শহীদ দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি

চে: বিপ্লবের মোহন বাঁশীওয়ালা

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০১৮, ১২:১৪

‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়/ আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা/ আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ/ শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস.../ বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা/ তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর/ তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে/ নেমে গেছে/ শুকনো রক্তের রেখা … / চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

১.
মানুষের মুক্তির চিরন্তন চেতনার নাম এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। তিনি সারা পৃথিবীতে বেঁচে আছেন আদর্শ ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। ‘চে’ নামটি শুনলেই রক্তের মধ্যে বিপ্লবের আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যার অনুপ্রেরনায় আজও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে দেশে দেশে দিকে দিকে। চে গুয়েভারা কিউবার বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে সুপরিচিত। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর আহতাবস্থায় ধরা পড়ার পর বন্দী চে’কে নির্মমভাবে কাপুরুষের মতোন গুলি করে হত্যা করা হয় ৯ অক্টোবর। মানবতার মুক্তির আলোক দিশারী বিপ্লবী চে গুয়েভারার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, বিপ্লবের মোহন বাঁশীওয়ালা চে গুয়েভারা ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন। চে গুয়েভারা স্বপ্ন দেখতেন কিউবার মতো ল্যাটিন আমেরিকার সকল দেশেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গড়ে উঠবে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা। সেই সুবাদে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। বলিভিয়ার অরণ্যে পাহাড়ে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়লেন চে গুয়েভারা এবং শহীদ হন। প্রাথমিকভাবে তাঁর মরদেহ গুম করেও ফেলা হয়। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্ত বিপ্লবের মহান প্রতীক। মৃত্যুর পর তিনি সমাজতন্ত্র অনুসারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন। আর তাই কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চে গুয়েভারার প্রতি’ কবিতায় সশ্রদ্ধ উচ্চারণের মত সারা বিশ্বের লক্ষ, কোটি মানুষের চে’র স্মরণে মাথা নত হয়ে আসে।

২.
“চলো যাই / সমস্ত বাধাকে ছিন্ন করে ললাটে থাক আমাদের / উজ্জ্বল মার্তির অভ্যুত্থাণের শিহরণ, / জয় চিহ্নিত হোক বিন্দু বিন্দু স্বেদে / অথবা স্পর্শ নিক নিঃশব্দ মৃত্যুর।” - চে গুয়েভারা (অনুবাদ : রথীন চক্রবর্তী)
চে গুয়েভারা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম। এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন বিপ্লবের মুখচ্ছবি হিসাবে বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। অথচ মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারার আরাধ্য মানব মুক্তি এখনো অর্জিত হয়নি। দেশে দেশে এখনো চলছে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ। চের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। চে মানুষের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি অন্য এক আলো প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর দেশে দেশে। সে আলো ছিল শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজের। শাসনে-শোষণে পিষ্ট পৃথিবী তাঁর ভেতরে জাগিয়ে দিয়েছিল মানুষের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবন তাঁকে টেনেছিল সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন লড়াইয়ের পথে। সে পথে হেঁটে যেতে যেতে বারবার তিনি উচ্চারণ করেছেন মহাকাব্যিক জীবনের জয়গান, ‘আস্তা লা ভিকতোরিয়া সিয়েম্প্রে’; যার মানে ‘চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো’। ইতিহাসের পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই পথিকের নাম এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। চে কখনো মরতে পারেন না। চে’রা কখনো মরেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের চেতনায়। আর মহান এই বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ দিনে তাঁকে জানাই আবারো শ্রদ্ধা ও লাল সালাম। 

৩.
চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। আবার গেরিলা যোদ্ধার পোশাকে ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ ‘গেরিলেরো হেরোইকো নামে’ আলবের্তো কোর্দার তোলা চে’র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁকে নিয়ে সারা বিশ্বে যে মাতামাতি হয়, তা অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়। শুধু লাতিন আমেরিকায় নয়- ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে তরুণদের দেখা যায় এই মহান বিপ্লবীর ছবি সংবলিত টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে, তার ছবি সংবলিত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে। যদিও এর অনেকটাই ফ্যাশনের আদিখ্যেতা, তবে এর একটি রাজনৈতিক দিকও আছে। সেটা হল চে গুয়েভারা এসব তরুণের কাছে সংগ্রামের প্রতীক এবং তারা নিজেদের তার আদর্শের উত্তরাধিকার হিসেবে ভাবতে বা পরিচয় দিতে ভালোবাসে। চে’র সংগ্রাম ছিল মার্ক্সবাদী বিপ্লবের পথে। আরও স্পষ্ট করে বললে তিনি ছিলেন স্তালিনবাদী অর্থাৎ কট্টরপন্থী ‘কমিউনিস্ট’ ষাটের দশকে যে পথ থেকে সরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের পথে এগোতে থাকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। কিউবা বিপ্লবে চে সফল হয়েছিলেন বটে, তবে এর পরবর্তী সময়টি ছিল বিশ্বজুড়ে এক অসাধারণ আন্দোলন-পরিবর্তনের যুগ। সেই শান্তিপূর্ণ বিপ্ল¬বে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানুষের জীবনযাত্রায় সত্যিই পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। এ অবস্থায় চে অনুসৃত হার্ডলাইন অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রামের দিন যে লাতিন আমেরিকায়ও ফুরিয়ে আসছিল, এটি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ট্রোও বুঝতে ভুল করেননি। তাই তিনি চে’কে ওই পথ থেকে সরে এসে অন্যত্র দৃষ্টি দিতে বলেছিলেন। আর আজ তো মার্ক্সবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বিশ্বে সংকটের মুখোমুখি হয়ে গেছে। সবার কাছে আজ তাই প্রশ্ন, চে এখনও কেন এত প্রাসঙ্গিক?

৪.
পুরো নাম এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সারনা। চে গুয়েভারার জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। তবে তার আরেকটি জন্ম তারিখ ১৯২৮ সালের ১৪ মে বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়। বাবার নাম আর্নেস্টো গুয়েভারা লিঞ্চ এবং মায়ের নাম সিলিয়া দ্যা লা সেরনা। জন্মের পর তার নাম দেওয়া হয়েছিল আর্নেস্তো। পরে বিপ্লবের স্বার্থে এবং নিজের আভিজাত্যকে চুর্ণ করতে চে নাম ধারন করেছিলেন এবং পরিচিতি লাভ করেছিলেন এই নামেই। দক্ষিণ আমেরিকায় চে অর্থ বন্ধু। চে গুয়েভারার ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। আর্নেস্তো চে গুয়েভারা ছোট বেলায় অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও খেলাধুলায় অনেক ভালো ছিলেন এবং সেই সাথে ছিল পড়াশুনায় ব্যাপক আগ্রহ। বড় হয়েও দেখা গেছে কিউবাতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় রাতে তাঁর ঘরে আলো জ্বলত সে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন এবং যুদ্ধের ময়দানে কবিতার বই এবং অস্ত্র থাকত তাঁর ব্যাগে। এভাবেই জ্ঞান সাধনায় মগ্ন থাকতেন মহান এই বিপ্লবী ও দার্শনিক। ১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে চে গুয়েভারার সঙ্গে প্রেমিকা হিল্দা গাদিয়ার বিয়ে হয়। ১৯৫৬ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি চে গুয়েভারা ও হিল্দার কন্যা সন্তানের জন্ম হয় হিলদিতার। 

৫.
একসময় আর্নেস্তো চে গুয়েভারার পরিবার রোসারিও শহর থকে বুয়েন্স আয়ার্সে চলে আসেন। এখানেই ডাক্তারি পড়ার জন্য বুয়েন্স আয়ার্সের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর তার মাথায় ভ্রমণের চিন্তা উদয় হয়। তাঁর বন্ধু আলবার্তোর সঙ্গে মটর সাইকেল ভ্রমণে যাবার কথা বাবাকে জানান। এখানে একটা মেয়ের সাথে চের ভাল সম্পর্ক ছিল, বাবা ভাবতেন এর জন্য হয়তো চে কোথাও যেতে পারবে না। যখন তিনি ছেলের নিকট শুনলেন, মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলে আর্নেস্তো বলেন আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে ফিরে আসব। সেই প্রেমের সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ না হয়ে আর্নেস্তো এবং তার বন্ধু ১৯৫২ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর মাত্র ২৪ বছর বয়সে মোটর সাইকেল ভ্রমণে বের হন। এ সময় তারা পেরু, চিলি, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। এই দেশগুলো ভ্রমন করার সময় এসব দেশের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, শোষণ, বঞ্চনা, কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছিল। আর তার জন্যই এই সবমানুষের জন্য ভালবাসার পরিমান বেড়ে গিয়ে তাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন চে। ভ্রমন শেষে তারা আর্জেন্টিনায় ফিরে আসেন এবং ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে সল্য চিকিৎসা ও ত্বক বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে চে ডাক্তারী পাস করেন। ১৯৫৩ সাল থেকেই তিনি আর থেমে থাকেননি। যাদের জন্য ভালবাসা জন্মেছিল সেই ভালবাসার প্রতিদান দিতে বিপ্লবী জীবনের শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর চে যান বলিভিয়ায়। সে বছরে কিউবার মার্কিন মদদপুষ্ট বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে মনকাদা আর্মি গ্যারিসনে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। বাতিস্তার সেনাবাহিনী বহু বিপ্লবীকে হত্যা করে। কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ ফিদেল কাস্ত্রো সরকারি বাহিনীর হাতে আটক হন। তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন পলাতক বিপ্লবীর সঙ্গে চের সাক্ষাৎ হয় কোস্টারিকার সান হোসে শহরে, সে বছরই। কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর চের জীবনের গতি পাল্টে যায়।
 
৬.
খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে উঠবার কারণে খুব অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন চে। যুবক বয়সে মেডিসিন বিষয়ে পড়ার সময় চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন ধনী গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করে দেবার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন থেকেই তিনি মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং স্বচক্ষে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখার জন্য ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে চে গুয়াতেমালা ভ্রমণ করেন। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সেখানে নির্বাচিত সরকার আরবেনজের শাসনামলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। তিনি মার্ক্সবাদের পাঠ নিতে থাকেন। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরেই সিআইএ-সমর্থিত বাহিনীর হাতে আরবেনজ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়। মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে চেকে গুয়াতেমালা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। চে চলে যান মেক্সিকো সিটিতে। সেখানে অবস্থান করছিলেন নির্বাসিত কিউবার বিপ্লবীরা। তাঁরা সেখানে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে উৎখাত করার। 

৭.
১৯৫৫ সালের মধ্যে চে গুয়েভারার সঙ্গে পরিচয় হয় রাউল ক্যাস্ত্রোর। পরে ১৯৫৫ সালে জুলাই মাসে মারিয়া এন্টোনিয়ার বাড়িতে চের সঙ্গে পরিচয় হয় কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। কাস্ত্রো গেরিলা দলের নেতৃত্বে ছিলেন। চে সেই গেরিলা দলে নিজেকে যুক্ত করে নেন অচিরেই। শুরুতে গেরিলা দলের চিকিৎসকের দায়িত্ব নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি রেবেল আর্মি কমান্ডার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে চে তাঁদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। খুব অল্পদিনেই চে বিপ্লবী সংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৮ সালে সান্তা ক্লারার যুদ্ধে রেবেল আর্মিকে সফল নেতৃত্ব দেন এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। কাস্ত্রো ও চের সমর্থন ও নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লবের সফলতা অর্জন শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফিদেল তখন ফুলজেনসিও বাতিস্তার শাসন থেকে মুক্তির জন্য গেরিলা বাহিনী গঠনে ব্যস্ত। চে গুয়েভারাকে কিউবার বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান ফিদেল। আশ্চার্যজনকভাবে আর্জেন্টিনার এই মানুষ তার অতীতকে পেছনে ফেলে মুক্তির আশায় বিপ্লবের নেশায় মত্ত হয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিউবার বিপ্লবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। তিনিই একমাত্র বিদেশী ছিলেন। 

৮.
গোপন প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় মেক্সিকোতে ফিদেল ক্যাস্ট্রে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং চে ও হিলদাসহ অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন। একমাস পর ফিদেল ছাড়া পান এবং চে ও হিলদা সহ কমরেডরা ছাড়া পান ৫৭ দিন পর। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড় থেকে কিউবার বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় কিউবান বিপ্লবীদের গ্রানামা জাহাজ অভিযান শুরু হয়। সেই অভিযানে একজন ডাক্তার হিসেবে তাদের সাথে ছিলেন চে গুয়েভারা। ১৯৫৭ সালের ২২ জানুয়ারী বিপ্লবীরা সরকারি সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটকে পরাজিত করে বিপ্লবের শুভ সূচনা করে এবং ১৯৫৮ সালের আগষ্ট মাসে বিপ্লবী বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু করে। এরপর চের বাহিনী শান্তা ক্লারা শহর দখল করে নেয় এবং বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটে এবং এরই সাথে আমেরিকা মহাদেশে প্রথম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় কিউবায়। ১৯৫৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চে গুয়েভারাকে কিউবার নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং তিনি কিউবার অন্যতম নেতা হন। ১৯৫৯ সালের ২ জুন চে গুয়েভারা আলেইদামার্চকে বিয়ে করেন। চে কিউবা রওনা দেবার পরই তার প্রথম স্ত্রী হিলদা পেরুতে ফিরে যান। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি বিপ্লবে চূড়ান্ত বিজয়ের পর নবগঠিত বিপ্লবী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন চে। কৃষি বিভাগের সর্বোচ্চ নির্বাহী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অথবা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে কিউবার প্রতিনিধিত্বও করেছেন চে গুয়েভারা। জাতিসংঘে কিউবার পক্ষে তিনি বক্তৃতা করেন ১৯৬৪ সালে।

৯.
কিউবার বিপ্লবের সাফল্যের পর চে ৩১ বছর বয়সে বিশ্বব্যাপি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি কিউবার সমাজ গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি স্বেচ্ছা শ্রম দিয়েছেন জনগনকে কাজে উদ্বুদ্ধ করতেন। এ সময় তিনি ভূমি সংস্কার, প্রতিষ্ঠানের শিল্প দফতরের প্রধান, জাতীয় ব্যাংকের গভর্ণর ও শিল্প দফতরের মন্ত্রী নির্বাচিত হন। চে গুয়েভারা কূটনীতিক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি মিশর, সুদান, পাকিস্তান, ভারত, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, জাপান, মরক্কো. যুগোস্লাভিয়া প্রভৃতি দেশে সরকারি সফর করেন। ১৯৬৪ সালে চে বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। চে গুয়েভারা কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে কিউবায় কমিউনিষ্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলে কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচিত হন। চে গুয়েভারা জাতিসংঘের ভাষণে কিউবার প্রধান বক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই সময় তিনি তার বক্তব্যে বলেন “আমরা চাই সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে। আমরা আমাদের নীতি হিসেবে ঘোষণা করছি যে, শান্তির লক্ষ্যে যারা কাজ করেছেন আমরা তাদের শরিক। আমরা নিজেদের মনে করি জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠীভূক্ত দেশ হিসেবে, যদিও আমরা মাকর্সবাদী-লেলিনবাদী, কিন্তু আমাদের মতোই জোট নিরপেক্ষ দেশগুলিও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়াই করছে, আমরা শান্তি চাই।” বিপ্লব যার রক্তে আলোড়ন তুলে, কঠিন যুদ্ধ যাকে টানে সে বিপ্লবী চে আর কিউবার গন্ডীতে আবদ্ধ থাকতে চাইলেন না আর তাই কিউবার বাইরে শোষণের অবসানের জন্য যুদ্ধ করতে চলে যাবার প্রয়োজন অনুভব করলেন। চে গুয়েভারা সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন। বিপ্লব-পরবর্তী এসব সাফল্য চিরবিপ্লবী চেকে তুষ্ট করতে পারছিল না এতটুকুও। তাঁর হূদয়ে তখন বিশ্ববিপ্লবের আহ্বান। এবার লক্ষ্য লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলো আর আফ্রিকা। নতুন বিপ্লবের হাতছানিতে ১৯৬৫ সালে তিনি গেলেন আফ্রিকার কঙ্গোতে। সেখান থেকে আবার ফিরলেন কিউবায়। ১৯৬৬ সালে সহযোদ্ধা গেরিলাদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন বলিভিয়ায়। বলিভিয়ায় তখন বিপ্লব-পূর্ববর্তী কিউবার মতোই মার্কিন ম“পুষ্ট স্বৈরশাসক বারিওন্তোস। সাম্রাজ্যবাদী শোষণে বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ তখন দিশেহারা। চে ভেবেছিলেন, বিপ্লবের ডাক বা সশস্ত্র লড়াইয়ের আপসহীন আমন্ত্রণ সেসব মানুষকে সংগ্রামের লড়াইয়ে কাতারবন্দী করবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হলো না। কারণ, বলিভিয়ার সেই অরণ্যে পাহাড়ের ছায়ায় যে বলিভিয়ানদের বসবাস, তাদের কাছে চে আর তাঁর সহযোদ্ধা গেরিলারা ছিলেন ভিনদেশি আগন্তুক। দুই পক্ষের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙল না বলে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়লেন চে গুয়েভারা। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর আহতাবস্থায় ধরা পড়ার পর বন্দী চেকে গুলি করে হত্যা করা হয় ৯ অক্টোবর। তাঁর মরদেহ গুম করে ফেলা হয়। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্ত বিপ্লবের প্রতীক।

১০.
১৯৬৫ সালে ১ এপ্রিল চে গুয়েভারা ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে লেখা এক চিঠিতে কিউবার শিল্প মন্ত্রী পদ, মেজরের পদ, কমিউনিষ্ট পার্টি সদস্যপদ এবং কিউবার নাগরিকত্ব পদ ত্যাগ করেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘ঠিক এই মুহূর্তে আমার অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছে, সেই যখন তোমার সঙ্গে মারিয়া এন্টোনিয়ার বাড়িতে আমার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। সেদিন তুমি আমাকে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে বলেছিলে এবং খুব উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আর তখন একটা প্রশ্ন উঠেছিল মৃত্যুকে বরণ করবে কে ? এই প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই পেয়েছিলাম। বুঝেছিলাম বিপ্লবের বিজয়ের আনন্দ আছে আবার তেমনি মৃত্যুর বেদনাও আছে।’ চে গুয়েভারার বিপ্ল¬বী জীবনের দিকে দৃষ্টি রেখে আমেরিকার জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘আমেরিকার যদি কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকত, তা’ অবশ্যই বিপ্লবের মধ্যেই নিহিত আছে। আর আমেরিকায় যদি কোন বিপ্লব সংঘটিত করতে হয়, তা’হলে অবশ্যই এলভিস প্রিসলীকে চেগুয়েভারা হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হবে।’ সেই থেকেই শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চে গুয়েভারা বলিভিয়াকেই বেছে নিলেন এবং ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে উরুগুয়ের ব্যবসায়ী এ্যাডোলফো মেনা গনজালেস নাম ধারণ করে ছন্মবেশে বলিভিয়ায় পৌঁছান। বলিভিয়ায় যাবার আগে তিনি তার সকল আপনজনের কাছে চিঠি লেখেন এবং সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বলিভিয়াকেই সর্বাপেক্ষা উপযোগী মনে করেন কারন প্রায় সকল দেশের সীমান্তের সাথে যোগাযোগ ছিল দেশটির। যার ফলে বিপ্লবী কর্মকান্ডের অনুকূল ছিল বলিভিয়া। 

১১.
চে গুয়েভারা বলিভিয়ায় বিপ্লবী কর্মকান্ড শুরু করার পর মনে মনে আর্জেন্টিনার কথা ভাবতেন তার এক চিঠিতে প্রমান পাওয়া যায়। তিনি ফিদেলকে বলেছিলেন বিপ্লবে জয় লাভ করার পর আমি একটি মাত্র কাজ করতে চাই। আর সেটি হচ্ছে আর্জেন্টিনার লড়াই। ১৯৬৭ সাল থেকে বলিভিয়ার স্বশস্ত্র যুদ্ধের শুরু হয় এবং চের নেতৃত্বে অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে সফল হয়। বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার গেরিলা সংগ্রাম ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিটি সরকার ও সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ভীত হয়ে পড়েন। তারা চে গুয়েভারার গেরিলা বাহিনী ধ্বংসের জন্য গোপনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনসন এবং সি. এই. এ প্রধান চেমসন মিলে গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ সময় চে গুয়েভারারকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫০.০০০ বলিভিয়ার ডলার পুরুস্কার ঘোষণা করে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে চের বাহিনী রিওগ্রানভ ও ভ্যালিগ্রান্ড শহরের মধ্যবর্তী লা হিগুয়েরা গ্রামের কাছে অবরুদ্ধ যে গিরিখাতের পাদদেশে অবস্থান নেয় এবং আলু চাষীর তথ্যের ভিত্তিতে সেই স্থানটা মার্কিন বাহিনী ঘিরে ফেলে। এই সময় চে তার বাহিনীকে যুদ্ধ করার এবং সময় গেলে ঐ স্থান থেকে সরে পড়ার নির্দেশ দেন তখনো তিনি এ্যাজমায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে গেরিলা এবং সৈন্যদের মধ্যে গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং চে গুয়েভারা তাদের পিছন দিক দিয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বলিভিয় সৈন্যদের গুলিতে চের এম. আই. কারবাইন অচল হয়ে যায় এবং বাম পায়ের পেশিতে গুলি লাগে। এ সময় উইলি তাদের সঙ্গে ছিল। সৈন্যরা আত্মসমর্পন করতে বলে কারবাইন অচল এবং পিস্তলে ক্লিপ না থাকা চে গুলি করতে পারলেন না। উইলি তার অস্ত্র ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে গুলি করো না। ইনি কমান্ডার চে গুয়েভারা, তাঁকে সম্মান কর। বলিভিয়ার সেই অরণ্যে পাহাড়ের ছায়ায় যে বলিভিয়ানদের বসবাস, তাদের কাছে চে আর তাঁর সহযোদ্ধা গেরিলারা ছিলেন ভিনদেশি আগন্তুক। দুই পক্ষের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের দেয়াল ভাঙল না বলে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়লেন চে গুয়েভারা। এরপর সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ও ভানদো এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব ষ্টাফ জুয়ান জোসে তারেস বৈঠকে মিলিত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে চে কে মেরে ফেলতে হবে। কারন তা না হলে সারা দুনিয়ায় ঝড় উঠবে এবং কিউবা বলিভিয়া আক্রমণ করবে। চে’কে বন্দি করার পর একটা স্কুলে আটকে রাখা হয় এবং পরের দিন তাকে মারার জন্য মারিও তেরন নামে একজন সৈন্যকে পাঠান। তখন চে তাকে বলেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে মারতে এসেছো এবং তোমরা মনে করছো আমাকে হত্যা করে বিপ্লব থামাতে পারবে, তা পারবে না শুধু আমাকেই আপাতদৃষ্টিতে সরিয়ে ফেলতে পারবে, আমাদের বিপ্লবকে মারতে পারবে না।’ তখন সেই সৈনিক প্রচন্ড স্নায়ুর চাপে ভুগতে থাকে এবং মদ পান করে প্রায় এক ডজন গুলি চালায় চে’কে লক্ষ্য করে। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর আহতাবস্থায় ধরা পড়ার পর বন্দী চে’কে এভাইে কাপুরুষের মতো গুলি করে হত্যা করা হয় ৯ অক্টোবর। এরপর তাঁর মরদেহ গুম করে ফেলা হয়। কিন্তু মহান এ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্ত বিপ্লবের জীবন্ত প্রতীক। এভাবেই একজন বিপ্লবীর জীবন কেড়ে নেয় সাম্রাজ্যবাদীরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর চে’র হাত এবং চুল কেটে ফেলা হয় এবং সবাইকে এক কবরে পুতে রাখা হয় চরম অসম্মান ও নির্মমতার সাথে। 

১২. 
চে’র প্রতি সম্মান জানাতে তাঁর মরদেহ বা কঙ্কাল খুঁজে বের করতে ১৯৯৬ সালে কিউবার বিশেষজ্ঞরা ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করে এবং প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকায় জরিপ চালানো হয়। ১৯৯৭ সালের জুনের শেষ দিকে কিউবা ও আর্জেন্টিনার বিশেষজ্ঞরা সম্মিলিতভাবে ভালেগ্রান্দে উদ্ধার অভিযান চালান। একপর্যায়ে একসঙ্গে কয়েকটি মানুষের দেহাবশেষের মধ্যে পাওয়া যায় বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই কঙ্কাল, যার হাত দুটি ছিল না। বিশেষজ্ঞরা জানতেন, মৃত্যুর পর চে’র হাত দুটি কেটে ফেলা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন ভ্যালিগ্রান্দের একটি গনকবর থেকে ৭টি কংকাল উদ্ধার করা হয় এবং দেহাবশেষ শান্তাক্রুজ শহরে এক হাসপাতালে পরীক্ষা চালিয়ে দুটি হাত ছাড়া কঙ্কালকে চের কঙ্কাল বলে চিহ্নিত করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন লেখক-সাংবাদিক জন লি অ্যান্ডারসন। সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যিকারের রোমাঞ্চ আর আনন্দ কাকে বলে, কিউবানদের চেহারায় তখন তা দেখেছি। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তাঁরা কাঁদছিলেন।’ ১২ই জুলাই ফিদেল ক্যাস্ট্রো পূর্ণ সামরিক মযার্দায় গ্রহণ করেন এবং হাভানার রেভ্যুলেশন স্কয়ারের বিপ্লবী কবি হোসে মার্তি মেমোরিয়ালে রাখা হয়। লক্ষ লক্ষ লোকে এখানেই চে কে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

১৩.
চে’র জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্ভাষণ জানানোর পাশাপাশি তার অভিজ্ঞতার দিকেও আলোকপাত করা উচিত। বিশেষ করে গত এক দশক ধরে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে নতুন পর্যায়ের সংগ্রামের যে ঢেউ লেগেছে, তার পটভূমি অনুধাবনে এটি অপরিহার্য। এসব দেশের বেশ ক’টিতে সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসানে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন বামপন্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছেন এবং শাসক শ্রেণী ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। তবে এ পরিবর্তন প্রক্রিয়া হুমকিমুক্ত নয়। একে স্থায়ী রূপ দেয়ার ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণা মিলতে পারে চে গুয়েভারার সংগ্রামী ভাবমূর্তি থেকে। বিশ্বের অন্যত্রও এটি প্রযোজ্য। ফ্যাশন, উচ্ছ্বাস বা মাতামাতি নয়- আমাদের দেশেও অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে চে গুয়েভারা হয়ে উঠতে পারেন অন্যতম প্রেরণাদাতা।

১৪.
চে গুয়েভারা চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু তিনি শুধু মানুষের চিকিৎসা করেননি, তিনি সমাজ পরিবর্তনেরও চিকিৎসক ছিলেন। কোনো রকম বিচার ছাড়াই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ, শাসকগোষ্ঠী বুঝে গিয়েছিল, চে বেঁচে থাকলে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ বেঁচে থাকবে না। এর পরও চের চেতনা পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে গেছে। সাম্রাজবাদী মদদ পুষ্ট বলিভিয়া সরকার চে কে মেরে বিপ্লবকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা প্রতিটি তরুণের মনে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা জাগায়। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রনয়নে পুজিবাঁদের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে চে অনুসরণীয়, অনুকরণীয় হয়ে আছেন। আজও সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহী চের সম্মান বা নাম স্মরনে রেখেই সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিকামী মানুষ। জয় চে গুয়েভারার, জয় মেহনতি মানুষের, জয় সমাজ তন্ত্রের। চে গুয়েভারা লাল সালাম।

১৫.
লক্ষ্য করার বিষয়, লাতিন আমেরিকা অথবা বিশ্বের অন্যত্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে চে খুব বেশি কিছু বলেননি। আসলে চে গুয়েভারার প্রাসঙ্গিকতা যতটা না মতাদর্শিক হিসেবে, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একজন প্রেরণাদাতা হিসেবে। ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত একনায়কতান্ত্রিক শাসনাধীনে। বলিভিয়ার বানজের, কিউবার বাতিস্তা, ব্রাজিলের ব্রাংকো, গুয়াতেমালার সেরেজো, হন্ডুরাসের কর্দোভা, হাইতির দুভেলিয়ের, চিলির পিনোশে, পানামার নরিয়েগা, নিকারাগুয়ার সমোজা, আর্জেন্টিনার ভিদেলা, ডোমিনিকান রিপাবলিকের রাফায়েলÑ নৃশংস ও বর্বর শাসক হিসেবে এসব কুখ্যাত একনায়কের নাম এখনও ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হয় সারা বিশ্বে। এমন কোন অন্যায় কাজ নেই, যা করতেন না এই একনায়করা। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কিউবার একনায়ক বাতিস্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার পর চে পরিণত হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বৈপ¬বিক সংগ্রামের প্রতীকে। তিনি ছিলেন অসাধারণ ক্যারিশম্যাটিক, আকর্ষণীয়, সম্মোহনী ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী এক পুরুষ। তার বক্তব্য, বিবৃতি, বক্তৃতা, কর্মকাণ্ডÑ সবকিছুতে ঘটেছিল এর প্রকাশ। যেভাবে তাকে হত্যা করা হয়, সে ঘটনাও তাকে পরিণত করে কিংবদন্তিতে। তবে বাস্তবতা হল, যে বলিভিয়া অভিযানে চে নিহত হন, সে অভিযানে অংশ নেয়া ছিল তার একটি ভুল পদক্ষেপ। ওই অভিযান সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তবুও চে’র সংগ্রাম ও আত্মদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শাসক শ্রেণীÑ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই দুর্নীতিপরায়ণ, অপ্রতিনিধিত্বশীল, অবিশ্বস্ত ও কায়েমি স্বার্থবাদী হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজš§ এ অবস্থার পরিবর্তন চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের তরুণদের কাছে চে বিবেচিত হচ্ছেন অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামী একজন নীতিবান বিপ্লবী যোদ্ধা হিসেবে। কাজেই একজন তরুণ যখন চে’র ছবি সংবলিত টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায় তখন সাধারণভাবে ধরে নেয়া যায়, ওই তরুণটির ভেতরে কাজ করছে শাসক শ্রেণীর অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশের ইচ্ছা। প্রকৃতপক্ষে এখানেই চে গুয়েভারার প্রাসঙ্গিকতা।

১৬.
চে গুয়েভারার রচনা : বলিভিয়ার পাহাড়-জঙ্গলে (এখানটাতেই তাঁকে মেরে ফেলা হয়) লড়াইকালীন সময়ে অস্ত্রের পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে সব সময় থাকত একটি ব্যাগ, আর ব্যাগের মধ্যে টুকিটাকি এটা-ওটার সঙ্গে এক ‘সবুজ খাতা’ কবিতার খাতা। নিজে কবিতা লিখতেন। কবিতার গোগ্রাসী পাঠক ছিলেন প্রেমের কবিতার, দ্রোহের কবিতার। চিলির পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩), পেরুর সেসার বাইয়েহো (১৮৯২-১৯৩৮), কিউবার নিকোলাস গিইয়েন (১৯০২-১৯৮৯) প্রমুখ ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। তাঁদের লেখা তাঁর প্রিয় কবিতাগুলো নিজ হাতে লিখে রেখেছিলেন ওই সবুজ খাতায়, ঊনসত্তরটির মতো। তাঁকে গুম করে মেরা ফেলার পর বলিভিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওই ব্যাগ এবং এর ভেতর থেকে যেসব কাগজপত্র উদ্ধার করেছিলেন (প্রায় ৪০ বছর আগেকার কথা), সেগুলো একটি বাক্সে রেখে দেওয়া হয়। উদ্ধার করা সেসব কাগজপত্রের মধ্যে ছিল এই সবুজ খাতা, যার ফটোকপি বহু হাত ঘুরে জীবনীকার মেক্সিকোর স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক পাকো ইগনাসিও তাইবো দ্বিতীয়র কাছে গিয়ে পৌঁছায়। তিনি কবিতাগুলো সাজিয়ে তুলে দিলেন প্রকাশনা সংস্থা পার্টির নেতার কাছে, যারা বছর কয়েক আগে এল কয়াদের্নো বের্দে দেল চে নামে মুদ্রণ করে এই সবুজ খাতাটি। চে গুয়েভারা কিউবান ভাষায় ৭০ টি প্রবন্ধ যার মধ্যে প্রায় ২৫ টি লিখেছেন ছন্মনামে। তিনি লিখে দিয়েছেন ৫টি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮-১৯৬৫ ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০ শ’র কাছাকাছি, বিভিন্ন ব্যক্তিকে লেখা চিঠি ৭০ টি সংগৃহীত আছে। লেখালেখি নিয়ে ৯ খন্ডের রচনাবলী রয়েছে। মটর সাইকেল ডাইরী সর্বোচ্চ বিক্রির খ্যাতি লাভ করেছে। পরে একই নামে চলচ্চিত্রও তৈরী হয়েছে। ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর মিয়ানি বিচে আর্ট ব্যাসন চলচিত্র উৎসবে চে পার্ট ওয়ান চলচিত্রের প্রদর্শনী হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই সিকুয়েল চে পার্ট টু মুক্তি পায়।
 
১৭.
ছবির কাহিনিটি-চে’র জীবন থেকে নেওয়া। চলচ্চিত্রটি এরকম, ১৯৫২ সাল। মেডিক্যাল পড়াশোনা শেষ করার কিছু আগে চে আর তাঁর বায়োকেমিস্ট বন্ধু আলবার্তো গ্রেনেডো মিলে ভাবলেন পুরো দক্ষিণ আমেরিকা একবার ঘুরে আসা যাক। ভাবনা আসা মাত্রই কাজে নেমে পড়লেন দুই বন্ধু। বাহন হিসেবে ছিল গার্নাডো’র নরটন ৫০০ মোটরসাইকেল। প্রথমে রোমাঞ্চনের জন্যই মূলত ভ্রমণ শুরু করেন কিন্তু পেরুতে এসে তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্যদিকে মোড় নেয়। পেরুর দুস্থ কুষ্ঠরোগীদের প্রায় বিনা চিকিৎসায় অকাতরে মরতে দেখে অস্থির আর হতবিহ্বল হয়ে গেলেন তাঁরা। নিজ শহর বুয়েনস এইরেস থেকে প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার দূরে তাঁরা আঁট বেঁধে নেমে গেলেন দুস্থদের সেবা ও চিকিৎসায়। তাঁদের যাত্রাপথে ছিল চিলি, আন্দিজ, আতাকামা পর্বত থেকে শুরু করে ভেনিজুয়েলা। তাঁদের একমাত্র বাহন নরটন ভেঙে পড়াতে যাত্রায় কিছুটা ধীর চলে আসে। কিন্তু এই দীর্ঘপথে তাঁরা খুব কাছ থেকে দেখে অনুভব করেন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সবখানে খনিশ্রমিক থেকে শুরু করে সব কিছু কিভাবে গুটিকতক মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। কিভাবে এই গুটিকতক মানুষ অন্যদের শোষণ করে। এই যাত্রাই চে’র জীবনের সব চিন্তা ও চেতনাকে পরিবর্তন করে দেয়। এমনই সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরি’ নামের এ চলচ্চিত্রটি। এই চলচ্চিত্রে চে’র অনুভতি ও চোখ দিয়ে গোটা বিশ্বকে দেখানো হয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফাঁকফোকর। যার মধ্য দিয়ে একদল হয়ে উঠে শোষক আর অন্যরা শোষিত। ১২৬ মিনিটের চলচ্চিত্রটি প্রথম মুক্তি পায় ২০০৪ সালে।

১৮.
বিশ্বময় অসংখ্য তরুণের স্বপ্নের নায়ক, বিপ্লবের জীবন্ত ‘আইকন’, দুনিয়া কাঁপানো এই বিপ্লবীর স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর নিরস্ত্র অবস্থায় ৯টি গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল বন্দি চে গুয়েভারাকে। কিন্তু স্তব্ধ করা যায়নি চে'র আদর্শকে। আজও পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে শুনি চে গুয়েভারার নামে চলছে বাঁচার লড়াই। শৃঙ্খলমুক্তির সংগ্রামে চে গুয়েভারার প্রয়োজন আজও ফুরিয়ে যায়নি। চে কেবল একটি বিপ্লবীর নামই নয়; তিনি যেন সংগ্রামের প্রতীক। চে'র আত্মত্যাগ তাকে মহীয়ান করেছে। বিপ্লবের জন্য, সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে চে একটি অমর নাম। আজ দেশে দেশে যে বিপ্লব, যে সংগ্রাম সেখানেই দেখি চে গুয়েভারার নাম। যে বলিভিয়ায় তাকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেও আজ চে'র আদর্শে চলছে আন্দোলন, সংগ্রাম। আজ তাই চে'র জন্মদিনে লাখো প্রাণের আওয়াজের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমি বলতে চাই- চে, তোমার মৃত্যু নেই; তুমি জেগে আছো অমর প্রাণ হয়ে, লাখো প্রাণের মন্দিরে।

১৯.
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চেকে নিয়ে যেসব কবিতা লেখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। বিশ্বের কবি-সাহিত্যিকেরা কীভাবে দেখছেন এই বিপ্লবীকে, তার কিছুটা আভাস এসব অনুবাদ থেকে পাওয়া যাবে। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী চিলির কবি পাবলো নেরুদা ‘এক বীরের মৃত্যুতে দুঃখের অনুভূতি’ কবিতায় চে কে স্মরণ করছেন এভাবে,
‘আমরা যারা দেখেছি জীবনে আজকের এই ইতিহাস,
আমাদের শোকাহত আশার
এই মৃত্যু আর পুনরুত্থান,
আমরা যারা বেছে নিয়েছি সংগ্রাম
দেখেছি পতাকার বেড়ে ওঠা,
জেনেছি আমরা কথা বলেছে যারা সবচেয়ে কম
তারাই ছিল আমাদের একমাত্র নায়ক
আর বিজয়ের পর
এসেছে উচ্চকণ্ঠের চিৎকার
মুখ তাদের ভরে গেছে গর্বের উচ্চারণ
আর লোলঝরা কৃতিত্ব প্রচারে।
মানুষ কুটেছে মাথা:
আর বীর ফিরে যায় নীরবে।
তবে সেই নীরবতা পালন করে শোক
যতক্ষণ না বেদনায় তা আমাদের করে দেয় শ্বাসরুদ্ধ
পাহাড়ে মৃত্যুবরণ যখন ছিল
গুয়েভারার শোভিত আগুন।
কমানদান্তের সমাপ্তি আসে
গিরিখাতে খুন হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কেউ করেনি উচ্চারণ একটিও শব্দ।
ইন্ডিয়ান পল্লিতে করেনি কেউ অশ্রুপাত।
গির্জার ঘণ্টাঘরে উঠে আসেনি কেউ,
কারও হাতে ওঠেনি বন্দুক,
আর ওরা
নিহত কমানদান্তে এসেছিল যাদের বাঁচাতে,
তুলে নিয়েছে নগদ পুরস্কার।
সেসব ঘটনায় অনুতাপ করছে না কি প্রতিফলন,
যা ঘটেছে এখানে তার?
যা সত্য তা হয়নি বলা
তবে ধাতব এই দুর্ভাগ্য
ঢেকে রাখা হয় কাগজে।
পথ তো মাত্র শুরু হয়েছিল খুলে যেতে
আর পরাজয় যখন আসে
সেটা ছিল যেন
নীরবতার পাত্রে এসে পড়া কুঠার।
বলিভিয়া ফিরে গেছে তার সঞ্চিত বিদ্বেষে,
ফিরে গেছে মরচে ধরা গেরিলায়,
নিজের আপসহীন দুর্দশায়,
আর আতঙ্কিত জাদুকরের মতো
লজ্জার এই সৈনিক
অপরাধের অসহায় সব জেনারেল,
দক্ষতার সাথে লুকায়
যোদ্ধার মৃতদেহ,
যেন সেই দেহের আগুনে দগ্ধ হবে তারা।
তিক্ত জঙ্গল শুষে নেয়
আন্দোলন, পথ,
আর যা কিছু মাড়িয়ে গেছে
ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের পা
পরগাছায় চুপিচুপি উচ্চারিত আজ
শেকড়ের সবুজ একটি কণ্ঠস্বর
আর বুনো হরিণ ফিরে আসে
বিস্ফোরণহীন শ্যামল অরণ্যে।’

২০.
১৯৯২ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া কবি ডেরেক ওয়ালকট ‘চে’ শিরোনামে কবিতায় লিখছেন,
ধূসর ধূলিময় খবরের কাগজের এই ছবিতে, দৃষ্টি যার
কারাভাজ্জিওর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় আঁকা ছবির মতো,
মরদেহ ছড়ায় শুভ্র মোমবাতির উজ্জ্বলতা এর শীতল বেদিতে—
বলিভিয়ার ইন্ডিয়ান কসাইয়ের প্রস্তর পাতের সেই দৃষ্টি
তাকায় যতক্ষণ না মোমের মাংস মার্বেলে শক্ত দানা বেঁধে
হয়ে ওঠে আেন্দজের শিরাযুক্ত শুভ্র লৌহদণ্ড;
তোমার নিজের ভয় থেকে, মূর্খ, বেড়ে ওঠে এর স্তম্ভ।
তোমার সন্দেহে হোঁচট খায় সে, আর তোমার ক্ষমার জন্য
পুড়ে হয়ে যায় ধূসর ছাই, সুবাসিত তুষার থেকে অনেক দূরে।’

২১.
স্প্যানিশ সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি রাফায়েল আলবের্তি ‘এর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে’ শিরোনামে চে কে স্মরণ করেছেন এভাবে,
‘তোমাকে দেখেছি আমি যখন ছিলে তুমি বালক
আর্জেন্টিনার কর্দোভার সেই গ্রামীণ পরিবেশে
খেলছিলে তুমি পপলারগাছের ছায়ায় আর ভুট্টার খেতে,
পুরোনো কাছারিবাড়ির গরু, দিনমজুরদের ভিড়ে...
এরপর আর হয়নি দেখা আমাদের সেই দিনের আগে
যখন আমি জানতে পারি তুমি হয়ে গেছ রক্তমাখা আলো,
উত্তর আকাশের সেই উজ্জ্বল তারা,
প্রতিটি মুহূর্তে যেদিকে আমাদের রাখতে হয় চোখ
সেই সত্যকে বুঝে নিতে কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে।’

(কৃতজ্ঞতা / সহায়ক তথ্যসূত্র : ডা. অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ, চে’র মটর সাইকেল ডাইরী : অনুবাদ আবীর হাসান, রোদ্দুর, সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কন্ঠ, দৈনিক যুগান্তর, ক্যালেন্ডার-২০১০ গণবিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত