেন, ‘আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।’ 

১০.৩
সেজাঁ-র হাত ধরে তত দিনে ইউরোপে কিউবিজ্মের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছে। পিকাসো তাঁর ছবিতে কিউবিজ্মের সঙ্গে নিজস্ব স্টাইল জুড়ে নিরীক্ষা শুরু করলেন। এক সময় আফ্রিকান মুখোশ দেখে ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত ছবি লে দ্যমোয়াজেল দা’ভিয়ঁ (Les Demoiselles d’Avignon) এ সময়ই আঁকা। অ্যাভিঁয়-র দেহোপজীবিনীরা এ ছবির বিষয়বস্তু। আফ্রিকান মাস্ক-এর প্রভাব ছবিতে স্পষ্ট। ছবিতে তাদের মুখচোখশরীর প্রচলিত দৃষ্টিতে এমন ‘বিকৃত’, ছবিটি দেখে অনেকেই বলতে শুরু করলেন, পিকাসো নষ্ট হয়ে গিয়েছেন। বহু বছর ধরে ছবিটি স্টুডিয়োতে পড়ে ছিল। মজার কথা হল, এটা পিকাসোর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবিগুলির একটি। সেই সময় ছবিতে এই ধরনের নান্দনিক শারীরিক বিকৃতি অন্য কেউ আনতে পারেননি। আসলে পিকাসো নিজে জানতেন, কখন সৃষ্টিশীলতার কোন ঝোঁক প্রয়োগ করলে ছবি অসামান্য হয়ে উঠবে।
 
১০.৪
পিকাসোর আর এক বিখ্যাত ছবি ‘উইপিং উওম্যান’। সেই সময় প্রেমিকা ডোরা মার-এর সঙ্গে পিকাসোর বিচ্ছেদ ঘটছে, তিনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ডোরা’র কান্নামাখা বিকৃত মুখের ছবি আঁকলেন তিনি। শুধু ইনিই নন, পিকাসোর জীবনে অনেক মহিলা এসেছেন। এবং প্রত্যেকেই তাঁর শিল্পকাজকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেন। তাঁদের সংস্পর্শে এসে প্রচুর ছবি তিনি এঁকেছিলেন। অদ্ভুত শিল্পকীর্তির জন্ম দিয়েছিলেন। মারি থেরেস-এর খেলোয়াড়সুলভ চেহারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভাস্কর্য করেছিলেন। শেষ জীবনটা যাঁর সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, সেই জ্যাকেলিন নিজেও ছিলেন পিকাসোর অনেক ছবির মডেল।

১০.৫
নিছক শিল্পীসত্তার জন্য নয়, পিকাসোর এই বর্ণময় চরিত্রটার কারণেই তিনি আমার এত পছন্দের। নাটক লিখতেন, সঙ্গে ছোট ছোট কবিতাও। সেরামিক পট-এর ওপর তাঁর সাবলীল ড্রইং অপূর্ব। ভাস্কর্যগুলোও মোটেই গতানুগতিক ছিল না। নানা ছুটকো জিনিস জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে তিনি ভাস্কর্য করেছেন। তাঁর তৈরি ব্রোঞ্জের গর্ভিণী ছাগল বিখ্যাত। সেটার পেটের মধ্যে একটা ঝুড়ি ঢুকিয়ে তিনি এটি তৈরি করেন। আবার, একটা সাইকেলের সিটে সাইকেলের হ্যান্ডলটা শিং-এর মতো ফিট করে এক লহমায় এনে দেন পশুর মাথার আদল।
আর এই সব কিছুর সঙ্গেই তাঁর গভীর আত্মিক যোগ ছিল। আদ্যন্ত এক শিল্পীর জীবন তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন। তাঁর প্রত্যেকটা ছবির মধ্যেই আসল মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ওয়ার্ল্ড আর্ট’-এ তিনি যে বৈপ্লবিক অবদান রেখে গিয়েছেন, তা অন্য কারও মধ্যেই দেখা যায় না। সেখানে তাঁর অবস্থান এতটাই তীব্র, মনে হয় না অন্য কোনও শিল্পী পাবলো পিকাসোকে শিল্পে তাঁর জায়গা থেকে সরাতে পেরেছেন।’

১১.
এবার নিজের কথায় শিল্পীকে জানার চেষ্টা করা যাক। পেইন্টিং নিয়ে পিকাসো কী বলছেন?
‘সবাই পেইন্টিং বুঝতে চান। তাঁরা পাখির গান কেন বুঝতে চান না? না বুঝেই কেন কেউ রাত, ফুল, চারপাশের সবকিছু ভালোবাসেন? কিন্তু পেইন্টিংয়ের বেলায় মানুষকে তা বুঝতে হবে।’ (ক্রিশ্চিয়ান জারভোস, পিকাসোর সঙ্গে কথোপকথন, ১৯৩৫)। জেরোম স্লেকার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কেন এমনভাবে ছবি আঁকেন, যা জনগণের পক্ষে বোঝা এত কঠিন?’ পিকাসো জবাব দিলেন, ‘আমি এভাবে ছবি আঁকি, কারণ এগুলো আমার চিন্তার ফলাফল। এখানে পৌঁছতে আমি বছরের পর বছর কাজ করেছি। আর আমি যদি এখান থেকে এক পা পিছিয়ে যাই, তাহলে জনগণকে অপমান করা হবে – কারণ আমার ছবিই আমার ভাবনার ফলাফল। কেবল বোঝাতে পারার পরিতৃপ্তির জন্য আমি সাধারণ কোনো পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারি না।’ (১৯৪৫)। আরো অনেক পরে আদ্রে মালরো বলেছেন, ‘মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কোনো কিছু শনাক্ত করার জন্য তাদের ব্যবহৃত পদ্ধতি গুঁড়িয়ে দিতে হবে। গ্রহণযোগ্য নয় এমন চিত্রকল্প নির্মাণ করতে হবে।’ (১৯৭৪)। ব্রাসাইর পিকাসোর সঙ্গে কথোপকথনে (১৯৭৪) শিল্পী বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন : সবসময়ই শুদ্ধতার প্রত্যাশা করতে হবে। আমার বেলায় তা হচ্ছে দূর থেকে আরো দূরে চলে যাওয়া, এক ক্যানভাস থেকে অন্য ক্যানভাসে। আশি বছর বয়সে পিকাসো বললেন, আমার পুরনো পেইন্টিং আমাকে আগ্রহান্বিত করে না। যে ছবি আমি এখনো আঁকিনি আমার অনুসন্ধিৎসা সেদিকেই। আরো আগেই বলেছেন, আমি একটি বিষয়কে যেভাবে দেখি সেভাবে আঁকি না, যেভাবে ভাবি, সেভাবেই আঁকি। পেইন্টিং হচ্ছে অন্ধ মানুষের পেশা; যা দেখেন তা তিনি আঁকেন না, যা অনুভব করেন, বিষয় সম্পর্কে তিনি নিজেকে যা বলেন তা-ই আঁকেন। 

১২.
পিকাসো আরো বলছেন- 
ঈশ্বর হচ্ছেন আর একজন শিল্পী। তিনি জিরাফ, হাতি ও বিড়াল আবিষ্কার করেছেন। তাঁর নিজস্ব কোনো স্টাইল নেই। তখন তিনি অন্যকিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। 
আমরা যখন মুখাবয়ব আঁকি, ভেতরে কী আছে তা আঁকি, পেছনে কী আছে তা-ও।
কোনো কোনো শিল্পী সূর্যকে একটি হলদে বিন্দুতে পরিণত করেন, কোনো কোনো শিল্পী হলদে বিন্দুকে সূর্য করে তোলেন। আমি অনুপ্রেরণা খুঁজি বাস্তবতায়। বাস্তবতাই আমার কল্পনাকে শক্তিমন্ত করে, আমাকে দেয় নতুন জীবন।
পেইন্টিং আমার চেয়ে শক্তিশালী; পেইন্টিং যা চায় আমাকে দিয়ে তা-ই করায়।
ভালো শিল্পীরা নকল করেন, মহান শিল্পীরা চুরি করেন। আমার যখন লাল থাকে না, আমি নীল ব্যবহার করি।
বিমূর্ত শিল্প বলে কিছু নেই। তোমাকে অবশ্যই কিছু একটা নিয়ে শুরু করতে হবে। তারপর বাস্তবতার সব চিহ্ন তুলে দেবে।
আমরা সবাই জানি, শিল্প সত্য নয়। শিল্প একটি মিথ্যে, যা সত্যকে অনুধাবন করায় – অন্তত যে সত্যটি অনুধাবনের জন্য আমাদের দেওয়া হয়।
কিউবিজম অন্য কোনো স্কুল অব পেইন্টিং থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
আমি ইংরেজি বই পড়তে পারি না, আমার কাছে ইংরেজি বই অর্থহীন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইংরেজি ভাষার অস্তিত্ব নেই। আমি যা বুঝি না, যার কিছুই জানি না, সেজন্য নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারোপ করব কেন?
শিল্প সৌন্দর্যের আইনকানুনের প্রয়োগ নয় – আইনকানুনের বাইরে হৃদয় ও মস্তিষ্ক যা ধারণ করতে পারে তা-ই। আমরা যখন একজন নারীকে ভালোবাসি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাপ মেলাতে শুরু করি না।
রাফায়েলের মতো করে আঁকতে আমার চার বছর লাগল; কিন্তু শিশুর মতো আঁকতে লেগে গেল সারাটা জীবন।
নিত্যকার যে ধুলোবালি আত্মার ওপর পড়ে, শিল্প তাই ধুয়ে দেয়।
ক্রান্তিকালের শিল্প বলে কিছু নেই।
আমাকে একটি জাদুঘর দাও, আমি পুরোটা ভরে দেব।
যদি কেবল একটি সত্য থাকত তাহলে একই থিম নিয়ে একশ ক্যানভাসে আঁকা যেত না।

১৩.
১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল ভোর তিনটা পর্যন্ত ৯১ বছর বয়সী পিকাসো ছবি এঁকেছেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে বিছানা থেকে নামতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি জ্যাকুলিনকে নাম ধরে ডাকেন। দশ মিনিট পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ বড়মাপের হার্ট অ্যাটাক। নিজেকে দিয়ে আঁকা সর্বশেষ সেলফ পোর্ট্রেট শেষ করেন ৩০ জুন ১৯৭২। সে পোর্ট্রেটের নাম : ‘সেলফ পোর্ট্রেট ফেইসিং ডেথ’ – মৃত্যুর মুখোমুখি আত্মপ্রতিকৃতি। কাগজের ওপর ক্রেয়নে আঁকা এই পোর্ট্রেট পিকাসো তাঁর নিজের মুখের ওপর স্থাপন করে তাঁর বন্ধু পিয়েরে দাইকে দেখিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এখানে ভীতির অভিব্যক্তি আসলে পিকাসোর একটি কৌশল। তিন মাস পর পিয়েরে আবার যখন পিকাসোর কাছে যান, দেখতে পেলেন ছবির রূঢ় দাগগুলো আরো গভীর হয়ে আছে, তিনি অপলক তাকিয়ে আছেন, তাঁর মনে হয়েছে পিকাসো সরাসরি নিজের মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে আছেন।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, শিল্প ও শিল্পী, কালি ও কলম, দেশ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত