প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

এরিক মারিয়া রেমার্ক

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:১৮

১.
জার্মান সাহিত্যিক এরিক মারিয়া রেমার্ক তাঁর যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর জন্য দুনিয়াজোড়া পরিচিত। তিনি ১৯৭০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৭২ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, জনপ্রিয় জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্ক ১৮৯৮ সালের ২২ জুন জার্মানির ওয়েস্ট ফেলিয়ার ওসনাব্রায়কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল এরিক পল রেমার্ক। রেমার্ক বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য নাম। নানা রচনায় যুদ্ধের চরম বিভীষিকার কথা বলে লেখক রেমার্ক আসলে শান্তির কথাই বলতে চেয়েছেন। বিশ্ব সাহিত্য সম্ভারে যে কয়জন মানবতাবাদী যুদ্ধবিরোধী লেখক রয়েছেন তাদের মধ্যে এরিক মারিয়া রেমার্ক রয়েছেন প্রথম সারিতে। ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’সহ অন্যান্য তাঁর উপন্যাস পাঠ আমাদের সরাসরি নিয়ে যায় যুদ্ধের ময়দানে এবং যুদ্ধের বীভৎস রূপকে চোখের সামনে তুলে ধরে বলে, যুদ্ধের আসল চেহারা দেখুন। 

২. 
‘জীবনে যখন আর কোন কিছু পাবার অপেক্ষা থাকে সেটির চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই’- রেমার্ক
এরিক মারিয়া রেমার্ক সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিল্প স্রষ্টার নাম। জীবনে হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে হয়ে উঠলেন একজন যোদ্ধা। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসেন। এরপর যুদ্ধ দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন দারুণ সব উপন্যাস। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘দ্য ড্রিম রুম’, দ্য রোড বাক’, ‘দ্য স্পার্ক অব লাইফ’, ‘এ টাইম টু লাভ এ্যান্ড এ টাইম টু ডাই’ , ‘হ্যাভেন হ্যাজ নো ফেভারিটস’, ‘ দ্য নাইট ইন লিসবন’, ‘দ্য প্রমিস ল্যান্ড’, ‘শ্যাডোস ইন প্যারাডাইস’, ‘থ্রি কমরেডস’, ‘ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ প্রভৃতি। যুদ্ধ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়। তার সহজ স্বাভাবিক জীবনকে ভেঙ্গে দেয়। রেমার্ক নিজের চোখে একজন সৈনিক হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই লেখনীর মধ্য দিয়ে বারবার ঘুরেফিরে যুদ্ধ বিরোধী কথাই বলতে চেয়েছেন। রেমার্ক তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ এ বলেছিলেন, ‘একজন মানুষের মৃত্যু একটি ট্রাজেডি কিন্তু অসংখ্য মানুষের মৃত্যু একটি পরিসংখ্যান’।

৩.
জার্মান কথাসাহিত্যিক এরিক মারিয়া রেমার্ক জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক নিম্নবিত্ত কর্মজীবী পরিবারে। বাবা ছিলেন পিটার ফ্রানস রেমার্ক এবং মায়ের নাম আনা মারিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এরিককে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে যোগ দিতে হয় যখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। ১২ জুন, ১৯১৭ সালে তাকে বদলি করে দেয়া হয় ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের ২য় কোম্পানিতে। ৩১ জুলাই এরিকের জীবনে এক ভয়াবহ ব্যাপার ঘটল। শত্রুপক্ষের বোমার স্প্রিন্টারে হাতে এবং কাঁধে আঘাত পেয়ে আহত হলেন। তাঁকে দ্রুতই মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ হবার সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন।
 
৪.
প্রথম মহাসমর শেষ হলো। তিনি ফিরলেন বাড়িতে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। তিনি শিক্ষকতার ট্রেনিংয়ে ফিরে এলেন। ১ আগস্ট ১৯১৯ তিনি লহনি এর একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। এর নানা জায়গার স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। ২০ নভেম্বর ১৯২০ সালে তিনি স্কুলের চাকরির ইস্তফার আবেদন করেন। সারা জীবনে তিনি অনেক ধরনের পেশা গ্রহণ করেছেন জীবিকার তাগিদে। কখনও লাইব্রেরিয়ান, কখনও বা পুরোদস্তুর সাংবাদিকতা। তবে ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছিলেন তিনি।

৫.
রেমার্কের বয়স যখন মাত্র ষোল বছর তখন থেকেই তিনি লেখালেখির চেষ্টা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল কিছু কবিতা, গদ্য এবং ভবিষ্যত উপন্যাসের কিছু ছোট ছোট খসড়া। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ড্রিম রুম’। ‘দ্য রোড ব্যাক’ রেমার্কের আরেকটি অন্যতম সেরা বই। যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়ে একটি উপন্যাস এটি। এটি মূলত ‘অল কোয়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসের সিকুয়্যেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জার্মানির একটি ফ্রন্টে সংঘটিত যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পাত্রপাত্রীদের ভূমিকা, যুদ্ধকালীন সংকট ও জীবনাচার, ধসে পড়া মূল্যবোধ, যুদ্ধের সমাপ্তি ও পরিণতির ছবি যে ভাষায়, যেভাবে রেমার্ক এখানে তুলে ধরেছেন, তা তুলনাবিহীন। ব্যঙ্গের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি। যুদ্ধের রূপ বর্ণনায় ছিল না তাঁর বিন্দুমাত্র লুকোছাপা। শেষে উপন্যাসের নায়ক আমাদের জানায়, ‘পুরোনো সঙ্গীরা সবাই ইতিহাস হয়ে গেছে। কেউ বেঁচে নেই। আমাদের ক্লাসের সাতজনের মধ্যে একা শুধু আমি পড়ে আছি।’ তারপরও আশাবাদীর সুরে বলছেন, ‘অতীত স্মৃতি কিছুই আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’

৬.
‘থ্রি কমরেডস’ রেমার্কের আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস। সারা পৃথিবীতে প্রায় বিশটির বেশি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। রেমার্কের একটি বেস্ট সেলার বই এটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানীর অস্থির রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের গল্পই এই উপন্যাসের পটভূমি। ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব- এর মাঝে বইটিতে উঠে এসেছে আরো অনেক কিছু। যুদ্ধের পরিণতি। মানবতার অপমান ও বিপর্যয়। আবার এই মানবতাকে বিজয়ী করবার লক্ষ্যে মানুষের অকান্ত সংগ্রামের কথা। ওরা তিন বন্ধু – রবার্ট, গোটফ্রীড, অটো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিন সৈনিক। প্যাট্রিসিয়া- দুঃসাহসী এক মেয়ে। কার্ল- লক্কড়মার্কা চেহারার তেজি এক রেসিংকার। যুদ্ধোত্তর জার্মানীর চরম দুঃসময়ে সুখে- দুঃখে এক সাথে এরা সবাই। উপন্যাসটি সেই তিন বন্ধুর গল্প, যারা যুদ্ধের ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে, তাদেরই বাস্তবতা আর অনুভবের গল্প। রবার্ট লোকাম্প, কোস্টার এবং অটো। যুদ্ধ থেকে ফিরে তারা একটি মোটর গ্যারেজ তৈরী করে। ভালোই কাটছিল তাদের দিন। একদিন গাড়ীতে করে সান্ধ্য ভ্রমণে গিয়ে তাদের সাথে এক তরুণীর দেখা হয়। মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় রবার্টের। দুজনের মধ্যে দারুণ এক সখ্যতা গড়ে ওঠে। মেয়েটি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবসে ফেলে রবার্টকে। আর তরুণীটি চোখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা খুঁজে পায় যুদ্ধ ফেরত রবার্ট। কিন্তু মেয়েটি একটি দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত, বৃষ্টি তার একদম সহ্য হয় না। মেয়েটিকে অনেক দূরের এক স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি করে রবার্ট। ফিরে আসতে তার যেন বুক ভেঙ্গে যায়। একদিন খবর আসে স্যানাটোরিয়াম থেকে যে মেয়েটি ভীষণই অসুস্থ। আবার ছুটে যায় রবার্ট। পাশে এসে দাঁড়ায় আরো দুই বন্ধু। কিন্তু মেয়েটিকে তারা বাঁচাতে পারে না। প্রেমিকার লাশ কোলে নিয়ে সারারাত বসে থাকে রবার্ট। দিনের আলো তখন একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। এরকমই কাহিনির এক দূর্দান্ত উপন্যাস ‘থ্রি কমরেডস’ লিখেছেন রেমার্ক। বিশ্বখ্যাত এই বইটি সম্পর্কে বিখ্যাত "নিউ ইয়র্ক টাইমস" পত্রিকার মতামতটি এরকম, "এটি সম্ভবত এই লেখকের সবচেয়ে কোমল, অনুভূতিময় এবং মর্মস্পর্শী উপন্যাস।... আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার গল্প।"

৭.
ব্যক্তিগত জীবনে জানা যায়, রেমার্ক ১৯২৫ সালে অভিনেত্রী ইলসে জুট্টা জ্যাম্বোনাকে বিয়ে করেন। তবে, এই জুটির দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের ছিলনা দুই তরফ থেকেই। ১৯৩০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। তবে, মজার ব্যাপার হচ্ছে রেমার্ক যখন নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হন অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে ইলসে রেমার্কের সাথে সুইজারল্যান্ডে চলে যান। ১৯৩৮ সালে তারা পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩৯ সালে তারা আমেরিকায় চলে যান। ১৯৫৭ সালের ২০ মে তারা আবার বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইলসে মৃত্যুবরন করেন। ১৯৪০ সালের দিকে রেমার্ক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আরেক বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর সাথে। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন তারা দুজনেই ভেনিস ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তবে, তাদের সাথে খুব একটা দেখা হতো না। মূলত চিঠি, টেলিফোন কল এর মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তাদের দুজনের লেখা চিঠি নিয়ে ২০০৩ সালে ‘টেল মি দ্যাট ইউ লাভ মি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে রেমার্ক অভিনেত্রী পল্লেট্টি গদার্ডকে বিয়ে করেন। এই পল্লেট্টি এক যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন ‘ইউরোপিয়ান স্টাডিজ’ নামে ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য। যেটার নামকরন করা হয়েছিল রেমার্কের নামে।
 
৮.
জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্কের বিখ্যাত রচনা ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ যারা পড়েছেন তারা জেনেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমিকায় এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে প্রায় দেড় কোটি মানুষ নিহত এবং দুই কোটি মানুষ আহত হয়েছিল। এই যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই। তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা। রাইফেল হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। সেই বয়সেই ট্রেঞ্চে বসে প্রত্যক্ষ করেছেন মিত্র বাহিনীর প্রবল আক্রমণ আর সহযোদ্ধাদের মৃত্যু। নিদারুণ খাদ্যের অভাব, উর্ধতন কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার এবং সামনে বিশাল এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা এক কিশোরের জন্য ছিল ভয়াবহ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বীভৎসতা, ধ্বংসযজ্ঞ তিনি কাছ থেকে দেখেন। যুদ্ধে গোলার বিস্ফোরণে তাঁর ডান হাত, বাঁ পা ও ঘাড় মারাত্মক জখম হয়। একটি জার্মান পত্রিকা ১৯২৮ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ছাপে, ইংরেজি অনুবাদের ফলে পরে যেটির নাম দাঁড়ায় ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। 

৯.
উপন্যাস পাঠে আমরা দেখি, ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসের সরাসরি নায়ক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তার ডালপালা বহুব্যাপ্ত হলেও সূচনাটা জার্মানির মাটিতে। ভয়াবহ তার রূপ। অন্তত জার্মানির পক্ষ থেকে এই যুদ্ধে যারা যোগ দিচ্ছে, দু-একজন ছাড়া তাদের প্রায় সবারই বয়স ‘উনিশের কাছাকাছি’। তাদের একজনের ভাষ্যে চলমান যুদ্ধের রূপটা এ রকমের, ‘আমরা যাব কোথায়? জীবনের শিকড় মাটিতে গেড়ে বসার আগেই অতীতের স্মৃতি মুছে গেছে যুদ্ধের তোড়ে। যুদ্ধ সবকিছু ধুয়ে মুছে দিয়েছে। এখন আমরা পতিত জমির মতোই। আর কখনো আমাদের জীবনের ফুল ফুটবে না।’ ‘কোথায় এর শেষ জানি না। যুদ্ধ আমাদের স্বাভাবিক মূল্যবোধকে কী ভীষণ পাল্টে দিয়েছে? সবকিছু কেমন বদলে গেছে।’ সত্যিই তাই। আলোচ্য উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় তার জ্বলজ্বলে সাক্ষ্য। একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের প্রকৃত রূপ এরিক মারিয়া রেমার্ক তুলে ধরেছেন রক্ত-মাংসসমেত। কারণও সুস্পষ্ট। কেননা লেখক নিজে ছিলেন এই যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

১০.
মানবতার দর্শনে ঋদ্ধ এই উপন্যাস সারা বিশ্বের মানুষের কাছে যুদ্ধের বীভৎসতা তুলে ধরার এক অনবদ্য দলিল। মূলত কিশোর যোদ্ধার চরিত্র এখানে শিল্পীর মমতায় তুলে এনেছেন রেমার্ক। নিজে রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন বলেই তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তুলে আনতে পেরেছেন তিনি। ট্রেঞ্চে বসে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা অথচ একটু পরেই হয়তো ছুটে আসবে শত্রুপক্ষের মেশিনগানের বুলেট। এর মধ্যেও আশ্চর্য রকমভাবে নিজের মানবিকতা টিকিয়ে রেখেছিল নায়ক পল ব্রেমার। তার চোখে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি যেমন চোখ এড়ায় না তেমনি বসন্তের ফুলের আগমন তাকে ভাবালু করে তোলে। দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে ফিল্ড হাসপাতালে থাকতে থাকতে মানুষকে জানতে শিখে যায় পল। সে নিজে শিক্ষক হতে চেয়েছিল অথচ যুদ্ধ তাকে বানিয়ে দিল সৈনিক। 

১১.
১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় মারিয়া রেমার্কের আরেকটি উপন্যাস ‘দ্য রোড ব্যাক’। ‘দ্য রোডব্যাক’ উপন্যাস গড়ে উঠেছে যুদ্ধফেরৎ সৈনিকের মনোজগৎ, যুথবদ্ধতায় গড়ে ওঠা সম্পর্ক, হেওে যাওয়া, দিগন্তের কাছে ভেঙ্গে পড়া মেঘের মত ‘শান্তি’। যুদ্ধেও প্রচন্ডতার মাঝে হঠাৎ নিশ্চল সময়, প্রায় অলৌকিক নির্লিপ্ততা, বিষাদেও ব্যাপ্তিতে থমকানো মানুষ, রক্ত মাংস চেটেপুটে মহীরুহের মত বীভৎসতা...। চরিত্রগুলো জার্মানীর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতিভু। আর্নেষ্ট, জাপ, ফার্দিনান্দ, ভালেণটিন, লুডভিগ চলে আসে পাঠকের একদম চোখের সামনে। নিখুঁত বাস্তবতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সাহিত্যে তুলে আনার ক্ষেত্রে মারিয়া রেমার্ক ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর এই বর্ণনারীতি পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকরা অনুসরণ করেছেন।

১২.
ইতিহাস জানাচ্ছে, ১৯৩৩ সালে জানুয়ারিতে সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতাসীন হবার পরে হিটলারের অধীনে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। দলে দলে কবি সাহিত্যিকরা জার্মানী ত্যাগ করতে শুরু করে। এই সময় রেমার্কও দেশ ত্যাগ করেন। নাৎসিদের অত্যাচারের ফলে রেমার্ককে নির্বাসিত জীবনে যেতে হয়। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে তাঁর এক বোনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর সব বইয়ের কপি পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং বইগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিযোগের তীরে মুক্তচিন্তা বিদ্ধ হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে নতুন নয়। বিভিন্ন সময় নানাবিধ কারণে এই তীর ছোড়া হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটির দিকে। তৎকালীন নাৎসি সরকারের মিথ্যাচার এবং এক তরুণের স্বপ্নভঙ্গের বেদনার কথা মনে করিয়ে দেয় উপন্যাসটি। যার শেষ পরিণতি করুণ মৃত্যু। লেখক এই উপন্যাসে যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। শুধু এটুকু হলে হয়তো এডলফ হিটলার রুষ্ট হতেন না। কিন্তু যখন দেখা গেল, নায়ক পল ব্রমার জার্মান সরকারের মিথ্যা প্রচারনার ফাঁদে পা দিয়ে সৈনিক জীবন বেছে নেন এবং খুব দ্রুত তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করতে থাকেন ঠিক তখনই ভুল ভাঙে। ব্রমারের মতো পাঠকের চোখের সামনেও মিথ্যার পর্দা সড়ে গিয়ে সত্য উন্মোচিত হতে শুরু করে। হিটলারের টনক নড়ে। তিনি বইটি নিষিদ্ধ তো করেনই, লেখককেও ইহুদি বানানোর চেষ্টা করেন। মিথ্যা অপবাদ এবং নিষেধাজ্ঞার খড়গ মাথায় নিয়েই এরিক মারিয়া রেমার্ককে দেশ ছাড়তে হয়।

১৩.
রেমার্ক ১৯৪৭ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে রেমার্ক সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানেই বাকী জীবনটা লেখালেখি করেই কাটান। ‘আর্চ অব ট্রাম্প’ আর ‘স্পার্ক অব লাইফ’ এর মাঝখানে সাত বছরের ব্যবধান। ১৯৫৪ সালে তিনি লেখেন ‘টাইম টু লাভ এন্ড টাইম টু ডাই’। 

১৪.
রেমার্কের বেশ কিছু উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৩০ সালে আমেরিকাতে মুক্তি পায় ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ন ফ্রন্ট’। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন লেউইস মাইলস্টোন। ১৯৩০ সালে এই ছবিটি অস্কারে শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ সিনেম্যাটোগ্রাফি- এই তিন ক্যাটাগরিতে অস্কার পায়। আমেরিকার ফিল্ম ইন্সটিউটের সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় এটি ছিল ৫৪ নম্বরে। ১৯৫৮ সালে পরিচালক ডগলাস শার্ক ‘টাইম টু লাভ এন্ড টাইম টু ডাই’ উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রে একটি অতিথি চরিত্রে অভিনয়ও করেন রেমার্ক। 

১৫.
এরিক মারিয়া রেমার্ক ১৯৭০ সালে সুইজারল্যান্ডে মারা যান। তাঁকে সুইজারল্যান্ডের লোকার্নোতে সমাধিস্থ করা হয়।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত