জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

শাবানা আজমি

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:৫০

১.
ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা আজমি। ১৯৫০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শাবানা আজমি। আমার মত অনেকেরই প্রিয় এই অভিনেত্রীকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’। এই ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কারও পান। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি আর্ট ফিল্মে অভিনয়ের জন্যও সমান খ্যাতি অর্জন করেছেন। ‘আর্ট ফিল্ম সব সময় জীবনের অনেক কাছাকাছি থাকে’ বলে মনে করেন তিনি। আবার শুধু অভিনয়ই করাই নয়, পাশাপাশি দায়িত্বশীল মানবিক একজন মানুষ হিসেবে সমাজের অবহেলিতজনদের জন্য সমাজসেবক হিসাবেও তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এবং এক্ষেত্রেও পেয়েছেন ব্যাপক সুপরিচিত। সমাজসেবী এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী মনে করেন ‘পরিবর্তন সব সময়ই লম্বা সফর।’
 
২.
শাবানা আজমি একজন সমাজকর্মী হিসেবে নিজের মূল্যায়ন করেন এভাবে, ‘আমি সব সময় আশাবাদী একজন মানুষ। আমার বাবা একটা কথা বলতেন, যেটাকে আমি মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছি। তিনি বলতেন, ‘পরিবর্তন আনার জন্য তোমাকে ক্রমাগত কাজ করে যেতে হবে। তোমার জীবদ্দশায় হয়তো পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু তোমাকে মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে পরিবর্তন সম্ভব। পরিবর্তন সব সময়ই একটা লম্বা সফর। ’ শাবানা আজমি ১৯৯৭ সালে ভারতের রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। আজও মূলধারার পাশাপাশি প্যারালাল ছবিতেও কাজ করে চলেছেন শাবানা আজমি। মানবাধিকার ও সমাজকর্মী শাবানা আজমী অভিনয়ের পাশাপাশি এইডস, মৌলবাদিতা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধে কাজ করে যাচ্ছেন এবং বিবিধ সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। 

৩.
শাবানা আজমি এই উপমহাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।বিশেষ করে ‘আর্ট ফিল্ম’ বা সমান্তরাল ধারার চলচ্চিত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বি। পরপর তিন তিনবার ভারতের সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেছেন। রেকর্ড পাঁচবার ’ন্যাশন্যাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট এ্যাক্ট্রেস’ পেয়েছেন। ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারও ওঠেছে তার হাতে। আবার বড়ো পর্দার বাইরে ছোটো পর্দায়ও তার উপস্থিতি বেশ সরব। আশির দশকে ছোট পর্দায় তার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। 

৪.
শাবানা আজমি ভারতের হায়দ্রাবাদ-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হলেন স্বনামধ্য ভারতীয় কবি কাইফি আজমি এবং মা শওকত আজমি একজন মঞ্চ অভিনেত্রী। তিনি বিয়ে করেছেন ভারতীয় গল্প লেখক জাভেদ আখতারকে। তার ভাই বাবা আজমি একজন সিনেমাটোগ্রাফার। শাবানা আজমি প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানের উপর গ্রাজুয়েশন করেন। জয়া ভাদুড়ির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। বলিউডের সমান্তরাল সিনেমার প্রধানতম এই অভিনেত্রী ১৯৭৪ সালে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। সব ধরনের চরিত্রকে সুন্দরভাবে বাস্তবরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারার সক্ষমতা শাবানা আজমিকে করে তুলেছে ভারতের সর্বকালের সেরা অভিনেত্রীদের একজন হিসেবে।

৫.
তিনি বহুভাষায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনয় জীবনের অসামান্য অবদানের জন্য ভূষিত হয়েছেন বহু পুরস্কারে। এর মধ্যে তিনি রেকর্ড সংখ্যাক পাঁচবার ’ন্যাশন্যাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট এ্যাক্ট্রেস’ পেয়েছেন। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে শাবানা আজমি ১২০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে আজমী বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় অভিনয় করেছেন। তিনি বহুভাষায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনয় জীবনের অসামান্য অবদানের জন্য ভূষিত হয়েছেন বহু পুরস্কারে। এর মধ্যে তিনি রেকর্ড সংখ্যাক পাঁচবার ’ন্যাশন্যাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট এ্যাক্ট্রেস’ পেয়েছেন। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে শাবানা আজমি ১২০টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ১৯৮৮ সাল থেকে আজমি বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় অভিনয় করেছেন। ‘ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল’ ও ‘ন্যাশনাল এডস কমিশন’-এর সদস্য শাবানা ১৯৯৮ সালে ‘ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড’-এর গুডউইল অ্যাম্বাসাডর নিযুক্ত হন। তার অভিনীত অন্যতম সেরা ছবিগুলি- নিশান্ত, জুনুন, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি, স্পর্শ, পরবরিশ ইত্যাদি। ১৯৮৮-এ পদ্মশ্রী ও ২০১২-তে পদ্মভূষণ খেতাব পেয়েছেন।শাবানা আজমি অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আঙ্কুর, ফাকিরা, অমর আকবর এ্যান্থোনি,মান্দি, ফায়ার, পার, গডমাদার, তেহজাব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বেশ কয়েকটি বিদেশি পুরস্কারও লাভ করেছেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়া ’গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল পিস এ্যাওয়ার্ড’ ওয়াল্‌র্ভ্র ইকোনমিক ফোরামের ’ক্রিস্টাল এ্যাওয়ার্ড’সহ দেশ-বিদেশের বহু সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। 

৬.
শাবানা আজমি এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ছোটকাল থেকেই বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত দেখে উৎসাহিত হয়েছেন তিনি। নিজেকে যুক্ত করেছেন বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। শাবানা আজমী ১৯৮৪ সালে ভারতের বিখ্যাত কবি জাভেদ আক্তারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শাবানা আজমির নিজের কোনো সন্তান নেই। তিনি শিশু অধিকার, এইডস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তিনি যখন এই কাজগুলো শুরু করেন তখন সমালোচকরা বলতে শুরু করে তিনি মিডিয়ার মনোযোগের জন্য এই কাজ করছেন। কিন্তু মানুষের জন্য তার কাজের এই আগ্রহ এবং স্পৃহা দেখে সেই সমালোচকেরাও আজ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 

৭.
বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমির ভাবনা, বলা কথাগুলো শোনা যাক, ‘নারীকে অবশ্যয় সকল উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে । এখন সময় হয়েছে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের । নারী ও পুরূষ দুইটি ভিন্ন সত্তা ,এমন দিনে দুটি ভিন্ন সত্তারই উপভোগ করা উচিৎ । আমাদের যারা পথিকৃৎ ছিলেন তাদেরকে আমি সালাম জানাই, তারা আমাদের জন্য জায়গা তৈরি করেছিলেন বলেই আজ আমি শাবানা আজমি । কিন্তু আমার লজ্জা লাগে যখন দেখি এই আধুনিক ভারত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও নারী সম্পৃকিত নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে ,এখনও নারী নির্যাতনের শিকার । কিন্তু এটা দিনের আলোর মত পরীক্ষিত যে নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় ।’

৮.
কিংবদন্তি বলিউড অভিনেত্রী শাবানা আজমি বাংলাদেশের স্মৃতি নিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার বাবা কাইফি আজমির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। নানা দিক দিয়ে তিনি বাংলাদেশের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি কবিতাও তিনি লিখেছিলেন। আমি তাঁর মেয়ে হিসেবে সুসম্পর্কের এই ধারাটাকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে চাই। ঢাকায় অনেক মুক্তমনা শিল্পী, বুদ্ধিজীবী আছেন। আমি বাংলাদেশি একটা ছবিতে অভিনয়ও করেছি। ছবিটার নাম মেঘলা আকাশ। আমি যখনই ঢাকা আসি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা পাই। এখানকার মানুষের আন্তরিকতা আর ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।’

৯.
তিনি মনে করেন, ‘আমার যেটা মনে হয়, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর যৌথ প্রযোজনার ছবি হওয়া দরকার। এটা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নেও খুব ভালো একটা মাধ্যম হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) যদি এক হয়ে কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা পারব না কেন। পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব—এসবের কোনো বিকল্প হয় না। আর শিল্পের কোনো সীমানা থাকাটা কখনোই উচিত নয়।’

১০.
সমাজকর্মের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমি খুব উদারমনা একটা পরিবার থেকে এসেছি। আমি এই বিশ্বাস নিয়েই বড় হয়েছি—শিল্প সমাজ উন্নয়নের একটি ভালো হাতিয়ার। আমার মা একজন মঞ্চ অভিনেত্রী। আমার বাবা একজন কবি। তাঁরা দুজনই খুব সমাজ ও রাজনীতিসচেতন মানুষ। কাইফি আজমির মেয়ে হিসেবে তাঁর কিছুটা ছায়া তো আমার মধ্যে থাকবেই। আমি নিজের অভিনয় পেশাকে একটি মহৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চেয়েছি।’

১১.
একজন অ্যাকটিভিস্ট হওয়ার সবচেয়ে কঠিন অংশটা বলে মনে করেন, ‘আমি একজন প্রশিক্ষিত অভিনেত্রী।আমার কিছু বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ আছে।একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর পক্ষে মানুষের খুব কাছাকাছি যাওয়াটা সহজ নয়, যেটা একজন অ্যাকটিভিস্ট পারে। আমি যখন এই কাজটা শুরু করেছি, শুরুতে মানুষ কিছুটা অবাক হয়েছে। তারা বুঝতে পারেনি আমি ঠিক কী করতে যাচ্ছি। অনেকে হয়তো ভেবেছে, এটা স্রেফ একটা লোক-দেখানো ব্যাপার। এর সমাধানটাও আমি জানতাম। সেটি হচ্ছে, নিরলসভাবে ভালো কাজ করে যাওয়া। বছর বিশেক আগে, আমি একবার অনশন ধর্মঘট করেছিলাম। আমি মুম্বাইয়ের রাস্তায় ছিলাম টানা পাঁচ দিন। আমার মনে হয়, এখনকার বলিউডের অভিনেতারা তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। আমির খানের নাম আমি বিশেষ করে বলব। সে দেখিয়েছে, সে মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। অন্তত তার মনটা ঠিকঠাক আছে। নার্গিস, সুনীল দত্ত, দিলীপ কুমাররাও মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। আমার মনে হয় চিত্রতারকাদের এই দায়বদ্ধতাটা থাকা উচিত।’

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত