জন্ম ও প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাঁইজি লালন

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’- লালন

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৪১

১.
বাউল সাধনার প্রধান গুরু, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা, গায়ক, ফকির লালন শাহ ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২ খ্রি.) ঝিনাইদহ জেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মতান্তরে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ভাঁড়রা গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রণ করেন। এ তথ্যটি পাওয়া যায় তাঁর মৃত্যুর দু’সপ্তাহ পরে ‘হিতকরী’ (১৮৯০) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ-নিবন্ধে। আর লালন প্রয়াত হন ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৬ অক্টোবর / ১৭ অক্টোবর, ১৮৯০)। আমাদের অনেকের মনের এই মানুষের জন্মদিনে, প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মানুষকে ধর্মের গোঁড়ামি মুক্ত করে সাঁইজি লালন দর্শন শেখায় যুক্তিবাদী তথা বাস্তববাদী হতে। আর মানবতাই বাউলের আদর্শ। লালন মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। মানবতাবাদী বাউল লালন দর্শনের মূল কথাই হচ্ছে মানুষ। আর এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি গানের বাণী-ভাষা শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। সাধকদের কাছে লালনের গান শুধু সুরে বসানো শব্দমালা নয়। তাদের কাছে লালনের গান জীবন-জিজ্ঞাসার অন্বেষণ। আর তাই এই ভবঘুরে বাউলেরও মন মজেছে সাঁইজি লালনের গানে, দর্শনে।

২.
‘সত্যকাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা না না না’- লালন
ক্ষমা করবেন হে স্বজন, আজও আবার শ্রদ্ধাঞ্জলির বাতি জ্বালানোর আগে সুতো পাকিয়ে নেই খানিকটা। প্রতিনিয়তই বড্ড সংশয়ে থাকি, ঝামেলায় পড়তে হয় আলোকিত মনীষীদের জন্মদিন আর প্রয়াণ দিনের সঠিক সন, তারিখ উদ্ধার করতে গিয়ে ।মহাত্মা লালনের জন্মদিন নিয়ে নানা বিভ্রান্তিরক তথ্যের সমাহার থাকলেও আমার সামনে বড় সংকট হিসেবে হাজির হয়েছে দুই বাংলার বাংলা পঞ্জিকার নানা স্ববিরেধিতা, মতপার্থক্য। এই যেমন গতকাল ১৬ অক্টোবর আমাদের পঞ্জিকানুসারে বাংলাদেশে পালিত হলো ১ কার্তিক আর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্জিকানুসারে আগামিকাল ১৮ অক্টোবর পালিত হবে ১ কার্তিক। আমার সামনে হিমালয়সম মানসিক বেদনার পর্বত, আমি আমার প্রাণের মানুষ, মনের সাধক মহাত্মা লালন ফকিরের জন্মদিন স্মরণে লেখাটিতে কোনদিনটিকে সঠিক জন্মদিন বলে লিখবো, উল্লেখ করবো? 

৩.
ফকির লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০)আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিকপাল। বাউলসঙ্গীতের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সাথে বাউলগানের রচয়িতা ও গায়ক। সেই সাধক লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষের কোন ধর্ম, জাত, বর্ন, লিঙ্গ, কূল নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন। লালনের এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না। লালন, মানব আত্মাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্ত্বা রূপে। খাচার ভিতর অচিন পাখি গানে তিনি মনের অভ্যন্তরের সত্ত্বাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথে, যা সহজেই খাঁচা রূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না। লালন কোনো জাতিভেদ মানতেন না। তাই তিনি গেয়েছেন: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতির কি রূপ দেখলাম না এ নজরে।’ এরূপ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিমুক্ত এক সর্বজনীন ভাবরসে সিক্ত বলে লালনের গান বাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিকট সমান জনপ্রিয়। তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি গান বাউল তত্ত্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। অসাম্প্রদায়িক সাধক ফকির লালন সাঁই-এর জীবনদর্শন মানব সমাজকে সত্য ও ন্যায়ের শিক্ষা দেয়। অথচ তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ। লালনের গান এক সময় এতই জনপ্রিয় ছিল যে, তা সাধারণ মানুষ ও নৌকার মাঝি-মাল্লাদের মুখে মুখে শুনা যেত। এমনকি বর্তমানেও সকল মহলে এ গানের কদর বাড়ছে এবং রেডিও-টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে।

৪.
লালন তাঁর অসংখ্য গানের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ আত্মার অনুসন্ধান করেছেন, তার গানে ও ভাবাদর্শে সুফিবাদের ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘আপনার আপনি চেনা যদি যায়।/ তবে তারে চিনতে পারি/ সেই পরিচয়।’ আর তাই আত্মশুদ্ধির জন্য লালনের গানের কোন বিকল্প নেই। আমাদের আত্মশুদ্ধির এক অনন্য শিক্ষক লালন। স্বাভাবিক পথচলার কথা তিনি তার গানের মধ্য দিয়ে শিখিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ দূর করতে হলে মেশিনগান দিয়ে নয়, গান দিয়ে করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোত্তম অস্ত্র হতে পারে লালনের গান। তাই লালনের গান ধরে রাখার গুরুত্ব অসীম। কারণ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করে চলেছি। এ সংগ্রামের সহায়ক হতে পারেন লালন ফকির। শুধু বিনোদনের জন্য লালনের গান নয়, এ গান আলোকিত হওয়ার জন্য। লালনের গান সত্য সুন্দরকে সদা খুঁজে ফেরে। ফকির লালন শাহ তাঁর গানের বাণীর ভেতর দিয়ে একটি সুসংবদ্ধ জীবন বিধানের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর গান এক গভীর দ্যোতনায় এই বিশ্ব-সংসার, মানবধর্ম, ঈশ্বর, ইহলৌকিক ও পারলৌকিকতা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করে। লালন ফকির নির্দিষ্ট কোনো ধর্মমত বা জাতপাত ও বর্ণে বিশ্বাস করতেন না; বরং সকল ধর্মের সমন্বিত ধর্মীয় মতবাদই তাঁর গানে প্রচারিত হয়েছে। লালন সমন্বিত ধর্মীয় মতাদর্শের মধ্য দিয়ে মানবধর্মকেই বড় করে দেখেছেন। লালনের গান গভীর নির্জন পথে মনের মানুষকে খুঁজে ফেরার গান। তিনি ছিলেন দেহবাদী আধ্যাত্মিক সাধক। ভক্তিবাদ তার সাধনার আশ্রয়। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মনের মানুষ। তাই বস্তুবাদ তার দর্শনের স্বভাব। আর তার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি যুক্তিবাদের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক সকল ধর্মেই ঈশ্বর বা আল্লাহ এবং সেই অদেখা সত্তার প্রতি পূজা অর্চনা ও প্রার্থনা এক স্বাভাবিক ব্যাপার এবং সেই অধর সত্তাই সকল কিছুর নিয়ন্ত্রা। কিন্তু লালনের যুক্তিবাদে তা অনেকটা ‘খেল্লো’। তিনি বলেছেন অধর সত্তা মানুষকে সৃষ্টি করেননি বরং মানুষই তাকে সৃষ্টি করেছেন। 
‘আল্লাহ হরি ভজন পূজন 
সকলই মানুষের সৃজন
আচানক অচিনাই কখন 
জ্ঞান ইন্দ্রিয় না সম্ভবে ॥ 

৫.
মহাগুরু ফকির লালন সাঁই বিশ্ব মানবতার প্রতীক। কথিত আছে, লালন শাহ যৌবনকালে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন সঙ্গীরা তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এমতাবস্থায় সিরাজ সাঁই নামে পাবনার একজন মুসলমান ফকির তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রূষা দ্বারা সুস্থ করে তোলেন। পরে লালন তাঁর নিকট বাউলধর্মে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া নির্মাণ করে সহসাধিকা মতান্তরে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস করেন। তাঁর কোনো সন্তানাদি ছিল না। তাঁর শিষ্যের সংখ্যা ছিল অনেক। বাংলা ১২৯৭ সনের পহেলা কার্তিক, ইংরেজি ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ফকির লালন সাঁই দেহত্যাগ করেন। আমৃত্যু ফকির লালন ছেঁউড়িয়াতেই ছিলেন, মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতেই তাঁর সমাধি নির্মিত হয়। সাঁইজির তিরোধানের পর থেকে ভক্ত-শিষ্যবৃন্দ প্রতি বছর পহেলা কার্তিক থেকে ছেঁউড়িয়া আখড়ায় পাঁচ দিনব্যাপী স্মরণোৎসব পালন করেন। প্রাণের টানে আমি অনেকবারই কুষ্টিয়ায় লালন আখড়ায় গিয়েছি তবে মাত্র একবার এই স্মরণোৎসবে উপস্থিত থাকার সুযোগ ঘটেছিলো। লালন বেঁচে ছিলেন প্রায় ১১৬ বছর। দেহও রেখেছেন অনেকদিন হলো। দুই শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজো লালন মরমী জগতের সার্বভৌম ব্যক্তিত্ব। এই দীর্ঘ সময়েও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাননি। বরং তাঁর সৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, বেড়েছে পরিধি। ফকির লালন শাহ দুই শতাব্দীরও বেশি সময় জুড়ে এক ঐন্দ্রজালিক মোহময়তা বিস্তার করে চলেছেন। অগণিত মানুষ তার বিশাল সৃষ্টি জগতে প্রবেশ করে সন্ধান করছেন যেন তাকেই। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় পাঁচ দিনব্যাপী লালন স্মরণ উৎসব। সারা দেশ থেকে আসা লালন অনুসারীদের মিলনমেলায় জমে ওঠে আখড়াবাড়ি ছেঁউড়িয়া। অগণিত বাউল-সাধকদের ভিড়ে ভরে যায় গোটা আখড়া এলাকা। পরিবার, ভক্তদের নিয়ে লালনের মাজার ও কালীগঙ্গা নদীর পাড় জুড়ে আসন পেতে বসেন আগতরা। লালনের গানে, একতারার বোলে সবাই ভক্তি জানান। স্থানে স্থানে সাধকরা জটলা করে দোতরা ও মন্দিরা বাজিয়ে গানের সুরে যেমন নিজেরা মজে ওঠেন যেমন, আবার তেমনি লালনের বাণী ও সুরে মাতোয়ারা করে তোলে ভিড় করে থাকা শ্রোতাদেরও। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ যেন এক মহামিলন মেলায় যুক্ত হন। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সাথে তাঁর পালিত মা মতিজান ফকিরানী, পালিত বাবা মলম শাহ, ফকির মণ্ডিত মানিক শাহ, শীতল শাহ, ভোলাই শাহ, বিশখা ফকিরানী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ অন্য আরো অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে। বহু তীর্থভ্রমণ এবং সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গলাভের পর এই ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় বসেই লালন আজীবন সাধনা ও সঙ্গীতচর্চা করেন।
 
৬.
লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের শাস্ত্র সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর রচিত গানে সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। লালনের লেখা গানের কোনো পান্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। সম্ভবত পরবর্তীকালে শিষ্যদের কেউ সেগুলি সংগ্রহ ও সংকলিত করেন। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুহাজার গান রচনা করেন বলে লালন গবেষকগণ মনে করেন। তাঁর গান মরমি ব্যঞ্জনা ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। সহজ-সরল শব্দময় অথচ গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী তাঁর গানে মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তাঁর মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, 'পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে'। লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তাঁর গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। শোনা যায় লালনের কোন কোন শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। কুষ্টিয়ার সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-৯৬) এবং সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) লালন শাহ ও তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। হরিনাথ তাঁর অতি প্রিয় শিষ্য ছিলেন। ছেঁউড়িয়া থেকে ছয় মাইল দূরে শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ লালন শাহর ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেন এবং সেগুলি থেকে ২০টি গান তিনি প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তিনি মানবধর্ম (Religion of Man) বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতায়ও লালনের গানের উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রনাথ লালনকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজে পরিচিত করেছেন। 

৭.
কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই বলা চলে বাউল গান তথা লালনের গানের সবচেয়ে বড় ভক্ত- অবশ্যই সুধী সমাজের সবচেয়ে বড় ভক্ত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বিশ্বকবি হয়ে ওঠার পেছনে লালনের গান এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৮৯০ সালের শেষের দিকে শিলাইদহে আসেন তখন তার বয়স ৩০। কিন্তু বাউল গানের সঙ্গে তার পরিচয় তারও অনেক আগে। ১৮৮৩ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি বাউল গানের সংকলনের সমালোচনা লেখেন। লালনের সাথে তার সরাসরি সাক্ষাৎ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে লালনের দেখা হয়েছিল কি না এ নিয়ে মতভেদ আছে। জমিদারীর তাগিদেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে থাকতেন, পদ্মার পারের নির্জনতায় বসে কাব্য রচনা করতেন। ফকির লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় তখন তিনি বয়সে কিশোর। তিনি একবার লালনের মৃত্যুর পর আখড়ায় এসেছিলেন, গভীর অথচ সহজ ভাষায় রচিত লালনের গান তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো। রবীন্দ্রনাথ কোথাও যেতে হলে পাল্কি ব্যবহার করতেন, লালন ফকির ঘোড়ায় চড়তেন। লালন ফকিরের প্রায় আড়াইশ' গান রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেন, যা ধারাবাহিকভাবে তৎকালীন সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সেজদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই বোটে বসা ভ্রমণরত ফকির লালনের একটি স্কেচ এঁকে ফেলেন যার একটি কপি এখনো লালন একাডেমির মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলো তা তাঁর কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যায়। শুধু কবিতায় নয়, রবীন্দ্রনাথের বেশভূষাতেও এসেছিলো অনবদ্য এক বাউলপনা। আলখেল্লা পরা বাবরী চুলের শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ যেন বাউল বেশে লিখে চলেছেন, 'একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে, যে নদীর নেই কোন দ্বিধা পাকা দেউলের পুরাকত ভিত ভেঙে ফেলতে'। একদা শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার পর প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষকে বলেছিলেন, তুমিতো দেখেছো শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যদের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। পোশাক পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারতো। এই থেকে বোঝা যায় তিনি কীভাবে শ্রদ্ধা করতেন, লালন ও তাঁর বাউল সমাজকে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেক জায়গায় বলেছেন, তাঁর অনেক গানেই লালনের ভাবধারা বিদ্যমান আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার হিসেবে শিলাইদহ অবস্থানকালে লালন ফকিরের কবর সংস্কার কাজে অর্থ প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ "লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন - আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।" যদিও তিনি একবার লালন 'ফকির' বলেছেন,এরপরই তাকে আবার 'বাউল' বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সংঘর্ষপ্রবণ।" গভীর জ্ঞানের অধিকারী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন ফকির লালন এবং তাঁর গানকে। তাই অজো পাড়াগাঁর সমাজবঞ্চিত ফকির লালন এবং তাঁর গরিব শিষ্যরা উঠে এসেছে তাঁর গানে, কবিতায়-উপন্যাসে।

৮.
ভারতবর্ষ বৈচিত্রের দেশ। এর ইতিহাস এবং ভূগোল উভয়ই বৈচিত্র্যপূর্ণ। বৈচিত্রের সেই প্রবাহ এ দেশের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেও লক্ষণীয়। তবুও একথা অনস্বীকার্য যে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য সাধনের যে মন্ত্র, তার উৎপত্তিস্থলও এই ভারতবর্ষ। সে মন্ত্রের বিস্তার উত্তরের হিমালয় থেকে শুরু করে আজ সমগ্র বিশ্বে। এই মন্ত্রের সাধকগণ যুগে যুগে ভারতভূমিতে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের মৈত্রীর শিক্ষা দিয়েছেন, সাম্যের শিক্ষা দিয়েছেন, মানবিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। এমনই একজন সাধক ফকির লালন শাহ। যাঁর মত ও পথ উভয়ই ‘মানব দর্শন’-এর পরিপূরক এবং নামান্তর। লোকজ চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক এই প্রবণতাকেই পরিণতভাবে সংরক্ষণ করেন সাধক-কবি লালন। দিন যত যাচ্ছে তাঁর চিন্তার দীপ্তি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির প্রভা আরও বিচ্ছুরিত হচ্ছে এবং তিনি ক্রমেই বন্দি হচ্ছেন এলিট শ্রেণীর গবেষণা ও আলোচনার বৃত্তের মধ্যে।

৯.
লালন দর্শনের একটি অন্যতম দিক হলো গুরুবাদ। গুরুর প্রতি ভক্তি নিষ্ঠাই হলো তাদের শ্রেষ্ঠ সাধনা। ধ্যান ছাড়া যেমন গুরকে ধারণ করা যায় না তেমন গুরুর প্রতি অসামান্য ভক্তি ছাড়া অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হয় না। মানুষের প্রতি ভালবাসা, জীবে দয়া, সত্য কথা, সৎ কর্ম, সৎ উদ্দেশ্য_ এই হলো গুরুবাদী মানব ধর্মের মূল কথা। মূলত ভক্তিই মুক্তি- ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার।/ সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার। যারা হাওয়ার সাধনা করে তারাই মূলত বাউল, তাদের মতে সাধনার চারটি স্তর আছে- স্থুল, প্রবর্ত, সাধক ও সিদ্ধ। প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা হলো স্থূল, দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবর্ত, তৃতীয় পর্যায়ে সাধক এবং চতুর্থ বা চূড়ান্ত পর্যায়ের শিক্ষা হলো সিদ্ধ। লালনের গানেও দেখা যায় সেই ভাবদর্শন- ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।/ সেকি সামান্য চোরা/ ধরবি কোনা কানচীতে।

১০.
অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারে জর্জরিত সমাজ যে সমাজে ধর্ম ব্যবসায়ী এবং সমাজপতিরা ছিল ভাগ্য নিয়ন্ত্রা সেই সমাজে বসে লালন একা মানবতার গান গেয়ে গেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। উনিশ শতকের শহুরে সমাজে হয়তো নানামুখী শিক্ষা এবং মানবতার চর্চা হয়েছিল এবং নানা মানবতাবাদী দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু গ্রামীণ সমাজ ছিল তার উল্টো। সেই উল্টো সমাজে বসেই লালন তার মানবতার সাধনা করে গেছেন নির্ভীক চিত্তে। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক অন্নদা শঙ্কর রায় যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলার নব জাগরণে রাম মোহনের যে ভূমিকা বাংলার লোক মানসে দেয়ালি উৎসবে লালনেরও একই গুরুত্ব।’ লালনের বেশ কিছু রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। লালনকে অনেকে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িক পরিচয় দিয়ে। কেউ তাকে হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। তবে লালন কিন্তু তার প্রতিটি গানে নিজেকে ফকির (আরবি "সাধু") হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর জাতিত্ব পরিচয় রহস্যময়। আসলে লালন নিজও তাঁর জন্ম পরিচয় প্রদান করতে উৎসাহবোধ করেননি, তা তাঁর গানেই স্পষ্ট, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।/ লালন কয় জাতের কিরূপ/ দেখলাম না এই নজরে।’সত্যিই তাই, জাতপাতের ঊধের্ক্ষ উঠে লালন নিজেকে শুধুই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।

১১.
আমরা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কথাই বলি আর তার পরবর্তী বিশ্বব্যাপী মানবতাবাদী দর্শনের কথাই বলি তার মূল সুর ছিল মানুষের অন্তর্নিহিত সত্তা আবিষ্কার করে মানুষকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা। মানুষকেই সবার উপরে স্থান দিয়ে মানুষের ভেতরের অনন্ত শক্তির আধারকে আবিষ্কার করা। লালন সেই কাজটিই করেছেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। এমনকি সেটি করতে গিয়ে তিনি মানুষকে স্রষ্টার সমকক্ষ করে তুলেছেন এবং একমাত্র মানুষ ভজনের মাধ্যমেই মানবজীবনকে সার্থক করে তোলার কথা বলেছেন। তিনি বারবার এই মানবজীবনকে সবার উপরে স্থান দিয়ে মানবজীবনকে বাঙ্ময় করে তোলার কথা বলেছেন। তার কাছে সব কিছুর চেয়ে মূল্যবান হলো এই মানব জীবন। তিনি যথার্থই বলেছেন এই মানব জীবন চলে গেলে আর পাওয়া যাবে না। তাই সময় থাকতে মানব জীবনকে কর্মময় করে সার্থক করে তুলতে হবে। লালন বলেছেন,
এমন মানব জীবন আর কি হবে 
মন যা কর ত্বরায় কর এ ভবে।’
লালন এই মানুষের মধ্য দিয়ে ধর্ম, বিধাতা খুঁজেছেন। ধর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের নিষ্কৃতি তিনি খুঁজতে যাননি। তার মতে এই মানুষই ভজনের সার। আমরা জানি যে ধর্ম এবং মানবতাবাদ দুটি বিপরীত প্রত্যয়। কিন্তু লালন এই দুটি প্রত্যয়কে এক করে দেখেছেন মানুষের ভেতর দিয়ে। মানুষ ছাড়া কোন ঈশ্বর নেই। লালনের মতে,
অধর চাঁদের কতই খেলা
সর্ব উত্তম মানুষ লীলা
না বুঝে মন- হলি ভোলা
মানুষ বিরোধী ॥ 

১২.
ধর্মের নামে মানুষকে সর্ব যুগে শোষণ করা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে মানুষে মানুষে বৈষম্য। কারণ ধর্মতত্ত্ববিদেরা ধর্মকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ধর্মের নামে মানুষকে করেছে খাটো। কিন্তু লালন বলেছেন, না, মানুষ ধর্মের জন্য নয় বরং ধর্মই মানুষের জন্য। তাই মানুষ ধর্মের চেয়ে ছোট হতে পারে না। লালনের উত্তর কালের আর এক মানবতাবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
‘মুর্খেরা সব শোনো 
মানুষ এনেছে ধর্ম 
ধর্ম আনেনি মানুষ কোন।’
ধর্মের নামে মানুষকে হেয় করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এই ধর্মের নামেই মানুষকে সবচেয়ে বেশি অবদমিত করা হয়েছে। ধর্মের নামে মানুষকে অবমাননা লালনের সময়ে তো বটেই বিংশ শতাব্দীতেও তা কম ছিল না। জাতপাতের করাল থাবা সমাজের মানুষে মানুষে এমন বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছিল যে একই সমাজের মানুষ একের ছোঁয়ায় অন্যে অশুচি হয়ে যেতো। জাতাজাতির যাঁতাযাঁতিতে নীচুতলার মানুষ নানাভাবে শোষিত বঞ্ছিত হচ্ছিল। লালন এসে বললেন, না, জাতের এই যে বৈষম্য তা সঠিক নয়। তিনি জাতপাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বললেন,
‘জাত না গেলে পাই না হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে,
লালন কয় জাত হাতে পেলে 
পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’
যিনি মানুষ ভজনা করে জীবনের পরম মুক্তি কামনা করেন। তিনি কি কখনো জাতের রঙে নিজেকে রাঙাতে পারেন? না পারেন না। লালনও পারেননি। তিনি জাতকে তুচ্ছভাবে দেখে তার আপন জাত সাত বাজারে বিকিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রকৃত অর্থে মানুষ করে তুলেছেন। লালন বলেছেন,
জগত জুড়ে জাতির কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতের ফ্যাতা
ডুবাইছি সাত বাজারে।’
এমন জোরালেভাবে জাতকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস লালনের সমাজের কেউই করেননি। লালন করেছেন। কারণ তিনি জাতের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য মানতেন না। মানুষকে প্রকৃত অর্থেই মানুষ রতন বলে মানতেন। মানুষের চেয়ে বড় তার কাছে কিছুই ছিল না। সুতরাং জাতি নয় মানুষই বড়। তিনি এই পৃথিবীকে মানুষময় মানুষের জন্য ভেবেছেন। এই পৃথিবীতে মানুষই মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত¡না দিয়েছে। এক্ষত্রে কোন দৈবপুরুষ এসে মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। তাই এই পৃথিবীর সর্বত্রই লালন শুধু মানুষকেই দেখেছেন এবং এই মানুষ দেখেই তার আঁখি জুড়িয়েছেন। লালন বলেছেন,
‘যথা যাই মানুষ দেখি
মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি।’

১৩.
লালন ধর্মীয়সম্প্রদায়গত ভাবে বাউল। বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়।বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এ সমস্তই ব্যক্ত হয়েছে তাদের গানে।এই সম্প্রদা্য়ের সাধকগণের তত্ত্ব দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই বাউল গান। রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা। বাউলের সাধনা, সহজ ভাবের সহজ ধারার সাধনা। তাই লালন সহজিয়া বাউল। বাউল সাধনার এই সহজ ভাব এবং সহজ ধারার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ‘মানব দর্শন’ এবং ‘মানুষ রতন’। এই সহজ সাধনার পথে গুরু এবং গুরুপরম্পরার প্রাধান্য রয়েছে। মানবদেহধারী সেই গুরুকে নিজের আরাধ্য রূপে ভজনার মাধ্যমে লালনের তথা সামগ্রিক ভাবে সহজিয়া বাউলদের ধর্ম, মানবতাবাদকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে ধর্মের আধার এই মানবদেহ এবং আরাধ্য ‘মনের মানুষ’ “So their God is the Man of the Heart (maner manush) sometimes simply the Man (purush)”। মানবতাবাদকে আশ্রয় করে নিজের জীবন এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে সম্প্রদায়গত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা এবং অবমাননার বিরুদ্ধে আঘাত হেনে লালন উদাত্ত কণ্ঠে জানিয়েছেন – ‘মানুষ ভ’জে মানুষ ধর, মন যাবি তুই ভব-পার।।’ মানব অন্তর মানুষের উপাস্য। মানবধর্মের অনুসন্ধান তার জীবন-সাধনা। বাউল সাধকদের ধারণা, মানুষ ভজনের অন্তরালেই ধর্ম সাধনা, বেদ পুরাণের কালো অক্ষরে ধর্ম নেই।

১৪.
মানবতাবাদী এই মতবাদের উৎপত্তিগত পটভূমি আলোচনার অপেক্ষা রাখে। সহজিয়া সাধনার মাধ্যমে মানুষকে জানা হল বাউলদের সাধনা। সেজন্য সামাজিক বিধিবিধান, জাতপাত, শ্রেণী বৈষম্য, পুথি-আচার প্রভৃতিতে এঁরা বিশ্বাসী নন। এঁদের সাধনার লক্ষ্য ‘মনের মানুষ’ খোঁজা। এই ধর্ম সাধনার মধ্যে একটা সমন্বয়ী সুর আছে। উপনিষদ, বৈষ্ণব সহজিয়া ও সুফিবাদের মতাদর্শের সঙ্গে বাউল গানের সাদৃশ্য রয়েছে। তাই শশিভূষণ দাসগুপ্ত বলেছেন – “In the conception of the ‘Man of the heart’ of the Baul, we find a happy mixture of the conception of the Paramātmana of the Upanisadas, the Sahaja of the Sahajiyās and Cubistic conception of the Beloved.”

১৫.
বাউলরা সমন্বয় সাধনায় বিশ্বাসী। তাই সমন্বয়ের সুরের প্রয়োজনীয়তা সমকালীন জীবনের পটভূমিকে স্পষ্ট করে দেয়। মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে সমাজে যখন জাত-পাত, প্রথা-সংস্কার, শ্রেণী বৈষম্য দেখা দিয়েছে তখনই সমন্বয়ী সাধক ও মহাপুরুষগণ আবির্ভূত হয়ে সামাজিক বৈষম্যের ভাঙনকে রোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেব তার বড় উদাহরণ। সুতরাং বাউল গানের সামাজিক পটভূমি হিসেবে আমরা সমকালীন জীবনের জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য যুক্ত সমাজ ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করতে পারি।

১৬.
লালন শাহ তথা বাউলেরা মানব শরীর, মানব জন্ম এবং ব্যক্তিরূপে মানুষের মহিমা কীর্তন করেছেন। তাঁদের কাছে পরম তত্ত্বই হল ‘মানুষ’। এই মানব-জীবন ও মানবদেহকে বাউলরা পরম সম্পদ বলে মনে করেছেন। তাঁদের সাধনার মূল আশ্রয়ই এই মানবদেহ। বাউলরা দেবদেবীর অস্তিত্ব ‘অনুমান’ মাত্র মনে করেন; মানুষ দেবপূজার মাধ্যমে বা ধ্যান-জপাদির দ্বারা অর্জিত পুণ্যে স্বর্গবাস করবে বা পরকালে উত্তমগতি লাভ করবে, একথা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্য। এই মানবদেহের মধ্যেই মূলতত্ত্ব আত্মা বা ভগবানের নিবাস। যাঁর ওপর নাম ‘মানুষ রতন’। এই মানবদেহকে আশ্রয়করে সহজ-সাধনার দ্বারা সেই মূল তত্ত্বকে উপলব্ধি করাই বাউলদের চরম আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। মানবদেহ আশ্রিত ‘মনের মানুষ’– এর সাধনাই তাঁদের ‘বর্তমান’।

১৭.
লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করে যে, শারীরিক প্রেম ভালবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই; প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। গুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছুলেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা যায়। লালনের অনুসারীরা বিবাহ এবং স্ত্রী সম্ভোগ করতে পারে কিন্তু তাদের বিশ্বাস সন্তান উৎপাদনের ফলে আত্মা খণ্ডিত হয়, আর খণ্ডিত আত্মা নিয়ে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায় না। সেই কারণেই তারা সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত থাকেন। তাছাড়া সন্তান উৎপাদনকে তারা বেদনাদায়ক বোঝা হিসেবেও বিবেচিত করে। পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম।আর এই দু’য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে।যৌন উত্তেজনার চুড়ান্ত পর্যায়ে (Orgasm) সহজ মানুষ বা ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়।কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অরগাজমে থেকে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।ফকির লালন একজন সিদ্ধপুরুষ।এবার দেখি লালন তার গানে কী বলছেন-
‘আমি কী সন্ধানে যাই সেখানে 
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে (ত্রিবেণী) 
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।
রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।
লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে 
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।’
এমন অসংখ্য গানে গানে লালন বা বাংলার অন্যান্য বাউলরা নিজেদের প্রেম,কাম, সাধনের কথা বলে গেছেন। রূপ (ঈশ্বর বা পরমাত্মা) থেকে স্বরূপে (মানব ও ঈশ্বর লীন) ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা। 

১৮.
লালনের যে রেখাচিত্রটি আমরা দেখি সেটি সাঁইজির জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।শিল্পগুরু নন্দলাল বসুর আঁকা লালনের কাল্পনিক চিত্রও সাধারন মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। লালনকে নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা, রচিত হয়েছে নানা ধরনের লেখা।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোরা’ শুরু হয়েছে লালনের গান ‘‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’’ দিয়ে। রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে সেনবাউল রাজা নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন বাউল রাজার প্রেম নামে একটি উপন্যাস। ভারতের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে রচনা করেন ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস। সমালোচকদের মতে, এই উপন্যাসে কোন নির্ভরযাগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই লালনকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হরা হয়, নাম দেয়া হয়েছে লালন চন্দ্র কর। ২০১০ এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা ২০১০ সালের ৪১তম ভারত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার লাভ করে। উল্লেখ্য, নানা কারণে এই চলচ্চিত্রটি লালন ভক্তদের অনেক সমালোচনারও মুখোমুখি হয়। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে সুনির্মল বসু ‘লালন ফকিরের ভিটে’ নামে একটি ছোট গল্প রচনা করেন।শওকত ওসমান ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দে রচনা করেন ‘দুই মুসাফির’ নামের একটি ছোটগল্প। লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন ‘লালন ফকির’ চলচিত্রটি। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একই নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদ ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র ‘দ্যাখে কয়জনা’ যা বাংলাদেশে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র ‘অচিন পাখি’। ২০০৪ সালে তানভির মোকাম্মেলের পরিচালনায় ‘লালন’ নামে একটি চলচিত্র নির্মাণ করা হয়।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, দেশ, বইয়ের দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত