জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৩৪

১.
মেঘনাদ সাহা, ভারতীয় উপমহাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করে যেসব বিজ্ঞানী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাদের অন্যতম অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা। জ্ঞানের অন্বেষণে ও কর্তব্য সাধনে অবিচল নিষ্ঠা, অদম্য অধ্যবসায় এবং বৈজ্ঞানিক অবদানে সর্বপ্রকার সচেষ্ট হওয়া ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। তিনি ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। অনন্য বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লির প্লানিং কমিশনের অফিসে যাওয়ার পথে মাত্র ৬২ বছর বয়সে স্ট্রোক করে তাঁর মৃত্যু হয়। মেঘনাদ সাহা তাঁর সারা জীবনের চিন্তা-গবেষণায় দেখিয়ে গেছেন যে, কীভাবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা, বস্ত্র, ক্ষুধা এবং প্রযুক্তির অপ্রতুলতার সংকট কাটিয়ে উঠতে হয়। কীভাবে বিজ্ঞানের সুফল ঘরে তুলতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বিশেষভাবে বাঙালির এ পরম ঘনিষ্ঠজনের অবদান আজো এ উপমহাদেশের মানুষকে আলো দিয়ে চলেছে, করছে আলোকিত।

২.
আলোকিত বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সফল প্রতিষ্ঠাতা, জনপ্রতিনিধি, চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক— এ ধরনের বহু অভিধায় তাকে পরিচিত করিয়ে দেয়া যায়। বহুগুণের সমন্বয় একজন মানুষের ভেতরে কীভাবে ঘটতে পারে, তার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ মেঘনাদ সাহা। তিনি এ ঢাকার সন্তান, এ দেশের আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। অবিভক্ত ভারতের ঢাকার শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম এ পথপ্রদর্শক, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে তার সে অবদানের কথা। তিনি পৃথিবীর সামনে ‘আনয়নের সমীকরণ’ রহস্য উন্মোচন করে কার্যত পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানীদের সামনে ঘোর তৈরি করেন।

৩.
মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন লেখা, তাঁর বক্তৃতা এবং গবেষণা, ক্যালেন্ডার পুনর্গঠনে ভূমিকা, স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন কমিশনের নেতৃত্ব দেয়া— এসবই এ বিজ্ঞানীকে একজন মহান সমাজ সংস্কারকের সারিতে স্থান দেয়। ভারতীয় অন্যান্য স্বনামধন্য গবেষকের তুলনায় সাহার জীবনে ছিলো অনেক নাটকীয় মোড়। তিনি হতদরিদ্র, অশিক্ষিত এবং নিন্মবর্ণের পরিবার থেকে দুঃখ-কষ্টের কষাঘাতে জর্জরিত হতে হতে বড় হয়েছেন। তারপরেও তিনি নিজেকে ভারতীয় ‘ভদ্রসমাজে’ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যথেষ্ট প্রভাবের সাথে। তিনি শুধু একাডেমিক দিক থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন নি বরং একজন সাংগঠক হিসেবে বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা ভারতের মানুষের মাঝে।

৪.
বৃটিশ শাসনামলে মেঘনাদ সাহা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বে একজন খ্যাতিমান পদার্থবিদ হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন। ১৯২০ এর দশকে তিনি নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণে তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্বে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে আমৃত্যু তিনি বিজ্ঞানের জন্য এবং বিজ্ঞানমনষ্কতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। তাঁর জীবনী আমাদের উৎসাহীত করবে নানা ভাবে। প্রথমতঃ তিনি বাংলাদেশের এক অজপাঁড়া-গাঁ এর দরিদ্র ও নিন্মবর্ণের হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহন করেও নানা প্রতিকূলতার বাধা পেরিয়ে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি কেবল একজন বিনম্র পড়ুয়া লোকই ছিলেন না, তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য বৃটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে জড়িয়েছিলেন যে আন্দলনের ফসল হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

৫.
বিগত শতকে এ দেশে যে কয়জন বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানচর্চার মানচিত্রে স্থান উজ্জ্বল করেছিলেন মেঘনাদ সাহা তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু অন্যতমই নন বরং অনন্য। তার কারণ তিনি বিজ্ঞানচর্চার মধ্যেই তার কর্মজীবন সীমিত রাখেননি। তিনি বিজ্ঞানকে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করে সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তৎকালীন ঢাকা জেলার তালেবাদ পরগনার অন্তর্গত সিওরাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাবা জগন্নাথ সাহা, মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান। তাঁর আবির্ভাব নামকরণ নিয়ে কোনো উৎসব হলো না, তবু খুব সহজে খুব নিঃশব্দে যেন একটা প্লাবন ঘটে গেল। এ শিশুটিই ভবিষ্যৎ ভারতে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে চিন্তাধারায় যুগান্তর আনল। বাল্যকালে তিনি কঠোর দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রতিপালিত হন। ছেলেবেলায় সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় এ পড়েন এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঝুটা কাজের বিনিময়ে থেকে। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষে মেঘনাদ নিকটবর্তী শিমুলিয়ায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি কাশিমপুর জমিদারের পারিবারিক চিকিৎসক অনন্ত কুমার দাসের আনুকূল্যে প্রতিপালিত হতে থাকেন। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত হওয়ার কারণে তাঁকে স্কুল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে মেঘনাদ সাহা কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯০৯ সালে বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে সর্বোচ্চ সম্মানসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি সে বছরের প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা বাংলায় তৃতীয় ও পূর্ববঙ্গে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯১১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে তিনি আই.এসসি পাস করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য কলকাতা যান। সেখানে তিনি স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, স্যার আচার্য প্রফুল¬চন্দ্র রায়, অধ্যাপক ডি.এন মলি¬ক, অধ্যাপক সি.ই কুলিস প্রমুখ শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেন। যদিও মেঘনাদ সাহা গণিত শাস্ত্রের ছাত্র ছিলেন, তথাপি তিনি স্যার প্রফুলে¬র দ্বারা প্রভাবিত হন, যিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক। অল্পদিনেই মেঘনাদ সাহা তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। গণিত শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থানসহ তিনি গ্রাজুয়েট (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। 

৬.
স্যার আশুতোষ মুখার্জী ১৯১৬ সালে কলকাতায় নবপ্রতিষ্ঠিত কলেজ অব সায়েন্স-এ মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞান ও মিশ্র গণিতের একজন প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। এই পেশায় নিয়োজিত থাকাকালে মেঘনাদ সাহা লন্ডনের কিংস কলেজে তাঁর ডক্টরাল থিসিস উপস্থাপন করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বছর ‘Selective Radiation Pressure and its Application to the Problems of Astrophysics’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। এই অভিসন্দর্ভের মধ্য দিয়ে তিনি নভোপদার্থবিদ্যার (Astrophysics) গবেষণা জগতে প্রবেশ করেন এবং তাঁর নতুন কর্মকান্ডের অধ্যায় সূচিত হয়। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি এবং গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি মেঘনাদ সাহাকে ১৯২০ সালে ইউরোপ যেতে উৎসাহিত করে এবং তিনি সেখানকার ইম্পিরিয়াল কলেজে কিছুকাল গবেষণা করেন। ইম্পিরিয়াল কলেজে তিনি নরম্যান লকইয়ার-এর উত্তরাধিকারী প্রফেসর এ ফাউলার-এর সঙ্গে তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণাকর্ম ‘গ্যাসসমূহের তাপীয় আয়নায়ন’ (Thermal Ionisation of Gases) প্রকাশনার লক্ষ্যে কাজ করেন। তাঁর তত্ত্ব হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় মানমন্দির-এর স্যার নরম্যান ও প্রফেসর পিকারিং কর্তৃক সঞ্চিত তথ্যসমূহের সুস্পষ্ট ও যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানে সক্ষম হয়। উপর্যুক্ত বিজ্ঞানিদ্বয় দুই লক্ষ তারকার বর্ণালি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের সুনির্ধারিত দলে শ্রেণীবিন্যস্ত করে।
 
৭.
মেঘনাদ সাহা এফআরএস (জন্ম: অক্টোবর ৬, ১৮৯৩ – প্রয়াণ: ফেব্রুয়ারি ১৬, ১৯৫৬) ১৯২১ সালে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষামূলক যাচাই-এর উদ্দেশ্যে বার্লিন গমন করেন এবং সেখানে প্রফেসর ডব্লিউ নেরনস্ত-এর গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। বার্লিনে গবেষণারত অবস্থায় তিনি জার্মানির পদার্থবিদদের তাঁর তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য মিউনিখের প্রফেসর সমারফিল্ডের কাছ থেকে আমন্ত্রণ লাভ করেন। ১৯২১ সালের মে মাসে মেঘনাদ সাহা বার্লিনে বক্তৃতা প্রদান করেন এবং তাঁর এই বক্তৃতা Zeitschrift fur Physik-এর ষষ্ঠ খন্ডে প্রকাশিত হয়। বার্লিনে অবস্থানের সময় তিনি কালজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন-এর সাহচর্যে আসেন। প্রায় একই সময়ে স্যার আশুতোষ খয়রা-র রাজার আর্থিক অনুদানে মেঘনাদ সাহার জন্য পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে একটি চেয়ার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। তৎকালীন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এক সঙ্কটপূর্ণ কাল অতিবাহিত করছিল এবং ড. সাহা কলকাতায় অবস্থান করে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষামূলক যাচাই সংক্রান্ত গবেষণাকর্মের জন্য একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে বন্ধু ড. এন আর ধরের চেষ্টায় অধ্যাপক সাহা ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে এলাহাবাদে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি অত্র বিভাগের উন্নয়ন সাধন এবং এর পাঠ্যক্রম পুনর্গঠন ও গবেষণাসূচি প্রণয়নে আত্মনিয়োগ করেন। 

৮.
ইতোমধ্যে অধ্যাপক সাহার ‘আয়নায়ন তত্ত্ব’(Ionisation Theory) নিয়ে কাজ করার জন্য অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানীই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম এবং সর্বাগ্রে ছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হেনরী নরিস রাসেল। অধ্যাপক রাসেল বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্র নিয়ে সাহার তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রসারণ নিয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন এবং সাহার অনেক অনুমানের যথার্থতা প্রমাণ করেন। প্রফেসর রাসেলের পথ ধরে ক্যামব্রিজের দুজন মেধাবী স্নাতক আর.এইচ ফাউলার এবং ই.এ মিলনি মেঘনাদ সাহার তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখেন এবং এই তত্ত্বের নতুন নতুন প্রয়োগ চিহ্নিত করেন। ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলার রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য অধ্যাপক সাহার নাম প্রস্তাব করলে দুবছর পর সাহা এই সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ফ্রান্সের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির আজীবন সদস্য এবং লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা ফেলো ছিলেন। তিনি এককভাবে অথবা সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানের বহু গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর নতুন প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ‘পরমাণুর গঠন’ (Structure of Atoms) পদার্থের ভৌত ধর্মাবলী (Physical phenomena) অধ্যয়নে একটি বিরাট অবদান হিসেবে প্রমাণিত হয়। এলাহাবাদে ১৫ বছরের (১৯২৩-১৯৩৮) অবস্থানকালে মেঘনাদ সাহা ডি.এস কোঠারী, আর.সি মজুমদার এবং পি.কে কিচ্লু সহ আরও অনেকের সহায়তায় একটি সক্রিয় গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। তবে গবেষণা কর্মকান্ড পরিচালনা ছাড়াও এসময় তিনি বিজ্ঞানীদের এমন একটি সম্মিলিত সংস্থায় সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে গভীরভাবে জড়িত হন, যে সংস্থাটি বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুধুমাত্র পেশাগত যোগাযোগই রক্ষা করবে না, অধিকন্তু গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিকভাবে তদ্বির করবে এবং বৈজ্ঞানিক উদ্যোগসমূহের প্রতি জনসমর্থন আদায়ের জন্য যথাযথ ভূমিকা রাখবে। সাহা ১৯৩৪ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স একাডেমী গঠনের প্রস্তাব করেন, যা ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস-এর দায়িত্বসমূহ গ্রহণ করবে। তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে, এ ধরনের সংগঠন রাষ্ট্রকে একটি জাতীয় গবেষণা কমিটি গঠন করতে উৎসাহিত করবে, যেখানে বিজ্ঞানীদের একটি যুক্তিসম্মত প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সাহার এই উদ্যোগের ফলাফল হিসেবে ১৯৩৫ সালে কলকাতায় ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে যার নামকরণ করা হয় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমী’। ১৯৪৫ সালে ইনস্টিটিউট-এর সদর দফতর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়। 

৯.
১৯৩৩ এবং ১৯৩৫ সালে ড. সাহা দুটি বিজ্ঞান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন- একটি হচ্ছে ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি (১৯৩৩) এবং অন্যটি ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশন (১৯৩৫)। এই সংবাদ সংস্থাটি ১৯৩০-এর দশকের মধ্যভাগ হতে Science and Culture নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে আসছিল, যেটি ভারতের জাতীয় পুনর্গঠন ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিতর্কে বিকল্প রাজনৈতিক উচ্চারণ হিসেবে কাজ করত। ড. সাহা জাতীয় পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানের ব্যবহারের ওপর প্রস্তাব পেশ করেন এবং সুভাষচন্দ্র বসুর বিখ্যাত লন্ডন তত্ত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। সুভাষ বসু তাঁর প্রদত্ত লন্ডন তত্ত্বে জাতি গঠনমূলক কর্মকান্ডে বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ১৯৩৮ সালে গঠিত জাতীয় পরিকল্পনা কমিটিতে অধ্যাপক সাহা একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। এসময় ড. সাহা এলাহাবাদ থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পালিত অধ্যাপক’ (Palit Professor) হিসেবে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সময়কালে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞানে নব আবিষ্কৃত ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক বিদারণ বিক্রিয়া (nuclear fission reaction) এবং শিল্প-কারখানায় পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ওপর অধ্যাপক সাহা গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি এম.এসসি পাঠ্যক্রমের একটি বিশেষ বিষয় হিসেবে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সকে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এর জন্য একটি বিশেষ গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স চর্চার একটি পৃথক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর একক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৪৮ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কলকাতায় এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯৫১ সালে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেরী জুলিও কুরী ইনস্টিটিউটটি উদ্বোধন করেন। গবেষণা কেন্দ্রটির নাম দেওয়া হয় ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। ড. সাহার মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয়েছে ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। 

১০.
ভারতের অন্য একজন খ্যাতনামা পদার্থ বিজ্ঞানী হোমি ভাবা (Homi Bhaba) পরমাণু শক্তি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করলে ১৯৪৮ সালে ভারত সরকার ড. সাহার মতামত জানতে চান। তিনি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং যুক্তি দেখান যে, প্রয়োজনীয় পরমাণু জনশক্তির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি তখন পর্যন্ত ভারতে এর সুষ্ঠু শিল্পভিত্তি গড়ে ওঠে নি। মেঘনাদ সাহার বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারত সরকার ভব-এর প্রস্তাব অনুসারে পরমাণু শক্তি কমিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যায় এবং সাহা নিজেকে ক্রমশ তার সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব পন্ডিত নেহেরুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন। তবে অধ্যাপক সাহা জাতীয় ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা অব্যাহত রাখেন এবং তাঁর জার্নালে তিনি এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। ভারতের নতুন সরকারের কাছে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে তাঁর অনেক চিন্তাভাবনা বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়। দামোদর উপত্যকার উন্নয়ন, খরা ও দুর্ভিক্ষের পুনঃসংঘটনের সমস্যা, জাতীয় ভিত্তিতে বিজ্ঞানের সংগঠন, জলতাত্ত্বিক গবেষণার উন্নয়ন প্রভৃতি জাতীয় পর্যায়ের নদী উপত্যকা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়। 

১১.
জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞানের জনক ড. মেঘনাদ সাহার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে: আগুনের শিখার পরিবাহিতা বিস্ফোরক বিজ্ঞান, নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, কণাত্বরণের আয়নন উৎস, থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রভৃতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার সাহা আয়নন তত্ত্ব অথবা কোনো না কোনো পরিবর্তিত রূপের বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। তাই সাহার আয়নন তত্ত্ব গত শতকের এক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বলা যায়।
 
১২.
তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অনুভূতি তাঁকে ১৯৫১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করে। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেঘনাদ সাহা তাঁর নিকটতম কংগ্রেস প্রার্থীকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে ভারতের লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সংশি¬ষ্ট ছিলেন। শরণার্থী পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে ড. সাহা বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করেছিলেন।বিস্তৃত জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ মেঘনাদ সাহাকে পঞ্জিকা সংস্কার প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত করেছিল।

১৩.
জনগণ এবং শিক্ষার প্রতি সতত নিবেদিত প্রফেসর মেঘনাদ সাহা ছিলেন একজন অক্লান্ত কর্মী। ১৯৫৪ সালের পর থেকে পরিশ্রমী এই জ্ঞানকর্মীর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে এবং ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে দিল্লির পরিকল্পনা কমিশন দপ্তরে যাওয়ার পথে প্রফেসর মেঘনাদ সাহার আকস্মিক মহাপ্রয়াণ ঘটে। জ্ঞানের অন্বেষণে ও কর্তব্য সাধনে অবিচল নিষ্ঠা, অদম্য অধ্যবসায় এবং বৈজ্ঞানিক অবদানে সর্বপ্রকার সচেষ্ট হওয়া ছিল তার জীবনের আদর্শ। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে, বংশে এমন সুসন্তানের জন্ম হোক, যাতে কুল পবিত্র হয় ও জননী কৃতার্থ হন, মেঘনাদ সেই প্রত্যাশার বেশি পূরণ করেছেন, তিনি মুখ উজ্জ্বল করেছেন, দেশ জননীকে কৃতার্থ করেছেন।

(তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক যায়যায় দিন, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত