প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মনোরমা বসু ‘মাসীমা’

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৩১

১.
স্বনামধন্য বিপ্লবী, সমাজসেববক, স্বদেশী আন্দোলনের নেত্রী মনোরমা বসু, যিনি সকলের মাঝে ‘মাসীমা’ উপাধিতেই সমধিক সুপরিচিত। সেই মনোরমা বসু মাসীমা ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, দৃঢ়চেতা, পরোপকারী এবং আদর্শনিষ্ঠ মনোরমা বসুর সমগ্র জীবন ছিল দেশপ্রেমে নিবেদিত। তিনি ছিলেন সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এবং যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ। দেশপ্রেম, সমাজসেবা ও মানুষের প্রতি ভালবাসার কারণে দলমত-নির্বিশেষে সকলে তাঁকে ‘মাসীমা’ বলে ডাকত।

২.
যে সকল মহান বিপ্লবী নিজের জীবন দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন তাদের স্মরণীয় একজন হিসেবে প্রণম্য নাম মনোরমা বসু। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন। আবার নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সমাজ সংস্কারেও রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। তিনি বরিশালের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মনোরমা রায়ের জন্ম ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর, বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানার নরোত্তমপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নীলকন্ঠ রায় এবং মায়ের নাম প্রমদাসুন্দরী রায়। মনোরমা ছিলেন বাবা-মা’র পঞ্চম সন্তান। আশৈশব দারিদ্র্য তাঁকে কঠোর সাধনায় সিদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। তিনি নিজের জীবনে শিক্ষার তেমন সুযোগ পাননি, কিন্তু সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ ও চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। 

৩.
১৯০৫ সালে মনোরমার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বদেশী আন্দোলনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন চলার সময় যখন স্বদেশীরা রাস্তায় গান গেয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল তখন তা দেখে খুবই আপ্লুত হন মনোরমা। সেই মিছিলেই হাতে হলুদ রাখি বেঁধে স্বদেশী আন্দোলনে দীক্ষা নেন তিনি। এরপর ১৯০৮ সালে যখন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয় তখন তাঁর মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে নিজেকে আরো সক্রিয় করে তোলেন। জন্মস্থানের অনুকূল পরিবেশ মনোরমা বসুকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। তাই মাত্র এগারো বছর বয়সে ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
 
৪.
শৈশবেই তাঁর বাবার মৃত্যু হলে সংসারে নানা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাতেই মাত্র তের বছর বয়সে মনোরমার বিয়ে হয় বরিশালের বাঁকাই গ্রামের বিপত্নীক জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সাথে। স্বামীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে তিনি স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। জমিদার বাড়ির রক্ষণশীলতা ও বিধিনিষেধ অতিক্রম করে তিনি মুক্ত জীবনে প্রবেশ করেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি জমিদার বাড়ি ছেড়ে বরিশালে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন।

৫.
১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী রাজনৈতিক প্রচারণা এবং তহবিল সংগ্রহের সংগ্রহের জন্য বরিশাল এলে মনোরমা বসু নিজের গহনা দান করেন। বরিশালে গান্ধীর সাথে এই সাক্ষাৎ তাঁকে আরো উজ্জীবিত করে তোলে। তিনি ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপ্লবী মনোরমা বসু মাসিমা নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি শুধু ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেননি, মানুষের মুক্তির জন্যও আন্দোলন করে গেছেন সারাজীবন। বরিশাল শহরে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন ‘মাতৃমন্দির’ । কুমারী মা, স্বামী পরিত্যক্তা, বিপথগামী ও আশ্রয়হীনা মেয়েদের আশ্রয়স্থল এই ‘মাতৃমন্দির’। অসহায় মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে গড়ে তোলেন ‘নারী কল্যাণ ভবন’, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য ‘মুকুল-মিলন খেলাঘর আসর’, সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জন্য ‘পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার’, নারী জাগরণ ও নারী অধিকার রক্ষায় ‘নারী আত্মরক্ষা সমিতি’, ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘মহিলা পরিষদ’সহ নানা সংগঠন।

৬.
বরিশালে অবস্থানকালে মনোরমা স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নারী অধিকার রক্ষায় ‘সরোজনলিনী মহিলা সমিতি’র শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম মহিলা সংগঠন। এ সমিতির মাধ্যমেই তিনি নারী সমাজকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি কংগ্রেস মহিলা কর্মী হন এবং ১৯৩২ সালে কংগ্রেসের ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। এ সময় বহরমপুর জেলে তিনি উর্মিলা দেবী (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বোন), জ্যোতির্ময়ী দেবী প্রমুখ প্রখ্যাত কংগ্রেস নেত্রীর সান্নিধ্য লাভ করেন।
 
৭.
মনোরমা বসু মাসীমা (জন্ম : ১৮ নভেম্বর, ১৮৯৭ – মৃত্যু : ১৬ অক্টোবর, ১৯৮৬)ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সমাজসেবক। তিনি অনাথ ও দুঃস্থ মহিলাদের, বিশেষ করে বিধবা ও কুমারী মেয়েদের আশ্রয় দানের জন্য বরিশালের কাউনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’। আজীবন তিনি এটি পরিচালনা করেন। তিনি নিজের বাড়িতে পাড়ার ও নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন মাতৃমন্দির সরকারী আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর্থিক সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি বাড়িতে বাড়িতে মুষ্টি-ভিক্ষার ঘট বসালেন। মাতৃমন্দিরের এই কঠিন কাজ করার পাশাপাশি মনোরমা বসু রাজনৈতিক কাজেও কঠোর পরিশ্রম করেন এসময়।তিনি ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা শহরের মতো বরিশালেও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে তোলেন মনোরমা বসু। তিনি এর প্রথম নির্বাচিত সম্পাদক হন।

৮.
১৯৪৩-৪৪ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সময় লঙ্গরখানা, চিকিৎসালয় ও উদ্ধার আশ্রম স্থাপন এবং পুনর্বাসন কাজে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বরিশাল জেলার বিভিন্ন নারী আন্দোলন, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক কাজের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বরিশাল জেলা শাখা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নারীমুক্তি আন্দোলনকে গতিশীল করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সহসভানেত্রী ছিলেন। 

৯.
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নতুন শাসকদের শাসন ও শোষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ১৯৪৮ সালে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে দেখা দিল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রতিকার চেয়ে ৫ জুন বুভুক্ষু মেয়েদের নিয়ে বরিশালে মিছিল করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের সামনে। ফলে পুলিশ তখন তাদের উপরেও লাঠিচার্জ করে এবং খাদ্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে মহিলা সমিতির ৪ জন নেত্রীসহ ৮ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় প্রায় ১০ মাস বিনাবিচারে কারাগারে আটক ছিলেন। পরে ৪ বছরের জেল হয় এবং জেল থেকে তিনি ছাড়া পান ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৫৪ সালের ১০ এপ্রিল স্বামীর মৃত্যুতে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সে আঘাত কাটিয়ে উঠে তিনি পুনরায় স্বীয় কর্মকান্ড শুরু করেন। 

১০.
১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে মনোরমা বসু আত্মগোপন করেন এবং সে অবস্থা থেকে আত্মপ্রকাশের পর তিনি ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’-এর কাজে ব্যস্ত থাকেন। একই সঙ্গে গড়ে তোলেন আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লিকল্যাণ অমৃত পাঠাগার (শহীদ অমৃতলালের নামে), আর শিশুদের জন্য মুকুল মিলন খেলাঘর। তাঁর অবর্তমানে মাতৃমন্দিরের কার্যনির্বাহের জন্য নিজের সব সম্পত্তি মন্দিরের নামে দান করে যান।
 
১১.
১৯৬২ ও ৬৪’র গণআন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মহিলাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ বরিশালের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এবছর দেশের দক্ষিণ উপকূল জুড়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। মনোরমা দেশের নানাস্থানে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করেন এবং তা সন্দ্বীপ ও পটুয়াখালির নিম্নাঞ্চলে বন্যার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেন।

১২.
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনোরমা বসু জুন মাসে চলে যান ভারতে। সেখানে গিয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারণা, অর্থ সংগ্রহ, নারীদের সংঘটিত করা ইত্যাদি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত হন। মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বয়স্কা মহিলাদের জন্য কালীবাড়ি রোডের চন্ডীসদনে স্থাপন করেন বৈকালিক স্কুল।১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত নারী কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে রাশিয়া ভ্রমণ করেন।

১৩.
১৯৮৩ সাল থেকেই তিনি বার্ধক্য আর নানা জড়ায় পীড়িত হতে থাকেন। অবশেষে এই মহিয়সী নারী ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবরে মৃত্যুবরণ করেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরে। মনোরমা বসুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ১৯৯২ সালের ১১ মার্চ মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে। পরে ১৯৯৭ সালে শেরেবাংলা পদক (মরণোত্তর), ১৯৯৮ সালে মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মননা (মরণোত্তর), ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তাঁর রেখে যাওয়া যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে ২০০১ সালে গঠন করা হয় ‘মনোরমা বসু মাসিমা স্মৃতি ট্রাস্ট’। তাঁর জীবদ্দশায়ই সত্যেন সেনের ‘মনোরমা মাসিমা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, বিপ্লবীদের কথা, গুণিজন, মনোরমা বসু মাসিমা- বদিউর রহমান, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত