প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রামকিঙ্কর বেইজ

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৫

১.
রামকিঙ্কর বেইজ, আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক, পুরোধা ব্যক্তিত্ব, ‘সাধক শিল্পী’। প্রবল স্বাপ্নিক রামকিঙ্কর বেইজ-এর আজন্ম সংগ্রামী জীবন ও সৃষ্টিকর্ম পাঠ শেষে এক কথায় অন্তরে ধ্বণিত হয় ‘... রামকিঙ্কর হয়ে উঠেছেন লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র।’ কলকাতার পিজি হাসপাতালে ১৯৮০ সালের ২ আগস্ট তিনি প্রয়াত হন। অমর এই শিল্পস্রষ্টার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তাঁর জন্ম-সময় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাঁকে যারা চর্চা করেন তারা বলছেন দুইটি দিন-তারিখের কথা- ১৯০৬ সালের ২৫ মে, মতান্তরে ২৬ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। দরিদ্র অন্ত্যজ নিরক্ষর পরিবারের সন্তান প্রান্তিক জীবনের রূপকার রামকিঙ্কর প্রবল আত্মবিশ্বাস আর গভীর প্রজ্ঞায় হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের জীবন শিল্পী। ‘ভারত শিল্পের ইতিহাসে রামকিঙ্কর এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ত্ব’ যাঁর অধিষ্ঠান ছিলো ‘স্বোপার্জিত’। মডার্ণ ওয়েস্টার্ণ আর্ট ও প্রি অ্যান্ড পোস্ট-ক্লাসিকাল ইন্ডিয়ান আর্ট ছিল তাঁর চিত্রশিল্পের মূল বিষয়বস্তু। সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, রবীন্দ্রভারতী কর্তৃক ডি. লিট ও ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব ‘পদ্মভূষণ’লাভ করেছেন। দেশে-বিদেশে তার অনেক একক ও যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় শিল্পকলা চর্চায় আধুনিকতার প্রবক্তা হিসেবে যাদের নাম উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে রামকিঙ্কর বেইজ অন্যতম।

২.
যে সব মানুষেরা প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থেকে সমস্ত প্রতিকূলতার তোয়াক্কা না করে আপন সৃষ্টিতে মগ্ন থেকেছেন, দেশ- দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলেছেন, আর আমাদের দিনগত পাপক্ষয়কে ক্রমেই লজ্জায় ফেলে ব্যাতিক্রমী জীবন কাটিয়েছেন তাঁদের অন্যতম বাঁকুড়ার এক পাড়াগাঁ-এর (হ্যাঁ, তখনো বাঁকুড়ার যুগীপাড়া গণ্ডগ্রামই) এক বিস্ময়! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের যে ‘অন্যরকম’ বাসিন্দাকে নিয়ে ভীষণ মুগ্ধ, যে মানুষের তথ্যচিত্র করার জন্যে অসুস্থ ঋত্বিক ঘটক ছুটে যান বোলপুরে, যে সান্নিধ্য পেতে ভর সন্ধ্যেয় হাজির হতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তিনিই রামকিঙ্কর।‘যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথা বারবার আওড়াতেন তিনি। এ যেন ছিল রামকিঙ্করের জপমালা। তথাকথিত নিচু জাতে জন্ম নেওয়া কিঙ্কর শান্তিনিকেতনেও স্বস্তি পাননি। তাঁর জীবন কেটেছে অস্থিরতার ঘোলাজলে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে। অবিবাহিত এই শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ও শিল্পকর্মের উপর আলো ফেলতে স্বল্প কথায় সম্ভব না হলেও যথাসাধ্য অপচেষ্টা করা হলো মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম স্নেহধন্য রামকিঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন অসামান্য স্রষ্টা, তারই পরিচয় পেলাম সম্প্রতি জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ’ মূল্যবান বইটি পাঠ করে।মাটি থেকে উঠে আসা রামকিঙ্কর সত্যিকার অর্থেই রবীন্দ্র ছায়ায়-প্রভাব বলয়ে থেকেও আপন সৃজনী বিকাশে–প্রকাশে এক আলোকিত স্রষ্টার নাম। আমার ধারণা, রবি কবির প্রচ্ছন্ন ছায়ায়, মায়ায় সেকালেই ‘বোহেমিয়ান’ জীবন যাপনের চরম দু:সাহস দেখাতে পেরেছিলেন ‘মাটির মানুষ’ রামকিঙ্কর সেকালের শান্তিনিকেতনের অনেকটাই ছকে বাঁধা জীবন প্রবাহের মধ্যেও। নিজস্ব ঘরানার সে এক বলিষ্ঠ জীবন দর্শনেরই বহি:প্রকাশ ছিলো বটে!

৩.
আমার শৈশব এবং স্কুল জীবন গ্রামে কাটালেও কিভাবে যেন কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকা অনিয়মিত হলেও পাঠের সুযোগ হয়ে যায়। সেই ‘দেশ’ পত্রিকায় সমরেশ বসু’র ‘দেখি নাই ফিরে’ মহাকব্যিকসম উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে পাঠকালেই আমার পরিচয় ঘটে রামকিঙ্কর বেইজ-এর সৃজনশীল সৃষ্টির সাথে। আর তাই সুযোগ পেয়ে শান্তিনিকেতন ভ্রমণে গিয়ে রামকিঙ্কর বেইজ-এর শিল্পকর্ম বিশেষত ‘সুজাতা’ ছুঁয়ে দেখে ভীষণই শিহরিত হয়েছিলাম, সে স্মৃতিও মনে পড়ছে, সে আলোড়ন আজও যেন চলমান আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ধ্রুপদি কথাশিল্পী সমরেশ বসু ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ‘দেশ’পত্রিকায় ধারাবাহিক রচনা ‘দেখি নাই ফিরে’ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে উপন্যাসটি সম্পূর্ণতা পায়নি। বিকাশ ভট্টাচার্যের অলংকরণ সমৃদ্ধ অসম্পূর্ণ গ্রন্থটি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয় ১ জানুয়ারি ১৯৯২। আমরা জানি, রামকিঙ্করের জীবনী-উপন্যাস লেখার আগে, নিরলস ক্ষেত্রসমীক্ষায় সমরেশ বসু বাঁকুড়ায় আসেন। বাঁকুড়ার লালবাজারে বাজোরিয়া গেস্ট হাউসে ড. পরিমল পাল প্রশ্ন করেন, ‘দেশে এত শিল্পী-কবি-লেখক থাকতে, কেন রামকিঙ্করকে নিয়ে বিশাল উপন্যাস লেখার কথা ভাবছেন?’ সমরেশ বসু হেসে বলেন, ‘রামকিঙ্করের মধ্যে আছে জীবনের বিচিত্র রূপ-রস-ছন্দ, মহাবিশ্বের বিস্ময়রহস্য, আর বিশ্বসত্তার সুবিপুল শিল্প সৌন্দর্য।’ তাঁকে নিয়ে বই লিখবেন বলে বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু, বাঁকুড়ার পথের ধুলো মাড়ালেন কতবার জানতে হলে “দেখি নাই ফিরে”পড়তেই হবে। যদি নাও পড়ে থাকেন আপাতত এটুকু পড়ে নিতে পারেন, তারপর ভাবতে থাকুন, এভাবেও বাঁচা যায় সব বিরুদ্ধতাকে স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে?

৪.
রামকিঙ্কর বেইজ-এর জীবনের কিছু স্বপ্ন ও কথামালা সেলুলয়েডে ধারণ করেছেন ঋত্বিক ঘটক। তথ্যচিত্রটি যতবারই দেখি, ততবারই মুগ্ধতার রেশ শেষ হয় না আমার। উল্লেখ্য, বিখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের (জন্ম : ২৫ মে, ১৯০৬- প্রয়াণ : ২ আগস্ট, ১৯৮০) ৪ দিন ব্যাপী কাজের চিত্রধারণ করেছিলেন শান্তিনিকেতনে ১৯৭৫ সালের জুলাইতে, আরেক বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক (১৯২৫ -১৯৭৬) । পরবর্তীতে তিনি আরও কিছু সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়াতে চলচ্চিত্রটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ঋত্বিক ঘটক শান্তিনিকেতন গিয়ে ১৬ মি.মি. রঙিন একটি তথ্যচিত্র করলেন কিঙ্করকে নিয়ে। অসুস্থ, তবু গেলেন। প্রতি ফ্রেমে নিজের মতো করে ভেঙেচুরে দেখালেন ভাস্করকে। গোড়ার দিকে একটি ফ্রেমে ক্লোজআপে দেখা গেল বুদ্ধের মুখ। ব্যাকড্রপে পাখোয়াজ। একটু পরেই ফ্রেমে ঢুকল অদূরে ক্ষীণ কটি, দীর্ঘাঙ্গী বনবালা— সুজাতা। ইউক্যালিপটাসের ছায়া সুনিবিড় পথে মাথায় পায়েসের রেকাব নিয়ে সে যেন হেঁটে চলেছে। মাদল আর বাঁশির আবহে কোপাই নদীর ধারে আদিবাসী গ্রাম, অনম্র বুক— সুঠাম আর ভারী কোমরের সাঁওতাল মেয়ে— ফ্রেমের পর ফ্রেমজুড়ে ঋত্বিক যেন কিঙ্করের রোদছায়া মাখা আদুল ক্যানভাস এঁকে চলেছেন। একটি ফ্রেমে ধরা দিলেন দুই শিল্পী। জড়ানো গলায় ঋত্বিকের সংলাপ, ‘‘কিঙ্করদা...!’’ ‘‘হুঁ।’’ ‘‘আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’ রামকিঙ্কর স্মৃতিতাড়িত হয়ে একচোট হাসলেন। তারপর বলেন, বলে চলেন, ‘‘উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’ছবি এগোয়, কিন্তু শেষ হয় না। দৃশ্য ফুরিয়ে যায়। প্রায় পুরো ছবির শ্যুটিং শেষ করে প্রাথমিক সম্পাদনার পর ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডট্র্যাকের কাজ শুরুর মুখেই চিরবিদায় নিলেন ঋত্বিক। অসমাপ্ত তথ্যচিত্রের স্ক্রিনজুড়ে একসময় নেমে আসে দুই শিল্পীর মুখোমুখি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শোনা যায় ঋত্বিক আর কিঙ্করের কথা। ঋত্বিক প্রশ্ন করেন, ‘‘এই যে আপনার চাল ভেঙে পড়ছে, জল পড়ছে, কী ভাবে সারাবার চেষ্টা করছেন আপনি?’’ রামকিঙ্কর বলেন, ‘‘পেনশনের টাকা যেটুকু পাই। সেইটুকু থেকে করছি আর কী!’’ ‘‘সেটা কি ছবি টাঙিয়ে করা হচ্ছে?’’ কিঙ্কর হেসে ফেলেন। বলেন, ‘‘সেও আছে’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘বড় বড় ক্যানভাস যেগুলো, সেগুলো উলটে দেওয়া আছে। অয়েল কালার কিনা। উপরে কোনও ক্ষতি হবে না। বৃষ্টি পড়ে কিনা, তাই ওগুলো ঝুলিয়ে দিই। ... এগজিবিশনের জন্য ক্যানভাসগুলি নিয়ে যেতে হল, তখন আর কী ঝোলাব?...’’ হাসতে হাসতে বলে চলেন, ‘‘খড় কিনতে হত, কিন্তু যেটুকু টাকা পাই...’’। ‘এখন কোনও কাজ নেই। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। এখন তো আর আঁকতেও পারি না।... চোখে দেখতে পাই না কিছুই। পড়তেও পারি না, কেউ পড়ে দিলে শুনি। কেউ ধরলে হাঁটতে পারি। সমর্থ বয়সের অত্যাচার তার শোধ তুলে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়। পাগল পাগল লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। একেবারে বাতিল হয়ে গেছি। চোখ চলছে না, হাত চলছে না, চোখ অন্ধ। মনে মনে আঁকছি।’

৫.
আধুনিক ভারতীয় কলা-ইতিহাসে ব্যক্তিত্বে, প্রতিভায়, কলা-সাধনায় রামকিঙ্করের তুল্য দ্বিতীয় কোনও শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এ কথা তাঁর বন্ধু, সতীর্থ, সহকর্মী, প্রত্যক্ষ পরিচিতদের কাছে যতই সত্য হোক, উত্তরকালের কাছে তার সাক্ষ্য-প্রমাণ পৌঁছে দেওয়া যাবে না কেবলমাত্র তাঁর শিল্পকৃতির মাধ্যমে। ‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে... কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভ’ বা ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ’— এমন সব উচ্চারণ সাম্প্রতিক কাব্যতত্ত্বে বাতিল হলেও পৃথিবী জুড়ে মহৎ স্রষ্টাদের জীবনী লেখা বন্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সমরেশ বসু, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে রামকিঙ্কর হয়ে উঠেছেন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র। অবশ্য ধরাবাঁধা ছকে চলা শিল্পী তিনি কোনওকালেই ছিলেন না, তাই তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে বিবিধ লেখা পেয়েছেন পাঠক- প্রবন্ধ, উপন্যাস (‘দেখি নাই ফিরে’র পর মণীন্দ্র গুপ্তও লিখেছেন ‘রং কাঁকর রামকিঙ্কর’ নামে একটি রচনা), নাটক (রামকিঙ্করের বান্ধবী বিনোদিনী মণিপুরি ভাষায় লিখেছিলেন ‘অশংবা নোংজাবী’ নামে একটি নাটক, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র শিল্পী গৌতম অনেকটাই রামকিঙ্করের আদলে নির্মিত), ‘রামকিঙ্কর’ উপন্যাস লিখেছেন শান্তি সিংহ ইত্যাদি। প্রকাশ দাস সম্পাদিত ‘রামকিঙ্কর: অন্তরে বাহিরে’ বইয়ের ভূমিকায় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই মূল্যায়ণ করেছেন, ‘মানুষ রামকিঙ্কর আর শিল্পী রামকিঙ্করে কোথাও ছলনা করেনি। দুয়ে মিলে পূর্ণ রামকিঙ্কর। আমরা তাঁর শিল্প সৃষ্টিকে আর তাঁর নিত্যদিনের জীবনকে আলাদা করে দেখতে চাইলেও সম্ভব নয়।’ 

৬.
শান্তিনিকেতনে সদ্য-গঠিত ‘বিশ্বভারতী’তে গড়ে ওঠে শিল্পচর্চার একটি ধারা। সমালোচকদের ভাষায় সেটা সমান্তরাল ধারা, ‘এক অর্থে সমান্তরাল তো বটেই, কিন্তু ইতিহাসই প্রমাণ যে, ক্রমে সেই ধারাই হয়ে উঠবে ভারতশিল্পের মূল স্রোত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ছবি আঁকছেন। বাক্যের সৃষ্টির ’পরে তাঁর সংশয় জন্মেছে। তাই চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বাকিটা ইতিহাস! ইতিহাস আরও এক জন। বলতে গেলে, সমাজের প্রান্তিক স্তরের প্রতিনিধি। এসেছেন কলাভবনে। পেয়েছেন বরাভয়। চিন্তার স্বাধীনতা। ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা। নিজে পথ কাটার স্বাধীনতা। এই ভাবে দিগন্তে দেখা দিলেন রামকিঙ্কর বেজ।’ ভারতশিল্পে আধুনিকতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ-রামকিঙ্কর-বিনোদবিহারীর যে অবদান, শিল্প সমালোচকদের মূল্যায়নে অতুলনীয় বলেই বিবেচ্য। শান্তিনিকেতনকে যারা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পচর্চা কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখার্জী তাদের অন্যতম। শিল্পী হিসেবে তার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে তিনি শিল্পচর্চা করতেন। চিরকুমার রামকিঙ্কর অত্যন্ত নির্মোহ ও খেয়ালি জীবনযাপন করতেন। তার সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

৭.
একাধারে ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ আধুনিক বাঙালি শিল্পীদের অন্যতম। ১৯০৬ সালের ২৫/২৬ মে তিনি বাঁকুড়ার জুগিপাড়া/ যোগীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাঁকুড়ার যোগীপাড়ায় গরিব, নিরক্ষর, দিন-আনি-দিন-খাই ক্ষৌরকার পরিবারে জন্ম নেওয়া রামকিঙ্কর বেইজের জন্ম তারিখ কোথাও লিখিত আকারে না থাকায় তার জন্ম সাল নিয়ে নানা মতান্তর রয়েছে। সমীর চট্টোপাধ্যায় ১৯৮০ সালে রামকিঙ্করের জীবনের শেষ বছরে নেশায় ও আড্ডায় বলা কয়েক দিনের কথা টুকে রেখেছিলেন ডায়েরিতে। সেই কথাবার্তায় রামকিঙ্কর বলেছিলেন— ‘উনিশশো দশে আমার জন্ম। পৈত্রিক নাম রামকিঙ্কর প্রামাণিক।’শান্তিনিকেতনে আসার পর তাঁর এই নাম নিয়েও নানা ঠাট্টা-মসকরার সম্মূখীন হতে হলো। কবি নিশিকান্ত তাঁর নাম নিয়ে ছড়া কাটতেন— ‘রামকিঙ্কর প্রামাণিক / নামটি বড় হারমোনিক।’

৮.
তাঁকে অনেকে আদিবাসী মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন। দলিত ও আদিবাসীদের জীবন নিয়ে ব্যাপক শিল্প সৃষ্টির জন্য তার সম্পর্কে মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার বেইজ পদবি সংস্কৃত বৈদ্য ও প্রাকৃত বেজ্জ-এর মিলিত রূপ। তিনি এক পরামাণিক পরিবারের সন্তান। কিন্তু ১৯২৫ সালে তার পরিবার ওই পদবি পরিত্যাগ করেন। শৈশবে বাঁকুড়ার কুমোরদের কাজ দেখে তিনি বড় হয়েছেন। তাদের দেখাদেখি কাদা দিয়ে মূর্তি গড়েছেন। এভাবেই ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। স্বশিক্ষিত শিল্পী বলতে যা বোঝায় রামকিঙ্কর বেইজ ছিলেন তাই। ১৯২৫ সালে ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় তিনি বিশ্বভারতীর কলাভবনে ভর্তি হন। সেখানে নন্দলাল বসু ও রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে তার শিল্পশিক্ষা বিশেষ মাত্রা লাভ করে। অধ্যয়ন শেষে তিনি ১৯৩০ সালে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কলাভবনে যোগ দেন। শান্তিনিকেতনকে যারা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পচর্চা কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিলেন রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখার্জী তাদের অন্যতম। শিল্পী হিসেবে তার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিশেষ এক লক্ষ্য নিয়ে তিনি শিল্পচর্চা করতেন। চিরকুমার রামকিঙ্কর অত্যন্ত নির্মোহ ও খেয়ালি জীবনযাপন করতেন। তার সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতি ও প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। রং-তুলি-কাঁকড়ে কাজ শিখতে শিখতে একদিন কলাভবনের পাঠ শেষ হল। শুরু করলেন স্বাধীনভাবে শিল্পের সাধনা। স্বপ্ন থেকে আসা সে সব সৃষ্টির উল্লাসে, মিশিয়ে দিলেন নিজের গোপন-গহন উল্লাস! নিত্য ভাঙা-গড়ার খেলায় তাঁর সহজিয়া জীবন নিয়ে ক্রমশই জলঘোলা হল শান্তিনিকেতনে। তাঁর দরাজ গলার রবীন্দ্রনাথের গান শুনল না কেউ! বরং শান্তিনিকেতনী তর্ক তুলল তাঁর জীবনচর্যা নিয়ে। কিঙ্করের তখন ঘরে-বাইরে ‘জীবন্ত মানুষের নেশা’। একবার, দিল্লি যাওয়ার পথে এক আদিবাসী রমণীর যৌবনের দুর্মর আহ্বানের কাছে নতজানু হয়ে তাঁর সঙ্গে নেমে গেলেন অজানা স্টেশনে। হারিয়ে গেলেন যেন। খবর নেই বহুকাল! হঠাৎ করে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছল ঠিকানাবিহীন এক টেলিগ্রাম। তাতে কিঙ্কর জানালেন, ‘I lost myself, search myself.’

৯.
‘ভুবনডাঙার কিঙ্কর’ শিরোনামের স্মৃতিচারণে আবীর মুখোপাধ্যায় শুরুতেই ক্ষোভের সাথে লিখছেন, ‘রামকিঙ্কর বেইজ। খড় কেনার পয়সা নেই, তাই ঘরের ভাঙা চাল ঢাকতেন নিজের তৈরি ক্যানভাসে। তাঁর দরাজ গলার রবীন্দ্রগান ক’জন শুনল? ওঁর মদ্যপ্রীতি, নারীসঙ্গই জানল শুধু!’ সেই রামকিঙ্কর প্রতীচ্যের শিল্পভাষাকে আত্মস্থ করে তার সৃষ্টিকর্মে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় শিল্পকলার আধুনিকতার পুরোগামী শিল্পী হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি এমন এক সময় শিল্প নির্মাণ শুরু করেন যখন ভারতীয় শিল্পকলা ক্রমান্বয়ে আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই তার শিল্পকর্ম ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। প্রথমদিকে রামকিঙ্কর ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা অসহযোগ আন্দোলনের সংগ্রামীদের আবক্ষ চিত্র আঁকতেন। মানুষের মুখ, অভিব্যক্তি, তাদের শরীরের ভাষা নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করাতে তার আগ্রহ ছিল বেশি। আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্প, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রকর্ম তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বিষ্ণুপুর মন্দিরের টেরাকোটা ভাস্কর্য দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। টেরাকোটা রিলিফ ও পাথর খোদাইয়ের পাশাপাশি তিনি জল ও তেলরঙে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। শিল্প নির্মাণে তিনি দেশজ উপাদানের প্রাধান্য দিতেন এবং একইসাথে একজন মডেল ও তক্ষণশিল্পীর দক্ষতা ব্যবহার করতেন। তার ভাস্কর্য গতি ও প্রাণপ্রাচুর্যের আধার। ভাস্কর্যের বিমূর্ত রূপরীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী প্রথম ভারতীয় শিল্পী ছিলেন রামকিঙ্কর। তার ভাস্কর্য গতিশীল, ছান্দিক ও প্রতিসম যার সাথে প্রকৃতির একটি আত্মিক যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতীয় ভাস্কর্যের চারিত্র্য নির্মাণে রামকিঙ্করের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তার শিল্পকর্মে সাঁওতালদের জীবন ও কর্মের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পাশ্চাত্য প্রকাশবাদী ঢঙে। তার ভাস্কর্য ও চিত্রকলার কোনোটিই তার সময়ের প্রচলিত ভারতীয় রূপরীতির অনুসারী নয়। সেগুলো তার নিজস্ব ভাবনার ঋদ্ধ প্রকাশ। শহরের আকর্ষণ ছেড়ে দূরে উত্তর কলকাতায় শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন প্রায় সারাটা জীবন। ওখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা তার আগ্রহ কেড়ে নিয়েছিল। ছবি ও ভাস্কর্যে তিনি তাদের জীবনকে ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার চারপাশে সচল, প্রাণবন্ত মৃত্তিকালগ্ন এই জীবন-প্রবাহ তাকে সার্বক্ষণিক টানতো। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার দানবীয় শক্তি উভয়ই তিনি তার শিল্পকর্মে ভিন্নমাত্রায় তুলে ধরেছেন। তাইতো তার ছবিতে দেখতে পাই ধানমাড়াইরত গ্রামীণ নারী, সাঁওতাল উৎসব, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা এবং ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিত্রিত। শিল্পী কে জি সুব্রামনিয়াম তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘সম্ভবত তিনি প্রথম ভারতীয় ভাস্কর যাকে সৃষ্টিশীল ভাস্করের খেতাব দেয়া যায়, তিনি ফরমায়েশকারীর চাহিদা মেটাতে নয় বরং নিজের আনন্দের জন্য ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন।’

১০.
মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের ভাবনায় তিনি গভীরভাবে মোহাবিষ্ট ছিলেন। নারী, পুরুষ ও শিশু- এই থিম নিয়ে তিনি অনেক ছবি ও ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। এই বিষয়ের প্রতি নিজের আগ্রহের কথা তিনি স্বীকার করেছেন এইভাবে, ‘প্রকৃতিতে আমরা দুটি আকৃতি পাই, পুরুষ আর নারী। তৃতীয়টি হচ্ছে তার প্রজনী- বাচ্চা। এই থিমটি এক অদ্ভুত সুন্দর। এর ওপর কত আনন্দ, কত সৌন্দর্যের খেলা চলেছে।’ (আত্মপ্রতিকৃতি, রামকিঙ্কর, গ্রাফিত্তি, কলকাতা) শরীরের গড়ন বা রূপরীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রকাশবাদী ধারার অনুসারী। তার অনুভূতিপ্রবণ মনের ভিত্তি গড়ে উঠেছে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠতায়। এর পেছনে বাম-সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাব রয়েছে যাকে তিনি তার শিল্পভাবনার সাথে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

১১.
বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, ‘দেশ’ পত্রিকা সম্পাদক সাগরময় ঘোষ লিখেছেন দুই শিল্পী রবীন্দ্রনাথ আর রামকিঙ্করের কথালাপ, ‘‘রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করকে ডেকে বললেন, শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি— সামনে।’’এর পর আর কখনও ফিরে দেখেননি কিঙ্কর। হাওয়ার উজানে এগিয়েছেন তিনি। আর এগোতে গিয়েই নিয়ত তাঁকে দুঃখ-দহনে পুড়তে হয়েছে! আবার, নিজের মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়েও রামকিঙ্করই বলতে পারেন, ‘‘মাস্টারমশাই শ্রদ্ধেয় নন্দবাবু ছিলেন ভীষণ গোঁড়া। তিনি ছিলেন জ্যান্ত মডেল ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। বলতেন ও-সব পশ্চিমে চলে। কিন্তু আমি তার উপদেশ মেনে চলিনি। মডেল ব্যবহার করেছি।’’ কারণ, খুব অল্প বয়সেই রামকিঙ্কর মূর্তি গড়া শিখেছিলেন কুমোরপাড়ার অনন্তজ্যাঠাকে দেখে দেখে। দু’চার আনার বিনিময়ে নিষিদ্ধ পল্লির রমণীদের মূর্তি গড়তে গড়তেই তাঁর ভাস্কর্যের সহজপাঠ। এই সময়ই স্বদেশি মেলায় তেল রঙে জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেও হাত পাকিয়েছেন তিনি। শিল্পের প্রতি অপার নিষ্ঠার মনটি সেই তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯২৫-এ বাঁকুড়ার যোগীপাড়া থেকে ম্যাট্রিক না দিয়েই ‘প্রবাসী’পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতন চলে এলেন কিঙ্কর। পিছনে পড়ে রইল বাঁকুড়ায় তাঁর বাল্যস্মৃতির গাঁ-ঘর, দারিদ্রে দীর্ণ পরিবার-পরিজন আর কাদামাটির কুমোরপাড়া। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তাঁর কাজের নমুনা দেখে নন্দলাল প্রথম দিনই বললেন, ‘‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’’ একটু ভেবে তারপর বলেন, ‘‘আচ্ছা, দু-তিন বছর থাকো তো।’’থেকে গেলেন কিঙ্কর। নাগাড়ে সাড়ে পাঁচ দশক শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সেই দু-তিন বছর আমার এখনও শেষ হল না!’’

১২.
সুশোভন অধিকারীর ভাষা ধার করে বলতে মন চায়, ‘রামকিঙ্করের কথা মনে পড়লেই স্রোতের বিরুদ্ধে চলা এক বেপরোয়া শিল্পীর কথা মনে পড়ে। আমরা জানি, দাগাবুলোনো পথের বিরুদ্ধে চলা রামকিঙ্করের পরম ধর্ম। এবং এই বিরুদ্ধতা কেবল মাটি-পাথর আর ক্যানভাসেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছবির ফ্রেম ছাপিয়ে, ভাস্কর্যের উঠোন পেরিয়ে সে মিশেছিল তাঁর প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে। আজ পেছন ফিরে ভাবলে অবাক লাগে, বাঁকুড়ার নিতান্ত সাধারণ গ্রামের সেই কিশোর ছেলেটি কীভাবে পার হয়ে এসেছিল এতটা কঠিন রাস্তা? সারল্যমাখা কিশোর কিঙ্করের সে অমলিন গ্রাম্যতা কখনো কি হোঁচট খায়নি কবির আশ্রমের অভিজাত চৌকাঠে? কীভাবে ভেঙেচুরে নিজেকে নির্মাণ করেছিলেন প্রতি মুহূর্তে? সহজ পথের বাইরে ছিটকে এসে ব্যক্তিজীবনের এ কোন বি-নির্মাণ! তাঁর প্রতি আশ্রম-আচার্যের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল – একথা আমরা শুনতে পাই। শুধু কি সেইটুকুই অবলম্বন, নিশ্চয় তা নয়। আধুনিকতার নিরিখে তাঁর সঙ্গে শিল্পভাবনার সঙ্গে অনেক সময় বিরোধ ঘটলেও নন্দলাল কখনো বাধা দেননি রামিকঙ্করকে – যা রামকিঙ্কর নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু পারিপার্শ্ব কীভাবে গ্রহণ করেছিল এই ‘পাগলপারা’মানুষটিকে? 

১৩.
‘কিঙ্করদার স্মৃতি’রচনায় সুশোভন অধিকারী লিখছেন,‘সব্যসাচী রামকিঙ্কর বেইজ। তাঁর আশ্চর্য জীবনযাপন, অলকসামান্য ছবি আর ভাস্কর্যমালাকে কি কোনো পুরস্কারের নিগড়ে বাঁধা যায়? এর আগেও একাধিক পুরস্কারে ভরে উঠেছে ডালা। তবু একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কাজের পাশে এসব পুরস্কারের মালা নেহাতই ম্লান হয়ে এসেছে। আমাদের দেশে রামকিঙ্করই তো সেই শিল্পী – যিনি মন্দিরের দেওয়াল থেকে, পাহাড়ের গা থেকে ছিঁড়ে ভাস্কর্যকলাকে উপড়ে এনেছিলেন – মানুষের মাঝে। প্রোথিত করেছিলেন আমাদের চোখের সামনে প্রকৃতির খোলা দরবারে। প্রতিমা তৈরির শিল্প আর স্কাল্পচারের তফাৎটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ভাস্কর্যকে স্টুডিয়োর অন্দর ছেড়ে বাইরে এনে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই আলো-বাতাস-মাটি ঘেরা উন্মুক্ত ভুবনে ভাস্কর্যকে দেখবার চোখ, তাকে অনুভব করবার বোধ সযত্নে নির্মাণ করে দিয়েছেন। সে কি একদিনে ঘটেছে? এ অসাধ্য সাধন করতে কত সীমাবদ্ধতা, কত কঠিন চ্যালেঞ্জ, কত দুর্বার হার্ডলের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে – তার কতটুকুই বা আমরা জানি?’

১৪.
‘‘জীবনে অনেক মেয়ে এসেছে, এটা সত্যি। কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউ এসেছে মানসিক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে। কিন্তু ছাড়িনি কাউকে। ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।...আমার মডেলরা আমার বহু স্কেচে, ছবিতে, মূর্তিতে, বেঁচে আছে। মডেলরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে।’’নিজের সম্পর্কে নির্দ্বিধায়ায় এমন করে আর কবে, কোন ভাস্করই বা অকপট হতে পেরেছেন! মডেলদের সঙ্গে রামকিঙ্করের সম্পর্ক নিয়ে নিত্য হাওয়ায় ছড়িয়েছে গসিপ। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘‘সব কিছুর মধ্যে যৌনতা আছে, যৌনতা ছাড়া সব কিছুই প্রাণহীন, ঊষর!’’ সে সবের প্রসঙ্গ তুললে কখনও এড়িয়ে যাননি কিঙ্কর। কাল্পনিক নয়, মডেলদের সম্পর্কে তাঁর সে-সব সত্য-স্বীকার আর উক্তিগুলো রামকিঙ্করের স্বীকারোক্তিতেই শুনি, ‘শান্তিনিকেতনের সাঁওতালরা আমায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।... ওরা এত অল্পে তুষ্ট যে বিস্ময় লাগে। সেই বিস্ময়ের আনন্দেই আমি ওদের ছবি করি। মূর্তি গড়ি। যেন মনে হয় ওদের চিনি। ওরাও বোধ হয় আমাকে চেনে। তাই এদের এই চলমান জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তকে আমি আমার ছবি ও মূর্তিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।’এক বার তাঁকে প্রশ্ন করা হল তাঁর মডেল বিনোদকে নিয়ে। তিনি উত্তর দেন, ‘‘বিনোদ, মানে বিনোদিনী? সে আমার ছাত্রী, মণিপুরী মেয়ে। একটু একটু করে শরীরের বাঁক, উপবাঁকের ভুবন চিনিয়েছিল ও-ই। আলো-অন্ধকারে ওকে ঘুরিয়েফিরিয়ে এঁকেছিলাম অনেক। এক দিন চলে গেল, মণিপুরি ভাষায় একটি নাটকও লিখেছে আমাকে নিয়ে।’’ অসমের মেয়ে নীলিমা? ‘‘নীলিমা বড়ুয়া। নষ্ট হয়ে গেল ওর পোর্ট্রেট। আঁকতে আঁকতে কত বার যে রঙ লেগেছে শরীর থেকে শরীরে... সে সব কোথায় গেল! ভুল করেছি, তখন টাকার অভাবে ভাল রঙ কাজে লাগাতে পারিনি।’’

১৫.
রামকিঙ্কর শিল্পী হিসেবে যতটাই সফল, ব্যক্তি রামকিঙ্কর বা একজন পুরুষ হিসেবে তার জীবনে রয়ে গেছে চরম চৈত্রে বীরভূমের বিদীর্ণ লাল মাটির শুষ্কতা বা পথ হারিয়ে পড়ে থাকা কোপাই নদীর নিঃসঙ্গতার মতো একলা জীবন অথবা পুজোর ছুটিতে খালি হয়ে যাওয়া শান্তিনিকেতন আশ্রমের মতো খা খা শূন্যতা। ব্যক্তি রামকিঙ্করের জীবনে বিভিন্ন সময় এসেছে বিভিন্ন নারী, চিত্রকলা বা ভাস্কর্যের মডেল হয়েও এসেছে অনেক নারী। এতো নারী সংস্পর্শে আসার পরেও তার জীবনে যে অপূর্ণতা রয়ে গেল তার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর জাত-বংশ। না পেড়েছে কাউকে নিজের করে আকড়ে ধরতে, না কেউ তাকে আগলে রাখলো। জীবনের শেষের দিকে বেশ ক’বছর একমাত্র রাধারানীই তার পাশে ছিল। তবু সে থাকা প্রেমিকার মতো নয়, বিবাহিত স্ত্রীর মতো নয়, সমাজে স্বীকৃত কোনো সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে নয়। রামকিঙ্কর নিজে থেকে গিয়েছেন অনেকের কাছে, অনেকে তাদের আনন্দের জন্যে এসেছিল, চলেও গেছে।

১৬.
রামকিঙ্করের জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে যে সকল নারীর নাম, তাদের নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বাঁকুড়ার শ্রেষ্ঠ শিল্পী রামাই পটুয়ার মেয়ে ধামাবতীর কথা। ধামাবতী ছিল রামকিঙ্করের বউদি বসন্তবালার সই। বিবাহিত জীবনে সুখী ছিল না ধামাবতী, স্বামী মদ্যপ, স্ত্রীর প্রতি উদাসীন। বসন্তবালাকে দেখতে আসার সুবাদে তখন কিশোর রামকিঙ্করের সাথে তার দেখা হয়ে যেতো। রামকিঙ্কর ছবি আঁকতে পারে সে কথা গ্রামের সব মানুষের মতো ধামাবতীরও অজানা ছিল না, সে নিজেও পারিবারিক পট আঁকা বিদ্যের চর্চা চালিয়ে নিচ্ছিল। একদিন কথা হলো— দু’জন দু’জনার ছবি আঁকবে, দেখা যাবে কার বিদ্যের কত জোর। এইরকম একটা লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে রামকিঙ্করকে ধামাবতী নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলো। নির্জন বাড়িতে রামকিঙ্করকে বসিয়ে ধামাবতী প্রথমে রামকিঙ্করকে পটুয়ার নিপুণ রেখায় আঁকলো। তারপর রামকিঙ্করকে নীরবে সিটিং দিলো। রামকিঙ্কর রোমাঞ্চিত হয়ে দেখলো তার স্তনের উপর থেকে আলগোছে খসে পড়ছে কাপড়— ধামাবতীর সাথে তার এই যোগ রাঢ়বাংলার পল্লীগীতিকার পালার মতো বিষণ্ণ ফুল হয়ে তোলা রইল নির্জন নারীর হাতের সুঁইয়ে ফোঁড়া চাদরের জমিনে। ধামাবতীর সাথে জীবনে আর একবারই তাঁর দেখা হয়েছিল কোনো এক গ্রাম্য মেলায়— সে দেখা দু’জন অপরিচিতের।

১৭.
রামকিঙ্করের কাছে একবার জানতে চাওয়া হলো, ‘মনে আছে এসথার জয়ন্তী জয়াপ্পাআস্বামীর কথা? রামকিঙ্কর উত্তরে বলছেন, ‘‘মনে থাকবে না কেন? সে তো দক্ষিণী ছাত্রী জয়া। খুব ছিপছিপে ছিল। জয়া নামটা আমারই দেওয়া। সুজাতা করেছিলাম ওকে মডেল করে।’’ ভুবনডাঙার খাঁদু? ‘‘দীর্ঘাঙ্গী খাঁদু ফিরে ফিরে এসেছে আমার ভাঙা ঘরে। সুন্দর ছিল ওর ফিগার। প্রায়ই দুপুর দুপুর আমার একলা ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার চৌকাঠ ধরে। এক কাঁখে থাকত ছেলে। সে দুধ খেত মায়ের বুকের। যে ভাবেই দাঁড়াত শরীরে নৃত্যের ভঙ্গি। অজস্র স্কেচ করেছি ওর।’’ আর রাধি? ‘‘ওই তো রইল শেষ পর্যন্ত আমার কাছে। ওর সঙ্গে মেশা নিয়ে অনেকে আপত্তি করেছিল। ডেকে পাঠিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর কর্তারাও। তাও ওকে ছাড়িনি। ও ছাড়েনি আমাকেও। আসলে রাধারানীর সঙ্গে আমার জড়ামড়ি সম্পর্ক!’’ ‘‘রিয়ালিটির সবটাই কপি করতে নেই।’’ এত ভাঙাচোরা, এত সম্ভোগের পরও এ কথা বলতেন স্বয়ং রামকিঙ্কর।

১৮.
ষাটের দশকের মাঝামাঝি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বন্ধু সমীর সেনগুপ্তকে নিয়ে এক বাসন্তিক বিকেলে হাজির হলেন শান্তিনিকেতন। রিকশা থামল অনিবার্যভাবে বাংলা মদের দোকান ‘আকর্ষণী’-তে। রিকশায় উঠল দু’ বোতল বাংলা। গন্তব্য রতনপল্লি, রামকিঙ্করের ডেরা। ‘‘কিঙ্করদা, ও কিঙ্করদা...’’ শক্তির হেঁড়ে গলায় হাঁক শুনে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে বাইরে এলেন রামকিঙ্কর। মুখে সেই চিরচেনা হাসি। ‘‘আরে কবি এসেচিস—আয়, আয়, কিছু এনেচিস তো হাতে করে?...’’ এর পরের আসরের বর্ণনা দিতে সমীর লিখেছেন, ‘‘শুয়োরপোড়া এল, ফুরিয়ে গেল, একটি রিকশওলাকে ধরে আরও দুটো বোতল আনানো হল, সঙ্গে ছোলাভাজা, সে দুটোও ফুরিয়ে গেল। আবারও দুটো আনানো হল বেশি পয়সা দিয়ে, তখন রাত দশটা বেজে গেছে। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, অফুরন্ত বাংলা মদ, অফুরন্ত বিড়ি, অফুরন্ত কথা, স্খলিত গলায় অফুরন্ত রবীন্দ্রনাথের গান।’’ ঢের রাতে ঘুম ভেঙেছিল সমীরের। অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে কোনও মতে চৌকাঠ পেরিয়ে দেখলেন, রামকিঙ্কর একটা টুলের উপর বসে রয়েছেন। উপর থেকে একটা লন্ঠন ঝুলছে। লুঙ্গিটা কোমর থেকে যে খুলে পড়েছে কিঙ্করের, সে খেয়াল নেই! সম্পূর্ণ নগ্ন! আর তাঁর সামনে একটা অসমাপ্ত মাটির ভাস্কর্য। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছেন কিঙ্কর।

১৯.
আবীর মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘রামকিঙ্করের একটি ভাস্কর্য নিয়ে শান্তিনিকেতনে তুলকালাম। তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। শেষ বিকেলের আলো এসে খেলা করছে জাফরি ছুঁয়ে লাল মেঝেতে। সেই নরম আলোয় কোণার্ক বাড়ির বারান্দায় একলা বসে লিখছিলেন কবি। ঠিক তখনই কিঙ্কর এলেন।
‘‘কার মূর্তি গড়েছ কিঙ্কর?’’
‘‘আমি ওটাকে জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি নে। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ওই মূর্তি আমার কাছে এসেছিল।’’
‘‘সেই মূর্তির মধ্যে কি কোনও প্রাণী আছে?’’
‘‘আছে। অথচ যেন নেই!’’
মুখ না ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছিলেন ওঁর সঙ্গে। ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি যেন একটি মেয়ের মূর্তি দেখেছি, মুখ নামানো।’’
কিঙ্কর মিতস্বরে বললেন, ‘‘হয়তো সে কাউকে চুমো খেতেই মুখ নামিয়েছে।’’
রবিঠাকুরের সামনে চুমু খাওয়ার কথাটা বলে ফেলে খুব অস্বস্তি হল কিঙ্করের। গলা শুকিয়ে কাঠ।’

২০.
তরুণ চিত্রশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর ‘রামকিঙ্করের প্রেম : নিদারুণ অকরুণের সাথে’ রচনায় সুন্দর করে লিখেছেন, ‘প্রেম এসেছিল জীবনে। সেক্সুয়াল রিলেশনও হয়েছে। তা কখনোই বলার নয়।’—এই কথাগুলো বলে রামকিঙ্কর তাঁর জীবনের গৌরব প্রকাশ করতে চাননি বরং ভদ্রলোকের সমাজে অন্ত্যজ এই মানুষটি— যার শিল্পীসত্তা ছোট ছোট পাহাড় অতিক্রম করে সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জীবনকালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে জাত-বর্ণের নিষ্ঠুর করাতে বার বার ভাগ হয়ে যাওয়া এই শিল্পীর করুণ হাহাকার বিকালের মিয়্রমাণ আলোর মতো ঘোলা হয়ে চলল সারাজীবন। জাত বর্ণের দোহাই দিয়ে শান্তিনিকেতন পল্লীর ভদ্র লোকেরা উঁচু জাতের কোনো মেয়ের সাথে তাকে যেভাবে মিশতে দেয়নি, ঠিক নিচু শ্রেণীর মেয়েদের সাথে যখন মিশেছে রামকিঙ্কর— তখনও তাকে সহ্য করতে হয়েছে নিদারুণ বঞ্চনা। আর তখন ভদ্রসমাজ থেকে উপেক্ষিত এই শিল্পীর একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতো কোনো বিধুর বাউল গান— ‘ও দারুণ, অকরুণ সাথে, এমন নিঠুর সাথে, আমি পিরিতি করিলাম না বুঝিয়া।’

২১.
প্রান্তিক জীবনের রূপকার রামকিঙ্করকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে নানা বাজে ধারণারও প্রচার ছিল। তিরিশের কোঠায় যখন রামকিঙ্কর, প্রচণ্ড লিবিডোতাড়িত এই মানুষটিকে আশ্রমবাসী সদাচারীরা সমাজবর্জিত করে রেখেছিলেন। তখন আশ্রমকেন্দ্রিক পরিবারগুলোর ভেতরে অদ্ভুত সব কেচ্ছার চল ছিল। শঙ্খ চোধুরীর ভাগ্নে ইরা ভকিল এমন একটা বিশ্রি গল্পের কথা বলেছিলেন— একজন বহুদিনের পুরানো অধ্যাপকের মেয়েকে সঙ্গে করে কলাভবনের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ইরা। সময়টা একটু একটু শীতের। দু’জনে একটা চাদর জড়িয়ে হাঁটছিল। সামনে রামকিঙ্কর আসছে দেখে ‘ও মা’ বলে মেয়েটা দিল দৌঁড়। ইরাকে পোটলার মতন করে জড়িয়ে সামনের কাঁকরের জমিতে টেনে নিলেন। ইরা ভকিল বাইরের মেয়ে, যথাযথভাবে বেড়ে ওঠা ইরার কাছে ভীষণ অভদ্রতা মনে হলো এই মেয়েটির আচরণ। ইরা বিরক্তি প্রকাশ করলে মেয়েটি বলেছিল, ‘তুমি জানো না, ছুটির সময় কিঙ্কর দা গাছের ডালে উঠে বসে থাকেন। নিচ থেকে কোনো মেয়ে গেলে লাফিয়ে ধরে নেন।’

২২.
সারাজীবন এই ভদ্রলোকেদের কাছে রামকিঙ্কর এক অচ্ছুত বস্তু হয়েই ছিলেন। কিন্তু রামকিঙ্কর সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার পর আজ আর তাঁর জাতের কথা নেই, ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক ভাস্করের পরিচয়ের কাছে আজ আর তাঁর জাতপরিচয় বড় কিছু নয়। কিন্তু ভদ্রলোকের সমাজ তাদের নিজেদের গড়া ডিসকোর্সের দোহাই দিয়ে রামকিঙ্করের মতো এতো বড় একজন শিল্পী, একজন মানুষকে, একজন প্রেমিককে কী নিষ্ঠুরভাবেই না একা করে রেখেছিল। রামকিঙ্কর এ নিয়ে কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য বা বিষাদগার করতে যাননি। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার দেওয়ালি সংখ্যায় ১৯৭২ সালে শুদ্ধশীল বসুর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রামকিঙ্করের জীবনে প্রেম ও কামবোধের এক দীপ্ত দীর্ঘশ্বাস পাওয়া যায়—
প্রশ্ন : শিল্পীর জীবনে প্রেমের ভূমিকা কী?
উত্তর : যে কোনো মানুষের পক্ষে এর গুরুত্ব যতটা, শিল্পীর ক্ষেত্রেও ততটাই। প্রেমের বিপক্ষে নিজেকে সংগঠিত রাখা উচিৎ। প্রেমই সব, প্রেম মহান, কিন্তু প্রেম ভয়ংকর ও সর্বনাশাও হতে পারে। 
প্রশ্ন : যৌনতায় কি তীব্র এক সৃজন শক্তি?
উত্তর : যৌনতায় সব। যৌনতা ছাড়া সব বন্ধ্যা।
কিন্তু রামকিঙ্করের জীবনে সত্যিকারের এই মোহন প্রেম, আর আশীর্বাদক কামের এক নিদারুন দরিদ্রতা রয়ে গিয়েছিল। কী গভীর নিস্তব্ধতা নিয়ে, একাকিত্বের বিরাট ভার নিয়ে চলতে হয়েছে তাকে। তবু আজ মনে হয় ধামাবতী, চন্দ্রা, খাদুবালা, আবরণ, জয়া, বিনোদিনী, রাধারাণী- এই সকল নারীদের থেকে পাওয়া কৃত্রিম বা অকৃত্রিম প্রেম, ঘৃণা, বেদনায় একটু একটু করে গড়ে তুলেছিল রামকিঙ্করকে। রামকিঙ্করের আত্মার গান হয়ে রইলো- ‘দারুণ, অকরুণ সাথে, এমন নিঠুর সাথে, আমি পিরিতি করিলাম না বুঝিয়া।’

২৩.
‘লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র’রামকিঙ্কর বেইজ মৃত্যু সম্পর্কে খোলামেলা ভাষায় বলছেন, ‘সবাই মারা গেছে, আমার দাদা-বোন-বাবা-মা— সবাই, সবাই।... মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়ই উদাসীন। একজন শিল্পী যতক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোনও ভাবেই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।’ নেশায় চুরমার হয়ে জীবন আর মৃত্যুর দ্বৈরথকে এভাবেই দেখতেন কিঙ্কর। শেষে কল্পনা করতে দোষ কী? প্রিয় রামকিঙ্করের প্রয়াণে ব্যথিতচিত্তে যেন গাইছেন তারই প্রিয় মানুষেরা, শিল্পীরা, তারই প্রিয় গানগুলি। সাহানা রাগে নীলিমা সেন গাইছেন, ‘হেরি অহরহ তোমারই বিরহ’। অপরদিকে প্রিয় মোহরের (কণিকা বন্দোপাধ্যায়) কানে ভেসে আসে কিঙ্করদার দরাজ গলায় গান, ‘মোর স্বপনতরীর কে তুই নেয়ে’। রামকিঙ্করের প্রিয় আরও একটা গানের কথাও মনে পড়তে পারে। আশ্রমের নাটকে কত বার যে বিশুপাগল সেজেছেন রামকিঙ্কর! তাঁর স্মরণে সেই গানই যেন গাইছে মোহর।—‘ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার, দুখের পারাবারে’। সুর নামল কোমলগান্ধার থেকে শুদ্ধ ঋষভে। আঁধার রাতে একলা এক পাগলের জন্য চোখের জলে তখন ভাসছে আদিগন্ত খোয়াই। অতএব ভরা থাক স্মৃতি সুধায়- শুধুই রামকিঙ্কর।

(তথ্যসূত্র : দেখি নাই ফিরে : সমরেশ বসু, বাংলাপিডিয়া, দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলা ট্রিবিউন, রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ : জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত