জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:৪১

১.
বাঙালি ও বাংলাদেশের গর্ব বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের গানের পাখি, সুরেলা কোকিল তথা বাংলা গানের অসম্ভব জনপ্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের জন্মদিন আজ। ১৯৫৪ সালের আজকের দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় চার দশক ধরে সঙ্গীতের ভূবনে তার সগর্বে বিচরণ। উচ্চাঙ্গ ধ্রুপদ, লোকসঙ্গীত থেকে আধুনিক বাংলা গানসহ চলচ্চিত্র মিশ্র আঙ্গিকের সুর-যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই যেন সোনা ফলেছে। শুধু দেশের গানেই তার যে অবদান, তা দিয়েই তিনি এ বাংলার বুকে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। বছরজুড়ে বিভিন্ন সময় তার গাওয়া দেশের গান আমাদের পুলকিত করে, অনুপ্রাণিত করে, আন্দোলিত করে। আর দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তার গাওয়া দেশের গানই যেন আগামী দিনে নতুন করে পথচলার সাহস জোগায়। দেশের গান ছাড়াও চলচ্চিত্রে হাজার হাজার গান গেয়েছেন তিনি। আর এমনি করেই গানে গানে সাবিনা ইয়াসমিন হয়ে উঠেছেন এদেশের তথা বাংলা ভাষাভাষীর অতি প্রিয় একজন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। গানের পাখির জন্মদিনে প্রিয় কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছাঞ্জলি। জন্মদিনের এই শুভক্ষণে সাবিনা ইয়াসমিন এর দীর্ঘজীবন কামনা করছি। জন্মদিন প্রসঙ্গে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘জন্মদিনটা সবসময়ই আমার কাছে খুব ভালোলাগার। কিন্তু বয়স বাড়ছে, আর এ বিষয়টি যখন মনে পড়ে তখন মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও এখনো বেশ ভালো আছি, সুস্থ আছি-এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আল্লাহ সবাইকে ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন। আমার জন্য দোয়া করবেন।’ ২০০৭ সালে সাবিনা ইয়াসমিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও দোয়ায় তিনি আবার দ্রুত সুস্থ হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার পর এখনও শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়ে যাচ্ছেন কোকিলকণ্ঠী এ গায়িকা। এখনকার গান করতে আগেকার মত পরিশ্রম, সময় বা ধৈর্যের র ঘাটতি দেখেন সাবিনা ইয়াসমিন। আগের দিনের গানগুলোর মত এখনকার চলচ্চিত্রের গান তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে শিল্পীদের গানের সঠিক রয়্যালটি না থাকাটা একটা অতৃপ্তি হিসেবে দেখেন তিনি।

২.
দেশাত্মবোধক গান থেকে প্রায় চার দশক ধরে বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার নানান উচ্চাঙ্গ ধ্রুপদ, লোকসঙ্গীত থেকে আধুনিক বাংলা গানসহ চলচ্চিত্র মিশ্র আঙ্গিককের সুরে শিল্পীর অবাধ যাতায়াতে সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন-এর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। জীবন্ত কিংবদন্তি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়েই শ্রোতাদের হৃদয় জুড়ে রয়েছেন শুরু থেকেই। ১৯৭১ সালে নঈম গহরের লেখা ও আজাদ রহমানের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম প্রেরণা জুগিয়েছিলো। গানের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের গানের মধ্যে মনে পড়ছে, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মত গন্ধ বিলিয়ে যাই’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও’, ‘ঝড়ের ও পাখি হয়ে উড়ে’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ এবং ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান’, ‘দুঃখ ভালবেসে প্রেমের খেলা’, ‘এ সুখের নেই কোন সীমানা’। আর তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’সহ ‘ও আমার বাংলা মা’, ‘মাঝি নাও ছাড়িয়া দে’,‘সুন্দর সুবর্ণ’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা’ সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি। তার গাওয়া দেশের গান আমাদের পুলকিত, অনুপ্রাণিত, আন্দোলিত করে। আর দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তার গাওয়া দেশের গানই যেন আগামীদিনে নতুন করে পথ চলার সাহস যুগায়। দেশের গান ছাড়াও চলচ্চিত্রে হাজার হাজার গান গেয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত সাবিনা ইয়াসমিন প্রায় ১৭ হাজারের মতো গান রেকর্ড করেছেন। তিনি ১৩ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১১ বার বাচসাস পুরস্কার এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১২ সালে তাকে ‘বাংলা একাডেমি’ সম্মানসূচক ফেলোশীপ প্রদান করা হয়।

৩.
বাংলাদেশের গানের জগতে অত্যন্ত পরিচিত নাম সাবিনা ইয়াসমিনের। জীবন্ত কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের ভূবনে আধিপত্য বজায় রেখেছেন। মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে এখনকার শিল্পীরদের সঙ্গে অবিরাম গেয়ে চলেছেন। উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আর,ডি,বর্মণের সুরে গান গাওয়া, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমারের ও মান্না দের সঙ্গেও ডুয়েট গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা।
 
৪.
ছোটবেলায় খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিলেন এ শিল্পী। মা ও বোনদের গানের মধ্য দিয়েই তাঁর গাওয়ার শুরু। প্রথমে ‘খেলাঘর’ নামে বেতারঅনুষ্ঠানে ছোটদের গান করতেন সাবিনা ইয়াসমিন। সঙ্গীতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ৭ বছর বয়সে স্টেজ প্রোগ্রামে অংশ নেন। ছোটদের সংগঠন খেলাঘরের সদস্য হিসেবে রেডিও ও টেলিভিশনে গান করেছেন নিয়মিত। বেতার ও চলচ্চিত্রে বড়দের গান করেন ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৭ সালে 'আগুন নিয়ে খেলা' এবং 'মধুর জোছনা দীপালি' গানটির মাধ্যমে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন। এর আগে 'নতুন সুর'-এ প্রথম গান করেন শিশু শিল্পী হিসেবে। বড়দের গানে যাত্রা শুরু হয় স্কুলে পড়ার সময়েই। তাই তৎকালীন দ্বৈত গানে প্লেব্যাক করতে অনেক সময় দুই বা তিন ধাপের টুল ব্যবহার করতে হত তাঁকে। ১৯৬২ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রয়াত বরেণ্য সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষের সঙ্গীত পরিচালনায় এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমাতে প্রথম গান করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ও নূরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সিনেমাতে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘মধু জোছনা দীপালি’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘চন্দ্রনাথ’, মইনুল হোসেনের ‘প্রেমিক’, বুলবুল আহমেদ’র ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’ , আমজাদ হোসেনের ‘দুই জীবন’, কাজী হায়াৎ’র ‘দাঙ্গা’, মতিন রহমানের ‘রাধা কৃষ্ণ’, মোহাম্মদ হোসেন’র ‘আজ গায়ে হলুদ’ ও চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

৫.
জীবন্ত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন অ্যালবাম ও চলচ্চিত্রের গানের পাশাপাশি নিয়মিত স্টেজ শো’তে গান পরিবেশন করছেন। তার গান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে দৈনিক আমাদের সময় অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। অকপটে বলেছেন, আমার কাছে সব মেয়ের কণ্ঠ একই মনে হয়। সেই আলোচনার নির্বাচিত অংশ পাঠ করা যাক।-
অনেকদিন পর সম্প্রতি দুটি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিলেন-
দুই মাস আগে ফরিদ আহমেদের সুর ও সংগীতে নতুন একটি সিনেমার গান গেয়েছি। এছাড়া কয়েকদিন আগে ‘কাঠগড়ায় শরৎচন্দ্র’ নামে একটি ছবিতে গান গেয়েছি। এখানে আমার সঙ্গে গেয়েছেন সুবীর নন্দী। দেড় বছর পর সুবীর নন্দী আর আমি একসঙ্গে গান গাইলাম। এটা একটা কীর্তন গান। খুব সুন্দর একটা গান হয়েছে। সুবীর নন্দী সব সময় অসম্ভব ভালো গায়। এই গানটাও অনেক ভালো গেয়েছে। আজকাল এই ধরনের গান হয় না। এজন্য আমার কাছে ভালো লেগেছে। বলতে গেলে এখন কীর্তন গান হয় না। দীর্ঘদিন পর কীর্তন গেয়ে ভালো লেগেছে।
আপনাকে আগের মতো নিয়মিত চলচ্চিত্রের গানে পাওয়া যায় না। এর কারণ কী?
ফিল্মের গান এখন বেশি গাইছি না। কারণ ফিল্মের গান যেগুলো হচ্ছে সেগুলো আমার স্টাইলের গান না। সেজন্য ফিল্মের গান আমার কম গাওয়া হচ্ছে। যেগুলো আমার মতো গান সেগুলো গাই।
প্রয়াত আলতাফ মাহমুদের ১০টি গান নিয়ে একটি অ্যালবাম করার কথা ছিল। সেটার কাজের খবর কি?
আলতাফ মাহমুদের হাত ধরেই আমি ফিল্মে গান গেয়েছি। তার ১০টি গান দিয়ে নতুন করে একটি অ্যালবামের কাজ শেষ করেছি। গানগুলো নতুনভাবে সংগীতায়োজন করেছে কলকাতার রকেট মন্ডল ও বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর। শিগগিরই অ্যালবামটি ইমপ্রেস অডিও থেকে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। আশা করি গানগুলো সবার ভালো লাগবে।
বলতে গেলে আগে প্রতিদিনেই আপনার রেকর্ডিং থাকত। এখন তেমন কাজ করেন না। গান ছাড়া সময় কাটে কীভাবে?
সময় কোথায় আমার। এখনও দেশ এবং দেশের বাইরে নিয়মিত অনুষ্ঠানে গান করছি।
বর্তমানে যারা গান গাইছেন তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ?
বলার কিছুই নাই। বর্তমানে এত বেশি শিল্পী যে, কার সম্পর্কে কি বলব। সব মেয়েদের কণ্ঠ আমার কাছে একই রকম মনে হয়। সুতরাং আমার মনে হয় সবাই ভালো গাইছে। কারণ মানুষতো তাদের গান পছন্দ করছে, না হলে এত শিল্পী গাইতে পারত না। সবাই তো শিল্পী এখন। এত শিল্পী যখন তাদের নিশ্চয়ই অ্যালবাম, সিডি বিক্রি হয়। হয়তো তাদের গানও অনেক পপুলার হয়। তা-না হলে সবাই গাইছে কেন? তাদের মধ্যে কিছু শিল্পী খুবই ভালো গান গায়। মূল্যায়ণ করার মতো তেমন কিছু নাই। আমার মনে হয় সবাই যদি ধৈর্য্য ধরে একটু ভালো করে ক্ল্যাসিকেলটা কিছুটা শিখে আসে। পুরোটা ক্ল্যাসিকেল শেখার দরকার নাই, অন্তত বেইজটা যদি একটু ক্ল্যাসিকেল থাকে তাহলে আরও ভালো হতো। আর রেওয়াজ করতে হবে। অনুষ্ঠান একটু কমিয়ে রেওয়াজটা নিয়মিত করা দরকার।

৬.
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের গানের জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি, জীবন্ত কিংবদন্তি। শুধু দেশের গানেই তার যে অবদান, তা দিয়েই তিনি এই বাংলার বুকে বেঁচে থাকবেন যুগযুগ ধরে। সাবিনা ইয়াসমিন বাংলা সঙ্গীতের রানী কিংবা সকল উপমায় প্রশংসা করলেও যার গানের কথা শেষ করা যায় না বলেই অনেকের ধারণা। কালের পর কাল যুগের পর যুগ ধরে যে কণ্ঠ এখনো তূর্যধ্বনি হয়ে বাঁজে হৃদয়পানে। আজ এই জীবন্ত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের জন্মদিনে আবারো জানাই শুভেচ্ছাঞ্জলি।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত