প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ১২:২১

১.
নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির প্রতীক, কিংবদন্তি নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, যিনি মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন, দেখাতেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনসহ মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রনায়ক, সিপিবি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন একজন কল্যাণকামী স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ ও মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামকেই তাঁর আজীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাপিডিয়াসহ বিভিন্ন জীবনীতে তাঁর প্রয়াণ দিবস ৭ অক্টোবর উল্লেখ করা হলেও ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ফওজিয়া মোসলেম লিখিত ‘মোহাম্মদ ফরহাদ: বিনম্র শ্রদ্ধা’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় লিখেছেন, ‘১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রণী নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ বনানী কবরস্থানে তাঁর স্মৃতি ফলকেও ৯ অক্টোবেই লেখা আছে। মহান এই নেতার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। 

২.
মোহাম্মদ ফরহাদ। কমরেড ফরহাদ নামেই যিনি পরিচিত। শোষণহীন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল যার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরহাদ (জন্ম : ৫ জুলাই, ১৯৩৮ – প্রয়াণ : ৯ অক্টোবর, ১৯৮৭), স্বাধীন বাংলাদেশের একজন স্থপতি,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি, জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্য এবং বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ আমাদের কাছে নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির প্রতীক। আর তাই জন্মদিনে তাঁকে শুধু স্মরণ করলেই চলবে না, দেশের সঙ্কট দূর করতে তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়নে দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করতে হবে। কমরেড ফরহাদের বিপ্লবী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের লড়াইকে বেগবান করতে হবে। তিনি সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং মানুষকে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাঁর মতো আদর্শবান, নীতিনিষ্ঠ, উজ্জ্বল রাজনীতিকের এখন বড়ই প্রয়োজন। কারণ আর কিছুই নয়, নীতিহীন, রুগ্ন ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি এখন আমাদের গ্রাস করছে এবং বেশ তীব্রভাবেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন যেমন প্রবলভাবে আক্রান্ত, তেমনি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার লোভে সাম্প্রদায়িকত, মৌলবাদী দল ও রাজনীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, নীতিহীন রাজনীতির বিপরীতে আদর্শবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটাতে হলে এই পাথর সময়ে কমরেড ফরহাদের মতো বলিষ্ঠ- আদর্শবাদী নেতৃত্ব ও গুরুত্ব তীব্রভাবে উপলব্ধি করছেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতোন অনেকেই। কারণ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সফল সংগঠক মোহাম্মদ ফরহাদের নাতিদীর্ঘ কিন্তু বহুমাত্রিক জীবন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শুদ্ধ রাজনীতির দৈন্যদশার পরিপ্রেক্ষিতে তা আরও বেশি। রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে মোহাম্মদ ফরহাদ স্বনামের চাইতে বেনামিতেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান। 

৩.
বাংলাদেশে সমাজ বদলের রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ফরহাদ। অগণতান্ত্রিক শাসন নির্মূল-সাম্প্রদায়িকতা ও শোষণমুক্ত রাজনীতির আদর্শ পুরুষ ফরহাদের জন্ম পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার জমাদারপাড়া গ্রামে ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই। তাঁর পিতা আহমেদ সাদাকাতুল বারী ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং মা তৈয়বন্নেসা। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ইংরেজি, আরবি, ফার্সি ও উর্দু প্রভৃতি ভাষায় তাঁর দখল ছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ পীরে কামেল কদম আলী শাহ্ জলপাইগুড়ি থেকে আগমন করেন শাহ্ বংশীয়। কমরেড ফরহাদরা মোট ৬ ভাই- বোন। তিনি পিতা মাতার মধ্যম পুত্র ও পঞ্চম সন্তান। দিনাজপুর জিলা স্কুল সংলগ্ন একটি প্রাইমারী স্কুলে চল্লিশের দশকের শুরুতে মোহাম্মদ ফরহাদ এর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে সর্বদাই পরিচিতি ও প্রশংসিত ছিলেন। মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৫৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালভাবে উত্তীর্ণ হন এবং দিনাজপুরের তদানিন্তন একমাত্র কলেজ দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যা আজকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালে সংগঠনটির জন্মকালে ফরহাদ দিনাজপুরে ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি দিনাজপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। খুব অল্প সময়েই ফরহাদ জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় পরিণত হন। পাশাপাশি তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের নজর কাড়েন কমরেড ফরহাদ। মোহাম্মদ ফরহাদ দিনাজপুর এসএন কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণমনুষের এই নেতা দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন শিশু সংগঠকও। মুকুল ফৌজ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। আবৃত্তিকার এবং নাট্যাভিনেতা হিসেবেও তার সুনাম ছিল।

৪.
মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৫৭ সালে কৃতিত্বের সাথে আই.এ পাস করেন। দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়নকালে মোহাম্মদ ফরহাদ সাহিত্যপাঠ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি কলেজ ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি ছিলেন। তেভাগার সংগ্রাম ও বাম আন্দোলনের ঐতিহ্যমন্ডিত দিনাজপুরে গোপন পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন মোহাম্মদ ফরহাদ। ছাত্র ও গণমানুষের কাছে কমরেড ফরহাদ যতই জনপ্রিয় হতে থাকেন নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্রও ক্রমশ কমরেড ফরহাদকে শত্রু হিসেবে নেয়। ফলে ফরহাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই নেমে আসে নিপীড়নের স্টিমরোলার। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলে মোহাম্মদ ফরহাদও গ্রেফতার হয়ে আট মাসকাল কারাভোগ করেন। তাঁকে আটক রাখা হয় বিনাবিচারে। কারামুক্তির পর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে তিনি আত্মগোপনকৃত কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি সুনামের সাথে বি.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন। কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আইয়ুববিরোধী মিছিল বের হয়। ১৯৬২ সালে আইন অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুব খান ফরহাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া বের করে। মোহাম্মদ ফরহাদ তৎকালীন ছাত্রী আন্দোলনের নেত্রী রাশেদা খানমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

৫.
মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৬২ সালে আইয়ূব বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন এবং এখান থেকে সূচিত হয় জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা। এই আন্দোলনের ফলে মোহাম্মদ ফরহাদের ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ফলে গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে তাঁকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভের পর মোহাম্মদ ফরহাদ কিছুকাল দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সাংবাদিকতা পেশায় তিনি স্থিত হতে পারেন নি। তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন। তাঁর সাংগঠনিক নেতৃত্বে ছাত্র-সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে চীন সোভিয়েত বিরোধের ফলে যে বিভেদ দেখা দেয় তার প্রভাবে এ দেশের বাম আন্দোলনও পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ১৯৬৫ সালে ছাত্র গণসংগঠনেও বিভক্তি দেখা দেয়। মোহাম্মদ ফরহাদ মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠীর তরুণ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে কমিউনিস্টদের সম্পৃক্ত হওয়ার পটভূমি তৈরিতেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন, নারী আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম প্রসারে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা। প্রবীণ প্রজন্মের ত্যাগী নেতা এবং নতুন প্রজন্মের নবীন কর্মীদের মধ্যকার সেতুবন্ধন ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। 

৬.
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন ফরহাদ। স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ লাভ করে এবং ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময়ে ফরহাদ একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৭৭ সালে সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তাঁকে বিনা বিচারে আটক করে। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮০ সালের মার্চে নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা শুরু করে। ১৯৮১ সালের আগস্টে সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশবলে তিনি মুক্তি পান। ১৯৭৮ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দল ও ৭ দলের যুগপৎ কর্মসূচি প্রণয়ন ও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ছিল বিশেষ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১৫ দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় অবদান রচনার পথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ৭ অক্টোবর (মতান্তরে, ৯ অক্টোবর) মস্কোতে চিকিৎসাধীন থাকাকালে মোহাম্মদ ফরহাদের অকাল মৃত্যু এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ১৯৮৭ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য রাশিয়ার মস্কোতে নেয়া হয়। এই প্রথাবিরোধী রাজনীতিকের জীবনাবসান ঘটলেও তিনি বেঁচে থাকেন আমাদের মাঝে তাঁর জনসম্পৃক্ত রাজনীতির কারণে।

৭.
সমাজ পরিবর্তনের পুরোধা ছিলেন প্রয়াত শ্রমজীবি মানুষের নেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ। অসাধারণ মেধা, বুদ্ধি আর প্রজ্ঞার অধিকারি কমরেড ফরহাদ অত্যন্ত সাধারণ ও সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও তিনি কোন লোভনীয় চাকরির পেছনে ছুটে যাননি। অথচ তিনি চাইলে সেটা অনায়াসে পেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে মানব মুক্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন সারাটা জীবন। এমন বিরল ত্যাগ আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন কেবল স্বপ্ন! চিরঞ্জীব কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদকে আমরা তাই ভুলবো না, ভুলতে পারি না। তাঁর সততা, আদর্শ আর দেশপ্রেম আমাদের প্রেরণা। তাঁর সংগ্রাম ও স্বপ্ন সফল হবেই। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের সেই স্বপ্নের কাঙ্খিত সফলতা আসতে সময় লাগবে, একদিন আসবেই। গণমানুষের বন্ধু মোহাম্মদ ফরহাদ, মহান মানবতাবাদী মানুষটি আমাদের মনে, মানুষের হৃদযয়ের মণিকোঠায় চির জাগরুক হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ধরে। তাঁর আদর্শ হোক আজকের প্রজন্মের প্রেরণা। জয় হোক কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের, শোষিতের। ল্যাটিন মহিলা ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দে বলেছিলেন, ‘মৃত্যু বলে কিছু নেই, মানুষের মৃত্যু ঘটে যখন আমরা তাঁকে ভুলে যাই’। নানা কারণে আজও তাই মোহাম্মদ ফরহাদ বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে, মানুষের জন্য কাজের কারণেই তাঁকে মনে পড়ে, তাই তাঁর মৃত্যু নেই।

৮.
জননেতা ও বাংলাদেশের বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ফরহাদের স্মৃতিচারণ করে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘প্রথমত, আমার দৃষ্টিতে মোহাম্মদ ফরহাদ হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিভূ, যাঁদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৪৭-এর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল। সে সময় বিকাশমান নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের দ্রুত নেতৃত্বে নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ নিজ গুণে এই উত্তরণকালীন-প্রক্রিয়ার মূল ধারক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত ১৬ বছরের কিশোর আট মাস জেল খাটেন। আর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় যে কথাটি আরও মনে পড়ে, তা হলো আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তথা শিক্ষা আন্দোলন রূপায়ণে তাঁর মেধাদীপ্ত অবদানের কথা। তিনি এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন আর ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টাই তাঁকে হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালের সব আন্দোলনেই ছিল তাঁর নিয়ামক অংশগ্রহণ। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে, বামপন্থীদের অবদানের মূর্ত প্রতীক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। কমিউনিস্ট-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি ছিলেন সংগঠক ও অধিনায়ক। প্রবাসী সরকার এ সময় কমরেড মণি সিংহ ও তাঁর মাধ্যমে পেয়েছে প্রভূত সমর্থন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। সশস্ত্র যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তাঁর স্বাধীনতা-উত্তর ‘দেশ গড়া’র চেতনাকে আরও শাণিত করে তোলে। চতুর্থত, অনেকেই মনে করেন, জাতীয় রাজনীতিতে মোহাম্মদ ফরহাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনকে একটি সুস্পষ্ট অবয়ব দান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোটকে একতাবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। সংসদের প্রার্থিতা মনোনয়নে দুই নেত্রীর মাঝে তাঁর ৫০-৫০ আসন ভাগের প্রস্তাব সে সময় ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। পঞ্চমত, এবং আমার মতে তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, সে সময় সিপিবিকে একটি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি থেকে জনমানুষের পার্টিতে পরিণত করা। মোহাম্মদ ফরহাদ কৃষক ও শ্রমিক ফ্রন্টকে দলের জনসমাবেশ শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংগঠনিক গুরুত্ব দেন। এর পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্টদের নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ১৯৮৬ সালে নিজে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। এককথায়, তিনি নিজ দলকে জাতীয় মূলধারার রাজনীতিতে দৃশ্যমান করে তোলেন। এসব তিনি করতে সক্ষম হন যখন তিনি স্বাধীন দেশে বারবার কারাবরণ করেছেন, দল নিষিদ্ধ হয়েছে এবং কর্মীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এককথায়, তিনি ছিলেন আশির দশকের সিপিবির স্বর্ণযুগের স্থপতি।’ অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো লিখছেন, ‘কঠিন আদর্শবাদী একজন মানুষের সংবেদনশীল এই বাস্তবতাবোধ আমাকে আশ্চর্য করত। মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে মস্কোতে গভীর রাতের প্রলম্বিত এক আলোচনায় ফরহাদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, দলকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন কী? তিনি তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কমিউনিস্টদের একটি গ্রুপ গঠন, দলের একটি নিজস্ব ভবন থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং দলের পত্রিকা একতাকে দৈনিকে পরিণত করা। তাঁর অবশিষ্ট সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি ১৯৮৬-র নির্বাচনে সংসদে পাঁচজন সিপিবির সদস্য পান। সিপিবিকে একটি স্থায়ী ঠিকানা দেওয়াকেও তিনি নিশ্চিত করেন। এবং আশির দশকে একতার প্রচারসংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মনে প্রশ্ন জাগে, আজ যদি দেশের বর্তমান জাতীয় ও দলীয় রাজনীতি নিয়ে আবার তাঁকে প্রশ্ন করতাম, তাহলে তিনি কী উত্তর দিতেন।’

৯.
মোহাম্মদ ফরহাদ-এর বন্ধু সুইডেন প্রবাসী নৃতাত্ত্বিক, লেখক নেহাল আদেল ‘স্মৃতিতে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ’ স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘কমরেড ফরহাদের সঙ্গে আমার পরিচয় যখন তিনি দৈনিক সংবাদের খেলাঘর পাতার সম্পাদক ছিলেন। প্রয়াত আনোয়ার জাহিদ, যিনি তাঁর আগে এ পাতাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন, আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যদিও দৈনিক সংবাদের প্রায় সবাই বামপন্থী ছিলেন। কিন্তু আমার কোনো ধারণা ছিল না, তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে পরিচয় পেলাম। … আমি মনে করি, কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের জনগণ মোহাম্মদ ফরহাদকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর মহান ত্যাগ-নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার আলোকে সঠিক মূল্যায়ন করবে।’

(সহায়ক তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত