প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কল্যাণ দার্শনিক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:০২

১.
ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্রপথিক, উপমহাদেশের প্রথিতযশা দার্শনিক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইদুর রহমান। এদেশে ‘কল্যাণ দর্শন’–এর জনক অধ্যাপক সাইদুর রহমান ১৯৮৭ সালের ২৮ আগস্ট ঢাকার নিজ বাসভবন ‘সংশয়’-এ মৃত্যুবরণ করেন। অসামান্য মেধাবী মানবিক এই ব্যক্তিত্বের, মহান এই মনীষার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯০৯ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন, তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির, সংশয়ের অবসান হয়েছে সম্প্রতি। কল্যাণ দার্শনিক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ, আমার প্রিয়জন, বিশ্বস্ত ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু গবেষক মাহমুদের কাছে নিশ্চিত হলাম যে, মানব কল্যাণ দার্শনিক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের প্রকৃত জন্মদিন বা তারিখ ১৯০৯ সালের ১৫ মে নয়, সঠিক ১ মে। ইতিহাসের নিরন্তর সত্যান্বেষী মাহমুদের (Mohammed Mahmuduzzaman) প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতা, অশেষ ধন্যবাদ। এ দেশের মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী চিন্তাবিদদের মধ্যে যারা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার অগ্রপথিক হিসেবে অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে অধ্যাপক সাইদুর রহমান এক স্মরণীয় নাম। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি রাজশাহী কলেজ, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন।

২.
বাংলাদেশে দর্শনচর্চার ইতিহাসে সাইদুর রহমানের দর্শন ‘কল্যাণ দর্শন’ নামে পরিচিত। কল্যাণ দর্শনের রূপরেখা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে: ‘জীবনসংগ্রামের লক্ষ্য হবে নবীন পরিবেশ সৃষ্টি এবং তাতে সামষ্টিক কল্যাণ গুরুত্ব পাবে, অবসান হবে শোষণ-বঞ্চনা-অন্ধকুসংস্কারের। কল্যাণ দর্শন হচ্ছে প্রগতির দর্শন। এ দর্শনের অবকাঠামোতে সমাজ গঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরার্থপর মানসিকতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা।’ নিতান্ত সহজ-সরল জীবনযাপনকারী এবং মানবদরদী সাইদুর রহমান দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অধ্যাপনা এবং সমাজসেবা করেন। সাইদুর রহমান স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি তাঁর নিজ বাড়িতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ছোট একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছিলেন। সাইদুর রহমানের একমাত্র গ্রন্থের নাম এ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ইসলামিক কালচার অ্যান্ড ফিলোসফি এবং বিখ্যাত প্রবন্ধসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অবস্থা বনাম ব্যবস্থা’, ‘প্রগতির দর্শন’, ‘সংশয়’, ‘পরার্থপরতার মানসিকতা’ ইত্যাদি।

৩.
আজ বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মীয় উগ্রবাদ এক ভয়ানক তাণ্ডবলীলা শুরু করেছে। দেশজুড়ে ধারাবাহিক বোমা হামলা এবং বিভিন্ন নাশকতামূলক তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশবাসী এ উগ্রবাদের বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষ করছে। অন্ধকারের এই শক্তি এখন গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই উচ্ছেদ করতে উদ্যত হয়েছে। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের অর্জন ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, নারীমুক্তির চেতনা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আজ এ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে। ধর্মীয় উগ্রবাদের এ ভয়াবহ আক্রমণের এ বাস্তবতায় অধ্যাপক সাইদুর রহমানের চিন্তাধারা উগ্রবাদ মোকাবেলায় যথেষ্ট শক্তি জোগাতে পারে। আপাদমস্তক আধুনিক মানুষটি মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যথিতও ছিলেন। তিনি তার লেখায় মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘মুসলমানরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের অনুসন্ধিসাকে আত্মস্থ করেনি, অন্তরের সুপ্ত জীবন-জিজ্ঞাসাকে জাগাতে দেয়নি। ফলে তারা পরিণত হয়েছে দৃষ্টিহীন, যুক্তিহীন প্রতিক্রিয়াশীলে। পৃথিবীর দেশে দেশে তারা আজ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দারিদ্র্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত, আত্মকলহে লিপ্ত, উন্নতিবিমুখ, আলস্য পরায়ণ, গণতন্ত্রবিহীন, সম্ভাবনাহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে।’

৪.
যে কাজ ও জীবনদৃষ্টি অধ্যাপক সাইদুর রহমানকে গতানুগতিক শিক্ষকতার বা ছাপোষা পেশাজীবীর স্তর থেকে বিশেষভাবে আলাদা করেছে সেটা তার শতভাগ সংস্কারমুক্ত মন। তিনি তাঁর সমসাময়িক সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিরুদ্ধে আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। সে কাজই তাকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। সাইদুর রহমানের পেশাগত জীবনের বিশেষ গৌরবের দিক হলো তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপক থাকাকালে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে সাইদুর রহমানের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু’র ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও তাঁর নানা স্মৃতি উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর অধ্যাপক সাইদুর রহমান তাঁর প্রিয় ছাত্রকে নিয়ে স্মৃতিকথাও লিখেছেন। তিনি সেখানে একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করতে ভোলেননি। সেটি আমাদের জানা জরুরি বলেই মনে করি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব যখন রাষ্ট্রপতি তখন সাইদুর রহমান তার প্রিয় ছাত্র মুজিবের কাছে যেতেন। আবার কখনো রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব গাড়ি পাঠিয়ে সাইদুর রহমানকে তার অফিসে নিয়ে এসে দেশের সমস্যা নিয়ে মতবিনিময় করতেন। সেরকম আলাপচারিতারই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে। শেখ মুজিব একদিন তার জাতীয় পরিষদ ভবনের অফিসে ডেকে নিয়ে আসেন সাইদুর রহমানকে। তখন দেশের অফিস আদালতে ঘুষ খাওয়ার হিড়িক দেখে বিরক্ত শেখ মুজিব সাইদুর রহমানকে বলেন, ‘স্যার, শুনে অবাক হবেন যে, হাইকোর্টের জজও এর ঊর্ধ্বে নন।’ তখন প্রশাসন ও সমাজ জীবনে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, খাইখাই ভাব ও চাটার দলের দৌরাত্ম্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাইদুর রহমানের অনেক কথা হয়। কথার এক পর্যায়ে শেখ মুজিব আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্যার মনে আছে একবার আপনার কাছে একশটি ভালো মানুষের তালিকা চেয়েছিলাম। আপনি আমাকে ভালো মানুষের সেই তালিকা কিন্তু আজও দিতে পারেননি।’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে রাজনীতি, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে ভালো এবং মেধাবী মানুষের বিকল্প নেই। সেই সৎ মানুষের খোঁজে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় শিক্ষকেরই শরণাপন্ন হয়েছিলেন। 

৫.
তৎকালীন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অবিজ্ঞানমনস্কতায় যারপর নাই উদ্বিগ্ন ছিলেন সাইদুর রহমান। তাই তার পরামর্শ, ‘...বিজ্ঞান, দর্শন এবং পৃথিবীর প্রগতিবাদী ধারার সঙ্গে সংগতি স্থাপন করে বাঙালি মুসলমানদের এখন অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা করতে পারলে এ জাতি উন্নত সমাজ ও ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে অবশ্যই সক্ষম হবে।’ আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়নের পর তিনি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক চার্বাক (প্রাচীন ভারতের একদল নিরিশ্বরবাদী লোককে ‘চার্বাক’ বলা হত) হয়ে ওঠেন। বুঝতে পারেন জগতের দৃশ্য-অদৃশ্য ক্ষয়, লয় ও পরিবর্তনের পেছনে আদিভৌতিক কোনো সত্তার (সৃষ্টিকর্তার) হাত নেই। সাইদুর রহমানের আরেক পরিচয় তিনি সংশয়বাদী বা সোফিস্ট। গ্রিক দর্শনের আদিযুগের এই সোফিস্টরা সৃষ্টিকর্তা আছেন কি নেই, এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করতেন। অধ্যাপক সাইদুর রহমান মনে করতেন, ‘সন্ন্যাসীপনা কিংবা যাপিত জীবনের প্রতি উদাস দৃষ্টিভঙ্গি ও মৃত্যু-পরবর্তী কাল্পনিক অমর জীবন সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাস এবং সে মোতাবেক আচরণ জীবনকে পার্থিব দুনিয়ায় অর্থহীন করে তোলে। যদি সুখের সন্ধান পেতে হয় বা মনুষ্য জীবনের পূর্ণতা লাভ করতে হয় তাহলে দেহে প্রাণ থাকতেই তা করতে হবে।’

৬.
ড. মো. আনোয়ার হোসেন ‘অনন্ত, আমরা চুপ থাকব না’ রচনায় অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে স্মরণ করছেন এভাবে, ‘এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগের সমাজটি কেমন ছিল? ফার্মগেটের কাছে একটি বাড়ির নাম মনে পড়ল। ‘সংশয়’ নামের এ বাড়ির মালিক সাইদুর রহমান আস্তিক নন। তাঁর সম্পর্কে নানা কথা শুনি। জগন্নাথ কলেজের এই আলোকিত অধ্যক্ষকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বললেন কলেজ ক্যাম্পাসে একটা মসজিদ বানাতে। উত্তরে সাইদুর রহমান বিনয়ের সঙ্গে জানালেন: ‘‘যে পূণ্যবানেরা এই শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা তো এখানে মন্দির বানাননি। আমি তাদের দান করা এই জায়গাতে মসজিদ বানাতে পারব না।’’ ইসলাম ধর্মে যার গভীর নিষ্ঠা, সেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের যুক্তি এক বাক্যে মেনে নিলেন। ‘সংশয়’ নামের বাড়িতে কখনও ঢিল পড়েনি, কেউ কালির পোঁচে ঢেকে দেয়নি নামফলকটি। ড. আহমেদ শরীফও আস্তিক ছিলেন না। ধর্ম তাঁর ছিল। তা মানবধর্ম। তার জন্য তাঁর প্রাতঃভ্রমণে কেউ বিঘ্ন ঘটায়নি। জীবননাশ তো নয়ই।’

৭.
অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ইহজাগতিক ও মানবতাবাদী দর্শনের অপর এক প্রবক্তা ছিলেন অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান (জন্ম : ১ মে, ১৯০৯- প্রয়াণ: ২৮ আগস্ট, ১৯৮৭)। দর্শনের জীবনমুখী ও মানবতাবাদী বাণীকে মুক্তবুদ্ধির আলোকে দেখা এবং নির্ভীক চিত্তে তা প্রকাশ, প্রচার ও মানবকল্যাণে প্রয়োগ করার জন্য তিনি অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল যাবৎ তিনি এ সত্যই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে, দর্শন শুধু তত্ত্ব নয়, উন্নত জীবনের দাবি এবং তাকে জীবনে বাস্তবায়ন করাই দার্শনিকের মুখ্য উদ্দেশ্য। জীবন-সংগ্রামের লক্ষ্য মানবকল্যাণকর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার হবে অবসান, বিলুপ্ত হবে অন্ধ কুসংস্কারের অনুশাসন। বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের সাধনা হবে এরূপ একটি পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক, যা থেকে কল্যাণসাধনের মানসিকতা জন্মলাভ করবে। প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করে নতুন মানবকল্যাণকর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে দর্শন। বিশ্বে মানুষ নিষ্ক্রিয় দর্শক নয়, বরং সতত ক্রিয়াশীল। মানুষের চেষ্টায়ই রূপান্তর ঘটেছে জগতের ঘটনা-প্রবাহের। যথার্থ দর্শনের জন্য প্রয়োজন কল্যাণচিন্তা ও বিশ্বমানবতার কল্যাণসাধনের মানসিকতা। বস্ত্তত, দর্শন বলতে সাইদুর রহমান বুঝেছেন এ কল্যাণধর্মকেই এবং এর নাম দিয়েছেন ‘কল্যাণ দর্শন’। পারলৌকিক ধর্মসাধনার চেয়ে তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন ঐহিক কর্মানুষ্ঠান ও বিজ্ঞানসাধনার প্রতি; ভক্তির চেয়ে তিনি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন যুক্তির প্রতি। তাইতো তাঁর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা: প্রগতির জন্য তপস্যা নয়, চাই কর্ম, চাই স্বাধীন ও সংস্কারমুক্ত মন, চাই ত্যাগ ও মানবকল্যাণের মানসিকতা।’

৮.
শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, সমাজসেবক সাইদুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের রসুলাবাদ গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তিনি তৎকালীন অবিভক্ত ভারতে মেধা তালিকায় স্থান অর্জন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক সম্মান (১৯৩১) ও এমএ (১৯৩২) উভয় পরীক্ষায় তিনি অসাধারণ ফলাফল অর্জন করেন। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরপরই তিনি রাজশাহী কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পেশাগত জীবনে সাইদুর রহমান বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতার বিখ্যাত বেকার হোস্টেলের সুপার, চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর অব স্কুলস, শিক্ষা বিভাগের স্পেসাল ইন্সপেক্টর অব এডুকেশন, স্পেসাল অফিসার ইন এডুকেশন ইত্যাদি পদে দায়িত্ব পালনে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। সাইদুর রহমান ১৯৫৭ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে বিলেত যান এবং ‘অরগ্যানাইজেশন এন্ড এডমিনিস্ট্রেশন এন্ড ফারদার এডুকেশন’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৩ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে কলেজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন। কলেজে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া সহশিক্ষার ব্যবস্থা তিনি পুনরায় চালু করেন। বিশাল কলেজের বিপুল সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল কর্মকান্ডকে যুবসমাজ ও দেশবাসীর মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি কলেজ বার্তা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর আমলেই এ কলেজে দুই শিফটে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয় এবং নৈশকালীন বি.এসসি কোর্স চালু হয়। এছাড়া তিনি ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন গার্লস কলেজসহ দেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

৯.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাইদুর রহমান ১৯৭২ সালের ৩ মে থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানী বাবদ প্রাপ্ত তাঁর সমুদয় অর্থ দিয়ে ১৯৭৫ সালে ‘সাইদুর রহমান ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়। ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন অনুষদের মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, মানবকল্যাণ, মানুষ ও পরিবেশ, বিজ্ঞানের দার্শনিক দিক ইত্যাদি বিষয়ে বক্তৃতামালার আয়োজন করা। এই বক্তৃতামালা প্রথম শুরু হয় ১৯৭৮ সালে এবং বর্তমানেও তা প্রায় নিয়মিত চলছে। এখানে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন বিষয়ে মননশীল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও বক্তৃতা প্রদান করেন। সাইদুর রহমান নারীশিক্ষা ও নারীর উন্নয়নে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঢাকায় তেজগাঁও মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত উক্ত কলেজের অবৈতনিক অধ্যক্ষ ছিলেন। সাইদুর রহমান বাংলাদেশ দর্শন সমিতি র একজন সক্রিয় সংগঠক ছিলেন এবং সমিতির জন্মলগ্ন (১৯৭৩) থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেসেরও একজন সক্রিয় সংগঠক ও সদস্য ছিলেন।

১০.
ছাত্রজীবন থেকেই সাইদুর রহমান মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সকল প্রকার গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তাঁর অবিচল আস্থা ছিল মার্কসের সমাজতন্ত্রে। মানবকল্যাণের সহায়ক শক্তি হিসেবে তিনি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, প্রগতি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করা এবং তাঁর প্রগতিশীল কর্মকান্ডের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে মওলানা ভাসানীর ‘এ্যান্টি স্টেট ব্রেইন ট্রাস্ট’ মনে করত। একারণে তৎকালীন সরকার তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করে এবং ছাত্রছাত্রীদের সাহচর্য থেকে দূরে রাখার জন্য তাঁকে এক পর্যায়ে ডি.পি.আই অফিসে অরফেনেজ অফিসার হিসেবে বদলি করে দেয়। এ পদে যোগদান করার ফলে বরং তাঁর পক্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার করার সুযোগ ঘটে। তিনি বিভিন্ন এতিমখানা পরিদর্শন করে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি নিউ স্কিমের মাদ্রাসাসমূহকে মাধ্যমিক স্কুলে রূপান্তরিত এবং তাতে বাধ্যতামূলকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা ও মেয়েদের ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন।

১১.
শিক্ষানুরাগী ও সমাজকর্মী অধ্যাপক সাইদুর রহমান তার সুদীর্ঘ জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, কলকাতার ভয়াল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানের জন্ম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা তার বিবেক ও বোধকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন রচনায় এসবের উদাহরণ পাওয়া গেছে। শৈশবে পবিত্র কোরআন শরীফ পুরো মুখস্থ এবং কর্মজীবনে ইসলামী দর্শন বিষয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনা সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল মতামতের জন্য তার সমালোচকরা তাকে নাস্তিক ও কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠীর কাছে তাকে নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বৈরাচারী গভর্নর মোনায়েম খানের সঙ্গে মতদ্বৈধতায় তিনি জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।

১২.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ সরদার ফজলুল করিমসহ অনেকের লেখাতেই অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে, তাঁর কল্যাণ ভাবনার স্বরূপ তথা ‘কল্যাণ দর্শন’কে পাই। আরজ আলী মাতুব্বরের সাথে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের গভীর সখ্যতার নানা প্রমাণ মেলে তাঁদের দুজনারই লেখাতে। অনমনীয়, প্রবল বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আরজ আলী মতুব্বর সম্পর্কে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান বলেছিলেন “আরজ আলী মতুব্বর জীবন জিজ্ঞাসার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাতে সক্ষম” । তিনি একদা কথায় বলেছিলেন “তিনি বিপুল পড়াশুনা করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেও সত্যের উপলব্ধির ক্ষেত্রে আরজ আলী মতুব্বরকে অতিক্রম করে যেতে পারেননি” । অধ্যাপক সাইদুর রহমান যেসব রাজনৈতিক নেতার সান্নিধ্যে এসেছিলেন তারা হলেন- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ প্রমুখ। এসব নেতাকেও তিনি তার চিন্তাধারা দিয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। আজ যখন আবারও চরম দক্ষিণপন্থা আর ধর্মীয় উগ্রবাদ সমাজ জীবনকে প্রভাবিত করছে, তখন আধুনিক মানুষের কাছে অধ্যাপক সাইদুর রহমান খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তার স্মৃতি চিরঅম্লান।

১৩.
তাঁর বাড়ির নাম ছিলো ‘সংশয়’। কেন ? তাঁর ‘কল্যাণ দর্শন’ বই (১৯৮৭) থেকে পাঠ করা যাক, `নাম দিয়ে মানুষের পরিচয় দেওয়া হয়, যদিও নাম কারো প্রকৃত পরিচয় নির্দেশ করে না। আবার কোনো কোনো সময় অন্য কোনো বিষয় বা বস্তুর নামে কোনো কোনো মানুষের পরিচয় দেওয়া হয়। যেমন ধরুন আমারই কথা। অনেক স্থানে আমার নামের চেয়ে আমি আমার বাড়ির নামেই বেশি পরিচিত। ‘সংশয়’ বললেই অনেকে আমাকে সহজেই চিনতে পারেন। তাই অনেকের কাছে আমার পরিচয়ের প্রতীক ‘সংশয়’ সম্বন্ধেই আমার বক্তব্য পেশ করব ভাবছি। আগেই বলেছি ‘সংশয়’ একটা বাড়ির নাম। কিন্তু একটা বাড়ির এমন নাম কেন হলো? বলছি। ‘সংশয়’ শব্দটা আমার খুবই প্রিয়। কিন্তু অনেকেই একে ভয় করেন। কেন, তা জানি না। আমি অবশ্য সংশয়কেই জীবনের অবলম্বন করে নিয়েছি এবং আমার জীবনের চলার পথে সংশয় আমাকে দিয়েছে উত্সাহ ও উদ্দীপনা। আমার সংশয় জিজ্ঞাসারই নামান্তর মাত্র। জীবনে কোনো জিজ্ঞাসা না থাকলে জীবন হয়ে পড়ে অর্থহীন ও স্থবির। সংশয় থাকলেই চিন্তা আসে ও চিন্তা করা যায়। সংশয় বা জিজ্ঞাসা না থাকলে অজানাকে জানবার ঔত্সুক্য জন্ম নেয় না। সত্যি কথা এই যে, সংশয়ই দর্শনের জনক। যে মানুষের কোনো সংশয় নেই, তার কোনো দর্শনও নেই।’ 

১৪.
সংশয়বাদ বা Skepticism আসলে কী ? দর্শনকোষে সরদার স্যার লিখছেন, ‘সংশয়বাদ হচ্ছে একটি দার্শনিক তত্ত্ব। বিশেষ করে জ্ঞানের প্রশ্নে প্রাচীন গ্রিসে এই তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। বিষয়ী বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়- এই হচ্ছে সংশয়বাদের মূল কথা। খ্রিষ্টপূর্ব চতূর্থ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিক সমাজ যখন সামাজিক অস্থিরতায় সংকটগ্রস্ত তখন প্রচলিত ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে সংশয় এবং অস্বীকারমূলক একটা মনোভাব জন্মলাভ করে। প্রাচীন সংশয়বাদের শক্তিশালি প্রকাশ ঘটে পিরহো, আরসেসিলাস, কারনিয়াডিস, ইনিসিডেমাস, সেক্সটাস এমপিরিকাস এবং অপরাপর দার্শনিকের মধ্যে। সফিস্টরা যখন প্রচলিত বিধিবিধান সম্পর্কে জনসাধারণের মনে প্রশ্নে উদ্রেক করেছিল তেমনি সংশয়বাদীগণ বলতে শুরু করে: জ্ঞানের প্রচলিত ধারণারই বা নিশ্চয়তা কি? জগৎ সম্পর্কে, বস্তু সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আছে বলে পন্ডিতগণ যে দাবি করেন তার কোনো ভিত্তি নেই। ব্যক্তি-নিরপেক্ষ কোনো জ্ঞান আছে বলে প্রমাণ করা যায় না। ব্যক্তির ইন্দ্রিয়সমূহের সুস্থতা, অসুস্থতা, ব্যক্তির অভাব অভিযোগ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, প্রচলিত বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আচার আচরণ দ্বারা ব্যক্তির জ্ঞান প্রভাবান্বিত হয়। অথচ জ্ঞান বলতে পন্ডিতগণ এমন কিছুকে বুঝাতে চান যা ব্যক্তির মন বা পরিপার্শ্ব, তার অবস্থা বা ইতিহাস কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু ব্যক্তি এবং অবস্থা নিরপেক্ষ যখন সম্ভব নয় তখন বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। প্রাচীন সংশয়বাদীগণ বলতেন যে, জ্ঞানে অতৃপ্তি এবং অসন্তোষের বৃদ্ধি। তাই মনের শান্তির জন্য শ্রেয় হচ্ছে কোনো কিছু সম্পকে কোনো সিদ্ধান্তমূলক অভিমত আদৌ গ্রহণ না করা। সংশয়বাদ মধ্যযুগেও গোঁড়া ধর্মীয় এবং দার্শনিক অভিমতসমূহের প্রভাব হ্রাসে বিশেষ সাহায্য করেছে। মধ্যযুগে প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সংশয়বাদী চিন্তা বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশকে সহজতর করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে হিউম এবং কান্ট সংশয়বাদের যে তত্ত্ব প্রচার করেন তাতে জ্ঞান কেবলমাত্র সত্তার বাহ্য প্রকাশে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কান্টের দর্শনে সত্তার যথার্থ জ্ঞান অতীন্দ্রিয় বোধ বা ধর্মীয় অনুভূতির মাধ্যমেই মাত্র লাভ করা চলে।’

১৫.
ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্রপথিক অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ইহজাগতিকতা বা Secularism বলতে কি বুঝতেন ? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আবারো সরদার স্যারের স্মরণাগত হই। দর্শনকোষে লিখছেন, `আমাদের ধর্মীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সেক্যুলারিজম’ কে ধর্মহীন, ধর্মশূণ্য ইতাদি বলে চিন্তা করার ধারণাটিই প্রবল। আসলে কথাটির উদ্ভব ও আলোচনার ক্ষেত্র ছিল ইউরোপের মধ্যযুগ। একদিকে খ্রিষ্টধর্ম তথা পোপের আধিপত্য, অপরদিকে জাগতিক, রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ জাগতিক শাসনের উপর জোর দেওয়াটাই ছিল ‘সেকুলার’ শব্দের দ্বন্ধের ক্ষেত্র। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় দাঙ্গা, হাঙ্গামা, গণহত্যার প্রভৃতির ক্ষেত্রে কাউকে সেক্যুলারিস্ট বলে তাকে অধার্মিক এমনকি নাসিত্ক বলে তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিকূল ও বৈরী মনোভাব তৈরির প্রবণতা দেখা যায়। কোনো আবেগের বশবর্তী না হয়ে সেক্যুলারিস্ট ইংরেজি শব্দের বাংলা হিসেবে ‘ইহজাগতিকতা’ ব্যবহার করা সঙ্গত। অনেকে এক্ষেত্রে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ শব্দকে ব্যবহার করতে চান। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিকে নিরীহ বলে বোধ হলেও তারও শেষ অর্থ দাঁড়ায় ধর্মে ধর্মে নিরপেক্ষতা তথা কোনো বিশেষ শাসক বা শক্তির কোনো ধর্মীয় মতামত বা বিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ পক্ষ অবলম্বন না করার কথা প্রচার করা। কিন্তু এরূপ ব্যাখ্যা অর্থহীন। বাস্তব সমাজ জীবনে নিরপেক্ষতার কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করা যায় না। ইউরোপে ম্যাকিয়াভেলির পর থেকে রাজনৈতিক তত্তইবিদ তথা হবস, লক, রুশো এবং পরবর্তীতে মার্কসবাদ সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব, প্রতিপত্তিকে অস্বীকার করতে চেয়েছে। সমাজ, জগৎ ও জীবনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমাত্রের সবকিছুর উর্ধ্বে এক অলৌকক শক্তির উপর বিশ্বাস থাকতে পারে। এরূপ বিশ্বাস বয়োঃপ্রাপ্ত ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। এজন্যই যুক্তিগতভাবে এরূপ কথা প্রচলিথ আছে : যার ধর্ম তার ধর্ম, কিংবা ‘তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, কোনো ধর্মেরই কোনো রাষ্ট্রগত ভূমিকা থাকতে পারে না কিংবা থাকা সঙ্গত নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন নাগরিকদের যৌথভাবে গৃহীত নীতি ও পদ্ধতির বিষয়। মূলকথা : রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ধর্মের ভালো মন্দ বলে কোনো নির্ধারক ভূমিকা নির্দিষ্ট করা সঙ্গত নয়।’

১৬.
বাংলাদেশে দর্শনচর্চার ইতিহাসে সাইদুর রহমানের দর্শন পাঠ নানা কারণে জরুরি । কারণ আমরা জানি, সাধারণ মানুষের তুলনায় দার্শনিকদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব অনেক বেশি। তারা সত্য ও সুন্দরের ধারক-বাহক হয়ে কৌতূহলী মনকে যুক্তির কষ্ঠিপাথরে যাচাই করতে ভালোবাসেন। যার কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে দর্শনের বিশাল ইমারত। জগৎ এবং জীবনকে ঘিরে যে সমস্ত অলঙ্ঘনীয় প্রশ্ন তার সন্তোষজনক উত্তর দানের চেষ্টা করেন তারা। বাঙালির দর্শন যে ধর্মকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত, সে ধর্ম পাশ্চাত্যের রিলিজিয়নমাত্র নয়। ধর্ম বলতে বাঙালি কেবল মোক্ষসাধনা কিংবা পরলোকচর্চাকে বোঝে নি, বুঝেছে সমগ্র জীবনচর্চাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বাঙালির ধর্ম বলতে সামাজিক কর্তব্যবোধ, রিলিজিয়ন, পলিটিক্স সবকিছুকেই বোঝায়। ঈশ্বর বলতেও আধুনিক বাঙালি জগৎ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কবিবর্জিত কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তাকে বোঝেনি, বুঝেছে সকল মানুষের মধ্যে যিনি স্বয়ং প্রকাশিত তাঁকে। মোট কথা, বাঙালির দার্শনিক চিন্তায় আবেগ ও বিশ্বাসের মাত্রা যাই থাক, সে আবেগ ও বিশ্বাসকে তাঁরা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছেন যুক্তি দিয়ে; ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনাকে তাঁরা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন একটা সুখি-সমৃদ্ধ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, রুটস, ‘কল্যাণ দর্শন’ : সাইদুর রহমান, দৈনিক সমকাল, দৈনিক জনকণ্ঠ, ইন্টরনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত