প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাজী নজরুল ইসলাম

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩২

১.
সাম্য ও মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের তূর্যবাদক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (২৯ আগস্ট, ১৯৭৬) আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরতরে অন্য ভুবনে পাড়ি জমান। যিনি বলেছিলেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।’ সত্যিই নিজেকে ভুলতে দেননি তিনি আপন সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে। প্রিয় কবির, ক্ষণজন্মা মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। সর্বকালদর্শী চিন্তন-বোধ-মননের হলেই কেবল এমন করে আপন ভাবনাকে বলে যাওয়া সম্ভব ! আর তাই আমাদের পক্ষে কী আর সম্ভব তার কর্মকে, সৃষ্টিকে ভুলে থাকা ? বলো তো কবি, কেমনে ভুলি তোমাকে আমরা ? তুমি যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগস্রষ্টা! সেই তোমাকে কী করে ভুলি বলো, যে তুমি বিস্ময়কর এক অনির্বাণ আলো হয়ে জ্বলছো নিত্য ! তুমি তো নিরন্তর নানা দু:সময়ে আশা আর স্বপ্নের পথ দেখিয়ে চলেছো বাঙালিকে, সেই তোমাকে কিভাবে ভুলি আমরা ? স্রষ্টা নজরুল, কবি নজরুল বেঁচে আছেন আমার মতোই এ দেশের সকল মানুষের মনে, হৃদয়ে। তিনি তাই শারীরিকভাবে অনুপস্থিত হলেও অমর চরিত্র। আর তাই নিজেদের জন্যই কবি নজরুলের স্মৃতিকে, তাঁর সাহিত্যকে আমাদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) ৭৭ বছর বয়সে কবি নজরুল মারা যান। যে দিনটিতে তিনি চলে গিয়েছিলেন সেদিন খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে হিসেবে তারিখ ছিল ২৯ আগস্ট। কিন্তু বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকার তারিখগুলো স্থির হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা ২৭ আগস্টকেই তাঁর মৃত্যুদিন হিসেবে মানি। আবারো প্রিয় বিদ্রোহী কবির স্মৃতির প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। উল্লেখ্য যে, চিরতারুণ্যের কবি নজরুল ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

২.
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। পরাধীন ব্রিটিশ আমলে সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: বাংলা বাঙালির হোক! বাংলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’মহান মুক্তিযুদ্ধে কবির গান ও কবিতা অনিঃশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর লেখনী থেকেই আমরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা পেয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

৩.
ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডারটিরও স্রষ্টা তিনি। অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালির চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করেছে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন তিনি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। জাত চেনাতে কবি নিজেই লিখেছিলেন,‘আমি চির বিদ্রোহী বীর,/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ তবে শুধু বিদ্রোহী বীর নন, তিনি ছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অপমানিতের মরম- বেদনা, বিষ-জ্বালা’নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের ভাবনা বিকশিত হয়েছিল সাহিত্যের সব ধারাতে। সঙ্গীত ভুবনেও তিনি উন্মুক্ত করেছেন একটি স্বতন্ত্র দুয়ার। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি সবর্দাই লড়েছেন অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে। পাশাপাশি সোচ্চার হয়েছে তার লেখনীও। বিভিন্ন সময় তিনি ছিলেন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সৈনিক। তার লেখায় ফুটে উঠেছিল বিদ্রোহী আত্মার প্রতিচ্ছবি। তাই তিনি বিশ্ব দরবারে ‘বিদ্রোহী’কবি বলে পরিচিত। আবার অসাম্প্রদায়িক এই কবিই লিখছেন, ‘যে জাত ধর্ম ঠুনকো এতো,/ আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,/ যাক না সে জাত জাহান্নাম,রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।/ জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া।’

৪.
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ভাবনার এক প্রধান অংশজুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা। স্মরণযোগ্য যে, সমগ্র আধুনিক বাংলাকাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি, যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। উভয় ঐতিহ্য থেকে অবলীলাক্রমে তিনি বিষয়, উপমা, রূপক, বাকভঙ্গি প্রভৃতি আহরণ করেছেন। তিনি একদিকে যেমন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কালীকীর্তন রচয়িতা (রাঙ্গাজবা, ১৯৩৬), তেমনি অন্যদিকে তিনি বাংলা ইসলামী গানের প্রবর্তক (জুলফিকার, ১৯৩২) এবং কাব্যে আমপারা (১৩৩৩), মরুভাস্কর (১৩৬৪) প্রভৃতির প্রণেতা। নজরুল মানসে হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে পরিপূরক হতে পেরেছে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার ফলে। নজরুলের মতোন চরম দু:সাহস নেই আমাদের যে নির্ভয়ে উচ্চারণ করি,
‘তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’
তাই নি:সংশয়ে বলা যায়, কবি নজরুল কোন বিশেষ দল কিংবা সমাজের ছিলেন, তা মোটেই নয়। কোন দেশ, কাল ও জাতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সকল কালের মানুষের গীতে মুখর তাঁর কাব্য। বাঙালির চিরকালের চেতনাকে সমুন্নত করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকল কালের, সকল জাতির কবি। বনের কুসুমের মতো, আকাশের পাখির মতো আপনি ফুটে উঠেছেন আপন স্বভাবে। আপনি গান গেয়েছেন মুক্তকণ্ঠে, আপন খেয়ালে। আর সে কারণেই হয়ে উঠেছেন সর্বদলীয় কবি। শুধু মুসলমান বা শুধু হিন্দুর কবি ছিলেন না, ছিলেন সকল ধর্মের, সকল গোত্রের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার স্মারক। নিজেই বলেছেন,‘ রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে যে, ‘আমার কণ্ঠে প্রলয় হুংকার একা আমার নয়, সে নিখিল আর্ত-পীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার।’ আবার এমনটাও বলেছেন, ‘ আমি লীগ কংগ্রেস কিছুই মানি না, মানি শুধু সত্যকে; মানি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বকে, মানি সর্বজনগণের মুক্তিকে।’ তাই দেখি ‘ বিদ্রোহী’র যে ‘আমি’ সেতো ‘বিশ্ব আমি’, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী। সারা বিশ্বের উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল থামানোর জন্যই আজীবন সংগ্রামমুখর ছিলেন। জগতের অনশনবন্দী, লাঞ্ছিত জনগণের ঘুম ভাঙ্গাতে আশা-অনুপ্রেরণায় বিশ্ববাসীকে উদ্দীপ্ত করতেই যেন তাঁর আবির্ভাব। গেয়েছেন সাম্যের গান। বুঝেছেন, মানুষের চেয়ে নয় কিছু গরীয়ান। লিখেছেনও তাই, ‘দীন দরিদ্র রবে না কেউ সমান হবে সর্বজন/ বিশ্ব হবে মহাভারত নিত্যপ্রেমের বৃন্দাবন।’ 

৫.
তিনি চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মুলত তিনি বিদ্রোহী কিন্তু তার প্রেমিক রুপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আয়নায়।’‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...।’এভাবেই অগ্রিম বিদায় নিয়েছিলেন চির অভিমানী কবি। বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে বিদ্রোহী বীর সাম্য প্রেম মানবতার কবি কান্ডারীকে থামতে হয়েছিল। তারিখটি ছিল ১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। কবির ভাষায়, ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ...।’ তাঁর আবির্ভাব ঝড়ের মতোই। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়।’ তবে তাঁর লেখা অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’র জন্যই তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর ওই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ঝড় বয়ে যায়। সে ঝড় বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে, সে ঝড় মানুষের চিন্তা-চেতনার মধ্যে। বলতে গেলে এই কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি নজরুল যেন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। কবিতাটি আলোড়ন তোলে বাংলা সাহিত্যের ধারায়। আবার, নজরুল বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীতের ইতিহাসে শুধু নয়, বাঙালীর রাজনৈতিক ইতিহাসেও অনন্য বিশিষ্টতার দাবিদার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের বিশিষ্টতার দাবি প্রতিষ্ঠা করে প্রধানত তার প্রথম পর্বের কবিতার মৌলিকতা এবং একটি দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক আবেগকে ধারণ, গদ্যে-পদ্যে, বিশেষত কবিতায়। নজরুল একমাত্র কবি যিনি প্রতিবাদী লেখার দরুন কারাবরণ করেছেন। বিদেশী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ ছিল একান্তই তার। প্রতিবাদী কণ্ঠ পৌঁছেছিল সারাদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের চিত্তে ও চেতনায়। তিনি মূলত কবি। বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, গণজাগরণের কবি, সংগ্রামী কবি, চেতনার কবি, শ্রমজীবী মানুষের কবি, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার প্রয়াসের কবি। ভারত স্বাধীনতার প্রথম প্রেরণার দানের কবি।আবার আপাদমস্তক এই সৃজনশীল মানুষটির এসেছেন যাঁরাই সংস্পর্শে, তাঁরাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন।নজরুল মানুষের মনে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন অদম্য আশার বাণী। 

৬.
সাম্য ও মানবতার চিরঞ্জীব কবি, তিনি প্রেমের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। কবি ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছেন, নারীর অধিকারকে করেছেন সমুন্নত। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সৃজনশীল কর্ম আমাদের অন্তহীন অনুপ্রেরণার উৎস। সেই নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় পন্ডিতকে। তাঁর গান আামদের দুস্তর পারাবার পেরিয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণদ্বারে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। কবির কাছে আমরা ঋণী। সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত, বিভেদমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এদেশের মানুষ লালন করে। নজরুলের কাছ থেকে আমরা এ চেতনাই লাভ করি। তাঁর সে সব কবিতা ও গান মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আজো তাঁর কবিতা ও গান আমাদেরকে শক্তি ও সাহস জোগায়। যেমনটি, ১৯৪২ সালে রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : এই পবিত্র বাংলাদেশ/ বাঙালির-আমাদের।/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়/ তাড়াব আমরা করি না ভয়/ যত পরদেশী দস্যু ডাকাত/ রামা-দের গামা-দের’। বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ কাজেই ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক বাঙালীর চিরকালীন জয়ধ্বনির উৎস নজরুলের চিরদ্রোহী কবিচিত্ত।

৭.
বাংলা কবিতায় নজরুলের আর্বিভাব একেবারেই উল্কার মত। বাংলা সাহিত্যে আর্বিভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে কিভাবে রাঙ্গিয়ে গেলেন অথবা উজ্জ্বল করে দিলেন তা নিয়ে এখনো গবেষনা হচ্ছে দেশ-বিদেশে। কোন সঞ্জীবনি মন্ত্রে তিনি উচ্চকন্ঠে বলতে পারেন ‘ বল বীর ,বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’। বাংলা সাহিত্যে যুগান্তরের শিল্পসম্ভার নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। কালের কল্লোলকে তিনি চিরকালের কবিতার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেন। এই বৈশিষ্ট্য যেমন তার কবিতার মৌলিক প্রান্ত, তেমনি বাংলাদেশের সমাজ মানস ও শিল্পসাধনার আবহমান প্রেরণাসূত্র। আমরা জানি, উত্তুঙ্গ দ্রোহ ও আশাবাদ, দেশপ্রেম, সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, গণমানুষের মুক্তি কামনা প্রভৃতি নজরুল-কাব্যের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য। বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবতা ও সাম্যের চেতনায় তাঁর ক্ষূরধার লেখনীর মাধ্যমে সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। শোষণের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম তাঁকে ‘বিদ্রোহী কবি’রও খ্যাতি দিয়েছে। তার মানবতাবাদী চেতনা আজও আমাদের প্রেরণা যোগায় এবং তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম আমাদের চিরকাল স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত করে । কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক।

৮.
ক্ষণজন্মা মানুষটি ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। মূলত লেটো দলে যোগদানের মাধ্যমেই সাহিত্যচর্চা অঙ্কুরিত হয়। এ দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা লেখেন। নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র দশ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সক্রিয় রাজনীতি করার কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বন্দিদশার ভেতর দিয়ে তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্পসহ অসংখ্য রচনা। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে কাজী নজরুল ইসসলাম দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। এই দুই সাহিত্যকর্ম বাংলা পদ্য ও গণসঙ্গীতের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল তখন। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাকাব্য জগতে নতুন দিনের সূচনা হয়। এ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী কামাল পাশা’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’সহ প্রত্যেকটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছিল।

৯.
কবি কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় গগণভেদী উচ্চারণ মনে পড়ে। “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য” নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। রোমান্টিক অনুভবে তিনি প্রত্যাশা করেছেন সুষম সুন্দর কল্যাণময় সমাজ। তাই তিনি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে; কবিতায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, সামন্তপ্রথা শাস্ত্রাচার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়েই নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজরোষে পতিত হন এবং এক সময় তাঁকে বরণ করে নিতে হয় বন্দিদশা। 'আনন্দময়ীর আগমনে' শীর্ষক কবিতা রচনার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কবিতাটি নজরুল প্রতিষ্ঠিত 'ধূমকেতু' (১৯২২) পত্রিকার ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পূজাসংখ্যা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির মূল ভাব ছিল ব্রিটিশ-বিরোধিতা। ভারতীয় পুরাণের চণ্ডী-চরিত্রকে অবলম্বন করে লেখা কবিতাটির কয়েকটি চরণ ছিলো এরকম-
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?...
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হুঁ'র কাঁদন-কেতন কণ্ঠে ধরে। ...
'ময় ভুখা হুঁ মারি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
আয় উমা আনন্দময়ী।
'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা রচনার জন্য নজরুল ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারাবলে তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কলকাতার তদানীন্তন চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে কবির বিচার হয়। ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি সুইনহো মামলার রায় ঘোষণা করেন। তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী মলিন মুখোপাধ্যায় বিনা পারিশ্রমিকে নজরুলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো নিজেও একজন কবি ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি নজরুলকে কারাগারে কোন ডিভিশন না দিয়ে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে দণ্ড জারি করেন। অভিযোগের বিরুদ্ধে সুইনহোর আদালতে নজরুল যে জবানবন্দি প্রদান করেন, বাংলার রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিবাদী সাহিত্যের ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল দলিল। নজরুলের এই জবানবন্দি ১৯২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি 'ধূমকেতু' পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। ওই জবানবন্দিতে নজরুল বলেন- "আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি রাজ কারাগারে বন্দী ও রাজদ্বারে অভিযুক্ত। একধারে-রাজার মুকুট, আর একধারে ধূমকেতুর শিখা, একজন-রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর একজন-সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড। ...আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই, কেননা ভগবান আমার সাথে আছেন। আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ পীড়ানিরুদ্ধ হবে না। আমার ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতে অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচারকে দগ্ধ করবে। আমার বহ্নি-এরোপ্লেনের সারথি হবেন স্বয়ং রুদ্র ভগবান। তারপর মাভৈঃ। ভয় নাই।"

১০.
বিচারাধীন থাকার সময় নজরুলকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি রাখা হয়। কারাদণ্ডের পর তাঁকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বসন্ত' নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলে বন্দি নজরুলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কিছুদিন রাখার পর নজরুলকে হুগলি জেলে পাঠানো হয়। হুগলি জেলে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এবং বন্দিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল বিদ্রোহ করেন এবং দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে অনশন আরম্ভ করেন। জেল-কর্তৃপক্ষ নজরুলের দাবি মানতে নারাজ, অন্যদিকে দাবি না মানা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যেতে নজরুল অটল। নজরুল দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ডাকে কলকাতার গোলদীঘিতে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা থেকে দাবি জানানো হলো_ 'নজরুলকে বাঁচানো বাংলাদেশ ও সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবে নজরুল যাতে অনশন ভঙ্গ করেন।' নজরুলের অনশন ভঙ্গের আহ্বান জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। ওই তারবার্তায় তিনি লেখেন_ 'গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ।' শেষ পর্যন্ত ৩৯ দিন অনশনের পর ১৯২৩ সালের ২২ মে নজরুল অনশন ভাঙেন মাতৃসমা বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে। অনশন ভঙ্গের পর কবিকে বহরমপুর জেলে বদলি করা হয়। এখানে কবিকে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদী হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। বহরমপুর জেল থেকেই ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল মুক্তি লাভ করেন।

১১.
নজরুল ইসলামের ব্যক্তি-জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজরুলের কারাজীবন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজন কবির রচনাকে ভয় পেয়ে তাঁকে বন্দি করেছে। অন্যদিকে তাঁর মধ্যে ছিল প্রবল প্রতিবাদী চেতনা। নজরুলের বন্দিদশা ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জেল-জীবনে বসে নজরুল যা রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারাগারের বাইরে যেমন, তেমনি কারাগারের ভিতরেও নজরুল ছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবনবাদী এক প্রবল বিদ্রোহী। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনও আপস করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ ইত্যাদি বিষয় তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রেহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান। এ অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। তাঁর চিকিৎসারও সুব্যবস্থা করা হয়। দেয়া হয় জাতীয় কবির সম্মান। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক।

১২.
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবির জীবনকাল ৭৭ বছরের। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে কবি শিল্প-সাহিত্যকে যা দিয়েছেন তা এক বাংলা তথা বিশ্ব পরিমণ্ডলেই অমূল্য সম্পদ। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। না, নজরুলকে ভুলে যায়নি কেউ; তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে রয়ে গেছেন কাছে।শরীরী পদচারণা না থাকলেও শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় আজও তার ‘উন্নত মম শির’। তাই কাজী নজরুল ইসলাম এখনও প্রাসঙ্গিক। বাঙালি জাতির সামনে চলার পথে অন্তহীন প্রেরণার উৎস নজরুলের কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যেও অমূল্য সম্পদ। দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে আসা কবিকে জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালবাসায় উদযাপন করে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত