জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

এরভিন শ্রয়েডিংগার

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫২

১.
আধুনিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিংগার ১৯৩৩ সালে শ্রয়েডিংগার সমীকরণের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এরভিন শ্রয়েডিংগার ১৮৮৭ সালের ১২ আগস্ট অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৬১ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক জীববিজ্ঞানী যাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনকদের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি জীববিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের দর্শনেও খুব উৎসাহী ছিলেন। জৈব-পদার্থবিজ্ঞানের উপর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তারই লেখা। জীবন দর্শনের বিষয়ে আমার অপার আগ্রহের কারণেই এই মহান বিজ্ঞানীর রচনার প্রতি আমি বিশেষভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়ি। স্বীকার করি, তাঁর ‘প্রাণ কী ?’ বইটির রচনাগুলো আমার চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে।

২.
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম স্থপতি এরভিন শ্রয়েডিংগার (জার্মান Erwin Schrödinger এয়াভিন্ শ্র্যোডিঙা, জন্ম: ১২ আগস্ট, ১৮৮৭–প্রয়াণ: ৪ জানুয়ারি, ১৯৬১) একজন অস্ট্রীয় পদার্থবিদ, যিনি দর্শনচর্চা করতেন, বিজ্ঞান বিষয়ক লেখনীতেও সাহিত্য ও দর্শনকে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল তাঁর বহুল আলোচিত বিজ্ঞান গবেষণা সংক্রান্ত তত্ত্ব। রেনে দেকার্ত, স্পিনোজা, গ্যেটেসহ অনেক দার্শনিক-সাহিত্যিকের লেখার সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর রচনায়।

৩.
এরভিন শ্রয়েডিংগার অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ১৮৮৭ সালের ১২ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটে। এই প্রতিষ্ঠানের গৌরব ছিল আকাশচুম্বী, কারণ এর বিনির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন অস্ট্রিয়ার সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী লুডভিগ বোলৎসমান। এরভিন শ্রয়েডিংগার এখানে ছাত্র হিসেবে আসার আগেই অবশ্য বোলৎসমান আত্মহত্যা করেন। বোলৎসমানই প্রথম নিয়মতান্ত্রিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জগতে পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্যতার গোড়াপত্তন করেছিলেন। ১৯২১ সালে এরভিন শ্রয়েডিংগার ইউনিভার্সিটি অফ জুরিখ এ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখানে থাকা অবস্থাতেই তরঙ্গ বলবিদ্যার ধারণা প্রকাশ করেন, শ্রয়েডিংগার সমীকরণ সমৃদ্ধ তার গবেষণাপত্রটি এ সময়ই প্রকাশিত হয়। মাক্স প্লাংক বলেছিলেন, "এই সমীকরণই আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেছে, ধ্রুপদী বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠায় আইজ্যাক নিউটন, জোসেফ লুই লাগ্রাঞ্জ এবং উইলিয়াম রোয়ান হ্যামিল্টন দের যে ভূমিকা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রতিষ্ঠায় এরভিন শ্রয়েডিংগারেরও সেই ভূমিকা।"

৪.
১৯২৬ সালে মাক্স প্লাংক ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিন এর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলে এরভিন শ্রয়েডিংগারকে জুরিখ থেকে এখানে চলে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রুশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর সদস্যপদ গ্রহণের অনুষ্ঠানে শ্রয়েডিংগার বলেছিলেন,"পুরনো ভিয়েনা ইনস্টিটিউট, যা এখনও লুডভিগ বোলৎসমানের শোক কাটিয়ে উঠছে, যে ভবনে ফ্রিডরিশ হাজেনয়াল ও ফ্রানৎস এক্সনার এর মত বিজ্ঞানীরা কাজ করে গেছেন, আমাকে বোলৎসমানের চিন্তাধারার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছিল। তার আদর্শই ছিল বিজ্ঞানের প্রতি আমার প্রথম ভালবাসা। আর কেউই আমাকে এতোটা আনন্দ দিতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। আধুনিক পরমাণু তত্ত্বের দিকে আমার যাত্রা ছিল বেশ ধীর। এর মধ্যকার পরষ্পরবিরোধিতাগুলো বোলৎসমানের পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ যুক্তির তুলনায় অনেক রুক্ষ ও স্থূল শোনাতো। এমনকি আমি এক সময় এ থেকে পালিয়ে গিয়ে এক্সনার ও ফ্রিডরিশ কোলরাউশ এর সহায়তায় বর্ণ তত্ত্বে আশ্রয় নিয়েছিলাম। চূড়ান্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েও পরমাণু তত্ত্বের ধারণা পরিষ্কার করতে আমি অনেক পরীক্ষা চালিয়েছিলাম, বর্জনও করেছিলাম অনেক প্রচেষ্টা। প্রথম স্বস্তি মিলেছিল লুই দে ব্রই এর তত্ত্বে যার ইলেকট্রন তরঙ্গ বিষয়ক ধারণাকে আমি তরঙ্গ বলবিদ্যায় রূপ দিয়েছিলাম। তারপরও একদিক দিয়ে তরঙ্গ বলবিদ্যা এবং অন্যদিক দিয়ে ভের্নার হাইজেনবের্গ এর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা যে ধারার জন্ম দিয়েছে তা পুরোপুরি আত্মস্থ করা থেকে আমরা অনেক দূরে আছি।"

৫.
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবচেয়ে পরিচিত প্যারাডক্স সম্ভবত শ্রয়েডিংগারের বিড়াল, যা কিনা কোয়ান্টাম সুপার-পজিশন প্রদর্শক সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা বলে যে, কোন বস্তু একই সাথে দুইটি ভিন্ন অবস্থায় থাকতে পারে না, কিন্তু কোয়ান্টাম সুপারপজিশন বলে পারে! আর তাই বলা হয়ে থাকে, বাস্তব জীবনে যদি সত্যিই সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম সিস্টেম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, তবে তা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।

৬.
নোবেল বিজয়ী অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ এরভিন শ্রয়েডিংগার ১৯৪৩ সালে এক সেমিনারে বলেছিলেন, জীবন হচ্ছে ‘এ কেমিক্যাল স্ট্রাকচার ইন লিভিং সেলস।’ সত্যিই তা–ই। কারণ জীব শরীর হচ্ছে (এককোষী ব্যাকটেরিয়া থেকে বিলিয়নকোষী মানবদেহ পর্যন্ত) এক থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন মাইক্রোস্কপিক সেলের এমন এক সুশৃঙ্খল পরিকাঠামো, যা জীবদেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শতকরা ৬৫ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত জল ও অন্যান্য জলীয় রসায়ন দ্বারা পরিপূর্ণ। জীবের সব রকম ফিজিওলজিক্যাল ফাংশনই (শরীরের গ্রোথ, ডেভেলপমেন্ট, রিপ্রোডাকশন প্রক্রিয়া ইত্যাদি) মূলত জীবদেহের মাইক্রোস্কপিক কোষগুলোর কার্যকারণ সম্পর্কের সুশৃঙ্খল, সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া। অনাদিকাল থেকে জীব সৃষ্টি ও জীবন রক্ষায় জলের ভূমিকা তাই অনন্য সাধারণ ও অপরিহার্য।এই জীবকুলের যথাযোগ্য বাসভূমি হয়ে উঠতেই জীবদেহের পরিকাঠামোর মতো সাগর মহাসাগর পরিবেষ্টিত জলের শয্যায় শায়িত বসুধা জননীর গঠন প্রক্রিয়াও। জীবকোষের প্রধান তিনটি স্তরের মতো পৃথিবীর শরীরও গঠিত হয়েছে প্রধান তিন স্তর দিয়ে (Interior layers)। ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স বজায় রাখতে এরা সিরিজ অব সিস্টেমসের মাধ্যমে জীবকোষের মতো পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত রয়েছে নিয়ত। পারস্পরিক সম্পর্কের এই ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে নানা পদার্থমিশ্রিত ভূগর্ভের বিপুল জলরাশি। জগৎ সৃষ্টির প্রথম পর্বে পৃথিবীকে যা জীবধাত্রী হয়ে উঠতে প্রস্তুতি দিয়েছিল। এ কথা বললে তাই অত্যুক্তি হয় না, ভারী বিছানার চাদরের মতো তিন স্তরের সুবিস্তৃত পৃথিবী মূলত ভেসে রয়েছে নানা কেমিক্যাল আর পদার্থ মেশানো এক তরল জলের বিছানায়। ভূপৃষ্ঠের সিংহভাগও (৭০ শতাংশ) আবৃত রয়েছে সাগর মহাসাগরের তরল আবরণ দিয়ে। সর্বজীবের উপযোগী তাপমাত্রা অক্ষুণ্ন রাখতে এই সাগর–মহাসাগরই কোটি কোটি ঊর্মিমালার মধ্যেমে বায়ুমণ্ডলের সোলার রেডিয়েশনকে (Heat energy) শুষে নিচ্ছে নিরন্তর। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তৈরি করছে বৃষ্টির শরীর, যার বর্ষণপাত ভিজিয়ে দিচ্ছে বায়ুমণ্ডলের সব শুষ্কতা। উর্বরতা দিচ্ছে শস্য ফলানোর মাঠকে। আবার এই বৃষ্টিপাতের কারণেই সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে ভূগর্ভসহ নানা জলের উৎসগুলোতে সঞ্চিত হচ্ছে জীবের ব্যবহার উপযোগী প্রচুর পরিমাণে পরিচ্ছন্ন জল (Fresh water)। জলের সঙ্গে তাই জগৎ ও জীবের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। (বিশ্বে জল ও জীবের ভবিষ্যৎ : দীপিকা ঘোষ, দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪)।

৭.১
‘বিজ্ঞান, শিল্প ও ক্রীড়া’ (মূল প্রবন্ধ Science, Art and Play) প্রবন্ধে এরভিন শ্রয়েডিংগার লিখছেন,‘মানুষ এবং অন্য সকল প্রজাতির সদস্যদের চিন্তা ও কর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের প্রয়োজন মেটানো এবং জীবন সংরক্ষণ। প্রতিবেশ জীবন ধারণের খুব বেশী প্রতিকূলে না থাকলে একটি উদ্বৃত্ত শক্তি থাকে- কেবল মানুষ নয়, অন্যসব প্রাণীর ক্ষেত্রেও এটি সত্য। ইতর প্রাণীদের জীবনে এই উদ্বৃত্ত শক্তি খেলাধুলায় প্রকাশিত হয়। খেলার সময় সকল প্রাণীই সচেতনভাবে জানে যে, এটি তার জীবনের কোন প্রয়োজন মেটানোর সাথে সম্পর্কিত নয়। একটি উলের বল পেলে বিড়ালছানা উৎফুল্ল হয়ে উঠে ঠিকই, কিন্তু এতে কোন সুকুমার বৃত্তির আশা করে না। লালায় সিক্ত পাথরটি ধাওয়া করতে করতে কুকুর আমাদের দিকে কাতর চোখে তাকায়, বলতে চায়, “আমার কোন লক্ষ্য নেই, পাথরটি ছুঁড়ে একটি লক্ষ্য ঠিক করে দাও”। মানুষের ক্ষেত্রে এই একই উদ্বৃত্ত শক্তি শারীরিক ক্রীড়ার পাশাপাশি এক ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রীড়ারও জন্ম দেয়। সাধারণভাবে এ ধরণের সকল বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রীড়াকেই তাস খেলা, বোর্ড গেম, ডোমিনো বা ধাঁধার মত খেলার সাথে তুলনা করা যায়। এমনকি বিজ্ঞানকেও আমি এই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রীড়ার শ্রেণীভুক্ত করব, সব বিজ্ঞান না হলেও অন্তত আভঁ গার্দ বিজ্ঞান যাতে বিশুদ্ধ গবেষণার স্বাদ পাওয়া যায়।’

৭.২
এরভিন শ্রয়েডিংগার লিখছেন, ‘ক্রীড়া, শিল্প এবং বিজ্ঞান- মানুষের কাজকর্মের এমন একটি অংশ যেখানে লক্ষ্য ও কার্যপদ্ধতি জীবনের কোন প্রয়োজনীয়তা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার তাগিদ থাকলেও যিনি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি শীঘ্রই সেই তাগিদ ভুলে মনের আনন্দে গবেষণায় মেতে উঠেন। সত্যি বলতে প্রয়োজনীয়তা আর চাহিদার ভাবনা মন থেকে দূর করতে না পারলে গবেষণায় উন্নতিই হয় না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রীড়ার উদ্দেশ্য ছাত্র বা শিল্পী নিজেই ঠিক করে এবং সেই উদ্দেশ্য হয় বাহুল্য- যা সাধন না হলেও কোন আসন্ন ক্ষতি নেই। সুতরাং এখানে অস্তিত্ব রক্ষার নগ্ন সংগ্রাম ছাপিয়ে আমাদের সামনে একটি উদ্বৃত্ত শক্তি সরাসরি কাজ করছে। সে হিসেবে শিল্প এবং ক্রীড়ার মত বিজ্ঞানও একটি বিলাসিতা- এই ধারণাটি একালের তুলনায় গত শতাব্দীতে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেতো। সেকালে কেবল রাজকুমার ও বিত্তবান রাজনীতিবিদরাই শিল্পী ও বিজ্ঞানীদেরকে নিজের দরবারে আনিয়ে আপাত-অলাভজনক কাজের বিনিময়ে তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। বিনোদন এবং নগর ও স্বয়ং রাজকুমারের সুনাম বৃদ্ধি ছাড়া এই বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রীড়াবিদদের আর তেমন কোন অবদান থাকতো না। প্রতি যুগেই এই ক্রীড়াকে অভ্যন্তরীণ শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হয়েছে; সাধারণ জনগণ এবং এমনকি শাসকরাও এই বিশুদ্ধ ও মহিমান্বিত বিলাসিতার অধিকারীদের ঈর্ষা করত।’

৭.৩
এরভিন শ্রয়েডিংগার মনে করেন, ‘এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঐকমত্য পোষণ করলে বলা যায়, অতীতের সকল যুগের মত বর্তমান যুগেও বিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জীবন যাপনের সাধারণ আনন্দ বৃদ্ধি করা। তাই একজন বিজ্ঞানের শিক্ষকের কাজ তার ছাত্রদেরকে পেশাগত জীবনে উপযোগী জ্ঞান বিতরণ হলেও তাকে সেই জ্ঞান এমনভাবে বিতরণ করতে হবে যাতে ছাত্ররা আনন্দ পায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ব্যস্ত প্রকৌশলী যাদের মূল উদ্দেশ্য বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কারের প্রায়োগিক দিক অনুসন্ধান তাদের সামনে বক্তৃতা দিতে এই শিক্ষকের যতটা আনন্দ হয়, কর্মজীবী মানুষ যারা তাদের কর্মব্যস্ত জীবনের একটি ঘণ্টা তার কথা শুনে বুদ্ধিবৃত্তিক তৃপ্তি লাভের সংকল্প করেছে তাদের সামনে কথা বলতেও তার ততোটা আনন্দ হতে হবে। বিশুদ্ধ জ্ঞান যে কি পরিমাণ আনন্দ দিতে পারে তা বলে বোঝানোর কিছু নেই; যাদের এ অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা খুব ভাল করেই জানে যে এর মধ্যে একটি গাঢ় নৈসর্গ্যিক উপাদান রয়েছে, বিশাল কোন শৈল্পিক কাজ সম্পাদনের যে আনন্দ অনেকটা তারই মত। যাদের অভিজ্ঞতা হয়নি তারা বুঝবে না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদেরকে আমাদের সমাজবৃক্ষে অবনতশাখা হয়ে থাকতে হবে, কারণ তারা জীবনপাত্র পূর্ণ করতে শিল্প-ক্রীড়ার বিশাল উন্মুক্ত ভাণ্ডার থেকে যে কোনটি বেছে নিতে পারে, হতে পারে ক্রীড়াবিদ, নৃত্যশিল্পী বা অ্যাথলেট। সাধারণভাবে বলা যায়, এই সবকিছুই একটি মহান শক্তির প্রস্ফূটন, সকল উপযোগিতার কাজ শেষে যে শক্তিটুকু নিজে আনন্দ লাভ এবং অন্যকে তা বিলোনোর জন্য আমাদের হাতে অবশিষ্ট থাকে।’

৭.৪
এরভিন শ্রয়েডিংগার আরো লিখছেন, ‘এত সমান্তরাল টানার পরও স্বীকার না করে উপায় নেই, বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে, আরও বেশি আছে হয়ত বিজ্ঞান ও ক্রীড়ার মাঝে। কারণ মানুষের ব্যবহারিক জীবন সাজানো এবং তার চাহিদা পূরণের উপর বিজ্ঞানের গভীর প্রভাব আছে। বলা যেতে পারে বিজ্ঞান প্রধানত বাস্তব জগতে আমাদের কল্যান সাধনের কাজ করেছে, ডাক্তার ও প্রকৌশলীর দক্ষতা এবং আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের প্রজ্ঞা যার ফসল। অনেক রাশভারী বিশ্লেষক বলতে পারেন, নতুন আবিষ্কারের আনন্দের তুলনায় সমগ্র মানবতার কল্যানের গুরুত্ব বেশি কারণ আনন্দটুকু কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও তাদের পাঠক-শ্রোতাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে শিল্পের জগতে এই অংক কষতে গিয়ে বেশ উদ্ধতভাবেই তিনি উল্টো সিদ্ধান্ত টানবেন। আর আমরাই কি বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ফলগুলোকে কিছু বিনোদনের উপজাত হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত? গবেষণার মূল আনন্দ কি তার মহৎ ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে নিহিত? তেমন হলে ক্রীড়ার সাথে তার বিভাজন রেখা টানতে হবে।’

৭.৫
এরভিন শ্রয়েডিংগার বলেন, ‘তবে মূল্যবোধের বিচার বেশ ঝামেলার। আধুনিক শল্যচিকিৎসক বা মহামারী রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত গবেষকদের কতটুকু ধন্যবাদ প্রাপ্য সে নিয়ে তর্ক চলে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, শল্যচিকিৎসার উন্নতি প্রয়োজন ছিল ফলিত বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর প্রগতির একটি প্রতিষেধক হিসেবে, তা না হলে যানবাহন আর বন্দুকের জখম সারিয়ে তোলার কেউ থাকত না। ফলিত বিজ্ঞানের কুৎসা রটানোর কোন উদ্দেশ্য আমার নেই, বরং আমি তো মনে করি তার এত খ্যাতির পক্ষে প্রধান যুক্তি হচ্ছে, সে বস্তুগত কল্যান এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে, সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক মুল্য সৃষ্টি করে বা তাকে সংবর্ধিত করে। এই মূল্য আবার বিরাজ করে তার নিজের খাতিরেই, কোন বস্তুগত লাভের খাতিরে নয়। দূরত্বকে জয় করে মানুষ পারষ্পরিক বোঝাপড়া এবং যোগাযোগে যে বিপ্লব সাধন করেছে তার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যেহেতু আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক। আমি স্বীকার করছি, এই দূরত্ব-জয়ের বস্তুগত দিক রয়েছে। হামবুর্গের একজন বণিক এখন মাত্র ৪ দিনে নিউ ইয়র্ক পৌঁছাতে পারে, জাহাজে থেকেই প্রতিদিন লেনদেনের সমীকরণগুলো বেতারের মাধ্যমে জেনে নিতে পারে, নিজের অফিসে নির্দেশনা পাঠাতে পারে। কিন্তু আমরা, এই মানবেরা, কি সত্যিই ব্যবসায়িক লেনদেনের দ্রুততা নিয়ে এতটা উৎসাহী? আমি তা অস্বীকার করছি। আমাদের অন্তরে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু আছে। আমাদেরকে প্রকৃত আনন্দ দেয় অন্য কিছু: আগের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ ভিনদেশে পাড়ি জমাতে পারে, জাতিগুলো পরষ্পরের কাছাকাছি আসতে পারে, এক সভ্যতা পারে আরেক সভ্যতার সমঝদারি করতে, বুঝতে পারে একে অপরকে। দুরন্ত অভিযাত্রীরা মেরুর বরফ ভেদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই না, কারণ প্রতিদিনই তাদের কাছ থেকে তারবার্তা পাই, জানতে পারি তারা কোথায় আছে, প্রয়োজনে সাহায্যও করতে পারি। উপরন্তু বলতে হয়, বিশুদ্ধ কৌশলগত আনন্দ, সমস্যা সমাধানের তুষ্টি, সাফল্যের সুখ ইত্যাদি দিনদিন ব্যবহারিক সুবিধার তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যারা উদ্ভাবনগুলো করে তারা সবসময়ই এই তুষ্টি ভোগ করে এসেছে, কিন্তু এখন সাধারণ মানুষের মাঝেও এটি ছড়িয়ে পড়ছে। ভাল্টার ফন ডেয়া ফোগেলভাইডে, তোরকুয়াতো তাসো এবং লুদোভিকো আরিয়োস্তো যে যে রাজসভায় কাব্যচর্চা করতো সেগুলো গৌরবান্বিত হয়েছিল, আর এ যুগে জেপেলিন এবং আটলান্টিকের ব্লু রিবন গোটা জার্মানিকেই এমন খ্যাতি এনে দিচ্ছে।’

৭.৬
এরভিন শ্রয়েডিংগার লিখছেন, ‘এমন কিছু সাধারণ উদাহরণ থেকে প্রত্যয়ে পৌঁছানো যায় যে, বিজ্ঞান আসলে যতটা ভাবা হয় তত নিবেদিতপ্রাণ সেবক নয়, বস্তুগত কল্যানের প্রতি তার দৃষ্টি আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক কম, অন্যদিকে বিশুদ্ধ আদর্শিক আনন্দের প্রতি তার অবদান আমাদের কল্পনার চেয়েও বেশি। এটা সত্যি যে বিজ্ঞানের এমন আনন্দঘন মুহূর্ত বেশ বিরল, তাৎক্ষণিৎ ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমে সকলের মন কেড়ে নেয়ার মত আবিষ্কার বা উদ্ভাবন হরহামেশা হয় না। বিজ্ঞান যখন মানুষের সামনে একটি শৈল্পিক সৃষ্টি তুলে ধরতে পারে তখনই কেবল আনন্দের প্রাবল্য চোখে পড়ে। দুই হাজার বছর আগে সৌন্দর্য্যকে স্বপ্নে দেখে এক শিল্পী যে শ্বেত পাথরের মূর্তি গড়েছিল তা একালে প্রত্নতত্ত্ববিদরা বার্লিন জাদুঘরে স্থাপন করেছেন। এই মূর্তির সামনে যারা দুরু দুরু বক্ষে রুদ্ধ নিশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের নিশ্চয়ই প্রত্নতত্ত্ববিদদের সে প্রচেষ্টার কারণ বুঝে নিতে এক বিন্দু দেরি হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর পথ দীর্ঘ ও বন্ধুর, কিছু বিরল ক্ষেত্রে আবার সে পথেও বাঁধা থাকে। কিন্তু আমরা মনে করি জ্ঞানবৃক্ষের এই প্রান্তিক কুঁড়িগুলোরও অস্তিত্বশীল থাকার অধিকার আছে; কারণ প্রতিটি প্রান্ত একে অপরকে উর্বর করে তুলতে পারলেই কেবল পুরো সম্প্রদায়ের জন্য আকাঙ্ক্ষিত ফলটি ফলবে। যেমন জার্মানিতে জেপেলিন বহনের উপযোগী জাহাজ গ্রাফ জেপেলিন নির্মান এবং তারও বহু বছর আগে খ্রিস্টপূর্বে দ্বিতীয় শতকে এশিয়া মাইনর নির্মীত পেরগামন বেদি।’

৭.৭
এরভিন শ্রয়েডিংগার বলেন, ‘একদিক দিয়ে চিন্তা করলে, একটি সাংস্কৃতিক অর্জন কত জন ব্যক্তি উপভোগ করছে তা অপ্রাসঙ্গিক। মানব মন তো দূরের কথা জীবনের কোন রূপকেই পাটিগণিত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না- গুণ-ভাগ এখানে অসম্ভব। একজন চিন্তাবিদের মনে যে চিন্তা খেলে যায় তা আরও কয়েক শত মানুষ অনুসরণ করলেও চিন্তার কোন বৃদ্ধি ঘটবে না। এই যুক্তি সত্যি হলেও মনে রাখতে হবে আমরা এখানে সংস্কৃতির একটিমাত্র অর্জন বা অঙ্গন নিয়ে আলোচনা করছি না, বরং সংস্কৃতির ক্ষেত্রই অসংখ্য। তাই একেবারে বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আবিষ্কারক তার আবিষ্কারের যতোটা সান্নিধ্য পেয়েছেন সাধারণ মানুষ ততোটা না পেলেও আবিষ্কারটির কথা সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এতে করে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ অনুকূল পরিবেশে একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যমূলক সম্পদে পরিণত হতে পারে যা গাণিতিক না হলেও অন্য এক ধরণের গুণন ঘটিয়ে দেয়। এক সময় এটি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের গুণনের চেয়েও বেশি কিছু হয়ে যায়। চিন্তা যখন ফলবতী হয় তখন সে অদৃষ্টপূর্ব সব উন্নয়নের দুয়ার খুলে দেয়।’

৮.১
একই প্রবন্ধে এরভিন শ্রয়েডিংগার বলছেন, ‘মাঝে মাঝে বলা হয় পদার্থবিজ্ঞান বর্তমানে একটি রূপান্তর ও বিপ্লবের পর্যায়ে আছে অনেকে আবার যাকে ক্রাইসিস হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই পর্যায় অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড এবং জীবনীশক্তি বৃদ্ধির পর্যায়। ইংরেজি ক্রাইসিস শব্দটি গ্রিক থেকে এসেছে সে ভাষায় যার অর্থ “সিদ্ধান্ত” (বাংলায় যদিও প্রতিশব্দ করা হয় সংকট). ভাষাগত অর্থে নিলে পদার্থবিজ্ঞান এখন ক্রাইসিসেই আছে। কিন্তু একে আবার ব্যবসায়িক ক্রাইসিস তথা সংকটের সাথে গুলিয়ে ফেলার অবকাশ নেই। ব্যবসার জগতে সংকটকালে ভয়ংকর সব সিদ্ধান্তের খেলা চলে এবং একসময় নেমে আসে পরিপূর্ণ ধ্বস। অন্যদিকে বিজ্ঞানের জগতে ক্রাইসিসের ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যায়: নতুন কিছু তথ্য বা ধারণার উৎপত্তি ঘটেছে যেগুলো আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের উত্তরে নির্দিষ্ট একটি অবস্থান নিতে চাপ দিচ্ছে, যে প্রশ্নগুলো আগে উন্মুক্ত ছিল বা যেগুলোর কোন সুস্পষ্ট উত্তর জানা ছিল না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের দিকে ধাবিত হওয়া এবং বিজ্ঞানের জগতে এমন অবস্থান সাধারণত পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষণের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। বিষয়টি যত গুরুত্বপূর্ণ তার দ্বারা সৃষ্ট ক্রাইসিস তত ভয়ংকর এবং এর সমাধানের মাধ্যমে আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মাত্রাও তত বেশি বৃদ্ধি পায়। আমি স্বীকার করছি এই ক্রান্তিকালের সাথে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মিল আছে, কারণ এতদিন ধরে সত্যি বলে ধরে নেয়া কিছু বিষয় এ সময় মিথ্যে হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু রোগের সাথে এর একটি বড় পার্থক্য আছে- বিজ্ঞান সবসময়ই নিশ্চয়তা দেয় যে রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তির পর সে অপেক্ষাকৃত মুক্ত, সুখী এবং সংহত জীবন লাভ করবে। বিভিন্ন বিজ্ঞানের সংকটগুলো জানার পর কেউ যদি ধরে নেয় বিজ্ঞানের একটি সাধারণ ঊষালগ্ন আছে তাহলে ভুল হবে, কারণ তা শব্দের অপপ্রয়োগ বৈ অন্য কিছু নয়। ক্রান্তিকাল বা কোন ধরণের দুর্যোগই অস্বাভাবিক নয় এটা ধরে নেয়া যায়। তবে সকল ধরণের মূল্যবোধের পুনঃমূল্যায়ন এবং পরিবর্তন কিন্তু ধ্রুব সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে এই পুনঃমূল্যায়ন কেন বিজ্ঞানের সকল শাখায় এত প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে? গণিত, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান- পুনঃমূল্যায়নের সংকট থেকে কারোই মুক্তি নেই। এ কি কোন দুর্ঘটনা?

৮.২
এরভিন শ্রয়েডিংগার আরো লিখছেন, ‘পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো খুব কম সময়ই দুর্ঘটনাবশত হয়। অধিকাংশ সময়ই নতুন ধারণা বা অনুকল্প পরীক্ষণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। যে ধারণাগুলো বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পটভূমি তৈরি করে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, একইসাথে তারা যুগের সাধারণ চিন্তাধারার সাথে একটি আদিম বন্ধনে আবদ্ধ। এর কারণ মানবকূলের যে উল্লেখযোগ্য এবং বর্ধিষ্ণু একটি অংশ বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করে তার সদস্যরাও মানুষ এবং সেহেতু যুগের সাধারণ আদর্শের সাথে নিবিঢ় আত্মীয়তার সূত্রে গাঁথা। এসব আদর্শের প্রভাব বিজ্ঞানের অনেক জটিল এবং কিম্ভূতকিমাকার শাখা-প্রশাখায় প্রস্ফূটিত হয়ে উঠে। কয়েক বছর আগে জ্যোতির্বিজ্ঞান এক ধরণের স্ক্লেরোসিস বা কাঠিন্যদশায় ভুগছিল কারণ তার দিগন্ত ছিল পুরোপুরি সংকটমুক্ত। ধ্রুপদী বা পুরাতন যুগের এই অভিশাপ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান অবশেষে মুক্তি পেয়েছে এবং এর পেছনে আধুনিক সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতির প্রভাব যতোটা তারচেয়ে অনেক বেশি প্রভাব তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের। জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু থেকে আসা বর্ণালী বিশ্লেষণের উপায় বাতলে দেয়ার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানই ক্রাইসিসটির উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। বলেছিল, প্রতিটি তারা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ না করে অনেকগুলো তারার উপর একসাথে তুলনামূলক পরিসংখ্যান প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। পরিসংখ্যানের এই ধারণাটি কিন্তু যুগের সাধারণ আদর্শ থেকেই এসেছিল, সেটি ছিল পরিসাংখ্যিক পদার্থবিজ্ঞানের যুগ। যুগের এই সাধারণ আদর্শই মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রায় অসীম পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছে। আমাদের এই যুগে সবাই প্রথাগত আচারানুষ্ঠান ও মতামতের তীব্র সমালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এতে করে একটি নতুন চেতনার জন্ম হচ্ছে যা কোন ধরণের কর্তৃত্ব মানে না, যা প্রতিটি বিষয়ে স্বাধীন ও যৌক্তিক চিন্তার দাবী জানায়। যুক্তি ও স্বাধীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত যেকোন চিন্তাকেই এই যুগ স্বাগত জানায় তা যত বৈপ্লবিক, প্রথাবিরোধী হোক না কেন, পূর্বতন ধারণার যতই বিরোধী হোক না কেন। আমার মতে বর্তমানে বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সংকটের মূল কারণ এই অভিনব চেতনা। এর ফলাফল আমাদের জন্য সবদিক দিয়েই ভাল হবে: কোন বৈজ্ঞানিক কাঠামোই পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় না, যা টিকে থাকার যোগ্য তা নিজেই নিজেকে টিকিয়ে রাখে, তার কোন সুরক্ষার দরকার পড়ে না। আমার মতে এটি কেবল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই সত্য নয় বরং এর একটি বিস্তীর্ণ প্রয়োগ আছে। যুগের চেতনা চিন্তার জগতে যে আকস্মিক হামলা চালায় তাকে বাঁধা দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই: যা বেঁচে থাকার যোগ্য তা নিজেই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, প্রাণ কী?: এরভিন শ্রয়েডিংগার, অনু: দেবল দেব, মন ও জড়বস্তু: এরভিন শ্রয়েডিংগার, অনু. ড: পূর্ণিমা সিংহ, দেশ: ৫ অক্টোবর-১৯৯৬, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত