প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শিবরাম চক্রবর্তী

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:০৫

১.
বাংলা সাহিত্যের রস ভান্ডারে রম্য গুরু শিবরাম চক্রবর্তীর স্থান সেরাদের সেরা বললে অত্যুক্তি হবে না। ১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা সাহিত্যের আকাশে আজও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়েই দীপ্যমান এই হাসির রাজার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, শিবরাম চক্রবর্তীর জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কলকাতায় মাতুলালয়ে। কবিতা-রচনা দিয়ে সাহিত্য-জীবনের শুরু। প্রথম কবিতা বেরোয় 'ভারতী' পত্রিকায়। প্রথম প্রকাশিত বই দুটিও-'মানুস' ও 'চুম্বন'-কবিতার। দুটিই প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। তারপর অজস্র লেখা লিখেছেন। প্রবন্ধ, নাটক এবং অদ্বিতীয় অজস্র হাসির গল্প। লিখেছেন 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা' নামে এক অনন্য স্মৃতিকথা। প্রবন্ধের বই: 'মস্কো বনাম পন্ডিচেরি' ও 'ফানুস ফাটাই', নাটকের গ্রন্থ: 'যখন তারা কথা বলবে'। বিচিত্র জীবন ছিল তার। রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, রাস্তায় কাগজ ফেরি করেছেন, ফুটপাথে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, আজীবন মেস-জীবন যাপন করেছেন। করেননি যা, তা হল বিয়ে।

২.
সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী (জন্ম : ১৩ ডিসেম্বর, ১৯০৩ - প্রয়াণ : ২৮ আগস্ট, ১৯৮০) “হাসির রাজা” নামে খ্যাত। শিবরাম চক্রবর্তী হলেন বাংলা সাহিত্যের রসময় সাঁইজিদের মধ্যে একজন অন্যতম কুলিন পুরোধা। শিবরাম মানেই হাসির পটরা। যা খুললেই কেবল হাসি আর হাসি। নানা রঙের হাসির ফোয়ারা বইয়ে মরু গাঙে জোয়ার আসার মত দুঃখে ভরা প্রাণে হাসির পরশ ছড়িয়ে দেয়। তাঁর গল্পও রম্য রচনা, যার অণুতে অণুতে ছড়িয়ে আছে কেবলই হাসি আর হাসি। ছোটদের জন্য তার রয়েছে প্রচুর লেখালেখি। ছোটদেরকে এতটাই ভালবাসতেন যে, সবসময় নিজের ফেলে আসা শৈশবকে ফিরে পেতে শিশুদের মত তিনি থাকতে, খেতে ভালবাসতেন। তার প্রিয় জিনিস ছিল টফি বা চকলেট। লেখালেখি না থাকলে মুখের ভেতরে একটা চকলেট নিয়ে তাকে চুষতে দেখা যেত। শিশু-কিশোরদের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে বজায় ছিল। বাংলা সাহিত্য ও সংবাদপত্র জগতে তাই শিবরাম চক্রবর্তী এখনও শিশুদের পরম বন্ধু হয়েই বেঁচে আছেন, আর বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কারণ তিনি নিজেই সাহসের সাথে বলছেন, ‘আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি, এমনকি বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাতেও নয়। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা, না, হয় করতে নয়, তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি। ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পড়বে, একটু বেলা হলে, বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়। সেই একটুক্ষণ তাদের একটুখানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুশি।’

৩.
শিবরাম চক্রবর্তীর ৭৭ বছর বয়স পেয়েছিলেন। যার মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে তার ভাগ্যান্বেষণে। একসময় তিনি জীবিকার তাগিদে সংবাদপত্রের হকারি করেছেন। সেই সময় কোলকাতার বিখ্যাত সংবাদপত্র বসুমতি বিক্রি করেছেন। এরপর সওদাগরী অফিসে কম মাইনার চাকরি করেছেন। কিন্তু তখনও লেখা-লেখিতে হাত দেননি। অবশেষে একটা সময় এসে তাকে লিখতে হয়। কারণ লিখেই তাকে খেতে হয়। দৈনিক বসুমতির সম্পাদক হেমন্ত প্রসাদ ঘোষই তাকে লেখালেখিতে নিয়ে আসেন। সাহিত্য সাধনা শুরু করে তিনি বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন তোলেন। রস রচনা এবং কৌতুক রচনায় সিদ্ধহস্ত শিবরাম গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতাও লিখেছেন। তার উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে 'প্রেমের পথ ঘোরাল আজ এবং আগামীকাল', মেয়েদের মন, শিবরাম রচনাবলি, ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা প্রভৃতি। আবার তিনি ছোটদের জন্য প্রচুর লিখেছেন। শিশুকালকে ধরে রাখতে তার এসব শিশুতোষ লেখা-লেখি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে। ছোটদের জন্য লেখা জন্মদিনের উপহার তার বিখ্যাত বই।

৪.
শিবরাম চক্রবর্তীর বাবার নাম শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী। বাবা ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধনার গুরু বক্তা। পথে পথে আধ্যাত্ম সাধনার বিষয়ে চমৎকার সব বক্তব্য রাখতেন তিনি। আর সে কারণেই অনেকে বলে থাকেন যে পৈত্রিক ধারাবাহিকতায় শিবরাম চক্রবর্তী অনেকটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। শিবরাম চক্রবর্তীর ছোট বেলার অনেকটা মধুর সময় কেটেছিল পাহাড়পুরে। তখন তার স্কুল জীবন। অদম্য স্বাধীন চেতা শিবরাম চক্রবর্তী স্কুল জীবন থেকেই স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরেন এবং গ্রেপ্তার হন। এরপর আর তার মেট্রিক পাসের কড়িডোর পার হওয়ার সুযোগ হয় নাই। ছোট বেলা থেকেই বেখেয়ালি এক উড়নচন্ডি স্বভাব তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল। বাঁধাধরা জীবন ছিল তার কাছে জেলখানার পরবাসীর মতো শৃঙ্খলিত। আর সে কারণেই লেখাপড়ায় মেট্রিকের কড়িকাঠ না পেরোতেই ইতি যবনিকায় দাঁড়ি চিহ্ন পরে যায়। এরপর স্বশিক্ষায় সার্থক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এভাবেই একদিন তিনি এক অবারিত মুক্ত জীবনের সুখ স্বপ্নে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। স্বার্থক হয়ে ফিরে আসার প্রত্যয়ী প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোনো চিঠিও লিখে যাননি বাড়িতে। কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন যে তিনি আর কোনো দিনই বাড়িতে ফিরে আসবেন না। তিনি তার জিদ রেখেছিলেন। জীবনের প্রতি তার এমন বিরহমাখা অনীহা কেন ছিল তা অবশ্য কেউ বলতে পারেন নাই। এমন কি তিনি নিজেও এ ব্যাপারে কিছু লিখে যাননি। তবে তার সকল লেখা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে জীবন রহস্যের এটা কিনারা পাওয়া যায়। 

৫.
চিরকুমার শিবরাম চক্রবর্তীর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতার ২৩৪ মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের একটি ছোট্ট মেস ঘরের নির্জন কক্ষে। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সেই কক্ষে থেকেছিলেন। বলা হতো ওটা দ্বিতীয় শ্রেণীর মেস। শ্রেণী কোনো বিষয় না। কারণ জীবনের প্রতি তার ঐ রকম কোনো কিছুর চাওয়া ছিল না। আজীবন বেহিসেবী শিবরাম কখনই দেনা-পাওনার হিসাব কাগজ-কলমে রাখতেন না। ছোট্ট কক্ষের দেয়ালই ছিল তার হিসাবের খাতা। সারা দেয়াল জুড়ে কার কাছে কত পাবেন তার নাম ও পরিমাণ উল্লেখ করে লেখালেখি। এসব নাম কখনোই কাটা যায়নি। কারণ তার দেনাদারেরা ঋণ শোধ করে ঋণমুক্ত হওয়াকে পাপ জ্ঞান করতেন। শিবরাম তাই লিখেছিলেন, অমুককে টাকা দিলাম। সে টাকাটা হাতে পেয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে বলল, শিবরাম ভায়া আমাকে তুমি চিরঋণী করলে। তোমার এ টাকাটা না পেলে এই কোলকাতা শহরে আজ আমাকে ট্রামের তলায় পড়ে আত্মহত্যা করতে হতো। ভাই তাই তোমার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে রইলুম। বলাবাহুল্য সে আর কোনদিনই শিবরামের ঋণ শোধ করার কথা মাথায় আনতো না। আর শিবরাম লিখলেন, সত্যিই তুমি আমার কাছে চিরঋণী হয়েই রইলে।

৬.
তিনি আজীবন মুক্ত জীবনে থাকার নীতিতে অটল থাকার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তার কাছে বিয়ে মানেই শৃঙ্খলিত জীবন। কথিত আছে একদিন এক জেলখানার কয়েদী জেলখানা থেকে পালাতে গিয়ে করা রক্ষীদের হাতে ধরা পরে যান। এরপর পলায়নপর কয়েদীকে জেলার সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলার সাহেব অনেকক্ষণ পলায়নপর কয়েদীর দিকে তাকিয়ে থেকে খুব নরম ভাষায় কয়েদীকে জিজ্ঞাসা করলেন 'তুমি পালাতে চেয়েছিলে কেন বাবা?' কয়েদী ব্যাচারি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো- স্যার অভয় দিলে সত্য কথাটা বলতে পারি। জেলার সাহেব অভয় দিলেন। বললেন নির্ভয়ে বলো। কয়েদী বলতে লাগল-স্যার জীবনে একটা বিয়ে করার খুবই সখ ছিল। আকাশছোঁয়া শখ। কিন্তু যাবজ্জীবন জেল হওয়ার কারণে বিয়ে করার সে শখ আর কিছুতেই পূরণ করতে পারছিলাম না। তাই জেল থেকে পালিয়ে একটা বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। জেলার সাহেব অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন 'তোমার দেখছি বাবা মুক্ত জীবন সস্পর্কে কোনো ধারণাই নাই'। শিবরাম চক্রবর্তী মহাশয় হয়তো কোনো এক মহা গুরুর কাছ থেকে প্রকৃত মুক্ত জীবনের একটা সঠিক ধারণা পেয়েছিলেন। আর সে কারণেই তিনি চিরকুমার ব্রতে সই হয়েছিলেন। 

৭.
শিবরাম চক্রবর্তী নিজের এই পালিয়ে যাওয়ার সত্য ঘটনার বর্ণনায় একটি চমৎকার গল্প লিখেছিলেন। গল্পের নাম দিয়েছিলেন 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'। পরবর্তীতে এ উপ-মহাদেশের অন্যতম সফল চিত্রপরিচালক ঋত্ত্বিক কুমার ঘটক 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' গল্পটির চিত্র রূপ দিয়ে দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন। তবে শিবরাম চক্রবর্তী তার সাহিত্য সাধনার প্রথম জীবনে একজন কবি হিসাবে উদিত হয়েছিলেন। কিন্তু নিরলস সাহিত্য সাধনার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি আর কবি থাকতে পারেন নাই। আর তাই রস-ভান্ডারি শিবরাম চক্রবর্তী ভারতবর্ষের একজন অন্যতম সেরা রম্য লেখক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে ধন্য হতে পেরেছিলেন। তার লেখা প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ছিল 'মানুষ'। লিখেছিলেনও চমৎকার। সমস্ত শরীর যার রসে টই-টুম্বুর তার পক্ষে কি আর কবিতার ছন্দে আবদ্ধ থাকা সম্ভব? তবে তার কবিতাতেও রস ছিল হাঁড়ি উৎলানোর মতোই রসে যেন টইটুম্বুর। তিনি রস ভরে তার নাম লিখতেন 'শিব্রাম চকরবর্তী'। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা 'দেবতার জন্ম' তাকে রম্য সাহিত্যের গুরুতে পরিণত করে দেয়। তার লেখা 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা' এবং তৎপ্রতিক্রিয়ায় 'ভালোবাসা ঈশ্বর পৃথিবী' 'আজ ও আগামীকাল' এবং 'একটি স্বর্ণ ঘটিত অপকৃর্তি' তার লেখাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে তিনি গল্প ছোট আকারে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। 

৮.
নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে তার জুড়ি ছিল না। একবার হয়েছে কি— বন্ধুরা এসেছে শিবরামের মেসবাড়িতে। সকলে জুতা খুলে তার কক্ষে ঢুকেছেন। জুতা বাইরে। তাই দেখে শিবরাম হাসতে হাসতে বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি, আমার ঘরের ময়লা তোমাদের দামী জুতায় লাগবে বলেই তোমরা জুতাগুলো বাইরে রেখে সে ময়লার হাত থেকে কৌশলে জুতাকে বাঁচালে—শিবরামের বাসায় একজন থাকবেন এমন সংবাদে চিররসিক শিবরাম বললেন, শিবের বাড়িতে আপনি থাকবেন, এতো বড়ই আনন্দের কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিনের বিছানা-বালিশ আর অনেকদিন ধরে মানে বলতে পারেন বিছানাটা পাতার পর তা আর তুলে দেখা হয়নি। এর নিচের অনেক সরীসৃপই আমার সাথে বসবাস করে। অবশ্য এদের প্রজাতি সাপ, ছুঁচো থাকাটাও বিচিত্র নয়—সাপ আছে এমন কথার পর আর কেউ কি সাপের সঙ্গে সহবাস করতে রাজি হবেন? একমাত্র নাগরাজ শিকারী সেই গল্পের সাপুড়ে ছাড়া। শিবরাম আমাদের শিবরাম চকোত্তি—তাই চির কৌতুক সঙ্গী করেই একদিন গত হলেন, অকৃতজ্ঞ বাঙালি সেদিনটাকেও মনে রাখেনি। বাঙালি কেবলই নিয়েছে, দেয়নি কিছুই—। শিবরামের ভাষায়: তার কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে রইলাম কিন্তু সে ঋণটুকু শোধ করার মত হিম্মত দেখাতে পারলাম কই? শিবরাম যেখানেই থাকেন না কেন, সুখে ও চিরশান্তিতে থাকুন। আর ক্ষমা করুন আমাদের এই অকৃতজ্ঞতাকে।

৯.
তিনি কবিতা, নাটক, উপন্যাস এবং রম্য গল্পসহ অনেক প্রবন্ধও লিখেছিলেন। তবে তিনি দেশ-বিদেশে একজন রম্য লেখক হিসাবেই সমধিক পরিচিত। অবশ্য অনেক অবহেলায় তার জীবনের বহু লেখা সযত্নে সংরক্ষণ করতে পারেন নাই তিনি। তার বহু মূল্যবান লেখা অবহেলায় খুঁইয়ে ফেলেছিলেন। অবশ্য তার জীবনটাও কেটেছে চরম অবহেলায়। কাজেই তার সৃষ্টি সংরক্ষিত হবে কীভাবে? শেষ জীবনে নিদারুণ অর্থকষ্টে তার জীবন চলতে থাকে। চলতে থাকে কথাটা বললে অবশ্য ভুল হবে। নিদারুণ অর্থকষ্টে তার জীবনটা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পরতে থাকে। অবশেষে তার আর আপন বলে কিছুই ছিল না। সর্বশেষ পশ্চিম বাংলা সরকার তার ভরণ-পোষণের দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন। সরকারি অনুদানে জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু চালিয়ে রেখেছিলেন। রসে ভরা শিবরাম ধীরে ধীরে রস শূন্য হয়ে পরতে থাকেন। ১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট কোলকাতার জীবন শেষ করে হাসি-সম্রাট মারা যান। 

১০.
শিবরাম চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ করে বাঙালি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা-গবেষক পন্ডিত ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘উত্তর কলকাতার মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের একই পাঁচমিশেলি মেসে একই ঘরে একই জীর্ণ তক্তাপোসের উপর একই ব্যক্তি দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী প্রায় যাপন করে, জীবনটাকে তুড়ি মেরে জীর্ণ বস্ত্রের মতো এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন যে পথভোলা, মহাবিবাগী, ছন্নছাড়া মানুষটি তাঁর নাম শিবরাম চক্রবর্তী। সারাটা জীবন তিনি যাদের সঙ্গে কাটালেন তাঁর মানস-জগতে, তাঁরা সব কিশোর-কিশোরী, মানস-মিথুন মধুর আত্মীয়তা তাদের সঙ্গে, হাস্যপরিহাসময় এক পরিবেশের মধ্যে। আর, বয়সে যাঁরা বড় তাদের সঙ্গে, তো সমস্ত সম্বন্ধটাই হাস্যপরিহাস ঠাট্টা তামাশার। অশনে বসনে সাজে সজ্জায় দৃষ্টিলেশহীন, নিজের সম্বন্ধে একান্ত অবজ্ঞাবিলাসী এই মানুষটির সঙ্গে এ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল; যোগসূত্র ছিলেন একাধিক বিপ্লবী রাজনৈতিক বন্ধু। তারপর আর বহুদিন আর কোনো বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। তবু, উত্তর ও মধ্য কলকাতায় ফুটপাতে কদাচিৎ কখনো দেখা হয়ে গেলে কাছে এসে হাত ধরে বলতেন, ‘হে বন্ধ, আছো তো ভালো?’ তারপর আর কোনো কথা নেই, বলা নেই, কহা নেই, ধাঁ করে ঢুকে পড়তেন নিকটতম সস্তা, নোংরা যে কোনো একটি চা-এর দোকানে। অথচ, অদৃষ্টের এমনই পরিহাস, মৃত্যুর মাত্র দু-তিন মাস আগে শিবরাম তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার, একটি রৌপ্য পদক ও কিছু বই, নিয়ে গেলেন আমারই হাত থেকে কবি কালিদাস রায় এর এক স্মৃতি-সন্ধ্যায়। যাবার আগে বলেছিলেন, ‘আমি তো আর বেশি চলা ফেরা করতে পারি নে, তবু একদিন আসব, বসে বসে গল্প করব।’ আসা আর তাঁর হয় নি। আমি জানি, তাতে শিবরাম চক্রবর্তীর কিছু ক্ষতি হয় নি, ক্ষতি যা হয়েছে তা আমার।’

১১.
শিবরাম চক্রবর্তীর প্রয়াণ দিবসে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ‘চক্কোত্তিমশাই’ স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘শিবরাম চক্রবর্তী, তিনি বলতেন বা লিখতেন শিব্রাম চক্কোত্তি। নিজের নাম নিয়েই খেলা করতেন। যখন আমি স্কুলে পড়ি তখন শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা পড়ার জন্য আমরা সকলেই খুব উতলা হতুম। পরশুরাম বালকদের তেমন বোধগম্য হতেন না। কারণ তাঁর ব্যঙ্গাত্মক লেখা, স্যাটায়ার ছিল বড়দের জন্য। আর ত্রৈলোক্যবাবুর কোনও কোনও লেখা ছোটদের হাত ধরতে চাইলেও তেমন জোরে ধরতে পারতেন না। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা যেমন ছোটদের জন্য, সেই রকম বড়দের জন্যও। এমনটা অনেকের ভাগ্যে ঘটে না। তিনি তো কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। গম্ভীর বিষয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু ব্যক্তি শিবরামের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। একেবারে অন্য রকমের মানুষ, অন্য রকমের লেখা। কারও সঙ্গে মিলবে না। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, তাঁর লেখার আকর্ষণটা কোথায়? তাহলে একটিই উত্তর বলতে পারব না। ভাল রাঁধুনি যেমন বলতে পারবেন না, ঠিক কীসের সঙ্গে কীসের সংযোগে এমন সুস্বাদু একটি পদ তৈরি হল। তাঁর লেখার মধ্যে একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যেত। না সাধু, না গৃহী সম্পূর্ণ মুক্তমনের একজন। পরবর্তী কালে যখন তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে পত্রিকায় লেখার সূত্রে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হল, তখন দেখলুম মানুষটি যেন রাজাধিরাজ। একেবারে বন্ধনমুক্ত। নিজের জীবন নিয়েই কত রসিকতা। গদ্যে তাঁর অভাবনীয় দখল ছিল। যার ফলে বাক্যকে এমন মোচড় দিতেন যা বিস্ময়কর। তাঁর প্রতিভার এটা একটা মস্ত দিক। সাফল্যের নব্বই ভাগ এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পানিং’। তিনি বলতেন, মুক্তারামবাবুর মুক্ত আরামে আছি। জমিদারের ছেলে। পরিবার-পরিজনের কী হল তা কখনও বলতেন না। একটি প্রাচীন মেসবাড়ির একটি ঘরেই তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার। ছেলেবেলার আকর্ষণ দিয়ে লেখার শুরু। হঠাত্ একদিন তাঁর সঙ্গে সারাটা দিন কাটাবার সুযোগ হল। নানা রকম খেতে ভালবাসতেন। বন্ধুত্ব করেছিলেন কিশোরদের সঙ্গে। আমার এক বন্ধুর মা অসাধারণ ভাল রান্না করতে পারতেন। একদিন খবর এল আমার এই বন্ধুর বাড়িতে তিনি দুপুরবেলা আসবেন, আহারাদি করবেন, থাকবেন অনেক ক্ষণ। জমিদারের ছেলে। সংস্কারে সেই বীজটি রয়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি, সাদা ধবধবে ধুতি। উজ্জ্বল মূর্তি, মাথার চুল বিচিত্র কায়দায় আঁচড়ানো। ফর্সা টকটকে কপালের উপর ঝুলে আছে এক গুচ্ছ চুল। তিনি এলেন। বৈঠকখানায় বসলেন আমাদের নিয়ে। বড়দের খুব একটা পাত্তা দিলেন না। একটি তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে আধশোয়া হয়ে মজলিসি ঢঙে শুরু হল নানা গল্প। শ্রোতা আমরা কয়েক জন অল্পবয়সি। মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, তোমাদের খুশি করতে পারলে খাওয়াটা জমবে। গন্ধ নাকে আসছে, প্রাণ বড় উতলা। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ফর্সা মুখে বুদ্ধির আভা। একজন একশোভাগ ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ। সময় সময় কিছু কথা বুঝতে অসুবিধা হলেও বেশির ভাগই বেপরোয়া মজা। অশালীন নয়, ভাঁড়ামি মুক্ত। এই দেখার স্মৃতিটি রয়ে গেল। এর পর জীবনপথে ঘুরতে ঘুরতে দেশ পত্রিকার দফতরে তাঁকে পেলুম একেবারে অন্য ভাবে। এর আগে তিনি অনেক লিখেছেন। সে সব লেখা সোশ্যাল স্যাটায়ার। যার সঙ্গে অনেক তাবড় তাবড় ইংরেজ লেখকের তুলনা করা যায়। সেই সব লেখায় মজার কোনও গল্প থাকত না, থাকত আঘাত। কায়দাটি খুব সুন্দর। এক একটি কথাকে ধরে ধুনুরির কায়দায় তুলোধোনা করা। দেশ পত্রিকায় তখন তিনি লিখছেন, ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’। কী সুন্দর নাম। এটিকে বলা যেতে পারে তাঁর আত্মজীবনী। একটি কথা এখানে বলা উচিত, তিনি ছিলেন অতি অভিজ্ঞ, অতি সুদক্ষ এক সারথি। নিজের রথ কী ভাবে কোন কায়দায় চালাতে হবে তা তিনি জানতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর কোনও উচ্চ অ্যাম্বিশন ছিল না বলে। জীবনদর্শন ছিল এই রকম কয়েক দিনের জন্য এসেছি, আনন্দ করতে করতে চলে যাব। এই আনন্দটাও ছিল রিবাউন্স করা। তোমাদের আনন্দ আমার আনন্দ। তোমাদের সঙ্গে খানিক মজা করব। জীবন নিংড়ে এমন কোনও লেখা বের করতে চাই না যার মধ্যে কোনও ইজম আছে। অথচ একসময়, জীবনের প্রথম দিকে তিনি রাজনীতি ঘেঁষা অবশ্যই ছিলেন। ঈশ্বর-পৃথিবীর ভালবাসা-র শুরুটাই করেছেন এইভাবে “প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয় নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতো লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকী কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতে জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি। অবশ্য মহাকাল কারও কারও প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শরত্চন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।” এই দুটি প্যারা পড়লে বোঝা যায় গদ্যের ওপর তাঁর বাঁধুনিটা কত মজবুত ছিল। এই আত্মজীবনীতেই দেখতে পাওয়া যাবে সব লেখকই যে যে দুস্তর বাঁধা অতিক্রম করেন তাঁকেও তা করতে হয়েছে। যেমন, জীবনের প্রথম দিকে প্রবাসীতে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। এবার নিজেই লিখছেন, দিন কতক বাদে লেখাটা ফেরত এল। সঙ্গে চারুদার এক চিরকুট। এই হলেন শিবরাম। চারুদার চিরকুট। শব্দ যেন তাঁর সঙ্গে খেলা করত। চিঠির বক্তব্য, কবিতাটি মন্দ হয়নি কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উত্সাহ দিতে চাই না। সম্পাদক উপদেশ দিয়েছিলেন, এই বয়সে লেখাপড়া করে মানুষ হও আগে। তারপর না হয় লিখো। সঙ্গীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভিতরে থাকলে তা আটকানো যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকেই তা প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবে অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনও দরকার নেই। শিবরাম লিখছেন, কথাগুলো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়েছিল অনেক দিন। এই সময় একদিন দেশ পত্রিকার অফিসে একজন লেখক এসে জানালেন, সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর ফুটপাথে শিবরামবাবু চিত হয়ে শুয়ে আছেন। সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাগরদা আমাকে ডেকে বললেন, ওর তো আজ লেখা দিতে আসার কথা। ফুটপাথে শুয়ে আছে কেন! দেখে এসো তো। আমি গিয়ে দেখি, ‘চাংওয়া’র সামনে তিনি আরামে শুয়ে আছেন। একটা হাত কপালে, আর একটা হাত সিল্কের পাঞ্জাবির পকেটে। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে। পকেট থেকে তেলেভাজা বের করে মাঝে মাঝে মুখে দিচ্ছেন। এই বার আমি গিয়ে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলুম, এইখানে এইভাবে শুয়ে আছেন কেন! আমাকে নিচু হতে ইশারা করলেন। ফিসফিস করে বললেন, চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে কোঁচা জড়িয়ে পড়ে গেছি। একটা ধেড়ে মানুষের পড়ে যাওয়াটা লজ্জার, না শুয়ে থাকাটা লজ্জার! আমি বললুম, এর উত্তর দেবেন সাগরদা। আপনি এখন উঠুন। সিল্কের পাঞ্জাবির পিছনে ধুলো। মাথার পেছনে ধুলো। আমি ঝাড়ার চেষ্টা করতেই বললেন, তুমি কিছুই জান না। এক সময় কলকাতার বাবুরা ভোরবেলায় খানা থেকে উঠে প্রাসাদে প্রবেশ করত। পাঞ্জাবির পেছনে ধুলো এটা একটা অ্যারিস্টোক্রেসি। একদিন মুক্তারামবাবুতে গেছি। একটা সভায় যাওয়ার কথা। আমাকে বললেন, আমার এই তক্তাপোশে পা তুলে বসো। কারণ এর তলায় কী কী জন্তু জানোয়ার আছে তা আমি জানি না। ঘাঁটাইনি কোনও দিন। সাপও থাকতে পারে। আমি আমার ড্রেসিং রুম থেকে আসছি। জিজ্ঞেস করলুম সেটা কোথায়? বললেন, ওই যে রাস্তার ওপারে যে লন্ড্রিটা রয়েছে ওইটা। আমি ওখানে গিয়ে আমার এই ধুতি আর পাঞ্জাবিটা ছেড়ে দেব। আর যেটা কেচে এসেছে সেটা পরে চলে আসব। দুটো সেট। কোনও ঝামেলা নেই। বাক্সপ্যাঁটরা নেই। বুঝলে, একেই বলে আপনি আর কোপনি। জীবনটাকে হালকা করো। রেল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেছ? ট্রাভেল লাইট। হাসির লেখার একটা অ্যানাটমি আছে। প্রথম কথা, ‘হাসির লেখা’ এই চিহ্নিত কথাটা আমার ভাল লাগে না। শ্রদ্ধেয় বিমলদা আমাকে বলেছিলেন, শোন! লেখা হাসিরও নয়, কান্নারও নয়। লেখা হল লেখা। তবে মজার লেখা উপভোগ্য লেখার একটা গঠন আছে। চরিত্রকেন্দ্রিক। শিবরামবাবুর লেখায় আমরা সেই সব চরিত্রদের পাই। যেমন হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন, পিসিলা, জহর ইত্যাদি। এই চরিত্রদের তিনি খেলিয়েছেন। গল্প অনেক ক্ষেত্রেই সামান্য। রস তৈরি হয়েছে কথার পিঠে কথা আর সিচ্যুয়েশনের মাধ্যমে। কত নাম করব। গন্ধচুরির মামলা, খোলাখুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনও দিন তাঁকে দেখিনি নিজের লেখা, বই আর প্রাপ্যের হিসাব রাখতে। সংস্কারটা যে ছিল জমিদারের আর ত্যাগীর। সেই জন্যই বইটির নাম প্রথমে ঈশ্বর, তারপর পৃথিবী এবং সব শেষে ভালবাসা। এই মানুষটিকে আমরা চিরকাল ভালবাসতে বাধ্য।’

১২.
শিবরাম চক্রবর্তীর স্মৃতিকথা 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা' গ্রন্থ থেকে ‘কেন লিখি’ রচনাটি পাঠ করা যেতে পারে। শিবরাম চক্রবর্তী লিখছেন, ‘… প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয়- নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতন লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতেই জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।… অবশ্য মহাকাল কারো কারো প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন, মানিক বন্দ্যো, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন। আর, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। কালের স্থূল হস্তাবলেপ তাঁর গায়ে লাগেনি। প্রতিভার নবনবোন্মেষে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত। নিত্য নব ভাষাভঙ্গি, নব নব ভাবের উদ্ভাবনায় বিভিন্ন শৈলীর শৈলশিখরে স্বচ্ছন্দ বিচরণে বাঁকে বাঁকে অবাক করা, নিতুই নব তিনি। হিমালয়ের মতই চিরন্তনরূপে সর্বকালীন বলে মনে হয় তাঁকে। চিরদিনের অপরূপের। কিন্তু ওই মনে হওয়াটাই। যথার্থ বললে হিমালয়ও কিছু চিরকালের নয়। কালস্রোতে সেও ক্ষয় পায়। ভেসে যায়। তাহলেও এই মনে হওয়াটাই অনেক। ক্ষণস্থায়ীদের ঝরতি পড়তির ভিড়ে এই দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্বটুকু বিস্তর। অমরত্বের ভ্রম জন্মায়। তাই কি কম? তবে সত্যিকার সর্বকালীন লেখা কি নেই? আছে। সেটা বিধাতার নিজের রচনায়। যদিও তা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে বদলে যায়, তবু তাঁর হাতের স্বাক্ষরে এক চিরকালের আদল বজায় থাকে। আর আছে তাঁর উচ্চারণায় - যা চারিধারে তিনি চারিয়ে দেন তাঁর প্রতিভূদের প্রতিধ্বনিতে। বেদ উপনিষদ গীতা চণ্ডী বাইবেল কোরআন্‌ কথামৃত - সেই জাতীয়। তা-ই কেবলমাত্র কালজয়ী। সর্বদাই আনকোরা, সর্বকালের মানুষ তার মধ্যে চিরদিনের জিনিষ খুঁজে পায় - চিরকালের প্রেরণা। তা বাদে আর সব লেখাই কালক্ষয়ী, কালক্ষয় করার জন্যে লেখা এবং পড়া। কালের সাথে সাথে ক্ষয় পাবার। সত্যিকারের হচ্ছে এই কালস্রোত। নদীর জলধারার মতই চিরন্তন, নিত্য নূতন। বহতা নদীর ধারে আমার কালজয়ী তাজমহল গড়ে তুললাম, অভ্রংলিহ সেই কীর্তিস্তম্ভ দাঁড়ালো বটে সগৌরবে, কিন্তু নদীর পথ পালটালো, নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেও অন্য ধারা ধরলো সে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জলপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদলেরও মতিগতি পালটে গেল, ভাব-ভাবনা হয়ে গেল আরেক ধারায়। বহতা নদীর তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুদুরপরাহত বহুকীর্তিত সেই কীর্তিমন্দির কারো কারো কাছে তখনো হয়ত পরিক্রমণীয় তীর্থ হলেও, নিজের দুর্বহতার বোঝা নিয়ে আর সবার কাছেই তখন তা যত্নসাপেক্ষ প্রত্ন-গবেষণার; একদা মিউজমহল কৌতূহলী সকলের কাছে তখন মিউজিয়ম হল্‌ ছাড়া কিছু নয়। আমার ধারণায়, আমাদের কারো কোনো লেখাই কখনই কালজয়ী হয় না। হতে পারে না সব লেখকই ক্ষণকালজয়ী - যদি না হয়। রূপের মতন সেই মুহূর্তের চোখ আর মন ভোলাতে পারলেই ঢের। তাহলেই সে সার্থক। পরমুহূর্তেই আবার নতুন রুপোদ্গমে নব বসন্তের নতুন মধুপদের আসর জমজমাট। পুরানো রূপসীর দিকে তাকাবার কারো ফুরসৎ কোথায়? আমি নিজের কথা বলতে পারি, আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি, এমনকি বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাতেও নয়। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা, না, হয় করতে নয়, তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি। ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পড়বে, একটু বেলা হলে, বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়। সেই একটুক্ষণ তাদের একটুখানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুশি। কিন্তু গোড়াতেই যেকথা বলেছি, ক্ষণজীবীই হোন আর দীর্ঘজীবীই হোন, খোদা কাউকে কখনো পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না, স্বেচ্ছায় না সরলে সরিয়ে নেন - শেষ খোদকারি সেই তাঁরই। পথচারীদের জন্যে সর্বদাই পথ সাফ রাখতে হয়, ট্রাফিক যেন জাম্‌তলায় না জমে। এক জায়গায় এসে দাঁড়ি টানতেই হয়। আর সবার পক্ষে দেহরক্ষার পর হলেও লেখকের বেলায় তার ঢের আগেই। বলবার কথা ফুরিয়ে গেলেই তার কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না আর। আমার নিজের কথা যদি বলি, আমার কী বলার ছিল আমি নিজেই জানি না। এতদিন ধরে কত কথাই বলেছি, বেশির ভাগই তার আজেবাজে আর হাসির কথাই, নিতান্তই টাকার জন্য, বাঁচার তাগাদায় লেখা - কিন্তু আর না। ... রূপোর ঝিনুক মুখে নিয়ে জন্মাইনি ঠিকই; আর, যদি জন্মাতুমও, তাহলেও ঝিনুকের থেকে মুক্ত হতে আমার দেরি হত না। অল্প বয়সেই আমি বুঝেছিলুম মুখ মোটেই ঝিনুকের জন্যে নয়; আর রূপো না, মুখের সম্মুখে যদি কিছু রাখতেই হয় তো সে হচ্ছে রূপ। ঝিনুকের থেকে মুক্তি পাবার পরেই সে মুক্ত! সেই নব নব রূপে অপরূপ মুক্তি। আর এই রূপই হল আমার অভিশাপ। এই রূপের জন্যেই জীবনে আমার কিছু হল না এবং যা কিছু হল তা হয়ত ওর জন্যেই হল। এই অনির্বচনীয়ের স্বাদ বাল্যকালেই আমি পেয়েছিলাম আর তার টানে সেই অতি কৈশোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির থেকে স্বাধীনতার সাথে শুধু কেবল বহুবিচিত্র রূপের আস্বাদে। মুক্তির রূপ আর রূপের মুক্তি এক হয়ে মিশে গেছে আমার জীবনে। এই কারণেই আয়াসসাধ্য কোনো সাধনা আমার দ্বারা হল না, সাধনালব্ধ কোনো সিদ্ধিও নয়। এমন কি, লিখে লিখে জীবনটা কাটলেও লেখকের মত লেখক আমি হতে পারলাম না কোনোদিনই। লেখক হতে হলে যে উদয়াস্ত পরিশ্রম বা নিদারুণ পড়াশোনা বা যে দুনির্বার দুঃখ ভোগ করতে হয় তা আমার কুষ্ঠিতে কই? লেখক হতে চাইওনি বোধ হয় আমি। লিখতেও ভালও লাগে না আমার। প্রেরণার বশে নয়, প্রাণের দায়েই, আর কিছু না হতে পেরেই অগত্যা আমার এই লেখক হওয়া - সাংবাদিক হতে গিয়েই লেখক। ঘরকুনো হয়ে ঘাড় গুঁজে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেখক হবার কোনোদিনই আমার সাধ ছিল না, পাঠক হতেই চেয়েছিলাম বরং...। ...গো অর্থে পৃথিবী, গো আবার মাতাও। শ্রীকৃষ্ণের গোদোহনের অর্থ হচ্ছে এই পৃথিবীকে দোহন করা। পার্থিব জগত থেকে অপার্থিব রস আহরণ। তিনি এই দোহনবৃত্তির ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন আমাদের...।’

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক দেশ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত