প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫৩

১.
আমাদের প্রিয় ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- স্মৃতিমাখা বাণীময় গানটি কালজয়ী হয়ে ওঠে সংগীতশিল্পী মান্না দের অসাধারণ আবেগি কণ্ঠের সুরে-ঝংকারে। আবার ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ গানটিও অমর হয়ে আছে শচিন দেব বর্মনের কণ্ঠে। কিন্তু আমরা ক’জনা এইসব গানের বাণীর রচয়িতার নাম জানি, মনে রেখেছি? গানটি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীত সাধক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলাভাষার কবি ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা সংগীত ভুবনে এক অসাধারণ স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর অসংখ্য অমর সৃষ্টি আমাদের সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর গান বিভিন্ন কণ্ঠে বার বার শুনেও যেন আশ মেটে না আমার মতোন বাঙালির। বরেণ্য গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রায় দশ বছর ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’, ‘এই রাত তোমার আমার’,‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’,‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ সহ নানা অমর গানের স্রষ্টার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, আমাদের ‘পাবনার পুলা’ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৪ (মতান্তরে ১৯২৫) সালের ৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাংলা ছায়াছবি ও আধুনিক গানের জগতকে যাঁরা মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। বাংলা ছবির গানের স্বর্ণযুগ বলা হয় গত শতাব্দীর পাঁচ, ছয়ের দশককে। সেই গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে, দোলা দেয় হৃদয়ে। একদিকে, চলচ্চিত্রের গান, অন্যদিকে মাঠ-ময়দানে গণ আন্দোলনের গানও আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল গোটা বাংলায়। সমকালে ছিলেন তিনি গীতিকার শ্রেষ্ঠ। তার গানের বাণী কখনো একঘেঁয়ে নয়। ভাব, ভাষা, শব্দ, ছন্দ ও রচনাশৈলী নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। একই ফর্মে বেশিদিন গান লেখেননি। এ ব্যাপারে ছিলেন সতর্ক, সচেতন। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি চেষ্টা করি এক এক সুরকার ও গায়কের জন্য এক এক রকম গান লিখতে। অনেক সময় সুরের স্বাধীনতা স্বীকার করে শব্দ বসাই।”

২.
শুরুতেই কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে চাই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তাঁরই লেখা সেই বিখ্যাত গানটি, ‘শোন একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ...।’ তার লেখা এই গান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে লক্ষ প্রাণে শিহরণ বইয়ে দিত। অনুপ্রেরণা যোগাত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিপাগল বাঙালির হৃদয়ে। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। । স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই মনে পড়ল তাঁর জন্মস্থানের কথা। ছুটে গেলেন কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা দেখতে। শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত গীতিকবিকে দেওয়া হলো প্রাণঢালা সংবর্ধনা। সেদিন মঞ্চে ছিলেন তাঁরই সহপাঠী, পাবনার আরেক কৃতি সন্তান ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যক্ষ কবি আবদুল গনি। উল্লেখ্য যে, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘শোন একটি মজিবরের কণ্ঠ থেকে’ গানটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন- ‘মিলিয়ন মুজিবরস সিংগিং’। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’র কথা আমরা কে না জানি। এর গীতিনাট্য রূপ দেন এইচএমভিতে লোকগানের প্রশিক্ষক ও গায়ক দীনেন্দ্র চৌধুরী, আর সুর ঠিক রেখে ‘পদ্মানদীর মাঝি’র গীতিনাট্যটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

৩.
লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে' গানটি হয়তো আপনি শুনে থাকবেন। অথবা, মান্না দের গাওয়া 'তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়', কিশোর কুমারের 'আকাশ কেন ডাকে', সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘জীবনে যদি দ্বীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ কিংবা ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে’- গানগুলো কি মনে করতে পারছেন? আরও আছে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান -মেঘ কালো, আঁধার কালো, আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, পথের ক্লান্তি ভুলে, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই ইত্যাদির কথা মনে পড়ে? হ্যাঁ, এসব গান স্মৃতিতে নাড়া দেওয়া মানেই বিখ্যাত সব কালজয়ী গানের অমর স্রষ্টা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথাই মনে আসবে, ভাসবে সুরের ধ্বণির সাথে তাঁর স্মৃতি।

৪. 
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন(মতান্তরে কলকাতায়)।তাঁর পিতা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ।শৈশবে কলকাতা চলে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। থিতু হয়েছিলেন পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায়। এ সময় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। কিন্তু মনের গহীনে যিনি শিল্পীসত্তা বহন করে চলেছেন তিনি তো সুযোগ পেলে সেদিকেই মন দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পাবনার আরেক কৃতিমান সাহিত্যিক, গীতিকবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। কিন্তু গানের ফুল ভালো করে ফোটার আগেই ১৯৫১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা চলে যান। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। 

৫.
ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তবে তিনি সংগীতেই মন উজাড় করে দিয়েছিলেন। গান লিখে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকী রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’ ১৯৮৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে অনেকটা অভিমান থেকেই বলেছিলেন- ‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। এ বড় ক্ষোভের কথা। অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারদের কবি প্রতিভা সম্বন্ধে কারোর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু কবি সম্মেলনে কোন গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কবিতা ছাড়াও অত গান লিখতেন না। তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তা একটি গানের বইয়ের জন্য।’

৬.
বাল্যকালেই সংগীতচর্চা শুরু হয় তাঁর। তবে শৈশবে তিনি সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন খেলাধুলায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে ছবি আঁকার প্রতিও বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। পরে তাঁর প্রধান ক্ষেত্র হয় কবিতা ও সঙ্গীত। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সুরকার অনুপম ঘটকের কাছে গান শিখেছেন। প্রিয়শিল্পী ছিলেন শচীনদেব বর্মণ ও আব্বাসউদ্দিন আহমদ। তাদের গানের জলসার নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন। সে সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে। ভেবেছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করবেন, পিতার মতোই অধ্যাপনা বেছে নেবেন। কিন্তু শচীন কর্তা তাকে যেন বেঁধে দিলে আষ্টেপৃষ্ঠে গানের জগতে। কিন্তু ছিলেন তিনি বাঁধন হারা। গানপাগল হলেও গায়ক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না। শচীন কর্তার অনুরোধে গান লেখা শুরু, তারপর আর থেমে থাকেন নি। এরই মাঝে কালিদাসের মেঘদূত অনুবাদ করেছেন। সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১৫ দিন। নিতান্ত সাধাসিধে, পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত এক বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। উচ্চতায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সমান বলেই হয়তো ঘনিষ্ঠতাও ছিল বেশি। একসঙ্গে কাজও করেছেন।

৭.
১৯৩৭ সাল। পাবনা শহরের গোপালপুর লাহিড়ী পাড়ার মৈত্রবাবুর নাতনি পদ্মার বিয়ে। বরযাত্রী এসেছে কলকাতা থেকে। বরযাত্রীর সঙ্গে ঢেঙ্গা-পটকা লিকলিকে একটি ছেলেকেও দেখা গেল। গায়ে তার অদ্ভুত জামা। জানা গেল জামাটির নাম ‘বড়ুয়া জামা’। তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার জামার আদলে বানানো। আরো জানা গেল ছেলেটি কলকাতার বালিগঞ্জ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এই ছেলেটিই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ওরফে বাচ্চু মজুমদার। ‘বাচ্চু’ ছিল তার ডাক নাম। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। যদিও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার লেখা গান প্রথম রেকর্ড হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যায় প্রথম গান- ‘ আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো, ঘুমায় মেঘ তারা…।’

৮.
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর লেখা 'বঁধু গো এই মধুমাস' গানটিতে শচিন দেব বর্মন নিজে সুর দিয়ে প্রথম রেকর্ড করেন। পরে ধীরে গীতিকার হিসেবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। রেকর্ডে তার গান প্রকাশিত হওয়ার পর, তিনি ধীরে চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখা শুরু করেন। অগ্নিপরীক্ষা, পথে হল দেরী, হারানো সুর, সপ্তপদী, দেয়া নেয়া, মরুতীর্থ হিংলাজ এবং আরও বহু সিনেমায় তাঁর লেখা গান জনপ্রিয় হয়েছিল। 

৯.
শচীন দেব বর্মনের হাতেই বাচ্চু মজুমদার থেকে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়। একে একে রচিত হতে থাকে কালজয়ী সব গান- ‘আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি, রুধিবে রাঙানো আমি তীর বেঁধা পাখি।’, ‘বধূয়া, এই মধুমাস বুঝিবা হলো বিফল’, ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, আমারই এ দুয়ার প্রান্তে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো’ এমন শত শত গান। 

১০.
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’- উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে এই গান তখন দর্শকদের অন্য এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেত। ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁট মেলানো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া, ছলো ছলো আঁখি মোর, জল ভরা মেঘে যেনো ছাওয়া’- গানটির যেন মৃত্যু নেই। মনে পড়ছে ‘দেওয়া-নেওয়া’ চলচ্চিত্রে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তার লেখা ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ গানটির কথা। এ গানগুলো তো ভোলার নয়।

১১.
পঞ্চাশ আর ষাট দশক ছিল অনেকের মতে বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ। কথা ও সুর সেই সময়ে একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করেছিল। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মত দিক্পালেরা; গীতিকার হিসেবে ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল ঘোষের মত প্রতিভাবান লেখকের দল।

১২.
একদিন তিনি নচিকেতা ঘোষের বাড়িতে গিয়েছেন গানের জন্য। সেখানে সুপর্ণকান্তি ঘোষকে দেখে বললেন, কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ। সুপর্ণকান্তি উত্তর করলেন, কী সব গদগদ প্রেমের গান লিখছ ? এই যে আড্ডার কথা বললে, এই আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো। বেশ কিছু সময় কথা বলার পর গৌরীবাবু বললেন, লিখে নাও দুটি লাইন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই/ আজ আর নেই’।

১৩.
তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। হটাত একদিন তাঁর এক সহকারী এসে বললেন, গৌরীদা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খুব করে ধরেছে। আপনি এখনি একটা গান লিখে দিন। এ ডাক ফেরানো যায়না। উনি কিছু সময়ের মধ্যেই লিখে ফেললেন গান, ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’। সে গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে জোয়ার এনেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে।
শচীনদেব বর্মণ একদিন ডেকে বললেন এখনই লিখতে হবে গান। সে অনেক আগের কথা। সেই সময়ে তিনি শচীনদেব বর্মণকে লিখে দিয়েছিলেন, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’।

১৪.
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রযোজিত ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে গান লেখার জন্য তাকেই ডেকেছিলেন। মহরতের দিনে তাঁর কাঁধেই রেখেছিলেন নির্ভরতার হাত। তিনি সেই ছবির জন্য লিখেছিলেন, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’,আর ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর ‘পরে ওই নীল আকাশ’। সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান।

১৫.
অমল মুখোপাধ্যায় হটাত সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পেয়ে গেলেন একটি ছবিতে। গৌরীবাবুকে যেয়ে বললেন, গৌরীদা, এমন একটা গান লিখে দিন না, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে। উনি হেসে, বললেই কি ওমন লেখা যায়রে। কিন্তু লিখে দিয়েছিলেন সেই গান, ‘এই সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’।‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে ওনার লেখা আর নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবনা’ গানটির জন্য গল্পেই পরিবর্তন এনেছিলেন পরিচালক! ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির প্রযোজক এসে ধরলেন। আমার সব ছবি ফ্লপ করছে। এবার আপনাকে আর হেমন্তদাকে নিয়েছি। এ ছবি হিট না করলে আমি পথে বসে যাব। সে ছবিতে তিনি লিখেছিলেন সেই গান, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো’। ছবি সুপার হিট।

১৬.
আরও যে সব গান তিনি লিখে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, এই পথ যদি না শেষ হয়, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, পথের ক্লান্তি ভুলে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো, অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু, মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো, এই রাত তোমার আমার, প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে, পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে, যদি কাগজে লেখো নাম…। এই সব অমর গানের বাণীর মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মনের মাঝে চিরকাল।

১৭.
মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্ট ভোগ শেষে ৬১ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড আজও বাজে বাংলার কোনো না কোনো ঘরে। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে লিখেছিলেন শেষ গান, গেয়েছিলেন নিজের সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই।’

(তথ্যসূত্র : অনুশীলন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত