জার্মান দার্শনিক হেগেল

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:১১

জার্মান দার্শনিক হেগেল ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট জার্মানির স্টুটগার্টে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পুরো নাম গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল। হেগেল ছিলেন জার্মান ভাববাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাস্তবতার ক্ষেত্রে তাঁর ঐতিহাসিক ও ভাববাদী অবস্থান ইউরোপীয় দর্শনকে বিপ্লবী করে এবং মহাদেশীয় দর্শন ও মার্কসবাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রদূত হিসবে বিবেচিত হয়।

হেগেলের দ্বান্দ্বিকতা হল তিনটি বিষয়ের সমন্বয়- প্রস্তাব, প্রতিপ্রস্তাব ও সংশ্লেষণ। বিষয়টা সোজা ভাষায় এরকম- কেউ একটা কথা বা প্রস্তাব উত্থাপন করল অর্থাৎ থিসিস দিল। আরেকজন কথাটার প্রতিবাদ বা প্রতিপ্রস্তাব উত্থাপন করল অর্থাৎ অ্যান্টিথিসিস দিল। এই বাদ - প্রতিবাদের মধ্য থেকে যে নতুন অধিকতর গ্রহণযোগ্য কথাটির উৎপত্তি হয় তা হল সংশ্লেষণ বা সিনথিসিস। সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন চিন্তাটি নতুন প্রস্তাব হিসাবে কাজ করবে আবার একটা পর্যায়ে এর প্রতিপ্রস্তাব বা অ্যান্টিথিসিস আসবে। একইভাবে থিসিস ও অ্যান্টিথিসিসের সংশ্লেষণে নতুন থিসিস তৈরী হবে এবং এভাবে সভ্যতার বিকাশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া চলতে থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য - এটাই হল দ্বান্দ্বিকতাবাদ। সভ্যতার বিকাশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া চিরন্তন এবং এভাবেই পুরাতন সমাজ ভেঙে নতুন সমাজের জন্ম হবে। সভ্যতা এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উন্নীত হবে। হেগেলের দর্শন অনুযায়ী এই প্রস্তাব-প্রতিপ্রস্তাব তৈরী হবে ভাব বা আইডিয়ার মাধ্যমে। এই জায়গায় এসে হেগেল ভাববাদী দার্শনিক।

দার্শনিক হেগেল তাঁর দ্বান্দ্বিকতা দিয়ে কর্তাসত্ত্বার সাথে বস্তুময় জগত বা অপরের সম্পর্ক সন্ধান করেছেন। হেগেলের মতে, পরমের জ্ঞান পেতে হলে দ্বান্দ্বিকতার আশ্রয় নিতে হবে কারণ জগত দ্বন্দ্বময়। এ জগতে কর্তা এবং কর্মকে বুঝার আগে আমাদের ক্রিয়ার জ্ঞান হয়, সেখান থেকে পেছনে ফিরে আমরা কর্তাসত্ত্বার উপস্থিতি টের পাই। কর্মের মাধ্যমেই কর্তাসত্ত্বা কর্তা ‘হয়ে ওঠেন’। হেগেলের দর্শন সমগ্রতার দর্শন, একটা সিস্টেমের মধ্যে কোন পরম ভাবনা বা চিন্তার সমন্বয় ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে শুধু দ্বান্দ্বিক ত্রয়ীর চর্চা করে জ্ঞানের অনুভূতি হবে কিন্তু সেটা সত্যিকারের জ্ঞান হবে না। জগত বা সত্যের ক্ষেত্রে জ্ঞেয় ও অজ্ঞেয়'র দ্বৈত রূপ হেগেল অস্বীকার করলেও তাঁর নিকট মূল হচ্ছে ভাব; বস্তু নয়। যা কিছু জ্ঞেয় বা দৃশ্যমান সবই হচ্ছে ভাবের প্রকাশ ও বিকাশ। এছাড়া ভাবের চরম বিকাশ জার্মান রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘটেছে বলে হেগেলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পেরেছে।

কবি জালালউদ্দিন রুমী’র ‘মসনভী’ এবং ‘দিওয়ান-ই শামস-ই তাবরেজি’ পড়ার পর দার্শনিক হেগেল নতুনভাবে উজ্জীবিত হলেন। রুমি’র নাম রাখেন ‘এ্যাক্সেলেন্টে রুমি’। হেগেল জার্মান ভাষায় রুমি পড়েছিলেন। হেগেল তাঁর তত্ত্বসমূহে কনসেপ্ট অব ডায়ালেক্টিকস-এর পদ্ধতিগত ব্যবহারের অনেক আগেই মওলানা জালালউদ্দিন রুমি’র কবিতার সাথে পরিচিত হন। রুমি’র সকল সাহিত্যকর্মের মূলভাব ছিল ডিভাইন লাভ। হেগেলের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রুমি পৃথিবীতে এসেছিলেন। হেগেলের ‘সায়েন্স অব লজিক’ কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রসঙ্গত কবি খলিল জিবরানকে আনা যায়। জিবরান দেখেছেন- ‘মানুষ ভিক্ষুক সব’। ধনীও ভিক্ষুক গরীবও ভিক্ষুক। রাজাও ভিক্ষুক প্রজাও ভিক্ষুক, প্রেসিডেন্টও ভিক্ষুক, জনগণও ভিক্ষুক, মাল্টি বিলিওনিয়ারও ভিক্ষুক পেনিলেস-কপর্দকশূন্য মানুষটিও ভিক্ষুক, বিজ্ঞানীও ভিক্ষুক অবিজ্ঞানীও ভিক্ষুক। মানুষ নামের প্রাণীগুলোর জীবন জুড়ে আছে কেবল এটা চাই ওটা চাই- অভাব আর অভাব। অভাবী কোনো সত্তার পক্ষে 'সেলফ-ডিটারমাইনিং' হওয়া সম্ভব না। এই ব্যাপারটা প্লেটোর চাইতেও অধিক শক্তভাবে বয়ান করেছেন হেগেল ‘সায়েন্স অব লজিক’-এ। হেগেলের যুক্তি ট্রেডিশনাল ধর্মপ্রাণ মানুষের ভাবনা, প্রত্যয় ও বিশ্বাসের পাশাপাশি সানন্দে স্থান করে নেয়।

বিশ্বের আমূল পরিবর্তনে হেগেলের মতো এত স্পষ্ট ভূমিকা খুব কম দার্শনিকই রাখতে পেরেছে। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাবটা রূপায়িত হয়েছে জার্মান জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে, আর পরোক্ষটা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক শিষ্য কার্ল মার্ক্সের মধ্য দিয়ে। সুতরাং হেগেলের চিন্তাধারার ব্যবহারিক ফলাফলগুলো দেখার জন্য বর্তমানে আমাদের চারদিকে তাকানোটাই যথেষ্ট। একাডেমিক দর্শনেও হেগেলের প্রভাব বিশাল: অনেকে বলেন হেগেল-পরবর্তী দর্শনের ইতিহাসকে হেগেলের প্রতি বিভিন্ন দিক থেকে দেয়া কিছু জবাবের সমষ্টি হিসেবে দেখা যায়।

গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল প্রায় সারা জীবনই বিভিন্ন রকমের শিক্ষকতা করেছেন। ক্যারিয়ারের এক পর্যায়ে প্রথমে হাইডেলবার্গ এবং পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হয়েছিলেন। দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে তাঁর অনেক দেরি হয়েছিল। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখেছিলেন ৩৭ বছর বয়সে। কিন্তু ১৮৩১ সালে যখন মারা যান তখন তিনি নিঃসন্দেহে ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত