প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মীরা দেববর্মণ

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৫৩

১.
মীরা দেববর্মণ ছিলেন বাংলা গানের এক অসামান্য গীতিকার, যিনি কৃতি স্বামী এবং সন্তানের নামের আড়ালে ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে আছেন আপন সৃষ্টির কারণেই। অনেকেই হয়তো জানেন না আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি প্রয়াত শচীন দেব বর্মণের স্ত্রী এবং উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তি সুরকার রাহুল দেব বর্মণের মাতা মীরা দেববর্মণ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের একজন নিভৃতচারিণী গীতিকার, যিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার এক অভিজাত পরিবারের কন্যা। প্রথিতযশা সুরকার ও শিল্পী মীরা দেববর্মণ ২০০৭ সালের ১৫ অক্টোবর দীর্ঘ রোগভোগের পর মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই সঙ্গীতের কিংবদন্তি গীতিকার মীরা দেববর্মণের স্মৃতির প্রতি। উল্লেখ্য যে, মীরা দেববর্মণ ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন জানা গেলেও সঠিক তারিখটি উদ্ধার করতে পারিনি। রাজকুমার শচীন দেব বর্মণের ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেব বর্মণ ছিলেন নানা স্মরণীয় গানের অমর গীতিকার।
 
২.
১৯৭১ সালে মীরা দেববর্মণের লেখা ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের বুকে জাগিয়েছে প্রণোদনা। গানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো শচীন দেব আরব সাগরের পাড়ে থেকেও প্রতিনিয়ত খবর নিতেন বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে কতটুকু জয় হাসিল করতে পারল। ভালো খবরের জন্য উত্সুক হয়ে থাকতেন। মীরাকে কুমিল্লার কথা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ঘুরে বেড়ানোর কথা, লোকগান সংগ্রহ থেকে যে ব্রাত্য সংস্কৃতিকে পরমাদরে আত্মস্থ করেছেন তার গল্প শোনাতেন অবিরত। তাঁর আত্মা তখন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম। মীরা শচীন কর্তার আবেগ ও আকুতি বুঝতে পেরেছিলেন আর তাই ১৯৭১ সালে রেকর্ড হলো ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’। এই গান দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সবটুকু ঢেলে দিলেন। জন্মভূমির ধূলি মাথায় ঠেকিয়ে গাইলেন ‘বাংলা জনম দিলা আমারে/তোমার পরান আমার পরান/এক নাড়ীতে বাঁধারে/মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই/সব ভুলে যাই তাও ভুলি না/বাংলা মায়ের কোল’। কী অসামান্য প্রাণস্পর্শী রচনা, কী হূদয়কাড়া সুর আর কী উদ্দীপক গায়নভঙ্গি।

৩.
শুরুতেই মীরা দেববর্মণ রচিত, শচীন দেব বর্মণের সুরে ও কণ্ঠে সুপরিচিত, আমার প্রিয় কয়েকটি গানের প্রথম কলি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।– বিরহ বড় ভাল লাগে- / গানের কলি সুরের দুরিতে— / ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা - / বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে - / কালসাপ দংশে আমায়- / কে যাস রে ভাটি গাঙ্গ বাইয়া - / কী করি আমি কী করি - / না আমারে শশী চেয় না – / নিটোল পায়ে রিণিক ঝিনিক –/ শোন গো দখিন হাওয়া - / তাকডুম তাকডুম বাজাই - ইত্যাদি।

৪.
বিরল প্রতিভা মীরা দেববর্মণ (জন্ম : মার্চ, ১৯২৩ – প্রয়াণ : ১৫ অক্টোবর, ২০০৭) ছিলেন বাংলা গানের এক অসামান্য গীতিকার। শচীন দেব বর্মণের অনেক বিখ্যাত গানের গীতিকার ছিলেন তিনিই। ১৯৩৭ সালে এলাহাবাদে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে তার সাক্ষাত ও প্রেম। ১৯৩৮ সালে বিবাহ। মীরা দেব বর্মণ তার স্বামী ও পুত্রের সঙ্গীত জীবনে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।আর নিজেকে রেখেছেন অন্তরালে। মীরা দেববর্মণ যে শুধু তাঁর স্বামী শচীন দেব বর্মণের গানের নোটেশন সংরক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তাই নয়। স্বামী ও পুত্রের চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দেয়ার মাপকাঠি নির্দ্দিষ্ট করেছিলেন। অবশ্যই নিজেকে প্রচারের আলোয় না নিয়ে এসে। ভালোবেসেই থেকেছেন দৃশ্যের আড়ালে। অসামান্য সঙ্গীতের বোধ ও শিক্ষা তাঁর ছিল। ফলে তিনি সফল ছিলেন একাধারে গীতিকার, সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন যেমন, সেই সঙ্গে যুগের তুলনায় সঠিকভাবে তালিমও পেয়েছিলেন। আর তাই সঙ্গীতের সকল ক্ষেত্রে সমান পারদর্শিতা ছিল তাঁর। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, সম্পূর্ণ ছিল সুরের জ্ঞান। 

৫.
তাঁর সম্পর্কে জানা যায় খুবই অল্প। মীরা দেববর্মণের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। ছোটবেলা থেকে দাদু ও দিদিমার বাড়ীতে থাকতেন। তাঁর দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট-এর চিফ জাস্টিস। দাদু ও দিদিমার বাড়ীতে জন্ম থেকেই থাকা পারিবারিক অসুবিধার কারনে। তারপর কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস শুরু করেন দাদু দিদিমার সঙ্গে। সেখানে শুরু হয় পড়াশুনো সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত এর তালিম। দাদু দিদিমার বাড়ীতে বিদ্যালয় শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষা সমানতালে চলে।দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।নাতনীর সঙ্গীত শিক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করেছিলেন । পড়াশুনো সঙ্গে সঙ্গে তিনি সঙ্গীত শিক্ষা নিতেন। ১৯৩৭ সাল থেকে শচীন দেবের কাছে গান শিখতেন। এ ছাড়াও তিনি সঙ্গীত গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। কীর্তন ও ঠুমরী শেখেন সঙ্গীতাচার্য ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে। ১৯৩০ সালে আনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেন এবং শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে নৃত্যে তালিম নিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে শচীন দেবের সঙ্গে তাঁর পরিণয় শেষে মীরা ধর হলেন মীরা দেববর্মণ। হলেন শচীন দেবের জীবন ও কর্মের সুযোগ্য সঙ্গী, শচীন দেবের সংগীত রচনার আজীবন সাথী। আর গান লেখার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের গীতিকারদের কাতারে তাঁর বিশেষ জায়গাটি সংরক্ষিত করলেন। 

৬.
কথিত আছে, সঙ্গীতগুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের তালিম নেওয়ার সময় পরিচয় হয় ভীষ্মদেবের আর এক কৃতী ছাত্র শচিন দেব বর্মণের সঙ্গে। গুরুর থেকে বয়সে কয়েক বছর ছোট ছিলেন শচীন। শোনা যায় যে মীরা দেবী ও শচিনের প্রেম ভীষ্মদেব খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি এবং তার ঠিক পরেই আরো দু’একটা ঘটনা নিয়ে শচীন কর্তা ও ভীষ্মদেবের সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতলতা এসে পড়ে। ভীষ্মদেব সব ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরী চলে যান। মতান্তরে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলনে শচীন দেব বর্মণের সাথে তার পরিচয় হয়। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হন শচীন। সেই বছরই তিনি শচীন দেব বর্মণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৩৮ সালে। তাঁদের বয়সের তাফাত ছিল অনেকটাই। এ ছাড়া শচীন ছিলেন ত্রিপুরা রাজ পরিবারভুক্ত। তাই আপত্তি উঠেছিল। ঝড় উঠেছিল দুই পরিবার থেকেই। কিন্তু দু‘জনেই ছিলেন অনড়।তাই শুভ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল সাড়ম্বরে ।শচীন এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে, হাতে তারবারি। বসেছিল নহবতখানা, বাজিয়েছিলেন আলি হুশেন খাঁ সাহেব। পুত্র রাহুলের জন্ম হয় ১৯৩৯ সালের জুন মাসে।

৭.
বিয়ের পর শচীন দেব বর্মন মীরা দেববর্মণের লেখা কয়েকটি গানে সুর প্রদান করেন। তাঁর বিষয়ে একজন সংগীত বোদ্ধার অভিমত যথার্থই মনে হয়, ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তুখোড় জ্ঞান সম্পন্ন গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, রবীন্দ্রসংগীতেও সমান দক্ষতা, গানের কথাকার হিসেবে আধুনিক মনষ্কতা, শব্দের ব্যবহার, মাটির কাছাকাছি থাকার প্রবনতা, অবাক হতে হয়; assistant music director – হিসেবে ও চমক দেয়ার মত সুরের বিভা ছিল তাঁর। শচীন দেব বর্মণের যে গান গুলোর সুরের আবেশে মাতাল হই ও নিয়ত গুন গুন করি- সেগুলোর অনেক সুরই মীরা দেববর্মণের সহায়তায় তৈরি হয়েছে।’

৮.
মীরা দেববর্মণ বিয়ের বছরে অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা থেকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। সেই সাথে শুরু করলেন পড়াশোনাও। আই এ পরীক্ষায় বসলেন।কিন্তু সংগীতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন অনেক আগেই তাই পড়াশোনায় ইতি দিয়ে সঙ্গীতের পথ ধরেই হাঁটলেন। ইতিমধ্যে শচীন দেব বর্মণ তার সঙ্গীতের অভিমুখ বম্বের দিকে নিদ্দির্ষ্ট করলেন ।আর এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে বম্বে গিয়ে তিনি ফয়াজ মহম্মদ খানের কাছে আবার তালিম নিতে শুরু করলেন। সঙ্গীতের পিপাসা ছিল অসীম। নিজেকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চলছিল নিরন্তর। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও, বোম্বে থেকে অডিশন পাশ করে ঠুংরি ও গজল পরিবেশন করতেন। সেই সময় তিনি দুইটি নাটক শান্তি ও নয়া প্রভাতের গানের কথা রচনা করেন। BOMBAY IPTA-র সংগেও যোগাযোগ ছিল। বম্বের সাংস্কৃতিক জগত তখন প্রগতিশীলতার কেন্দ্র। শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে অনেক গানের রেকর্ডও করেন তিনি। আবার, সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। নয়া জমাণা, তেরে মেরে স্বপ্নে, শর্মিলি, অভিমান, বারুদ, প্রেম নগর – এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রে বাইরে মীরা দেববর্মনের গাওয়া ও লেখা অনেকগুলো গান জনপ্রিয় হয়।

৯.
১৯৭৫ সালে তাঁর স্বামী আধুনিক বাংলা গানের রাজপুত্র শচীন দেব বর্মণ এবং ১৯৯৪ সালে পুত্র রাহুল দেব বর্মণের মৃত্যুর পর মীরা দেববর্মনের জীবনযাপন বেশ কঠিন হয়ে পরে। পুত্র ও স্বামীর মৃত্যুর অসম্ভব শোক তাকে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় পৌছে দিল। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর ছিল এই অসামান্য গীতিকার, সুরমালিকার ।কথায় কথায় মালা গেথেছিলেন যিনি,বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কথা। কেবল শচীন দেব বর্মণের গান শুনলে নড়ে চড়ে উঠতেন। চেতনার জগত তার কাছে মুল্য হারিয়েছিল। এমতাবস্থায় ত্রিপুরা সরকার তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁকে মুম্বাইতে স্থানান্তর করে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে মুম্বাইতে রাহুল দেববর্মনের বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে ঐ বছরেরই ১৫ অক্টোবর তারিখে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তাঁর মৃত্যু হয়।

১০.
এবার গীতিকার মীরা দেব বর্মণ রচিত এবং শচীন দেব বর্মণের কন্ঠ ও সুরে একটি বহুল জনপ্রিয় গানের বাণী পাঠ করা যাক। এখানে উল্লেখ্য করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এই গানটি বিশ্ববরেণ্য বাঙালি জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ তাঁর একটি বিখ্যাত জাদুর প্রদর্শনীর আবহ সঙ্গীত হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন।-
তাকডুম তাকডুম বাজাই
আমি তাকডুম তাকডুম বাজাই
বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই
তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল
বাংলা জনম দিলা আমারে ।।
তোমার পরান আমার পরান
এক নাড়িতে বাঁধা রে
মা-পুতের এ বাঁধন ছেড়ার
সাধ্য কারো নাই
সব ভুলে যাই
তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল
মা তোমার মাটির সুরে সুরেতে ।।
আমার জীবন জুড়াইলা মাগো
বাউল ভাটিয়ালিতে
পরান খুইলা মেঘনা তিতাস
পদ্মারই গান গাই
সব ভুলে যাই
তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল
বাজে ঢোল নরম গরম তালেতে
বিসর্জনের ব্যাথা ভোলায়
আগমনের সুরেতে
বাংলাদেশের ঢোলের বোলে
ছন্দ পতন নাই
সব ভুলে যাই
তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত