জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আঙ্গুরবালা দেবী

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৫

১.
বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আঙ্গুরবালা দেবী। ‘বাংলার বুলবুল’ হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। শত-সহস্র প্রতিকূলতা আর বাঁধার হিমালয় ডিঙ্গিয়েও যে আপন পথে চলা সম্ভব সেই আলোকিত শিল্প পথিকের অমর নাম কণ্ঠশিল্পী আঙ্গুরবালা দেবী। ১৯০০ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রিয় শিল্পীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, আঙ্গুরবালা দেবী ১৯৮৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

২.
আঙ্গুরবালা দেবী সারা জীবনে হিন্দি, বাংলা উর্দু ভাষায় অসংখ্য গান রেকর্ড করেছেন। আর সেই সব অনবদ্য গানের জন্য তাঁকে ‘বাংলার বুলবুল’এবং ‘কলকাত্তা কি কোয়েল’ বলে ডাকা হত। এক সময় ছায়াছবির গানেও প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচশত। এছাড়া তিনি মিনার্ভা থিয়েটারের অভিনেত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন।

৩.
তাঁর সমকালে মেয়েদের গান গাওয়াটা সমাজ ভাল চোখে দেখত না। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে গান গাওয়াটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা ছিল দৃঢ় সাহসী মানসিকতার পরিচয়। শৈশব থেকে গানের প্রতি তাঁর দারুণ উৎসাহ ছিল। গানই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম প্রেম। লোকে বলত তিনি নাকি রসিক লোকেদের কানে মধু ঢেলে দিতেন! আর তাঁর গান হয়তো রসিক স্রোতার মন ছুঁয়ে জীবন নদীর ওপারে নিয়ে যেতে পারত। গ্রামোফোনের টার্নটেবলে ঘুরতে থাকা সেই কালো গালার রেকর্ডে যখন শুরু তাঁর গান তখন সে গানের আকুতি কিংবা মদকতা মুগ্ধ করত সব বয়সের শ্রোতাদের। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে অতীতের সেই সব স্মৃতি হয়তো বাংলার বুলবুলের কিছুটা অভিমানী অহংকারী শিল্পীসত্ত্বাকে পুনরায় উস্কে দিত। তাই অন্য কোনও পরিচয় নয়, তিনি চেয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায় মিস আঙ্গুরবালা হয়েই বেঁচে থাকতে।

৪.
১৯০০ সালে (মতান্তরে ১৮৯৬ সালে) আঙ্গুরবালার জন্ম উত্তর কলকাতার কাশীপুরে। বাবার নাম সুধীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম হরিমতী দেবী। তাঁর বাবার দেওয়া নাম প্রভাবতী দেবী। ডাক নাম নেড়া। তাঁদের পৈত্রিক নিবাস ছিলো বর্ধমানের ইন্দ্রাস। ছোটবেলাটা কেটেছিল শ্যামপুকুর অঞ্চলে। ছোটবেলায় লেখাপড়া শুরু দর্জিপাড়ায় জয়রাম মিত্র স্ট্রিটের একটি মিশনারি স্কুলে। শোনা যায় তিনি মেধাবী ছাত্রী ছিলেন আর সেই জন্যই স্কুলে পেয়েছিলেন ডবল প্রোমোশন। এর পরে হেঁদোর কাছে নরম্যাল স্কুলে ভর্তি হলে সেখানেই চলতে থাকে তাঁর পড়াশুনা। সেখানে ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষায় তিনি স্কলারশিপ পেয়েছিলেন।

৫.
খুব ছোট বয়স থেকে গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। ছোটবেলায় বেলায় তিনি একবার যে কোনো গান শুনেই কণ্ঠে তুলে নিতে পারতেন। গানের প্রতি আগ্রহ দেখে মা হীরামতি দেবী তাকে গান শিখবার উৎসাহ দেন। দর্জিপাড়ার স্কুলে পড়ায় সময় এক দিন আঙ্গুরবালা আর তাঁর বন বিজু, স্কুলে যাওয়ার পথে একটি বাড়ির জানালার সামনে ভিড় দেখে আর গানের গানের আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। দেখেছিলেন, ভিতরে একটা যন্ত্র চলছে, আর একটি মেয়ের গান শোনা যাচ্ছে। দেখে দুই বোন অবাক হয়ে ভেবেছিল যে একটি মেয়েকে নিশ্চয়ই ওই যন্ত্রটির ভিতরে হাত পা কেটে বন্দী করে রাখা হয়েছে, আর সেই গান করছে! গ্রামোফোন সম্পর্কে তাঁর সেই ধারনা বহুদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

৬.
পিতৃবন্ধু অমূল্য মজুমদার এক দিন নেড়ার গান শুনে বুঝতে পেরছিলেন তাঁর প্রতিভার কথা। তিনি নিজেই উৎসাহী হয়ে গান শেখাতে শুরু করেছিলেন। সাত বৎসর বয়সেই তাই তিনি তাঁর পিতার বন্ধু অমূল্য মজুমদারের কাছে গান শেখা শুরু করেন। পরে তিনি তিনি ঈষাণ ঠাকুরের কাছে কীর্তন, জমীরুদ্দিন খাঁর কাছে গজল, দাদরা এবং ঠুংরী এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাছে নজরুলগীতি শিখেছিলেন। পরে সে যুগের বিখ্যাত গায়ক মন্তাবাবু ও জিতেন ঘোষ আঙ্গুরবালার গান শুনে তাঁকে গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ড করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ব্যস! গান রেকর্ড করার কথা শুনেই আঙ্গুরবালা আঁতকে উঠেছিলেন। মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেবেলার সেই ধারণাটা। মনে মনে খুব ভয়ও পেয়েছিলেন। 

৭.
গান রেকর্ড করার ভয় তখনও কাটেনি। আঙ্গুরবালা শুরু করলেন ‘বাঁধো না তরী খানি আমার এ নদীকূলে’ গানটি। প্রথম সেই গান রেকর্ড শেষ হতেই গ্রামোফোন কোম্পানির সাহেব বলে উঠলেন ‘ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল’ গান রেকর্ড হয়ে গেছে। আঙ্গুরবালা একে বারেই হতবাক! গান রেকর্ড করার ভয় কেটে যাওয়ায় সে দিন আরও কয়েকটি গান রেকর্ড করেছিলেন। গান রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পরে সে দিন আঙ্গুরবালা রেজিস্টারে সই করে পেয়েছিলেন চল্লিশ টাকা। আর এভাবেই মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে তাঁর প্রথম গান প্রকাশিত হয়। সে দিন থেকে প্রভাবতী হয়ে গেলেন আঙ্গুরবালা। যে নামটি বহু দশক পর্যন্ত সুরের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করেছিল। এর কিছু দিনের মধ্যেই আঙ্গুরবালার গানের রেকর্ড ছেয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলায়। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তাঁর গানের রেকর্ডই সব থেকে বেশি বিক্রি হত। প্রতি মাসে কম করে তিন-চারটি রেকর্ড প্রকাশিত হত। সে যুগে এটা একটা বড় ব্যাপার ছিল।

৮.
এর পরে ঠুমরী গজল দাদরা শেখার জন্য তিনি জমিরুদ্দিন খানের কাছে তালিম নিতে শুরু করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আঙ্গুরবালা লিখেছিলেন, ‘‘জমিরুদ্দিন খানের কাছে তালিম নিতে গিয়ে কত যে মার খেয়েছি তার ঠিক নেই...।’’ কীর্তন শিখেছিলেন ঈশান ওস্তাদের কাছে। আর নজরুলগীতি শিখেছিলেন কাজী নজরুলের কাছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ১৯২৮ সালে নজরুলের কথায় সুরে ও পরিচালনায় তিনি রেকর্ড করেছিলেন ‘ভুলি কেমনে আজও যে মনে’ গানটি। ক্রমেই আঙ্গুরবালা হয়ে উঠেছিলেন নজরুলের গানের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বি শিল্পী।

৯.
এক সময় থিয়েটারে গান গাওয়ার সুযোগ এসেছিলো তাঁর। আঙ্গুরবালা দেবী সে কালের বেশ কিছু থিয়েটারে গান গেয়েছিলেন। সঙ্গীতশিল্পীর পাশাপাশি তিনি ভাল অভিনেত্রী ছিলেন। বহু নাটকে এবং বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পাশাপাশি সুযোগ এসেছিল বেতারে গান গাইবার। কলকাতায় বেতার কেন্দ্রের যে দিন সম্প্রচার শুরু হয়েছিল সে দিন প্রথম শিল্পী ছিলেন আঙ্গুরবালা। দেশের বিভিন্ন রাজা মহারাজার দরবারে মেহফিলে গান শুনিয়ে তিনি দেশ জোড়া খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিলেন। তার মধ্যে মহীশূর রাজ দরবারে এবং হায়দরাবাদের নিজামের দরবারে তাঁর মেহফিলের কথা আজও সঙ্গীতের ইতিহাসে প্রতিধ্বনিত হয়। এক কথায় সেই সময় ভারতের সঙ্গীত জগতে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এক সময় অভিনয় ছা়ড়লেও কখনও গান ছাড়েননি। পরিণত বয়সেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। 

১০.
এক সময় তাঁর মূজরের দক্ষিণা ছিল তিরিশ হাজার টাকা। আঙ্গুরবালা এতটাই জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন যে তাঁর নাম লেখা শাড়ি বাজারে বেরিয়েছিল, আর সেকালের মহিলারা সেই শাড়ি পরতেন। এমনকী সেকালের নাম করা পানের দোকানে পাওয়া যেত খানদানি আঙ্গুরবালা পান। ১৯৭৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আঙ্গুরবালাকে গাল্ড ডিস্ক দিয়ে সম্মানীত করেছিল। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার।

১১.
আঙ্গুরবালা দেবী ১৯৬৩ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি পান। ১৯৮৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেমে যায় ‘কলকাত্তা কি কোয়েল’-এর ডাক । কিন্তু তিনি চিরঞ্জীব হয়ে আছেন আমাদের মাঝে তাঁর কাজের কারণেই।

১২.
সবশেষে সেই মানুষটার সাথে আঙ্গুরবালা দেবীর কথা বলা যাক একটু, যে মানুষটা আপাদমস্তক ছিলেন সৃজনশীল। যাঁরা এসেছেন তাঁর সংস্পর্শে, তাঁরাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মানুষের মনে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন অদম্য আশার বাণী। আমরা নজরুলের কথা বলছি। কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতীয় কবি। আঙ্গুরবালা দেবী নজরুলের প্রথম যে গানদুটি রেকর্ড করেছিলেন, তা হলো ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’ ও ‘এত জল ও কাজল চোখে’। আঙ্গুরবালা দেবীর পর্যবেক্ষণ হলো, তাঁর কাজীদা গানের শব্দ-বিকৃতি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তিনি হয়তো লিখেছেন ‘বিন্ধিল’, যিনি গাইছেন তিনি হয়তো প্রমিত উচ্চারণ করলেন ‘বিঁধিল’-এটা পছন্দ করতেন না কবি। কবির গান শেখানোর ধরন ছিল এ রকম: প্রথমে একটি গান দিলেন আঙ্গুরবালাকে, শুনলেন। গলায় সুর কীভাবে উঠছে দেখে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করলেন গানটির। অনেক সময় কথাও বদলাতেন। খুব ভালো গাইলে বলতেন, ‘তোমার কণ্ঠে আমার গান প্রাণ পেল।’ কখনো ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আমি তো কাঠামোটা তুলে দিলাম। এবার তুমি আঙুরের রস মিশিয়ে মিষ্টি করো।’ ১৯৭৪ সালে আঙ্গুরবালা দেবী ঢাকায় এসেছিলেন কবিকে দেখতে। খালি গায়ে কবি শুয়ে ছিলেন। তাঁর বুকের ওপর ছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। আঙ্গুরবালা পাউডারের প্রলেপ দিয়ে সেই ঘাম শুকিয়ে দিয়েছিলেন। গানও শুনিয়েছিলেন কবিকে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আঙ্গুরবালা দেবীর গান প্রচার করা হয়েছিল। সে গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই’। শেষোক্ত গানটি গেয়েই সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পেয়েছেন শিল্পী। নজরুলের সংগীত রচনা, পরিচালনায় ঋদ্ধ ধ্রুব চলচ্চিত্রের নারদ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নজরুল। আঙ্গুরবালা সে ছবিতে গান করেছেন। আর ধ্রুবর মা সুনীতির চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।

(তথ্যসূত্র : অনুশীলন, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত