জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৭

১.
বাংলা নাটকের গৌরজন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেয়া তাঁর নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুঁয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। নাট্যকার, শিক্ষক সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। নানান স্মৃতি আর অবদানের কারণে তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করছি, সেই সাথে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। আজ একই সাথে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের প্রয়াত স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেছা, আমাদের প্রিয় পারুল ম্যাডামকেও। ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি তিনিও অচেনালোকে চলে যান। উল্লেখ্য যে, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে। কিন্তু রেখে যান তাঁর অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টিসম্ভার। সেলিম আল দীনের নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। প্রতি বছরই নিয়ম মেনে ১৪ জানুয়ারি আর ১৮ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কিন্তু তাঁকে, তাঁর অমর সৃষ্টি ও চেতনাকে আমরা কতটা অন্তরে, আচরণে ধারণ করি সেটা নিয়ে প্রশ্ন, সংশয় কিন্তু থেকেই যায়।

২.
সেলিম আল দীন স্যারের কথা মনে পড়লেই আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। আমি স্মৃতির রশি ধরে ফিরে ফিরে যাই সেইসব দিনে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে।যদিও স্যারের সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তির আগেই হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে কাজের সুবাদে। ১৯৯২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও আমার নিত্য আনাগোনা ছিলো কলাভবনে নাট্যতত্ত্ব বিভাগে, সেলিম আল দীন স্যারের কাছে। স্যার যখন টিএসসির দায়িত্ত্বে ছিলেন তখন সেই সম্পর্ক আরো গভীর হয়, আড্ডা বেড়ে যায় কারণ আমার বিভাগের পাশেই ছিলো টিএসসি এবং সেখানেই ছিলো আমাদের সাংবাদিক সমিতির অফিস। সরকার ও রাজনীতির ছাত্র হিসেবে সরদার ফজলুল করিম স্যারের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছি, রাষ্ট্র নিয়ে গুরু সক্রেটিস বলতেন, ‘রাষ্ট্ররূপ অশ্বের জন্য আমি হচ্ছি বিধি প্রদত্ত ডাঁশ পোকা’। এসব প্রসঙ্গ উপস্থাপনকালে সেলিম আল দীন স্যারের বলা একটি কথা খুব মনে পড়ছে। স্যার বলতেন, লিখেছেনও-‘রাষ্ট্রের দেহ আছে। মনুষ্যদিগেরও আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দেহ ছেদবিচ্ছেদে নিত্যই পূর্ণ। যেমন ছোটোকালে পারদ দেখিয়াছিলাম আধুলির সমান। তা কচুপাতায় রাখিলে অখণ্ড আবার কচুপাতা হইতে ঝরিয়া পড়িলে অনতিবিলম্বে বহুসংখ্যক রূপালি বিন্দুতে পরিণত হইয়া বিচ্ছিন্নভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করে। রাষ্ট্র সেইরূপ।’ স্যার মনে করতেন, একাত্তরে বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলেও চিন্তনে ও মননে স্বাধীনতা লাভ করেনি। কেননা বাঙালির রুচি, শিল্পবোধ সর্বত্রই পাশ্চাত্য প্রভাব প্রবলরূপে দৃষ্ট। তিনি এই চিন্তনের জগতে আঘাত হেনেছেন। স্বাধীনতার নানা বিতর্কেও এই রাষ্ট্রে তিনি স্বভূমিজ শিল্পরীতির কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, তাঁর ‘চাকা’ নাটকটির কথা। তাঁর ‘চাকা’ নাটকে বিষয় ও আঙ্গিক সকল ক্ষেত্রেই দেশজ ধারার দিকেই পক্ষপাত। ‘চাকা’ রচনাকালীন সময়ে বাংলাদেশে সামরিক বুটের দাপট। সেই সময়ে গণতন্ত্রের জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র, পেশাজীবীরা প্রাণ দিচ্ছে। বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে নুর হোসেন রক্ত দেয়। এছাড়া অনেক অজ্ঞাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয় ক্ষমতাসীনদের হাত। নাট্যকার এই অজ্ঞাত মানুষকে পৌঁছে দিতে চান জ্ঞাত ঠিকানায়। কিন্তু পথ চলতে চলতে দেখা যায় মরদেহ মানুষের বুকে স্বজন হারানোর বেদনা জাগিয়ে তোলে। পাঠক-দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র যখন বিশেষ বাহিনীর হাতে পরিচালিত সেই সময়ে সাধারণ মৃত্যুর উৎসবেই জীবনের মানে খোঁজে। একইভাবে মৃত্যুর মিছিলে মুক্তি সন্ধান হয়।

৩.
কাকতালীয় হলেও ২০১৭ সালের মতোনই ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারিও আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথম পুনর্মিলনীর দিনে সেলিম আল দীন স্যারের কবরে শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে আসতেই দেখা হয় সিনিয়র ভাই, ক্যাম্পাসের সাংবাদিক প্রিয়জন মেজবাহউদ্দিন তুহিন ভায়ের সাথে। স্যারের কবর থেকে আসছি শুনে তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন বিশেষ একটি দিনের কথা, যেদিন সেলিম আল দীন স্যারের সাথে তাঁকে নিয়ে দৈনিক বাংলা ভবনের সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদৎ চৌধুরীর অফিস থেকে বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের কলাবাগানের বাসায় গিয়েছিলাম, জম্পেস দীর্ঘ আলাপনের সেই স্মৃতিকথাকে। সেই দেখা – সাক্ষাতের ফলাফল ছিলো নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নাটকে আলোর ব্যবহার, আলোক সম্পাতসহ মঞ্চকে কিভাবে বহুমাত্রিকভাবে ব্যবহার করা যায়- এরকম নানা বিষয়ে জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের ক্লাসের সফল আয়োজন। জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদুদলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমিও ছিলাম সেই প্রশিক্ষণ ক্লাসের সহায়তাকারীর ভূমিকায়। দুই মহান শিল্পীর আলোকিত আলোচনার বিরল স্বাক্ষী হওয়ার এরকম আরো অসংখ্যবার সুযোগ আসে আমার তাঁদের মতোন মানুষদের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে, সাংবাদিকতার সুযোগেও। সেসব দিন তাই ভীষণই নস্টালজিক, স্মৃতিময়। স্যারকে নানা ভূমিকায় দেখেছি এবং প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিতও হয়েছি কারণ প্রথাগত শিক্ষকের মতো শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষেই পাঠদান, পরীক্ষা, খাতা দেখা, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন না তিনি। ক্লাসের বাইরেও তাঁর সৃজনশীল কাজের অংশীদার করে তুলতেন শিক্ষার্থীদের। তাদেরকে মানব সভ্যতার নানান বিন্দুকে চিনিয়ে দিতেন তিনি। তাদের হাতে তুলে দিতেন যার যার নিজস্ব শিল্পগৃহ খোলার চাবিকাঠি। স্যারকে নিয়ে লিখতে বসলে বড়ই ‘নস্টালজিক’ হয়ে পড়ি, আমার লেখা আর এগুতে চায় না, গতি পায় না।

৪.
‘নস্টালজিয়া’ শব্দটি মনে এলেও মনে ভাসে কথক সেলিম আল দীন স্যারের মুখচ্ছবি, বাচনভঙ্গি। ‘নস্টালজিয়া’ বিষয়ে অনেকবার স্যারের কাছে শুনেছি, কিছু মনে আছে, অনেক কথাই ভূলেও গেছি।গ্রিক শব্দ ‘নস্টালজিয়া’ মানে বাড়ি ফেরার বেদনা, পেছনে ফেরার আকুতি । বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যবহার করেন বুদ্ধদেব বসু।একসময় নিরাময় অযোগ্য চিকিৎসা হিসেবেও আলোচিত ছিলো। মাত্র ১৯ বছর বয়সে সুইস চিকিৎসা বিজ্ঞানী জোহানেস হুপার নস্টালজিয়া বা হোম সিকনেসকে চিকিৎসা যোগ্য করে তোলেন। প্রিয়জন সঙ্গ পেলে স্যার কথা বলতে ভালোবাসতেন। এরকম কত আলোকিত কথা যে শুনেছি, তার কিছু আমার সাংবাদিকতার নোটবুকে আছে, কিছু আছে স্মৃতির পাতায়। মনে পড়ে ‘নস্টালজিয়া’ সংক্রান্ত সেদিনের সেই আলোচনায় সেলিম আল দীন স্যার তাঁর প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশের একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন, `আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে; / বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল / তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল; / সব ক্লান্তি রক্তের থেকে / স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি; / এই নদী তুমি।'/ 'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?' / মাছরাঙাদের বললাম; / গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম। / আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;।’ সেলিম আল দীন এভাবেই আত্মানুসন্ধান করে চলতেন নিজেকে, তাঁর সব নাটকে, রচনায়। বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গ্যেটে, দান্তে, হোমার প্রমুখের রচনায় নস্টালজিয়া বা হোম সিকনেস প্রবলভাবে উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সেলিম আল দীনের নাটক ‘হাত হদাই’ তো এমন বাড়ি ফেরার প্রবল বেদনা এবং টানেরই বিমূর্ত স্পষ্ট উচ্চারণ।

৫.
স্যারের সাথে ক্যাম্পাসের বাইরে ঢাকাতে তাঁর অনেক প্রিয়জনের সাথে মেশার সুযোগ হয় আমার। শিল্পময় সে সব আড্ডার স্মৃতিতে ফিরে যেতে চাই, দেখতে পাই এক অনন্য কথককে, আলো পিপাসু পথিককে। স্যারের প্রিয়জন অভিনেতা আফজাল হোসেনের বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’র অফিসেরও অনেকবার গেছি স্যারের সাথে, সেখানে আসতেন অনেকেই, আমি তাঁদের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, কেবলি শুনতাম, অনেকসময় সাংবাদিকতার স্বভাবসুলভ নোট নিতেও চাইতাম, স্যার মানা করতেন না। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে স্যারের ৫০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানটির কথা। সেদিন সকালে ক্যাম্পাস থেকে স্যারের সঙ্গী হয়েছিলাম আমি। মহিলা সমিতিতে হয়েছিলো বর্ণাঢ্য জন্ম উৎসব। স্যারের প্রিয় সুর বেজে উঠেছিলো, প্রিয় শিল্পীগণও শুনিয়েছিলেন গান। সেই জমজমাট আয়োজনের সংবাদ লিখে আমার তৎকালীন কর্মস্থল দৈনিক ভোরের কাগজের বাংলামোটরের অফিসে জমা দিয়ে স্যারের সাথেই রাতে ক্যাম্পাসে ফিরেছিলাম। এরকম অজস্র আলোকিত অধ্যায় খুঁজে পাই স্যারের সাথে।

৬.
সেলিম আল দীন ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক। অবশ্য প্রথমে তিনি শিক্ষক হিসেবে ঢোকেন সেখানকার বাংলা বিভাগে। সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য হলে স্যার তাঁর স্বপ্নের নাট্যতত্ত্ব বিভাগ খোলার সুযোগ পান। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারের সহায়তায় নিরন্তর পরিশ্রমে সেলিম আল দীনের যোগ্য নেতৃত্বে দাঁড়িয়ে যায় বিভাগটি। পরবর্তীতে স্যার সব সময় স্বীকার করেছেন এই ঋণ। তাঁর প্রকাশিত রচনাবলির প্রথম খণ্ডটি উৎসর্গ করেছেন এই লিখে: ‘আচার্য সৈয়দ আলী আহসান।’ প্রচন্ড আশাবাদী ও নিরক্ষাধর্মী সৃজনশীল মানুষ সেলিম আল দীন স্যার নিজের লেখালেখি নিয়েও বলতেন অনেক কথা। তিনি মনে বলতেন, ‘আমার মনে হয় লেখক জীবনের একেকটা পর্বে একজন লেখককে বাধ্য হতে হয়, এটা অনিবার্য, এটা লিখতে হবে আমাকে। সে তাগিদটা যখন প্রবল একটা আকাশের মতো হয়ে যায়, প্রবল হয়ে ওঠে তাগিদটা, তখন নিশ্চিতভাবে একজন লেখক লিখতে বাধ্য হন। … যে কোনো লেখাই এমনকি পৃথিবীতে যেসব লেখাকে ডিটাচড বাই ইমপারশিয়াল আর্টস যেগুলোকে আমরা বলি, সেগুলোও এক ধরনের আত্মজৈবনিকতা আচ্ছন্ন। সেটি বোঝার উপায় নেই। কারণ লেখক যা কিছু ভাবেন- সেটা তার জীবনের মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেন বলেই ভাবেন, সে অর্থে এটা তার জীবনেরই অংশ। কাজেই ইডিপাস বলি বা আইসখলুসের নাটক যদি আমরা ধরি- যদিও তাকে ডিটাচড মনে হচ্ছে অন্যের কাহিনী তবু তা আত্মজৈবনিক।’ আমরা জানি, সেলিম আল দীন প্রেরণা পেয়েছেন হোমার, ফেরদৌসী, গ্যেটে আর রবীন্দ্রনাথের মতো কবিদের কাছ থেকে। তাঁদের কাছ থেকে বারবার ফিরে গেছেন একান্ত বাধ্যগত শিষ্যের মতো। আবার তাঁদেরকে গুরু মেনে তাঁদেরকে পেরিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা দিনরাত মনের ভেতরে লালন করতেন তিনি। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন তাঁর সেই আশা কোন দিন পূরণ হওয়ার নয়। শেষদিকে লেখা তাঁর দিনপঞ্জির অসংখ্য পাতায় এর প্রমাণ আছে। সেলিম আল দীন যেসব কাজ করেছেন সেগুলির মূলে আছে পাশ্চাত্য শিল্পধারাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজস্ব শিল্প সৃষ্টি করে তা অনুশীলন করা। পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের লেখক, কবি, শিল্পী ও নাট্যকর্মীদের এই বোধে উজ্জীবিত করা যে আমাদের শিল্প ঐতিহ্য নিয়েই আমরা তৈরি করতে পারি আমাদের নিজস্ব শিল্পজগত। পরের অনুকরণ করে কখনও নিজস্বতা অর্জন করা যায় না। খুব জোরের সঙ্গে বারবার বলেছেন, 'অন্যের বসন কখনও নিজের হয় না। হয় না সেটা নিজের ভূষণ।' 

৭.
সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের মান অনেক উঁচুতে তুলে দিয়ে গেছেন। তাঁর সম্পর্কে একথা এখন বলাই যায় যে, তিনি বাংলা নাটকের একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি ভাগ্যবান ছিলেন, তাই নাটকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তিনটি জিনিস নিজের করে পেয়েছিলেন। প্রথমটি হলো নিজের নাটক লেখার প্রতিভা, দ্বিতীয় হলো নাটক মঞ্চায়নের জন্য নিজস্ব গ্রুপ এবং তৃতীয়টি, নাটক সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগ। বলা যেতে পারে, নাটক লেখার মতো প্রায় নিকটতম উদ্ভাবনী সাংগঠনিক প্রতিভা ব্যবহার করে তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন 'ঢাকা থিয়েটার' (অন্যদের সহযোগে) ও 'নাট্যতত্ত্ব বিভাগ'। এই তিনটি মাধ্যমই ছিল তার জন্য একে অপরের পরিপূরক। সেলিম আল দীন আপাদমস্তক ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। নিঃসন্তান এই মানুষটির লেখালেখিই ছিল সন্তানের মতো। কবিতা ও কবির প্রতি পোষণ করতেন সরাসরি পক্ষপাত। শিল্পের প্রায় সব শাখার জ্ঞানের সম্মেলন ঘটেছিল তার মধ্যে। সব সময় যেন সৃষ্টিশীলতার এক ধরণের ঘোরের মধ্যে থাকতেন। বাংলা নাট্য সাহিত্যের অপ্রতিরোধ্য নাট্য প্রতিভা সেলিম আল দীন স্বদেশ, স্বকাল, ইতিহাস ও সময়ের নিরন্তর প্রবাহের ভেতর তাঁর অন্বেষণকে সাহিত্যের মানুষেরা নিরন্তর শ্রদ্ধা করে এসেছে। জীবিত অবস্থায় লেখা, লেখার জন্য সাধনা ও সার্বক্ষণিক শিল্পবোধ তরুণ লেখকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। নাট্য আঙ্গিকের ক্ষেত্রে, নাট্য গবেষণার মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং নাট্যের বিষয় ও ল্যান্ডস্কেপের বিশালত্বের ক্ষেত্রে তার কৃতি ও কৃতিত্ব ব্যাপক। মানব চরিত্রের গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধান তিনি লোকমানসের ভেতর করেছেন। সেলিম আল দীনকে অনেকে ঐতিহ্য অনুসন্ধানী নাট্যকার হিসেবেও মূল্যায়িত করে থাকেন। বঙ্গ-ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে কেন্দ্রে রেখেই তাঁর নাটকের ভিত্তিভূমি রচিত। বেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ-মহাভারত হয়ে মধ্যযুগের সাহিত্য ছিলো তাঁর বিচরণভূমি। অতীতের শিক্ষাকে তিনি বর্তমানের সঙ্গে একাঙ্গীভূত করেছেন। ঐতিহ্যের সূত্র ধরে সমকালকে ধরবার চেষ্টা ছিল তাঁর। তাঁর প্রায় সব নাটকেই ঐতিহ্যের অনুসন্ধান প্রবল। আমরা জানি, শিল্প বিষয়ে জ্ঞান অর্জন, নিজের শিল্পবিশ্বাস নির্মাণ করে তা অনুশীলন ও পরবর্তী প্রজন্মকে সেই শিল্প ধারণায় অবগাহনের প্রেরণা আমৃত্যু সঞ্চার করেন যিনি তিনিই তো একজন আচার্য হয়ে ওঠেন। সেই অর্থে সেলিম আল দীনের অবস্থান আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে একজন আচার্যের মতোই। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অর্পন করে গেছেন, তা তাদেরকে অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যাবে। গুটিকয়েক গতানুগতিক একাডেমিক গবেষণা ছাড়া সেলিম আল দীনকে মূল্যায়নের প্রচেষ্টা সচরাচর দেখা যায় না। মৃত্যুর পর লেখক সেলিম আল দীনের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয়কে তার লেখার মধ্য দিয়ে অন্বেষণ করার নতুন সম্ভাবনা হয়তো তৈরি হয়েছে। এতোদিন না হলেও আশা করা যায়, এখন সম্ভব হবে তার লেখার যথার্থ নান্দনিক বিচার।

৮.
সেলিম আল দীনের অনেক নাটক এবং রচনাই আমার প্রিয় কিন্তু সেসবের আলোচনায় এখন যাবো না, প্রতিটি পছন্দের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে স্বতন্ত্র করে লেখার বাসনা পোষণ করি বলে। তবে তাঁর একটি নাটকের কথা না বললেই নয়, সেলিম আল দীনের ‘নিমজ্জন’ আমার খুবই প্রিয় একটি নাটক। আর নাটকটি প্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে প্রিয়বন্ধু হিটো’র ( জাহেদুল আলম) বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সতীর্থ চিন্তাবন্ধুটির প্রতি এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কারণ ওর সাথে বিভিন্ন সময় উত্তাপ ছড়ানো আলাপনেই নাটকটি নিয়ে আমার নানান অস্পষ্টতার মেঘ দূর হয়, আলোর দেখা পাই। আমরা নাটকটির অভিনয় দেখলে এবং পাঠ নিলে দেখতে পাই, সেলিম আল দীন তাঁর ‘নিমজ্জন’ নাট্যের স্ত্রোত্রস্পর্শী নানান পংক্তির মাধ্যমে এক আশ্চর্য অভিনব কাব্যিক অভিজ্ঞতায় পৃথিবীর গণহত্যার ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন। প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ ও আধুনিককালের সারাবিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণহত্যার লোমহর্ষক বয়ানই হয়ে ওঠে তাঁর নাটক ‘নিমজ্জন’ । আর এ-বয়ানের দৃশ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সমকালীন বাংলা নাট্যমঞ্চের যশস্বী নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ। নাটকটিতে তিনি নিজের শিল্প-মানসের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলে নাট্যবোদ্ধারা বলে থাকেন। তাঁরা আরও বলেন, এ-নাটকের মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকের অভিমত, ‘নিমজ্জন’ নাটক ও তার মঞ্চায়নকে রবীন্দ্র মহাভুবনের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়েছে। কারণ, রবীন্দ্রনাথই প্রথম প্রাজ্ঞ বাঙালী, যিনি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বৈজ্ঞানিক মানুষের অশুভ যান্ত্রিক বুদ্ধিতে সৃষ্ট দুটি মহাযুদ্ধের অভাবিত সর্বনাশ তথা অচিরাগামী অকল্যাণের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। অথবা রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু-আজীবন যে-মঙ্গলময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন, ‘নিমজ্জন’ তারই বিপরীতে দাঁড়ানো এক বাস্তব দলিল; যা সভ্যতার অন্তর্গত রক্তক্ষতকে উদঘাটিত করেছে। সভ্যতার উলঙ্গ নখদন্ত কীভাবে গণহত্যার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে এক অনিশ্চিত মহাপ্রলয়ের পথে নিয়ে চলেছে, সে-আভাস এ-নাটকের অবলম্বন। আবার ‘নিমজ্জন’-এর রচনা কৌশলকে সমালোচকগণ বিশ্ব শিল্পধারায় ফোররিয়ালিজমের প্রথম উদ্ভাবন হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। এ-নতুন শিল্পধারা শুধু বাংলা নাটক নয়, বরং বিশ্ব শিল্প-অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও এক নতুন শিল্প-দর্শন হয়ে দাঁড়াতে পারে। ‘ফোররিয়ালিজম’ বা ‘সম্মুখবাস্তবতা’ এ-পরিভাষা দুটি সেলিম আল দীনেরই উদ্ভাবিত।

৯.
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাঁর গীতি কবিতাগুলো কি কবিতা নয়?’ আর তাই তাঁর নাটক, প্রবন্ধ, সবকিছু আরেকবার পড়ার আবেদন পেশ করছি আগ্রহীজনের প্রতি। তাহলেই বোঝা সহজ হবে যে, তাঁর সব লেখাই আসলে কবিতা । হ্যাঁ সব। তাঁর ' দ্বৈত অদ্বৈত' মতবাদের কথা সভ্য বাঙালি ভুলবে কেমন করে ? শুধু গদ্য - পদ্য বলে কথা নয়। সব শিল্পই আসলে এক। আর তাই কবি সেলিম আল দীনকে নিয়ে ফরহাদ মজহারের লেখা স্মৃতিচারণ থেকে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না বলে অগ্রিম ক্ষমা চাই। সেলিম আল দীনের প্রয়াণের পর ১৯ জানুয়ারি ২০০৮ তারিখে ‘সেলিমের জন্য’ শিরোনামে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ‘আমি যাদের সঙ্গে ষাট ও সত্তর দশকে বড় হয়েছি, এক ঘরে থেকেছি, গাদাগাদি করে এক ঘরে তিনচারজন ঘুমিয়েছি, তারাশংকরের রাইকমল পড়ে জগৎময় শ্রীমতি রাধিকাকে দর্শন করে বেড়িয়েছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সেলিম আল দীন। … সোজা কথা, প্রমিত ভাষা বলে কোনো স্থির ও খাপ খাপ ভাষা আছে সেটা আমরা মানতাম না। কসম খোদার। সব ভাষাই ভাষা, যদি যুৎ মতো কওন যায়—এটা আমাদের চেয়ে খিস্তিখেউড়ে পারঙ্গম আর কোন্ শালা জানত? যদিও নিষ্ঠুর এই প্রমিত সমাজের সাংস্কৃতিক অত্যাচার ও নিপীড়নে আমাদের ভাষাচর্চা প্রকাশ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবং আমরা ভদ্রভাবে প্রমিত ভাষায় নির্ভুল ব্যাকরণে কাব্যগুণ সম্পন্ন বাক্য উচ্চারণ করতে শিখেছি আমাদের দুষমণদের চেয়েও ভালভাবে। … সেলিম কবি হতে চেয়েছিল। নাটকও যে আসলে কবিতা এই সত্য তাকে বোঝাতে, যদ্দূর মনে পড়ে আমাকে বেগ পেতে হয়েছিল। বোঝাবার একটা বিশেষ দায় ছিল আমার। ষাট দশকে আগামি দিনের যে সব নায়কেরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সামনের সারিতে আসবার পাঁয়তারা করছিল তাদের দুর্দান্ত শ্লোগান ছিল: “প্রথম বিপ্লবের খুন বেরুবে ভাষা থেকে।” এই শ্লোগান এখন অসামান্যই মনে হয়। বিদ্যমান চিহ্নব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া, ওলোট পালট লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া, চিহ্নে চিহ্নে একটা খুনোখুনি ঘটিয়ে দেবার যে তীব্র নান্দনিক তাগিদ আমরা বোধ করেছিলাম তার চরিত্র ছিল আগাগোড়াই রাজনৈতিক। তখন নতুন জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের আবির্ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই শ্লোগানের সহজ সরল মানে হচ্ছে যতক্ষণ ভাষা বা বিদ্যমান চিহ্নব্যবস্থায় ভাঙন না ঘটানো যাচ্ছে, একটি জনগোষ্ঠির বৈপ্লবিক রূপান্তর অসম্ভব। সেই রূপান্তর শুধু আর্থ-সামাজিক নয়—রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সর্বোপরি ভাবুকতার। এই শ্লোগান মনে রেখে সেলিমসহ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দীর্ঘদিন আমরা শরিফ মিয়ার কেন্টিনে আট আনার বিরিয়ানি খেতে খেতে বিচার করেছি ছাপাখানা থেকে ‘কবিতা’ নামে যা মুদ্রিত হয়ে বার হয় তাকে কবিতা গণ্য করতে হবে এমন কোনো কথা নাই। কবিতা ও গদ্যে যেমন ফারাক নাই, কবিতা ও নাটকের মধ্যেও কোনো পার্থক্য নাই। বাংলাদেশের কবিতা থেকে কীভাবে কাব্যচর্চার নতুন মাধ্যম হিশাবে নাটক স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল সেই ইতিহাস জানলে সত্তর দশকে বাংলাদেশের নাটকে আসলে কী ঘটেছে তার তাৎপর্য বোঝা যাবে। এই দিকটা ধরতে না পারলে সেলিম আল দীনের নাটকের তাৎপর্য বোঝা দুঃসাধ্যই হবে বলে আমার ধারণা।’

১০.
সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি 
জন্ম ও শৈশব : নাট্যকার সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে। বাবার চাকুরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনা করেছেন তিনি। 
শিক্ষা : সেলিম আল দীন ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন সেলিম আল দীন। 
পেশা : বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে কপি রাইটার হিসেবে চাকুরি জীবন শুরু করলেও পরে সারাজীবন শিক্ষকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। 
রচিত গ্রন্থ : প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক' (১৯৭৩)। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক-গ্রন্থ: 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন' (১৯৭৫), 'বাসন' (১৯৮৫) 'মুনতাসির', 'শকুনত্মলা', 'কিত্তনখোলা' (১৯৮৬), 'কেরামতমঙ্গল' (১৯৮৮), 'যৈবতী কন্যার মন' (১৯৯৩), 'চাকা' (১৯৯১), 'হরগজ' (১৯৯২), 'প্রাচ্য' (২০০০), 'হাতহদাই' (১৯৯৭), 'নিমজ্জন' (২০০২), 'ধাবমান', 'স্বর্ণবোয়াল' (২০০৭), 'পুত্র', 'স্বপ্ন রজনীগণ' ও 'ঊষা উত্সব'৷ রেডিও টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক: 'বিপরীত তমসায়' (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), 'ঘুম নেই' (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), 'রক্তের আঙ্গুরলতা' (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), 'অশ্রুত গান্ধার' (বিটিভি, ১৯৭৫), 'শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য' (বিটিভি ১৯৭৭), 'ভাঙনের শব্দ শুনি' (আয়না সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), 'গ্রন্থিকগণ কহে' (বিটিভি ১৯৯০-৯১), 'ছায়া শিকারী' (বিটিভি ১৯৯৪-৯৫), 'রঙের মানুষ' (এনটিভি ২০০০-২০০৩), 'নকশীপাড়ের মানুষেরা' (এনটিভি, ২০০০), 'কীত্তনখোলা' (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)৷ 
গবেষণাধর্মী নির্দেশনা: 'মহুয়া' (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), 'দেওয়ানা মদিনা' (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), 'একটি মারমা রূপকথা' (১৯৯৩), 'কাঁদো নদী কাঁদো', 'মেঘনাদ বধ' (অভিষেক নামপর্ব)৷ অন্যান্য: 'চাকা' নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪, 'কীত্তনখোলা' নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে৷ 'একাত্তরের যীশু' চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে। 
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৮৫; কথক সাহিত্য পুরস্কার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা); নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫। 

১১.
বাংলা নাট্যের মহাকবি সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। সেলিম আল দীনের মৃত্যু তো আসলে মৃত্যু নয়, এটা আরেক উজ্জীবনের নাম। তাঁর চলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর অস্তিত্বকেই বরং আমরা বারবার টের পাব তাঁর রচনাবলির মধ্য দিয়ে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অর্পন করে গেছেন, তা তাদেরকে অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যাবে। স্বদেশ, স্বকাল, ইতিহাস ও সময়ের নিরন্তর প্রবাহের ভেতর তার অন্বেষণকে শিল্প ও সাহিত্যের দুনিয়ার মানুষেরা নিরন্তর শ্রদ্ধা করে চলেছে। আচার্য সেলিম আল দীনের মৃত্যুবার্ষিকীতে আবারও জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসুত্র: বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক ভোরের কাগজ, থিয়েটারওয়ালা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত